somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

আংটি

৩০ শে এপ্রিল, ২০১৬ রাত ৮:৩৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

বাদশাহ হারুনুর রশীদকে সবাই চেনে বা তার নাম শুনেছে। বাদশাহ হবার পরের ইতিহাস সবার জানা বা বই পুস্তকে অঙ্কিত আছে। কিন্তু বাদশাহ হওয়ার আগের ইতিহাস সবার জানা নয়। যুবরাজ থাকাকালীন সময়ের একটি খন্ডিত অথচ মর্মস্পর্শী ঘটনা নিয়েই এই দৃশ্যকাব্য। চলুন দেখে আসা যাক........


প্রথম অঙ্ক

(খলীফা হারুনুর রশীদের শোভাযাত্রা এগিয়ে চলছে)
একটি কন্ঠস্বরঃ (শোভাযাত্রার মাঝ থেকে ভেসে এল) আমীরুল মুমিনীন
আমীরুল মুমিনীন! আমার কাছে আপনার একটি আমানত আছে।
হারুনুর রশীদঃ এই লোকটির পথ ছেড়ে দাও।
কণ্ঠস্বরঃ আসসালামু আলাইকা ইয়া আমীরুল মুমিনীন!
রশীদঃ ওয়ালাইকাস্ সালাম। তুমি কী বলতে চাও?
কণ্ঠস্বরঃ আমার কাছে আপনার একটি আমানত আছে।
রশীদঃ আমানত!!! (সীমাহীন আশ্চর্য তার চোখে মুখে)।
কণ্ঠস্বরঃ (দৃঢ়তার সাথে) জ্বি, হ্যাঁ, আমীরুল মুমিনীন। এই আংটির মালিক আমাকে তা আপনার নিকট পৌঁছে দিতে বলেছেন।
রশীদঃ (ব্যতিব্যস্ত হয়ে) কী বলো তুমি? এই আংটি কোথা থেকে নিয়ে এসেছো?
কণ্ঠস্বরঃ এর মালিকের কাছ থেকে আমীরুল মুমিনীন!
রশীদঃ তুমি কি তার মালিককে চেনো?
কণ্ঠস্বরঃ জ্বি, হ্যাঁ, তিনিইতো আমাকে বলেছেন এটা আপনার নিকট পৌঁছে দিতে।
রশীদঃ (তার প্রহরীদেরকে লক্ষ্য করে) এই লোকটিকে তোমাদের সাথে রাখো। আমি তাকে প্রাসাদে দেখতে চাই।
প্রহরীদের কণ্ঠস্বরঃ তাই হবে আমীরুল মুমিনীন।
(শোভাযাত্রা এগিয়ে চললো)
খলীফার প্রাসাদে
রশীদঃ এ্যাই লোক, আমার কাছে আসো।
লোকঃ আমি উপস্থিত আমীরুল মুমিনীন।
রশীদঃ তোমার নাম কি? আর সত্যি করে বলো তুমি কোথা থেকে এসেছো?
লোকঃ আমি আব্দুল্লাহ বিন ফারজ। আমি বসরা থেকে এসেছি আমীরুল মুমিনীন।
রশীদঃ সত্যিই কি তুমি এই আংটির মালিককে চেনো?
লোকঃ জ্বি, হ্যাঁ, আমীরুল মুমিনীন। তিনি হলেন আহমদ আস সাবিয়ী।
রশীদঃ (চরমভাবে বিস্মিত হয়ে) আহমদ আস সাবিয়ী!!!?
আব্দুল্লাহঃ হ্যাঁ, সেখানেতো তাকে এ নামেই ডাকা হয়।
রশীদঃ কোথায়?
আব্দুল্লাহঃ বসরায়।
রশীদঃ সে কি এখনো বসরায় আছে?
আব্দুল্লাহঃ তিনি বসরায় ছিলেন আমীরুল মুমিনীন!
রশীদঃ এখন সে কোথায়?
আব্দুল্লাহঃ আমীরুল মুমিনীন! আল্লাহ তায়ালা আপনাকে দীর্ঘজীবী করুন। তিনিতো ইন্তেকাল করেছেন। আল্লাহ তার প্রতি রহমত বর্ষণ করুন।
রশীদঃ ইন্তেকাল করেছে? (চোখে মুখে তার বিষন্নতার ছাপ)।
আব্দুল্লাহঃ হ্যাঁ, আমীরুল মুমিনীন! আল্লাহ তায়ালা তার ব্যাপারে আপনার অনুগ্রহকে মহিমান্বিত করুন এবং আপনার শোক প্রকাশকে চমৎকৃত করুন।
রশীদঃ কিন্তু ইবনে ফারজ, তুমি প্রথমে আমার কাছে তার শারিরীক কাঠামোর কিছু বিবরণ দাও।
আব্দুল্লাহঃ আমীরুল মুমিনীন! বিশের কোঠা ছুঁই ছুঁই করা এক তরুণ যুবক, প্রশস্ত বক্ষের অধিকারী এবং ক্ষীণ দেহাবয়বী।
রশীদঃ (হঠাৎ আব্দুল্লাহর দিকে ভালভাবে লক্ষ্য করে) আশ্চর্যতো, তুমি এভাবে আমার দিকে তাকিয়ে আছো কেন?
আব্দুল আমাকে ক্ষমা করবেন আমীরুল মুমিনীন! আপনার সাথে তার বিস্তর সাদৃশ্যটা আমাকে ধাঁধাঁয় ফেলে দিয়েছে। যদি তিনি ক্ষীণ দেহাবয়বের না হতেন তাহলে আমি বলতাম তার চেহারা আপনার থেকেই গঠিত।
রশীদঃ ব্যাস, ব্যাস, হয়েছে; তোমাকে আর বলতে হবে না। নিশ্চয়ই সে ব্যক্তিটি ও-ই। আল্লাহ ছাড়া আর কোন শক্তির অধিপতি নেই। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন।
আব্দুল্লাহঃ আমীরুল মুমিনীন! সে কি আপনার ছেলে?
রশীদঃ হ্যাঁ, সেই হলো আমার প্রথম সন্তান, আল্লাহ তায়ালা তার মাধ্যমে আমাকে আনন্দিত করেছেন। সে কি তোমাকে এ ব্যাপারে কোন কিছু বলেনি?
আব্দুল্লাহঃ না, আমীরুল মুমিনীন! এ ব্যাপারে সে আমাকে কিছু বলেনি। আমাকে তো বলেছেন আলহাজ্বা খাদিজা হামুয়ী। যার সাথে তিনি বসবাস করতেন।
রশীদঃ কে এই আলহাজ্বা?
আব্দুল্লাহঃ তিনি হলেন সতী-সাধ্বী আল্লাহভীরু এক মহিলা। যিনি আপন আলয়ে নিজেকে শুধু ইবাদতের জন্য নিবেদিত করেছেন। আমি এও জানতে পেরেছি যে, তিনি ছোট বেলা থেকেই তার কাছে লালিত-পালিত হয়ে বেড়ে উঠেছেন।
রশীদঃ নিশ্চয়ই তার সম্পর্কে তুমি আরো অনেক কিছু জানো। সুতরাং তুমি তার ব্যাপারে যা জানো তা আমাকে খুলে বলো।
আব্দুল্লাহঃ আমীরুল মুমিনীন! আমি আশাবাদী আপনি আমাকে এ ব্যাপারে ক্ষমা করবেন।
রশীদঃ কী বলছো? কেন কী হয়েছে?
আব্দুল্লাহঃ আমীরুল মুমিনীন! আমি আপনাকে সেই ঘটনা বলতে লজ্জাবোধ করছি।
রশীদঃ আব্দুল্লাহ, এর চেয়ে বরং তুমি আমার কাছে তার ঘটনা খুলে বলো। কেননা তা আমাকে ভাবিয়ে তুলছে।
আব্দুল্লাহঃ আমীরুল মুমিনীন! আপনি কি আমার কথাকে সত্য মনে করবেন যদি আমি বলি যে তিনি একজন রাজমিস্ত্রী ছিলেন এবং পারিশ্রমিকের বিনিময়ে মানুষের বাড়ী নির্মাণের কাজ করতেন?
রশীদঃ (দুঃখিত স্বরে) আব্দুল্লাহ! কিভাবে তুমি তার পরিচয় পেলে, বলো ।
আব্দুল্লাহঃ আমার বাড়ীর কিছু অংশ সংস্কারের প্রয়োজন দেখা দিলো। তখন আমি রাজমিস্ত্রীর খোঁজে তাদের নির্দিষ্ট জায়গার উদ্দেশ্যে বের হলাম। এরপর তাকে সেখানে দেখতে পেলাম।

