দেশের বিভিন্ন স্কুলের শিশুদের মাঝে একটি বইকে কেন্দ্র করে বির্তক উঠেছে। ‘নিজেকে জানো’ নামের এই বই রাজধানীর কয়েকটি স্কুলের শিক্ষার্থীদের মাঝে বিতরণ করায় বিব্রত অভিভাবক ও সাধারণ মানুষ। সচেতনতার জন্য প্রজনন স্বাস্থ্য¨ বিষয়ক এই বইয়ে রয়েছে যৌন বিষয়ে অশালীন বর্ণনা। এ নিয়ে একটি জাতীয় দৈনিক এক প্রতিবেদনও প্রকাশ করে।
প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, রাজধানীর বিভিন্ন স্কুলের অষ্টম শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের মাঝে প্রজনন স্বাস্থ্য¨ বিষয়ক বই নিজেকে জানো বিতরণ করেন স্কুলেরই শিক্ষকরা। এই বইয়ের বিভিন্ন অধ্যায়ে রয়েছে যৌন বিষয়ে কুরুচিপূর্ণ বর্ণনা। নারী-পুরুষের গোপন অঙ্গের খোলামেলা বিবরণ, যৌনমিলনের বিভিন্ন পর্যায়, যৌনমিলন কেন, কিভাবে এসব বিষয়ের উপর বইটি লেখা হয়েছে।
বইটি নিয়ে কিছু কথা না বললেই নয়। স্বাস্থ্য¨ সচেতনার প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম সেটা স্বীকার করে নিতেই হবে। এই জন্য শিক্ষা ব্যবস্থা একটা গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম। ছোট বেলা থেকেই যদি একটা ছেলে কিংবা মেয়েকে স্বাস্থ্য¨ সচেতন করা যায় তবে ব্যক্তি জীবন তথা সমাজ জীবনে তা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। আর তা হতে হবে শালীন ও সৌন্দর্যমন্ডিত। এমন ভাবে তাদের বুঝাতে হবে যাতে বিষয়টি দুপক্ষের জন্যই সাবলীল হয়। কিন্তু বিষয়টির উপস্থাপন যদি কুরুচিপূর্ণ হয়, তবে..।
বইটির শারীরিক ও মানসিক পরিবর্তন অধ্যায়ে লেখা আছে, ...যখন একটি মেয়ে ১০-১২ বছর বয়সে পৌছে, তখন তার শারীরিক পরিবর্তন শুরু হয়। যেমন- উচ্চতা বাড়ে, মাসিক শুরু হয়, স্তন বড় হয়, বগলে ও যৌনাঙ্গে চুল বা লোম গজায়। এই পরিবর্তনগুলিই হচ্ছে মেয়েদের বড় হওয়ার লক্ষণ। মাসিক একটি মেয়ের শারীরের স্বাভাবিক প্রক্রিয়া, যা সাধারণত ১০-১৩ বছর হওয়ার পর শুরু হয় এবং স্বাভাবিক নিয়েমে ৪৫-৪৯ বছর বয়স পর্যন্ত চলে। মাসিক স্রাব শুরু হওয়ার প্রথম বছগেুলোতে কিছুটা অনিয়ম হতে পারে এবং তলপেটে ব্যথা হতে পারে। যদিও এ বয়স থেকেই মেয়েরা গর্ভবতী হতে পারে ,তবে ২০ বছরের আগে শারীরিক বৃদ্ধি পুরোপুরি না হওয়ার কারণে সন্তান ধারণ করা উচিত নয়।
মেয়েদের মতো ছেলেরা যখন বড় হতে থাকে তাদেরও বিভিন্ন শারীরিক পরিবর্তন দেখা যায়। যেমন- উচ্চতা বাড়তে থাকে, কাঁধ চওড়া হয় এবং শরীরের মাংসপেসী শক্ত হতে থাকে। ছেলেরা বড় হচ্ছে তার আরও লক্ষন হলো দাড়ি-গোফ গজানো ও গলার ¯^‡ii পরিবর্তন। এ বয়সে ছেলেদের শরীরে শুক্রানুযুক্ত রস মাঝে মধ্যে মূত্রনালী দিয়ে বের হয়ে আসে, যাকে স্বপ্নদোষ বলা হয়। এই শুক্রানুই সন্তান জন্মদানের বীজ। স্বপ্নদোষ আসলে দোষের কিছু নয় বরং এটা ছেলেদের স্বাভাবিক বৃদ্ধি ও প্রজনন ক্ষমতা অর্জনের লক্ষণ।...
