“আল্লাহ তাআলা ও রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি এর কটুক্তিকারী নাস্তিক ব্লগারদের শাস্তির দাবিতে লাখ লাখ তৌহিদী জনতা ২০১৩ সালের ৬ এপ্রিল ইতিহাস সৃষ্টিকারী এক লংমার্চ করে শাপলা চত্বরে সমবেত হয়েছিল। ৬ এপ্রিল রাত তিনটা পনের মিনিটে আল্লাহ ও রাসূলপ্রেমী তরুণদেরকে উদ্দেশ্য করে ফেসবুক স্ট্যাটাসের মাধ্যমে একটি চিঠি পোষ্ট করে গণজাগরণ মঞ্চ সংগঠক ও নাস্তিকদের সহযোগী আরিফ জেবতিক। যা তাদের মহলে আলোড়িত হয়। এরপর তার চিঠির জবাবে কওমী মাদরাসার তরুণদের পক্ষ থেকে ৮ এপ্রিল সন্ধ্যা ৬টা ২৪ মিনিটে আল্লাহ ও রাসূলপ্রেমী একজন তরুণ ব্লগার আরেকটি চিঠি পোষ্ট করে। যা সর্বমহলে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করে। হাজার হাজার পাঠক তা পাঠ করার পাশাপাশি বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমে তা শেয়ার করেন। ইতিহাসের অংশ হয়ে থাকা সেই ঘটনার দিকে সকলের দৃষ্টি ফেরাতেই চিঠি দুটি তুলে ধরা হল।”
শাপলা চত্বরের এক নাম না জানা তরুণের কাছে শাহবাগ চত্বর থেকে খোলা চিঠি
তোমাকে গতকাল বিকেলে দেখলাম মহাখালীর এক বাস থেকে নামছ। খানিকটা ভীরু ভীরু চোখ, সঙ্গে আরো দুই চারজন-আশেপাশে এমনভাবে তাকাচ্ছ যাতে কোন অদৃশ্য গোয়েন্দা ব্যাটা ক্যাঁক করে ধরে না বসে। কিন্তু তোমার অনভ্যস্ত চোখের অতিরিক্ত সতর্কতা আমার মতো একজন সাধারণ মানুষেরই চোখে পড়ে গেল, প্রফেশনালরা চাইলেই কি আর তোমাকে চিনতে পারবে না। তোমার বেশভূষা, তোমার চোখের চাহনি, তোমার জড়সড় ভাব-তোমাকে চিনিয়ে দিতে যথেষ্ট। আমি নিশ্চিত, তুমি শাপলা চত্বরের জনসভার জন্য অগ্রবর্তী দলের একটা অংশ। এই রাজধানী নগরটায় কেউ একজন তোমাকে ব্রাত্য ঘোষণা করেছে, এজন্য তুমি দল বেঁধে, বাসের ছাদে কিংবা ট্রেনের বগিতে সহপাঠিদের সঙ্গে জোর গল্প করতে করতে এখানে আসতে পারছ না। এই কষ্ট যেমন তোমার, সেই কষ্টটা আমারও। এই দেশের রাজধানী শহরের আমি যতটুকু অংশীদার, তুমি তার চেয়ে কম নও, অথচ তোমাকে নিজের রাজধানীতেই আজ আসতে হচ্ছে লুকিয়ে লুকিয়ে-এ তোমার-আমার দুজনেরই সমবেত কষ্টের হওয়া প্রয়োজন।
জানি, তুমি আমার ফাঁসি দাবি করে এসেছ। এজন্য তোমার প্রতি আমার কোনো ক্ষোভ নেই। সেই শৈশবে যেদিন তুমি অসহায় ছিলে, তখন আমি তোমাকে আনতে যাইনি। তোমার মাদ্রাসার হুজুরই কোথাও থেকে তোমাকে এনে ছাত্রাবাসে আশ্রয় দিয়েছেন, লিল্লাহ-সদকা-কোরবানির চামড়া মেগে এনে তোমাকে তিনিই পেলেপুষে বড় করেছেন। সুতরাং তোমার ওস্তাদ তোমার পিতৃতূল্য অভিভাবক, তাঁর নির্দেশে সাড়া দিয়ে তুমি আজ এই রাজধানীতে আমার ফাঁসি চাইতে এসেছ।