দ্বিতীয় অঙ্ক

(বসরায়)
আব্দুল্লাহঃ তুমি কি রাজমিস্ত্রী?
আহমদঃ হ্যাঁ।
আব্দুল্লাহঃ তোমার পারিশ্রমিক কত?
আহমদঃ তিন দিরহাম।
আব্দুল্লাহঃ এতো বেশী চাইছো কেন? আমি তোমাকে দুই দিরহাম দিবো।
আহমদঃ তাহলে আমাকে বাদ দিয়ে অন্য একজন রাজমিস্ত্রী তালাশ করুন।
আব্দুল্লাহঃ আমিতো দেখছি যে, তুমি একেবারে দুর্বল দেহাবয়বী।
আহমদঃ অচিরেই আমার কাজ দেখে আপনি মুগ্ধ হয়ে যাবেন ইনশাআল­াহ্।
আব্দুল্লাহঃ এসো আমার সাথে।
আহমদঃ আপনার সাথে যাবো। তবে একটি শর্ত আছে।
আব্দুল্লাহঃ কী সেটা?
আহমদঃ যখন যোহরের নামাজের সময় হবে এবং মুয়াজ্জিনের কণ্ঠস্বর ভেসে আসবে তখন আমি আমার কাজ ছেড়ে দিয়ে মসজিদে নামাজ আদায় করতে যাবো। আসরের সময়ও এমনটি করবো।
আব্দুল্লাহঃ কিন্তু!
আহমদঃ ভয় পাবেন না। আল­াহ্র হকের কারণে আপনার হকে কোন ত্র“টি হবে না।
আব্দুল্লাহঃ ঠিক আছে, আমি তোমার শর্ত মেনে নিলাম। এসো আমার সাথে।
আব্দুল্লাহঃ আমীরুল মুমিনীন! দিন শেষে আমি দেখতে পেলাম সে দুজন ব্যক্তির কাজ সম্পন্ন করেছে। তাই আমি তার পারিশ্রমিক বাড়িয়ে দিতে মনস্থ করলাম। কিন্তু সে আমাকে তা ফিরিয়ে দিলো।
রশীদঃ এরপর কী হলো আব্দুল­াহ্?
আব্দুল্লাহঃ আমীরুল মুমিনীন! এরপর থেকে যখনই আমার কোন প্রয়োজন দেখা দিতো আমি তাকে তলব করতাম। খুঁজে ফিরতাম। আর আমি আমার বন্ধুদেরকেও তার কথা বললাম। যেন সে তাদের কাজগুলোও করতে পারে। এরপর তারাও তার কাজ দেখে কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করেছিলো এবং তার প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়েছিলো। অবশেষে একদিন সে আমার কাছে কাজ করার জন্য এলো। সেটা ছিলো রমজান মাসে। তখনতো আমি ভীষণ আশ্চার্যান্বিত হলাম তার দুর্বল কায়া ও বিবর্ণ চেহারা দেখে।
আব্দুল্লাহঃ আহমদ! আজতো তোমাকে বড্ড ক্লান্ত দেখতে পাচ্ছি। থাক, আজ কাজের প্রয়োজন নেই। বাসায় চলে যাও।
আহমদঃ না, না, মনিব! আমার কিছুই হয়নি। আপনি যেটা দেখতে পাচ্ছেন সেটা রোজা রাখার আলামত মাত্র।
আব্দুল্লাহঃ না, না, বৎস! আজ চলে যাও।
আহমদঃ আপনি যখন চাচ্ছেন না যে, আমি আপনার কাজ করি; তবে জেনে রাখুন অবশ্যই আমি আজ অন্যের কাজ করবো। কেননা টাকা আমার বড্ড প্রয়োজন।
আব্দুল্লাহঃ না, আহমদ তুমি আজ কিছুতেই কাজ করো না। আমি তোমাকে আজকের দিনের পূর্ণ পারিশ্রমিক দিবো।
আহমদঃ মনিব, আপনি জানেন যে আমি দান গ্রহণ করি না।
আব্দুল্লাহঃ আমীরুল মুমিনীন! এরপর আমি তাকে কাজ করার অনুমতি দিয়ে দিলাম। যখন যোহরের সময় হলো তখন আমি তাকে খুঁজতে লাগলাম। কিছুক্ষণ পর দেখতে পেলাম যে, সে বসে আছে। আর তার শরীর থেকে দরদর করে ঘাম ঝরছে এবং সে কাঁপছে।
আব্দুল্লাহঃ বৎস! আমি কি তোমাকে বলিনি যে, আজকে কাজ করোনা।
আহমদঃ আমার মনিব! আপনি কি আমার একটি উপকার করে দিতে পারবেন?
আব্দুল্লাহঃ হ্যাঁ, বলো।
আহমদঃ আমাকে হাসান বসরী রোডে অবস্থিত আমার বাড়িতে আলহাজ্বা খাদিজা হামুয়ীর নিকট নিয়ে যান। আমি আশংকা করছি যে, আমি তাকে দেখার পূর্বেই ইহলোক ত্যাগ করব।
আব্দুল্লাহঃ এরপর আমি তাকে একটি সওয়ারীতে করে বাড়ি নিয়ে গেলাম। সে আমার উপর ভর করে ঘরে প্রবেশ করলো। তখন খাদিজা আমাদেরকে অভ্যর্থনা জানালেন। এরপর তিনি তার অবস্থা বেগতিক দেখে দ্রুত বিছানায় শুইয়ে দিলেন।
আলহাজ্বাঃ আমি কি তোমাকে বলিনি যে, বৎস! আজ কাজ করো না?
আব্দুল্লাহঃ এটা কোন ব্যাপার না মা! আমিতো কখনও এটা ভাবতেই পারি না যে, আমি আল­াহ্র সাথে সাক্ষাৎ করবো কর্মক্ষম বেকার হয়ে।
আব্দুল্লাহঃ জনাবা, এটা নিন। এটা তার আজকের কাজের পারিশ্রমিক।
আহমদঃ কত?
আব্দুল্লাহঃ তিন দিরহাম।
আহমদঃ না, মা না, আপনি কখনোই তার থেকে দেড় দিরহামের বেশি গ্রহণ করবেন না। এক দিনের পারিশ্রমিক ..... আল্লাহ আপনাকে উত্তম বিনিময় দান করুন আব্দুল্লাহ বিন ফারজ! আজ যখন আপনি আমাকে গৃহে পৌঁছেই দিয়েছেন, আপনি কি আমার আরেকটি উপকার করে দিতে পারবেন?
আব্দুল্লাহঃ নিঃসন্দেহে, তুমি নিশ্চিন্ত মনে বলতে পারো।
আহমদঃ আল্লাহ আপনাকে উত্তম বিনিময় দান করুন। আম্মাজান, ইনি একজন সৎ ও বিশ্বস্ত লোক। যদি আপনার অনুমতি হয় তবে আমি ভেবে রেখেছি যে, আমার ওসিয়ত তার কাছেই পেশ করবো।
আব্দুল্লাহঃ বৎস, তুমি তা করতে পারো।
আহমদঃ আংটিটি কোথায় আম্মা?
আলহাজ্বাঃ দাঁড়াও, দিচ্ছি বাবা।
আহমদঃ ভাই আব্দুল্লাহ বিন ফারজ! আপনি একটু কাছে আসুন। আমার আশা- যখন আমি ইহলোক ত্যাগ করবো তখন আপনি এ আংটিটি নিয়ে বাগদাদ যাবেন এবং তা খলীফা হারুনুর রশীদের নিকট হস্তান্তর করবেন।
আব্দুল্লাহঃ হারুনুর রশীদ?
আহমদঃ হ্যাঁ, কিন্তু আপনার জন্য তা কী খুব কষ্টদায়ক হয়ে যাবে?
আব্দুল্লাহঃ কিন্তু কিভাবে আমি তার কাছে পৌঁছতে সক্ষম হবো?
আহমদঃ আপনি খলীফার শোভাযাত্রার অপেক্ষা করবেন। যখন তা আপনার নিকটবর্তী হবে তখন আপনি আংটিটাকে তার সামনে তুলে ধরবেন। এরপর নিশ্চয়ই তিনি আপনাকে কাছে ডাকবেন এবং সম্মানিত করবেন। যখন আপনি তার সাথে মিলিত হবেন তখন বলবেন-এই আংটির অধিপতি আপনাকে সালাম জানিয়েছেন এবং আপনাকে বলেছেন ......
রশীদঃ এবং আপনাকে বলেছেন- কী বলেছে?
আহমদঃ আমাকে ক্ষমা করুন আমীরুল মুমিনীন। আমি বলতে পারবো না।
রশীদঃ বলো , কী বলেছে?
আব্দুল্লাহঃ সে আপনাকে উদ্দেশ্য করে বলেছে- আফসোস আপনার জন্য। আপনি আপনার এই বাদশাহী প্রতাপ নিয়ে মৃত্যুবরণ করবেন না। আপনি যদি আপনার এই ক্ষমতার উন্মত্ততা নিয়ে মৃত্যুবরণ করেন তাহলে আপনি অনুতপ্ত ও লজ্জিত হবেন এবং আপনার অনুশোচনা দীর্ঘস্থায়ী রূপ লাভ করবে (সেদিন যেদিন সম্পদরাজি ও সন্তানাদি কোন কাজে আসবে না। তবে সে ব্যক্তি ব্যতীত যে সমর্পিত কলব ও পরিচ্ছন্ন হৃদয় নিয়ে আল্লাহ নিকট আগমন করবে)।