যদিও এই বিষয়গুলো নিয়ে পক্ষে বিপক্ষে যথেষ্ট যুক্তি রয়েছে। প্রয়োজনীয়তা উপলব্দি করেই বিষয়গুলো আরো শালীনভাবে উপস্থান করা যেত।
একটি অধ্যায়ের আরেকটি শিরোনাম হলো, পরিস্থিতির চাপে যদি দৈহিক মিলনের সম্ভাবনা দেখা দেয় তবে আমি সে অবস্থায় কী করবো? এখানে লেখা হয়েছে, বিয়ের আগে ছেলেমেয়েদের দৈহিক সমপর্ক স্থাপন কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। তবে কোনো ক্ষেত্রে মেয়েরা পরিস্থিতির চাপে এরকম অবস্থায় পড়তে পারে। মনে রাখা প্রয়োজন, আবেগকে না বলতে জানাটাও বড় হওয়ার একটা লক্ষণ।
পরিচয়ের একপর্যায়ে দৈহিন সমপর্ক গড়ে উঠতে পারে। যদি কারো মনে হয় যে তার প্রেমিক এ ধরনের সমপর্ক গড়ে তুলতে আগ্রহী, তবে মেয়েটাকে এ প্রস্তাবে সায় না দিয়ে বড় কারো সাথে বিষয়টি আলোচনা করা ভালো। যদি তা না করা যায় আর দৈহিক সমপর্ক হওয়ার সম্ভাবনা থাকে তবে গর্ভধারণ থেকে নিরাপদ থাকার জন্য কোনো অস্থায়ী পদ্ধতি ব্যবহার করা জরুরি। এরপরও যদি কোনো সমস্যা হয় তবে উপদেশের জন্য তুমি কাছের কোনো ক্লিনিকে যেতে পারো। (বইটির শেষে বিভিন্ন এনজিও পরিচালিত বেশ কয়েকটি কিনিক/সেবা সংস্থার তালিকা দেয়া রয়েছে এ সংক্রান্ত সেবা গ্রহণের জন্য)।
খুবই অদ্ভুদ লাগল এই লেখাগুলো। সমাজ ব্যবস্থা ধ্বংস করার এক ঘৃন্য অপপ্রয়াস। যেখানে বইটিতে বলা হয়েছে, বিয়ের আগে ছেলেমেয়েদের দৈহিক সমপর্ক স্থাপন কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয় সেখানে এর সমাধান কি সুন্দরভাবে দিয়ে দেয়া হল। বিবাহ বহির্ভূত দৈহিক সম্পর্ককে উস্কে দেয়া ছাড়া এর আর কিছুই নয়। একটি ছোট মেয়েকে কিভাবে বিবাহ বহির্ভূত দৈহিক সম্পর্ক করতে হবে তার সুনিপুণ বর্ণনা। আর সাথে রয়েছে সুষ্ঠ সমাধান। এখানে সুক্ষ্মভাবে প্রেমের বিষয়টাকে টেনে আনা হয়েছে। যাতে তারা সহজেই প্রেমে জড়াতে পারে আর দৈহিক সম্পর্কে।
