ঘটনাস্থল পিয়ার লতিফ উচ্চ বিদ্যালয়।
ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়া একটি ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে, সংসদ সদস্য সেলিম ওসমানের নির্দেশনায় এক ব্যক্তি কান ধরে উঠ-বস করছেন।
যে ব্যক্তিকে কান ধরে উঠ-বস করতে দেখা যাচ্ছে তিনি নারায়ণগঞ্জের কল্যান্দি এলাকার পিয়ার সাত্তার লতিফ উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শ্যামল কান্তি ভক্ত।
সে শিক্ষকের বিরুদ্ধে অভিযোগ হচ্ছে তিনি ইসলাম ধর্মকে অবমাননা করে শ্রেণীকক্ষে মন্তব্য করেছেন।
কিন্তু শ্রেণীকক্ষের এই কথিত ইসলাম বিরুদ্ধে মন্তব্য কিভাবে এতটা জটিল আকার ধারণ করলো? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে মঙ্গলবার আমি গিয়েছিলাম কল্যান্দি গ্রামে।
প্রধান শিক্ষক শ্যামল কান্তি ভক্ত।
গ্রামের সবার মাঝেই এখন বিষয়টি নিয়ে আলোচনা চলছে। গ্রামে ঢুকেই দেখলাম একদল কিশোর স্কুলের মাঠে ফুটবল খেলছে। এদের মধ্যে একজন পিয়ার সাত্তার লতিফ উচ্চ বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণীর ছাত্র। তার নাম মো: মৃদুল। এই দশম শ্রেণীর একটি ক্লাসেই প্রধান শিক্ষক ইসলাম ধর্ম অবমাননা করে মন্তব্য করেছেন।
কী ছিল সে মন্তব্য? দশম শ্রেণীর ছাত্র মো: মৃদুল বলেন, একজন শিক্ষকের ক্লাসে শিক্ষার্থীরা হট্টগোল করছিল। এমন সময় প্রধান শিক্ষক সে ক্লাসের পাশ দিয়ে প্রধান শিক্ষক শ্যামল কান্তি ভক্ত যাচ্ছিলেন।
ছাত্র মৃদুলের বর্ণনায়, “হেড স্যার আইয়া ক্লাসের ভিতরে দাঁড়াইছে। তারপর বলতাছে তোগো আর শিক্ষা হবে না। তোরা অনেক কথা বলছ। শিক্ষকদের কথা শুনছ না। শুনবি কিভাবে? তোগো আল্লাহও নাপাক তোরাও নাপাক। ”
দশম শ্রেনীর ছাত্র রিফাত হাসান।
যেদিন এ ঘটনা ঘটে সেদিন ছিল রোববার। সে একই দিন বিকেলে দশম শ্রেণীর আরেকজন ছাত্র রিফাত হাসানকে প্রধান শিক্ষক বেধড়ক পিটিয়েছে বলে অভিযোগ উঠে।
এ বিষয়টি নিয়ে শিক্ষার্থী রিফাত হাসান স্কুলের ম্যানেজিং কমিটির কাছে প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে লিখিত নালিশ করেন। সে আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে গত শুক্রবার সকাল দশটায় স্কুলের ম্যানেজিং কমিটির বৈঠক বসে।
কিন্তু প্রধান শিক্ষক শ্যামল কান্তি ভক্ত জানালেন তিনি তার বিরুদ্ধে অভিযোগ নিয়ে আগে থেকে জানতেন না। ম্যানেজিং কমিটির বৈঠকে এসে তিনি এটি জানতে পারেন।
প্রধান শিক্ষক শ্যামল কান্তি ভক্ত বলেন, সে একই বৈঠকে তার বিরুদ্ধে আকস্মিকভাবে ইসলাম ধর্ম অবমাননার অভিযোগ আনা হয়।
কিন্তু প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধ অভিযোগকারী ছাত্র বিবিসি বাংলাকে জানিয়েছেন, তিনি তার লিখিত অভিযোগে শিক্ষকের বিরুদ্ধে ইসলাম ধর্ম অবমাননার কোন অভিযোগ আনেননি।
কিন্তু প্রধান শিক্ষক ইসলাম ধর্মকে অবমাননা করে মন্তব্য করেছেন বলে দাবী করেন অভিযোগকারী ছাত্র রিফাত হাসান।
তিনি বলেন , “ আমার ক্লাসে একশ ছাত্র-ছাত্রী আছিলো। এই ব্যাপারটা সবাই শুনছে। শুধু আমি একলা শুনি নাই। ” যদি প্রধান শিক্ষক ইসলাম ধর্মকে নিয়ে অবমাননাকর মন্তব্য করেই থাকেন তাহলে লিখিত অভিযোগ সে বিষয়টি উল্লেখ করা হলো না কেন?