অথচ আমি কখনোই তোমার প্রতিপক্ষ ছিলাম না। বিশ্বাস করো, আমিও সামান্য মানুষ, আমার পিতাকে হত্যা করা হয়েছিল পুকুর পাড়ে, আমার ধর্ষিতা মা কে জ্যান্ত কবর দেয়া হয়েছিল বাড়ির উঠোনে, আমি শুধু সেই নিষ্ঠুরতার সর্বোচ্চ শাস্তি দাবি করে রাজপথে নেমেছিলাম।
অথচ ঘাতকেরা খুব কৌশলী, ঘাতকদের অনেক টাকা, সেই টাকায় কেনা রাশি রাশি জ্ঞানপাপী মানুষ। তারা ঠিকই একটা না একটা দাবার ছকে আমাকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ফেলবে-এই সত্যি আমি বরাবরই জেনে এসেছি। অতঃপর তারা আমার বিরুদ্ধে তোমাকে উস্কে দিয়েছে। বাকি সবই যুক্তি-কুযুক্তির বেড়াজাল, সত্য শুধু এটুকুই, তারা আমার বিরুদ্ধে নিজেরা না পেরে তোমাকে উস্কে দিয়েছে।
আমি এখন যতবারই বলি আমি মুসলিম, তারা তোমাকে সেটা বিশ্বাস করতে দেবে না। প্রয়োজনে তারা নিজেরাই আল্লাহ আর মহানবী ( সাঃ ) কে অসম্মান করে সেই অসম্মানের দায় আমার কাঁধে ফেলে রাখবে। আমি তোমার দিকে হাত বাড়ালে তারা চিৎকার করে বলবে, ঐ নাপাকের হাত স্পর্শ করিস না রে, আর তুমি আঁতকে উঠে দূরে সরে যাবে।
আমি তোমার দরজায় যেতে চেয়েছিলাম। আমি চেয়েছিলাম একদিন তুমি আর আমি বসে সবগুলো গল্প করি, তোমাকে জানাই কীভাবে আর কেন আজ তুমি আর আমি প্রতিপক্ষ হয়ে উঠলাম। আমাকে সে সুযোগ দেয়া হয়নি। ঘাতকেরা দাবার গুটিতে চাল দিচ্ছে আর তুমি রেগেমেগে চিৎকার করে বলছ-নাস্তিকের সঙ্গে কোনো আলাপ নেই, আমি তার কল্লা চাই।
এই দায় তোমার নয়। আমরা এমন রাষ্ট্র তৈরি করতে পারিনি, যেখানে তুমি আর আমি একই ইতিহাস বই পড়ে বড় হয়ে উঠব, একই বিদ্যায়তনের বেঞ্চে বসে কাটাকুটি খেলে খেলে বড় হব। তুমি কাসে ফারসি পড়েছ, আমি ইংরেজি পড়েছি। রাষ্ট্রতো সেই ছোটবেলায়ই তোমার আর আমার ভাষাকে ভিন্ন করে দিয়েছে। আজ যদি আমরা একই ভাষায় কথা বলতে না পারি, সেই দায় তবে তুমি একলা নেবে কেন? আর তাই আমরা এমন রাষ্ট্র তৈরি করতে পারিনি যেখানে তুমি আর আমি মিলে পরষ্পরকে একটাও গালি না দিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা তর্ক করে কোন একটা সিদ্ধান্তে একমত হয়ে এক কাপ চা খাব। তোমাকে কাঠমোল্লা ভেবে, আনপড় গোঁয়ার ভেবে আমি উপহাস করব না তরুণ, তুমিতো আমারই হারিয়ে যাওয়া ভাই, আজ ভাগ্যের ফেরে আর ভ্রষ্টদের প্ররোচনায় সেই তুমিই ভাবছ আমায় বিভ্রান্ত শত্রু। লাঠি-গুলি-টিয়ারগ্যাসের ভয়কে জয় করে তুমি আজ ঢাকা শহরে আমার মাথাটা কেটে ফেলার দাবি নিয়ে এসেছ তরুণ। আমি তবু তোমার মঙ্গল কামনা করি। তোমাকে যারা প্ররোচিত করল আমি তাদের অভিশম্পাত দিব, কিন্তু তোমার মঙ্গল কামনা করা থেকে বিচ্যুত হব না।
আমি কায়মনে দোয়া করি, এই ইট-কাঠ-বর্গার শহর থেকে তুমি আবার নিরাপদে তোমার মায়ের কোলে ফিরে যেও।
তোমাকে অভিবাদন।