কারণে বইটির বন্ধুত্ব ও ভালবাসা শীর্ষক অধ্যায়ে একটি শিরোনাম হলো প্রেম করলে কেন ছেলেমেয়েরা ধরাধরি করে? এখানে লেখা হয়েছে- প্রেম এমন একটি সমপর্ক যেখানে প্রেমিক প্রেমিকা দুজনের প্রতি প্রচণ্ড আকর্ষণ অনুভব করে, এ অনুভব হতেই তারা পরসপরের খুব কাছাকাছি পেতে চায় এবং এ কারণেই অনেক সময় তারা পরসপরকে সপর্শ করে। আসলে কোনো সমাজেই এটা ভালো চোখে দেখে না। কৈশোর হলো জীবন গড়ার সময়। এ বয়সে এসব করে তাই সময় নষ্ট না করাই ভালো।
যেহেতু পরিবার তথা সমাজ প্রেমকে ভাল চোখে দেখে না, তাহলে এ সম্পর্কে বর্ণনা কতটুকু যুক্তিপূর্ণ তার প্রশ্ন থেকে যায়। প্রেমের বর্ণনা দেয়া হল আর তা থেকে অবৈধ দৈহিক সম্পর্ক সাথে সমাধান। দৈনিক প্রত্রিকার পাতা খুললেই দেখা যায় এই অবৈধ প্রেম, দৈহিক সম্পর্ক, তা থেকে আত্মহত্যা, সামাজিক হেনস্থা। এতকিছুর পরে কিভাবে এত ছোট একটি ছেলে কিংবা মেয়েকে এর বিস্তারিত বর্ণনা (সমাধান সহ) বইটিতে দেয়া হল বোধগম্য নয়।
বইটির এ অধ্যায়ে আরো লেখা হয়েছে, ইচ্ছার বিরুদ্ধে বা অন্য কোনো কারণে দৈহিক মিলনের ফলে একটি মেয়ের পেটে বাচ্চা আসতে পারে। তাই বিয়ের আগে দৈহিক মিলন থেকে বিরত থাকা উচিত। যদি পেটে বাচ্চা এসে যায়, তবে দেরি না করে উপদেশের জন্য মা-বাবা অথবা কাছের কোনো স্বাস্থ্যকেন্দ্রে যোগাযোগ করতে হবে। মা-বাবাকে যদি ব্যাপারটা বোঝানো না যায় আর মেয়েটিকে তারা গ্রহণ না করে, তাহলে কোনো অভিজ্ঞ ডাক্তার এর পরামর্শ নেয়া ভালো।
বিয়ের আগে কেউ কেউ কনডম বা খাবার বড়ি ব্যবহার করে। সেটা কি ঠিক? শীর্ষক শিরোনামে লেখা হয়েছে এ দুটি জন্ম নিরোধক ব্যবহারের প্রয়োজনীয়তা। বিবাহবহির্ভূত সমপর্কের ক্ষেত্রে তার প্রয়োজনীয়তা ও গুরুত্ব বর্ণনা করা হয়েছে।
দৈহিক মিলন অধ্যায়ের আরেকটি শিরোনাম হলো অনেকের সাথে দৈহিক সমপর্ক গড়ে উঠলে তা ক্ষতিকর। এরকম হলে কিভাবে নিরাপদ থাকা যায়? এখানেও লেখা হয়েছে- অনেকের সাথে দৈহিক সমপর্ক থাকলে কনডম ব্যবহার খুবই জরুরি।
কেন আমি অবৈধ দৈহিক মিলনে যাব। আর বাচ্চার প্রশ্নতো কল্পনাতীত। এতকিছুর বর্ণনা দেয়ার উদ্দেশ্যই বা কি?