তৃতীয় অঙ্ক

(রাজ প্রাসাদে হারুনুর রশীদ ও তার স্ত্রী জোবায়দার কথোপকথন)
জোবায়দাঃ আমীরুল মুমিনীন! আপনার ছেলের অকাল মৃত্যুতে আপনার প্রচন্ড দু:খিত হওয়া আমাকেও ব্যথিত করে তুলেছে।
রশীদঃ জোবায়দা! তুমি আমাকে কিছুক্ষণ একাকী থাকতে দাও। আল্লাহ কসম, যদি আমি সারাজীবনও তার শোকে কাঁদি তবুও আমি আমার শোক কাতরতা পূর্ণ করতে পারবো না। সে এক দিরহাম অথবা দুই দিরহামের বিনিময়ে রাজমিস্ত্রীর কাজ করতো। অথচ প্রাসাদে আমার চাকর-বাকররা গোশত ও মিষ্টান্ন দ্রব্য ভক্ষণ করে।
জোবায়দাঃ এতে আপনার দোষ কী? সে তো নিজেই এ জীবনকে বেছে নিয়েছে।
রশীদঃ আফসোস! যেদিন সে প্রাসাদে আমাদের সাথে সাক্ষাৎ করতে এসেছিলো সেদিন যদি তার উপদেশগুলো মেনে নিতাম!
জোবায়দাঃ সে তো কামনা করেছে যে, আপনি ওমর বিন আবদুল আজিজের জীবনালোকে পথ চলবেন। আপনার পক্ষে কি তা সম্ভব ছিলো?
রশীদঃ আমার উচিত ছিলো তার সাথে তাল মিলিয়ে চলা এবং নম্র আচরণ করা। কিন্তু আমি প্রাসাদের লোকদের নির্দেশ দিয়েছিলাম যে, তারা যেন তার সাথে কথা না বলে এবং জনসাধারণকে নিষেধ করেছিলাম তারা যেন তার সাথে কোন প্রকার সম্পর্ক স্থাপন না করে। অবশেষে তার জীবন সংকীর্ণ হয়ে পড়েছিলো। ফলে সে প্রাসাদ থেকে পালিয়ে গিয়ে আত্মগোপন করেছিলো।
জোবায়দাঃ তার সাথে তো আপনার আচরণ সঠিক ছিলো। কিন্তু সেইতো মানুষকে আপনার বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তুলছিলো।
রশীদঃ বরং তুমিইতো তার বিরুদ্ধে আমাকে প্ররোচিত করেছিলে এই আশংকায় যে, আমি তোমার ছেলের স্থানে তাকে খেলাফতের উত্তরাধিকারী বানাবো।
জোবায়দাঃ আমীরুল মুমিনীন! আপনি কি মনে করেন যে, তার মত কট্টর ইবাদতকারী খেলাফতের উত্তরাধিকারী হিসেবে উপযুক্ত?
রশীদঃ আমি আগামীকাল বসরায় যাবো। তার কবর যিয়ারত করবো এবং তার প্রতি আমার সমবেদনা প্রকাশ করবো।
জোবায়দাঃ হ্যাঁ, আপনি তাই করুন । হয়তোবা তা আপনার দু:খবোধকে হালকা করে দিবে।
রশীদঃ আমি তার মার সাথেও সাক্ষাৎ করে আসবো।
জোবায়দাঃ তার মা!!? সে কি আমাদেরকে বলেনি যে, তার মা ইন্তেকাল করেছেন?
রশীদঃ শান্ত হও জোবায়দা। তুমি যার কথা বলতে চাচ্ছো - তিনিতো সেই মহীয়সী যিনি আহমদকে জন্মদান করেছেন এবং যাকে দেখলে তুমি জ্বলে উঠতে। তিনি ইহলোক ত্যাগ করেছেন বটে। আর আমি মা বলতে বুঝাতে চাচ্ছি সেই সতী-সাধ্বী বৃদ্ধা মহিলাকে যিনি তাকে লালন-পালন করেছেন।
জোবায়দাঃ আসলে আপনি তার কথা বলে অন্য কাউকে হয়তো খুঁজছেন যার কাছ থেকে আহমদের প্রকৃত মায়ের সংবাদ জানতে পারবেন, যাকে আপনি প্রচন্ড ভালবাসতেন।
রশীদঃ আমি তোমাদের (নারী জাতিদের) দেখে বিস্মিত হচ্ছি। তোমাদের একজন তার সতীন মারা যাবার পরও তাকে তোমরা সহ্য করতে পারো না।
জোবায়দাঃ হারুন, এটা সতীনের প্রসঙ্গের ন্যায় কোন প্রসঙ্গ নয়। আমি জানি আপনি কোনদিন তার ভালোবাসার কথা এবং তার প্রতি আপনার অনুরাগের কথা ভুলতে পারবেন না।

(বসরায়)
রশীদঃ আব্দুল্লাহ বিন ফারজ, তার কবর কোথায়?
আব্দুল্লাহঃ এইতো এখানে আমীরুল মুমিনীন! আব্দুল­াহ্ বিন মালিকের কবর স্থানে তার কবর অবস্থিত।
রশীদঃ চুপ করো, আমাকে এভাবে সম্বোধন করবে না। আমি চাই না কোন ব্যক্তি জেনে ফেলুক “কে আমি”।
আব্দুল্লাহঃ ভুল হয়ে গেছে হে ..........
রশীদঃ হারুন।
আব্দুল্লাহঃ আমায় ক্ষমা করবেন হে হারুন। আমি আসলে ভুলে গেছি।
রশীদঃ না কোনো সমস্যা নেই। এবার আমাকে বলো তার কবর কোথায়? তবে আমার হৃদয় বলছে ওটাই তার কবর।
আব্দুল্লাহঃ হ্যাঁ, নি:সন্দেহে এটা তার কবর। আর এটা তার মায়ের কবর। (খলীফা হারুনুর রশীদ কবর দুটির সামনে দাঁড়িয়ে অঝোরে কাঁদতে লাগলেন)।
আব্দুল্লাহঃ আপনি তো প্রচুর কেঁদেছেন। এবার একটু শান্ত হোন।
রশীদঃ আলহাজ্বা খাদিজার সামনে কাঁদার চেয়ে এখানে দাঁড়িয়ে কাঁদা অনেক ভালো। তার বাড়ী কোথায়? এখান থেকে কি বেশী দূরে?
আব্দুল্লাহঃ না, না, আমরা তার বাড়ির নিকটেই আছি। এটাই হলো হাসান বসরী রোড।
রশীদঃ হায়,আফসোস! আহমদ আমার ছেলে অথচ সে এই জনপদে লালিত-পালিত হয়েছে। (আবার অঝোরে কাঁদতে লাগলেন)।