শাহবাগ থেকে
তোমারই নাম না জানা কোনো এক ভাই
আরিফ জেবতিকের খোলা চিঠির উত্তরে কওমি মাদ্রাসার তরুণের খোলা চিঠি
আসসালামু আলাইকুম আরিফ জেবতিক।
আলহামদুলিল্লাহ, ভাই, আমি তোমার লেখা চিঠিটা পেয়েছি। আশা করছি তুমি সহি-সালামতেই আছ।
ভাই! তুমি বলেছ যে, আমি যখন মহাখালিতে নামি তখন আমার চোখে যে ভয় খেলা করেছে তা তুমি দেখেছ। সত্যি ভাই ভয় ছিল আমার চোখে। এমনকি আমার অন্তরেও। তোমরা যে হাজার হাজার মেটাল বুলেট কিংবা জেল-রিমান্ড আমাদের জন্যে রেডি রেখেছিলে- ভয়টা সে জন্য ছিল না। ভয়টা ছিল-না জানি আমি এই ঈমানী পরীক্ষায় অকৃতকার্য হয়ে যাই। সামান্য এই ‘জীবন-প্রেমটা’ই না আবার ‘রাসূল প্রেম’ থেকে বড় হয়ে দেখা দেয়।
ভাই! আমার কাছে আমার ঈমানটা (বিশ্বাস) সব থেকে বড়। এই জীবন থেকেও। তাইতো সরকার প্রধান যেদিন তোমার উপর রুষ্ট হল, সেদিন তুমি ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে পালিয়ে গেলে। আর আমি সরকারের রক্ত চোখ উপেক্ষা করে, তোমার মুরব্বিদের হরতাল, তোমার অবরোধ উপেক্ষা করে দাঁড়িয়েছি তোমাদেরি বুলেটের সামনে।
ভাই, তোমরা ব্লগ লেখ। তোমরা মুক্তমনা ও মুক্তমুখের ভাষার অধিকারী। আমি আকাট মুর্খ। কিন্তু দেখ, তুমি কত কম জান। আমাদের অনেকেরই পিতা মাতা বেঁচে আছেন (আল্লাহ তাদের হায়াত বৃদ্ধি করুন)। আমরা তাদের জন্য প্রতি নামাযের পর দুআ করি- ‘হে আল্লাহ আমার পিতা মাতা আমাকে শৈশবে যেমন আদর করে লালন পালন করেছে আপনি তাদের তেমন করে লালন পালন করুন।’
কিন্তু দেখ ভাই, তুমি কত কম জান। আমাদের সবাইকে তুমি নিতান্তই এতিম বানিয়ে দিয়েছ। বুঝিয়েছ- তোমরা বড় হয়েছ প্রাচুর্যে, আর আমরা খুদ-চিড়া-ভিক্ষার চাল খেয়ে। তোমার ধারণা কত নিচু! তুমি বলেছ তোমার বাবাকে তারা মেরেছে পুকুর পাড়ে। কিন্তু তুমি জান না যে, তারা আমার দাদাকে মেরেছে জায়নামাজে কোরআন পড়ারত অবস্থায়। ঘর থেকে টেনে নিয়ে গেছে আমার আপন ফুফুকে। মাদ্রাসা থেকে ফেরার পথে সেই অগ্নিঝরা একাত্তরে আমার ছোট চাচা আসছিলেন বাড়িতে, আমি যেমন আসছিলাম ঢাকাতে । আমার মত তাকেও তল্লাশি করা হয়। তারপর আমার চাচাকে মেরে ফেলে হায়না পাকিস্তানি বেজন্মাগুলোর সহযোগী রাজাকাররা। দেখ ভাই, তুমি কত কম জান। তোমরা তাদের সাথে ৯৬ তে না কবে জানি জোট করলে? কবে জানি ক্ষমতায় যাবার আন্দোলন করলে? আমরা কিন্তু তাদেরকে জন্মের পর থেকেই ঘৃণা করতাম।
এই ফেব্রুয়ারিতে তোমরা যখন শাহাবাগে সমবেত হলে আমরা কিন্তু তোমাদের বাধা দেই নাই। বরং দুআ করেছি। দাড়ি-টুপি নিয়ে আমাদের অনেকে কিন্তু সেখানে গিয়েছিল। আমিও গিয়েছিলাম। তোমার চোখ মনে হয় সেদিকে যায়নি। তোমরা তখন আকাশে উড়ছিলে, মাটিতে চোখ যাবে কেমন করে?