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, বইটির পেছনে লেখা রয়েছে মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়। এমপাওয়ারমেন্ট অ্যান্ড প্রোটেকশন অব চিলড্রেন অ্যান্ড উইমেন প্রকল্পের জন্য ইউনিসেফের সহায়তায় মুদ্রিত। বইটি প্রণয়ন করেছে বাংলাদেশ সেন্টার ফর কমিউনিকেশন প্রোগ্রামস (বিসিসিপি)। বইটি প্রণয়নে সহায়তা নেয়া হয়েছে এমন ১১টি সংস্থার নাম বইয়ের শুরুতে উল্লেখ করা হয়েছে। বইটি কী পরিমাণ স্কুলে বিতরণ করা হয়েছে তা নির্দিষ্ট করে জানা না গেলেও অনেক দিন ধরেই বইটি বিতরণ করা হয়েছে। বিভিন্ন এনজিও সংস্থা তাদের কাছ থেকে এ বই নিয়ে বিভিন্নভাবে বিতরণ করেছে। বেসরকারি একটি সংস্থা সারা দেশে যাদের অনেক স্কুল রয়েছে তারাও এ বই তাদের স্কুলে বিতরণ করেছে।
এ বই নিয়ে রীতিমতো বিব্রত এবং অস্বস্তিকর অবস্থায় পড়েছেন অনেক অভিভাবক এবং শিক্ষার্থী। তাদের মধ্যে বিরাজ করছে তীব্র ক্ষোভ। প্রশ্ন উঠেছে স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে এ ধরনের বই বিতরণের উদ্দেশ্য নিয়ে। সরকারের কোন কর্তৃপক্ষ কী বিবেচনায় তা অনুমোদন করল? স্কুলের শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্য সচেতন করতে এই বই বিতরণ করা হলেও বইয়ের লেখার মান ও বর্ণনা প্রশ্নবিদ্ধ করছে এই কার্যক্রমকে। পুরো প্রক্রিয়াটা সুষ্ঠ ও শালীন হওয়ার যোগ্যতা হারিয়েছে। আর তা উন্মোচন করছে সামাজিক অবক্ষয়ের এক নতুন দাড়। কেউ যদি প্রকৃতপক্ষে সমস্যাই পড়ে তবে তার অভিভাবকরা এর জন্য যথেষ্ট। তারাই তার স্বাস্থ্য ও সামাজিক অবস্থা বিবেচনা করবেন। এই বইয়ের মাধ্যমে ছেলে মেয়েরা তাদের অভিভাবকরে অগোচরে নিজেরাই এক ভয়ানক কান্ড ঘটিয়ে বসতে পারে। সামাজিক ব্যবস্থা ধ্বংস, বিবাহ বহির্ভূত দৈহিক সম্পর্ক, আর ছেলে মেয়েদের স্বাস্থ্য সচেতনার পরিবর্তে স্বাস্থ্য হানী থেকে শুরু করে বিভিন্ন ধ্বংস ডেকে আনবে বলে আমার বিশ্বাস এই বই। তাই বইটির ব্যাপক পরিবর্তন অতীব জরুরী।
কিশোর-কিশোরীদের প্রজনন স্বাস্থ্য সম্পর্কিত কয়েকটি বইয়ের মধ্যে এটি একটি হচ্ছে নিজেকে জানো। অন্যান্য বইগুলো হচ্ছে “বয়ঃসন্ধিকাল”, “বিয়ে এবং পারিবারিক স্বাস্থ্য এবং “যৌনরোগ ও এইচআইভি/এইডস”। ইউএসএআইড্থির আর্থিক সহায়তায় এআরএইচ ওয়ার্কিং গ্রুপের ১১টি সংস্থার সার্বিক তত্ত্বাবধান ও সহযোগিতায় বাংলাদেশ সেন্টার ফর কমিউনিকেশন প্রোগ্রাম বইটি প্রনয়ন করেছে। ১১টি সংস্থা হলো- বাংলাদেশ সেন্টার ফর কমিউনিকেশন প্রোগ্রাম (বিসিসিপি), বাংলাদেশ রুরাল এডভান্সমেন্ট কমিটি (ব্রাক), বিসিসি ইউনিট, পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর, ফ্যামিলি হেল্থ রিসার্চ প্রজেক্ট, আইসিডিডিআর-বি, ফোকাস অন ইয়ং এডাল্টস, এনজিও সার্ভিস ডেলিভারী প্রোগ্রাম ( এনএসডিপি), মেরী স্টোপস ক্লিনিক সোসাইটি, সোস্যাল মার্কেটিং কোমপানী (এমএসসি), ইউএনএফপিএ, ইউনিসেফ, ইউএসএআইডি।