চতুর্থ অঙ্ক

আলহাজ্বাঃ স্বাগতম আব্দুল্লাহ বিন ফারজ। আল্লাহর শোকর, আপনি নিরাপদে ফিরে এসেছেন। আপনি কি আমার ছেলের ওসিয়ত পৌঁছে দিয়েছেন?
আব্দুল্লাহঃ হ্যাঁ।
আলহাজ্বাঃ আল্লাহ আপনাকে উত্তম বিনিময় দান করুন।
আব্দুল্লাহঃ জনাবা, আমি আমার সাথে একজন মেহমান নিয়ে এসেছি।
আলহাজ্বাঃ আপনাকে এবং আপনার মেহমানকে স্বাগতম। কে তিনি? আমীরুল মুমিনীন? আপনাকে স্বশ্রদ্ধ অভিবাদন। আপনি কি আপনার পুত্রের কবর যিয়ারতের উদ্দেশ্যে আগমন করেছেন?
রশীদঃ হ্যাঁ, মহোদয়া, আমি আব্দুল­াহ্ বিন ফারজের সাথে যিয়ারত করেছি।
আলহাজ্বাঃ আর তার পাশের কবরটি কি যিয়ারত করেছেন?
রশীদঃ হ্যাঁ, আমেনা রহ. এর কবর যিয়ারত করেছি।
আলহাজ্বাঃ আল্লাহ তায়ালা উভয়ের উপর রহমত বর্ষণ করুন। তারা ছিলেন শ্রেষ্ঠ মাতা এবং শ্রেষ্ঠ ছেলে। তারা ছিলেন দুনিয়া বিমুখ এবং আখেরাত অন্বেষী। আর আখেরাতই হলো শ্রেষ্ঠ ও চিরস্থায়ী।
রশীদঃ জনাবা, আপনি কি জানেন-আহমদ তার দুনিয়া বিমুখতা ও খোদাভীরুতা কোথা থেকে পেয়েছে?
আলহাজ্বাঃ হ্যাঁ, আমীরুল মুমিনীন জানি, তার মা আমেনার কাছ থেকে। তিনিতো দুনিয়া বিরাগী ছিলেন।
রশীদঃ মহোদয়া, আমি আশাবাদী যে, আপনি আমাকে বলবেন কিভাবে আপনি আমেনার পরিচয় পেলেন।
আলহাজ্বাঃ নি:সন্দেহে আমীরুল মুমিনীন। নিশ্চয়ই আমেনার আলোচনা আমার কাছে খুবই প্রিয়। তার চরিত্র মাধুর্যতা সন্দেহাতীতভাবে সতী-সাধ্বী মুমিন রমণীদের মধ্য হতে সবচেয়ে সুন্দর। আমীরুল মুমিনীন! আজ থেকে প্রায় পঁচিশ বছর আগের কথা। এক রাতে আমার দরজায় কড়া নাড়ার আওয়াজ শোনা গেলো। আমি দরজা খুলে দেখি যে, এক অপরূপা, সুন্দরী রমণী দাঁড়িয়ে আছে। তার চেহারায় রয়েছে দু:খ-বেদনার সুস্পষ্ট ছাপ।
আমেনাঃ আপনিই কি আলহাজ্বা খাদিজা হামুয়ী?
আলহাজ্বাঃ হ্যাঁ, এসো মেয়ে ভিতরে এসো। (দরজা বন্ধের আওয়াজ শোনা যায়)।
আলহাজ্বাঃ কে তুমি? আর কী বা চাও আমার কাছে?
আমেনাঃ আমি দুনিয়া থেকে পলায়নপর এক নারী। আর আমি সন্তান সম্ভবা। সে প্রসব হওয়ার উপক্রম। আপনি কি আমার প্রতি এতটুকু অনুগ্রহ করবেন যে, আমার সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়া পর্যন্ত আমি আপনার বাড়িতে অবস্থান করবো। পাশাপাশি আমি আপনার খেদমত করবো এবং আপনার সততা দ্বারা উপকৃত হবো।
আলহাজ্বাঃ তোমার পরিবার-পরিজন কোথায় মা?
আমেনাঃ আমার পরিবার-পরিজন বলতে কেউ নেই। আমি আমার দাদীর সাথে বসবাস করতাম। তিনি ইহলোক ত্যাগ করেছেন।
আলহাজ্বাঃ কোথায়? বসরায়?
আমেনাঃ না, মহোদয়া, বাগদাদের বহিরাগত এক এলাকায়।
আলহাজ্বাঃ তার মানে তুমি ভিনদেশী?
আমেনাঃ হ্যাঁ।
আলহাজ্বাঃ তোমার নাম কি মা?
আমেনাঃ আমার নাম আমেনা।
আলহাজ্বাঃ আমেনা, তোমাকে আমার গৃহে সুস্বাগতম।
আমেনাঃ আল্লাহ আপনাকে উত্তম বিনিময় দান করুন হে মহানুভবী! আপনি আমার থেকে তা-ই দেখতে পাবেন যা আপনার কাজকে সহজ করে দিবে ইনশাআল্লাহ।
আলহাজ্বাঃ আমীরুল মুমিনীন! এভাবেই আমেনার সাথে আমার পরিচয় ঘটেছে। এরপর তার খোদাভীরুতা ও সততার কারণে তাকে আপন করে নিয়েছি এবং মেয়ে হিসেবে গ্রহণ করেছি। কিছুদিন পর সে একটি সন্তান প্রসব করলো। তখন আমরা তার নাম রাখলাম ‘আহমদ’। যখন সে আস্তে আস্তে বড় হলো তখন আমরা তাকে এক নির্মাণ শিল্পীর হস্তগত করে দিলাম। যাতে করে সে পুরোপুরিভাবে নির্মাণ শিল্পকে আয়ত্ত করতে পারে। আমার জানা ছিলো না যে, সে খলীফা হারুনুর রশীদের ছেলে।
রশীদঃ তাহলে সে আপনাকে তার ঘটনা পুরোপুরি বর্ণনা করেনি?
আলহাজ্বাঃ না, আমীরুল মুমিনীন। প্রথম প্রথমতো সে এ ব্যাপারে আমাকে কিছুই বলেনি। আর আমিও তাকে এ ব্যাপারে কোন কিছু জিজ্ঞেস করিনি যাতে সে বিব্রতবোধ করে। তবে আমি ধারণা করেছি (আসতাগফিরুল্লাহ- আল্লাহর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করছি) যে, সে খারাপ কাজ করার পর তওবার ইচ্ছে করেছে। তখন আমি নিজেকে প্রবোধ দিয়েছি এই বলে- এটাইতো আল্লাহর কাছে সর্বশ্রেষ্ঠ আমল। এ অবস্থায়ই চলতে লাগল আমাদের দিনকাল; তার সেই ব্যাধি হওয়া পর্যন্ত যাতে আক্রান্ত হয়ে সে ইহলোক ত্যাগ করেছে। একদিন সে আমাকে এবং আহমদকে কাছে ডাকলো। আমরা তার বিছানার পাশে গিয়ে বসলাম।
আমেনাঃ আপনার কাছে আহমদের পিতার নাম বলে দেবার সময় এসেছে। আর আহমদ, আজ তোমার উপর কর্তব্য হলো আমি মারা যাবার পূর্বেই তোমার ভালোভাবে জেনে নেয়া- কে তোমার বাবা।
আলহাজ্বাঃ আমেনা, তুমি আমাকে একটু বিশ্রামের সুযোগ দাও, আর নিজেকে ক্লান্ত করো না।
আমেনাঃ মহীয়সী, আশা করি আপনি ভালোকিছুই শুনবেন।
আহমদঃ আম্মাজান, আপনি আমাকে বলেছেন যে, আমার বাবার নাম হারুনুর রশীদ। তিনি বাগদাদের একজন ব্যবসায়ী। তিনি সফরের কাফেলার সাথে বেরিয়ে গেছেন। এরপর আর ফিরে আসেননি।
আমেনাঃ হ্যাঁ, বৎস, তার নাম হারুন। তিনি আমাকে বিবাহ করার সময় বলেছেন যে, তিনি বাগদাদের একজন ব্যবসায়ী। বিবাহের পর আমার কাছে স্পষ্ট হয়েছে যে, তিনি মাহদীর ছেলে এবং খেলাফতের উত্তরাধিকারী। আর এটাই হলো তার সেই কাফেলার যাত্রা যা আমার নিকট আর ফিরে আসেনি।
আলহাজ্বাঃ তুমি কি বুঝাতে চাচ্ছো যে, তিনিই আমীরুল মুমিনীন হারুনুর রশীদ?
আমেনাঃ হ্যাঁ, এই হলো তার সেই আংটি যা সে আমার কাছে রেখে গেছে। হে মহানুভবী, আপনি এটা আপনার হেফাজতে রাখুন। আহমদ বড় হয়ে যদি তার পিতার কাছে যেতে চায় তখন সে যেন তার সাথে এই আংটিটা নিয়ে যায়।