তারপর তোমাদের ওইখানে আমরা যখন কিছু কালপ্রিটকে দেখলাম একাত্তরের রাজাকারদের মত, আমরা বললাম তোমরা তাদেরকে সেখান থেকে বের করে দাও। কিন্তু তোমরা তা করলে না। তাদের বাঁচাতে এগিয়ে এলে। আমরা বারবার বললাম যে, তোমাদের সাথে আমাদের কোন বিরোধ নাই, আমরাও যুদ্ধাপরাধের বিচার চাই। তারপরও তোমরা তাদের সঙ্গ ছাড়লে না। তোমরা কি এতই দুর্বল যে, তাদের ছাড়া তোমরা অচল হয়ে পড়তে। বাংলার সব মানুষ ছিল তোমাদের সাথে। তোমরা অপরের কাদা নিজের গায়ে লাগিয়ে আনন্দ পেলে। তোমাদের ফেসবুকে-ব্লগে হাসাহাসি শুরু করলে এই বলে যে, মূর্খ গরিব ভুখা নাঙ্গা এতিমরা তোমাদের নাস্তিক বলেছে। তোমরা নিলে একে ‘ক্রেডিট’ হিসেবে।
ভাই! তোমরা আলোচনা করতে চেয়েছিলে, কিন্তু একবারওতো সেই কালপ্রিটদের- যারা তোমাকে আমাকে মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে তাদের প্রতি ঘৃণা জানালে না। বরং আপ্রাণ চেষ্টা করলে তাদের সাধু প্রমাণ করতে। তাহলে তোমাদের সাথে আমরা আলোচনা করি কিভাবে। একবার শুধু তাদের প্রতি ঘৃণা প্রকাশ করতে, দেখতে এই মূর্খ গরিব ভুখা নাঙ্গা এতিমরা তোমাদের জন্য কী করত!
ভাই! তোমরা যেমন চেয়েছ সোনার বাংলাদেশ গড়তে তেমন আমিও চেয়েছি। মনে হয় তোমার থেকে বেশি করেই চেয়েছি। কারণ তুমি ইচ্ছা করলে চলে যেতে পারবে অন্য কোন দেশে (তোমাদের অনেকে অলরেডি চলে গেছে), সে সামর্থ্য তোমার আছে, আমার নেই।
তোমার মত করে আমিও চেয়েছি আমার পিতৃপুরুষের সম্মান। আমি চাই নি আমার দাদার মত জায়নামাজে আমার পিতার মৃত্যু হোক কিংবা তার জায়নামাজে বসা নিয়ে কেউ হাসি-তামাশা করুক। ভাই, আমি তোমার অসমাপ্ত কাজটিই পূর্ণ করতে চেয়েছি মাত্র। কিন্তু তুমি কি করলে- আমাকে তালেবান, যুদ্ধাপরাধীর দোসর, ধর্মগাধা কত কী বানাতে চাইলে। চেষ্টা করলে দূর্বল করতে আমার বিশ্বাস।
ভাই! আমরা তোমাদের মত মুক্তমনা নই। আমার মনটা ছোট। আমাদের সাধ্য নেই তোমাদের মত নাইট ক্লাব, বারে যাবার। আমরা ব্লগ পড়ি না বা লিখি না। চটি লিখি না। আমাদের পৃথিবীটা ভীষণ ছোট। আর এই ছোট মন আর পৃথিবীটা জুড়ে আছে আল্লাহ-নবীর প্রেম। তাই সকল অপপ্রচারে রইলাম অটুট। আমার দৃঢ় মনোবল দেখে তুমি আমাকে প্রতিরোধের ডাক দিলে। তোমার সরকারি ক্ষমতা দিয়ে আমার গাড়ি বন্ধ করলে, আমাকে দাঁড় করালে এনে নগ্ন বুলেটের সামনে।
ভাই! তোমরা অনেক বুঝ। কোরআন হাদিস নাকি আমাদের থেকেও বেশি গবেষণা কর। ফেসবুকে-ব্লগে তা নিয়ে লেখ। ভাই তবে বল, সবকিছু জেনে বুঝেও আমাদের বিরোধিতা করাকে কি মুনাফেকী বলে না?
ভাই বলে ডেকেছ। কিন্তু দেখ, তোমার সমস্ত চিঠি জুড়ে রয়েছে আমার প্রতি নিদারুণ অবজ্ঞা। আমরা গরিব, তোমার মত প্রাচুর্য পাইনি। তবে আমার আবার আন্দোলনের অধিকার কী- তোমাদের কাছে ব্যাপারটা যেন এমনই। তবে বল এমন আচরণকে কি মুনাফেকী বলে না?
ভাল থেকো ভাই।
ফী-আমানিল্লাহ
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই মে, ২০১৬ ভোর ৬:২৭