জবাবে ছাত্র রিফাত হাসান বলেন, “ সব ছাত্ররা একলগে কইছে আন্দোলন করব। সেজন্য উল্লেখ করি নাই।”
পিয়ার সাত্তার লতিফ উচ্চ বিদ্যালয় থেকে কিছুটা দুরেই একটি মসজিদ আছে।
শুক্রবার ম্যানেজিং কমিটির বৈঠক যখন চলছিল তখন সে মসজিদের মাইকে ঘোষণা দিয়ে বলা হয় প্রধান শিক্ষক ইসলামকে অবমাননা করেছে এবং এলাকার মুরুব্বিদের স্কুলের আসতে আহবান জানানো হয়। কিন্তু মসজিদের ভেতরে ঢুকে মাইকে ঘোষণা দিল কে? এটি এক বড় প্রশ্ন। মসজিদের ইমাম মাহমুদুল হাসান বিবিসিকে জানিয়েছেন, কে এই ঘোষণা দিয়েছে সেটি তার জানা নেই।
স্থানীয় বাসিন্দারা বলেছেন, এই ঘোষণার পর স্কুলের মাঠে কয়েকশত মানুষ জড়ো হয়ে যায়। প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনায় তখন তাদের মধ্যে কয়েকজন মিটিং রুমের ভেতরে ঢুকে প্রধান শিক্ষককে পিটিয়েছেন।
এমন অবস্থায় উপজেলা কর্মকর্তা মৌসুমী হামিদকে খবর দেয়া হয়। তিনি ঘটনাস্থলে আসেন দুপুর সাড়ে ১২টায়।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জানান , “ ম্যানেজিং কমিটির কাছে অভিযোগ ছিল যে উনি (প্রধান শিক্ষক) ছাত্রকে মেরেছেন। সেটার বিচার হচ্ছিল।”
তিনি বলেন, উত্তেজিত জনতাকে নিয়ন্ত্রণের জন্য প্রশাসনের কর্মকর্তারা সেখানে যায়। ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেবার অভিযোগকে কেন্দ্র করে উত্তেজিত মানুষজন সেখানে জড়ো হয়েছিল বলে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জানান।
তিনি বলেন পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবার আশংকায় স্থানীয় সংসদ সদস্য সেলিম ওসমানকে খবর দেয়া হয়। বিকেল সাড়ে চারটা নাগাদ সেলিম ওসমান সেখানে উপস্থিত হন
।
কোন কোন গ্রামবাসী এবং সেলিম ওসমানের সমর্থকরা বলছেন প্রধান শিক্ষককে কোন অপমান করার উদ্দেশ্যে নয়, বরং তাকে উত্তেজিত জনতার হাত থেকে রক্ষার জন্যই কানে ধরে উঠ-বস করানো হয়েছে।
সংবাদটি এক ক্লিকে পড়তে
http://www.bbc.com/bengali/news/2016/05/160517_narayanganj_school_teacher_humiliation_selim_osman#share-tools