পঞ্চম অঙ্ক

আলহাজ্বাঃ আমীরুল মুমিনীন! আমেনা ইন্তেকাল করতে না করতে আহমদ আমার কাছে কাতর মিনতি শুরু করে দিলো- আমি যেন তাকে আপনার কাছে যাওয়ার অনুমতি দেই। তখন আমি তাকে এই বলে ফিরিয়ে দিচ্ছিলাম যে, আগে তুমি বড় হও, তারপর দেখা যাবে। সেখানে যাওয়ার জন্য তোমাকে অবশ্যই বড় হতে হবে।
আহমদঃ আম্মাজান, আপনি আমায় অনুমতি দিন। আমি আমার বাবার কাছে যাবো। নি:সন্দেহে আমি একজন সুপুরুষ।
আলহাজ্বাঃ বৎস, আমি আশংকা করছি যে, তুমি আর আমার কাছে ফিরে আসবে না।
আহমদঃ আম্মাজান, আমি জানি আপনি কিসের ভয় করছেন। নিশ্চয়ই আপনি আমার ব্যাপারে দুনিয়ার প্রতি আকর্ষণ ও রাজত্বের প্রতি সম্মোহনের কথা ভেবে উদ্বিগ্ন হচ্ছেন। যা আমাকে আল্লাহ এবং আখেরাতের কথা ভুলিয়ে দিবে।
আলহাজ্বাঃ হ্যাঁ বৎস, আমি তোমার ব্যাপারে এই আশংকাই করছি।
আহমদঃ আম্মাজান, আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন। এমনটি কখনোও হবে না ইনশাআল­াহ্। আমার ইচ্ছা- আমি আমার বাবার কাছে যাবো তাকে কিছু নসীহত করার জন্য এবং উপদেশ দেওয়ার জন্য। যেন তিনি দুনিয়া বিমুখ ন্যায়পরায়ণ খলীফা ওমর বিন আবদুল আজীজের ন্যায় হতে পারেন।
আলহাজ্বাঃ আমীরুল মুমিনীন, তখন আমি তাকে অনুমতি দিলাম। আংটিটাও সাথে দিয়ে দিলাম এবং বাহনের ব্যবস্থা করলাম। এরপর আপনার সাথে তার যা হবার তাতো হয়েছেই।
রশীদঃ হ্যাঁ, মহোদয়া, আমি তাকে খেলাফতের উত্তরাধিকারী বানাতে চেয়েছিলাম। কিন্তু সে আমাকে ওমর বিন আবদুল আজীজের ন্যায় দেখতে চেয়েছিলো। আমি তার জন্য দুনিয়া কামনা করেছি আর সে আমার জন্য আখেরাত কামনা করেছে। সে যা আশা করেছে তা যখন আমার কাছে পায়নি তখন আমাকে বিদায় না জানিয়েই প্রাসাদ ত্যাগ করে চলে এসেছে। আমি তার খোঁজে সৈন্যবাহিনী প্রেরণ করেছিলাম কিন্তু কোন লাভ হয়নি। অবশেষে আব্দুল­াহ্ বিন ফারজ তার সংবাদ নিয়ে এসেছে।
আলহাজ্বাঃ আমীরুল মুমিনীন! আপনার কাছ থেকে পালিয়ে সে আমার কাছে ফিরে এসেছে এবং যা যা ঘটেছে সবকিছুই আমাকে বলেছে।
রশীদঃ আপনাকে সে কী বলেছে?
আলহাজ্বাঃ সে অশ্র“সজল চোখে আমায় বলতে শুরু করলো-
আহমদঃ আম্মাজান, আব্বা আমার কোন কথাই শুনলেন না। এদিকে প্রাসাদের সমস্ত লোক ছিলো আমার বিরুদ্ধাচরণকারী।
আলহাজ্বাঃ বৎস! তোমার দু:শ্চিন্তার কোন কারণ নেই। তুমি যা চেয়েছো তা মোটেও কোন সহজ বিষয় ছিলো না। তোমার বাবাকে উপদেশের যে দায়িত্ব ছিলো তা তুমি পুরোপুরিভাবে আদায় করেছো।
আহমদঃ আম্মাজান, আমি কি আব্বাজানের জন্য কিছুই করতে পারবো না? আমি কি তার কোন উপকারে আসবো না?
আলহাজ্বাঃ অবশ্যই, বৎস! তুমি আল্লাহকে ভয় করবে, সৎ কাজ করবে এবং তার জন্য দু’আ করবে।
রশীদঃ আহ্, আফসোস! আমিতো ধারণা করেছিলাম যে, সে আমার প্রতি বিদ্বেষী হয়ে চলে এসেছে।
আলহাজ্বাঃ কখনোই না, আমীরুল মুমিনীন। সে আপনাকে অত্যধিক ভালোবাসতো। সে দিনে কাজ করতো এবং তার পারিশ্রমিকের একটি অংশ ফকীর মিসকীনদের মাঝে সদকা করে দিতো। আর রাত কাটাত ইবাদতের মাঝ দিয়ে। এভাবেই তার শরীর দুর্বল হয়ে পড়েছিলো। তাইতো আমি তার ব্যাপারে এই আশংকা করেছিলাম।
আলহাজ্বাঃ বৎস! কী হলো তোমার। তোমার শরীরতো একেবারে দুর্বল হয়ে পড়েছে। তুমি মানুষের কাজ করা ছেড়ে দাও। আল­াহ্র অনুগ্রহে আমার কাছে যা আছে তা আমার এবং তোমার জন্য যথেষ্ট।
আহমদঃ আম্মাজান, আপনার আবার কী হলো! আপনিতো জানেন দান হলো সর্বোত্তম আমল। আর সর্বশ্রেষ্ঠ মাল (সম্পদ) হলো যা মানুষ আপন কর্মঠ হাত দিয়ে অর্জন করে। আপনি আমাকে নিয়ে ভাববেন না। আমি সর্বশ্রেষ্ঠ মালই সদকা করবো। হয়তোবা আল­াহ্ তায়ালা এর ওসীলায় আমার পিতা আমীরুল মুমিনীনকে ক্ষমা করে দিবেন।
আলহাজ্বাঃ আমীরুল মুমিনীন! আপনিতো আমায় অনেক প্রশ্ন করেছেন। আমি উত্তরও দিয়েছি। এখন আমি কি আপনাকে কোন প্রশ্ন করতে পারি?
রশীদঃ নি:সন্দেহে আপনি করুন।
আলহাজ্বাঃ আপনি আমায় বলুন- কিভাবে আপনি আহমদের মা আমেনাকে বিবাহ করলেন? আর কেমন করেই বা তাকে ছেড়ে দিলেন, যার দরুন সে বসরায় উপস্থিত হতে বাধ্য হয়েছে? আমার এ রহস্য অজানা। আমিও তাকে এ ব্যাপারে কোন প্রশ্ন করে বিব্রতকর অবস্থায় ফেলতে চাইনি।
রশীদঃ অবশ্যই জনাবা আমি আপনাকে বলবো যা আপনি শুনতে চেয়েছেন। ঘটনাটি ঘটেছিলো আমার পিতা মাহদী রহ. এর জীবদ্দশায়। আমি ছিলাম সতেরো বছরের যুবক। ঘোড়ায় চড়ে বেড়াতে খুবই পছন্দ করতাম। একদিন রাজধানীর বাইরে ঘুরে বেড়াচ্ছিলাম। হঠাৎ আমার খুব পিপাসা লাগলো। এমন সময় আমি আমার সামনে তার ছোট্ট কুটিরটি দেখতে পেলাম। সে তখন ছাগলের দুধ দোহন করছিলো। আমি তার কাছে গিয়ে পানি চাইলাম। সে আমায় পানি পান করালো। আমাকে বিমুগ্ধ করলো তার লজ্জাবনত চেহারা ও তার বাচনভঙ্গি। আমি আবিষ্ট হলাম। এরপর থেকে প্রতি রাতে আমি তার সাথে সাক্ষাতের লক্ষ্যে আসা-যাওয়া করতে লাগলাম। ফলে তার অনুপম চরিত্র মাধুর্যতায় আমার বিমুগ্ধতা এবং তার প্রতি আমার ভালোবাসা দিন দিন বেড়েই চললো। এদিকে আমি তাকে এবং তার পরিবার পরিজনকে বলেছিলাম যে, আমি একজন ব্যবসায়ী। এই শহরে স্থায়ীভাবে চলে আসছি। একদিন আমি তাকে গোপনে বিবাহ করলাম। যেন আমার পিতা বিষয়টি জানতে না পারেন। কেননা তিনি আমার জন্য বিবাহের পাত্রী ঠিক করে রেখেছিলেন। সে হলো আমার চাচাতো বোন জোবায়দা। এভাবে তার কাছে আমার আসা-যাওয়া ছিলো। অবশেষে একদিন জোবায়দাকে বিবাহ করলাম। মাহদী ইন্তেকাল করলেন এবং আমি তার পরবর্তীতে খলীফা হিসেবে সমাসীন হলাম। এরপর বেশ কিছুদিন খেলাফতের দায়-দায়িত্ব আমাকে তার থেকে বিরত রেখেছিলো। একদিন ভীষণভাবে মনে চাইলো তার সাথে সাক্ষাৎ করতে। তখন আমি ছদ্মবেশে তার কাছে উপস্থিত হলাম। আমার প্রকৃত অবস্থা তার কাছে পেশ করার জন্য এবং তাকে প্রাসাদের সুখময় জীবন-যাপনের প্রতি আহবান করার জন্য।

ষষ্ঠ অঙ্ক

আমেনাঃ কী হয়েছে তোমার প্রিয়তম! কেন তুমি এই সুদীর্ঘকাল আমার কাছে আসোনি?
রশীদঃ আমেনা, আজকের পর আর কখনো তোমার থেকে দূরে যাবো না। অচিরেই তুমি আমার সাথে প্রাসাদে বসবাস করবে।
আমেনাঃ তুমি কি বাগদাদে প্রাসাদ কিনেছো?
রশীদঃ না আমেনা, আমি তা কিনিনি। বরং আমার পিতা থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছি।
আমেনাঃ লা হাওলা ওয়ালা কুওআতা ইল্লা বিল্লাহ, বলো কি, তোমার পিতা ইহলোক ত্যাগ করেছেন অথচ আমি জানিনা!
রশীদঃ তুমি তার ওফাতের খবর শুনেছো আমেনা।
আমেনাঃ না, না, আল্লাহর শপথ প্রিয়তম! আমি শুনিনি। আর কিভাবেই বা আমি তা জানবো? আমিতো কেবল জানি যে, তার নাম মুহাম্মদ বিন আব্দুল­াহ্ ।
রশীদঃ প্রতিটি দেশের মানুষ তার মৃত্যু সংবাদ শুনেছে।
আমেনাঃ হারুন, তুমি এর দ্বারা কী বুঝাতে চাচ্ছো?
রশীদঃ তুমি কি আমীরুল মুমিনীন মাহদীর ওফাতের খবর শুনোনি?
আমেনাঃ হ্যাঁ, শুনেছি।
রশীদঃ তিনিই আমার পিতা।
আমেনাঃ তোমার পিতা!!?
রশীদঃ হ্যাঁ , আর আমিই হারুনুর রশীদ।
আমেনাঃ (কাঁদতে লাগলো এবং কেঁদেই চললো)।
রশীদঃ প্রিয়তমা, তুমি কাঁদছো কেন? তোমার জন্য কি এটা সুখময় নয় যে, তোমার স্বামী আমীরুল মুমিনীন।
আমেনাঃ না।
রশীদঃ তবে তুমি কাঁদছো কেন?
আমেনাঃ আমি তোমাকে হারিয়ে ফেলেছি হারুন। তুমি আর আমার কাছে ফিরে আসবে না।
রশীদঃ তুমি কী বুঝাতে চাচ্ছো?
আমেনাঃ তুমিতো জোবায়দা বিনতে জাফরের স্বামী।
রশীদঃ হ্যাঁ, এবং জোবায়দার আগে আমেনার স্বামী।
আমেনাঃ আমি তো অনেক দূরের! আর সে তোমার চাচাতো বোন।
রশীদঃ কিন্তু তুমিতো আমার প্রথম, প্রিয়তমা।
আমেনাঃ এ অনেক দূরের কথা হারুন! তুমি এখান থেকে চলে যাও হারুন। আজকের পর তুমি আর আমার কাছে আন্তরিকতাপূর্ণ হবে না।
রশীদঃ তোমার প্রতি আমার ভালোবাসাকে অস্বীকার করার কোন অধিকার তোমার নেই।
আমেনাঃ তাহলে তুমি আমাকে কোথায় নিয়ে যেতে চাও?
রশীদঃ প্রাসাদে, আমার একান্ত নিকটে।
আমেনাঃ আমি জোবায়দার সতীন হওয়ার জন্য? হারুন, তুমি আমাকে সত্যি করে বলো- তুমি কি আমার জন্য তোমার প্রাসাদে তোমার চাচাতো বোন জোবায়দার সমপরিমাণ অবস্থান তৈরী করতে পারবে?
রশীদঃ (নিশ্চুপ, নির্বাক)।
আমেনাঃ উত্তর দিচ্ছো না কেন? উত্তর দাও।
রশীদঃ এটা হয়তো সম্ভব হবে না। কিন্তু আমি তোমাকে রাখবো .....
আমেনাঃ শুনে রাখো হারুন! আমি এটা না জেনেই তোমাকে বিবাহ করে ফেলেছি যে, তুমি আমীরুল মুমিনীন মাহদীর ছেলে। আমিতো তোমাকে সাধারণ লোকদেরই একজন মনে করেছিলাম। যদি আমি জানতাম যে, তুমি খলীফা বংশোদ্ভূত তাহলে আমি কিছুতেই তোমাকে বিবাহ করতাম না। তাই তুমি এখনই আমাকে সুন্দরভাবে তালাক দাও।
রশীদঃ কখনো না, আমি তোমাকে কিছুতেই তালাক দিতে পারবো না। আমি তোমাকে ভালবাসি।
আমেনাঃ তাহলে আমি যেমন আছি তেমনি থাকতে দাও। আর তোমার যখন মন চায় তখন তুমি আমার কাছে এসো।
রশীদঃ না আমেনা, আজকের পর তা আর আমার পক্ষে সম্ভব নয়।
আমেনাঃ তাহলে আমাকে তালাক দাও।
রশীদঃ না, না, কিছুতেই আমি তোমাকে তালাক দিবো না। আমি এখনই সৈন্যবাহিনী পাঠাবো যারা তোমাকে প্রাসাদে বহন করে নিয়ে যাবে।
আমেনাঃ হারুন, তুমি ভুলে যেয়ো না যে ,আমি একজন অভিজাত নারী, বাদী নই।
রশীদঃ আমি আমীরুল মুমিনীন।
আমেনাঃ তাতে কী, আমি পরোয়া করি না।
আলহাজ্বাঃ আমীরুল মুমিনীন। আপনি কি তার কাছে সৈন্য প্রেরণ করেছিলেন?
রশীদঃ না মহোদয়া, আমি ভীষণ অনুশোচনায় দগ্ধ হয়েছিলাম। কেননা আমি তাকে ক্ষেপিয়ে তুলেছিলাম। এ ঘটনার কয়েকদিন পর আমি তাকে সন্তুষ্ট করার লক্ষ্যে এবং তুষ্ট করার প্রয়াস চালাতে তার কাছে ছুটে গিয়েছিলাম। যেন সে আমার সাথে প্রাসাদে ফিরে আসে। কিন্তু গিয়ে দেখি তার কুটির শূন্য। তখন তার খোঁজে বিভিন্ন দিকে লোক পাঠিয়েছি। কিন্তু তারা তাকে খুঁজে পায়নি।
আলহাজ্বাঃ আপনি কি জানতেন যে, সে অন্তঃসত্ত্বা?
রশীদঃ হ্যাঁ, এ বিষয়টিই তার ব্যাপারে আমার দুঃখবোধকে আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। এই সুদীর্ঘ বছরগুলোতে আমি সেই পরিতাপেই দগ্ধ হয়ে চলেছি।
আলহাজ্বাঃ আল্লাহ তার উপর রহমত বর্ষণ করুন। আপনার প্রতি তার প্রচন্ড ভালোবাসা ছিলো। হয়তো আপনার একান্ত মিলনই ছিলো তার প্রধান কারণ।
রশীদঃ আহ, আমি যদি জানতাম যে, সে আপনার এখানে বসবাস করছে!
আলহাজ্বাঃ আমীরুল মুমিনীন! এটাই ছিল আল্লাহ ইচ্ছা, (যার মাধ্যমে তিনি অনিবার্য বিষয়কে পূর্ণাঙ্গ রূপ দান করেছেন। আল্লাহ তায়ালা অনিবার্য বিষয়গুলো পূর্ণাঙ্গ রূপদানকারী।

সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে এপ্রিল, ২০১৬ রাত ৯:০৬
২টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

মি. চুপ্পুর পক্ষ নিয়েছে বিএনপি-জামাত; কারণ কী?

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ৩১ শে অক্টোবর, ২০২৪ বিকাল ৩:৩৬


বিএনপি গত ১৬ বছর আম্লিগের এগুচ্ছ কেশও ছিড়তে পারেনি অথচ যখন ছাত্ররা গণহত্যাকারীদের হটিয়েছে তখন কেন বিএনপি চু্প্পুর পক্ষ নিচ্ছে? অনেকেই বলছে সাংবিধানিক শুন্যতা সৃষ্টি হবে তার সংগে বিএনপিও... ...বাকিটুকু পড়ুন

=এতো কাঁদাও কেনো=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ৩১ শে অক্টোবর, ২০২৪ বিকাল ৫:০৬




আয়না হতে চেয়েছিলে আমার। মেনে নিয়ে কথা, তোমায় আয়না ভেবে বসি, দেখতে চাই তোমাতে আমি আর আমার সুখ দু:খ আনন্দ বেদনা। রোদ্দুরের আলোয় কিংবা রাতের আঁধারে আলোয় আলোকিত মনের... ...বাকিটুকু পড়ুন

ব্লগারেরা প্রেসিডেন্ট চুপ্পুমিয়াকে চান না, কিন্তু বিএনপি কেন চায়?

লিখেছেন সোনাগাজী, ৩১ শে অক্টোবর, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:২৪



**** এখন থেকে ১৯ মিনিট পরে (বৃহ: রাত ১২'টায় ) আমার সেমিব্যান তুলে নেয়া হবে; সামুটিককে ধন্যবাদ। ****

***** আমাকে সেমিব্যান থেকে "জেনারেল" করা... ...বাকিটুকু পড়ুন

ফিকাহের পরিবর্তে আল্লাহর হাদিসও মানা যায় না

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ৩১ শে অক্টোবর, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৪




সূরা: ৪ নিসা, ৮৭ নং আয়াতের অনুবাদ-
৮৭। আল্লাহ, তিনি ব্যতীত কোন ইলাহ নাই। তিনি তোমাদেরকে কেয়ামতের দিন একত্র করবেন, তাতে কোন সন্দেহ নাই। হাদিসে কে আল্লাহ থেকে বেশী... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ্‌ সাহেবের ডায়রি ।। পৃথিবীকে ঠান্ডা করতে ছিটানো হবে ৫০ লাখ টন হীরার গুঁড়ো

লিখেছেন শাহ আজিজ, ৩১ শে অক্টোবর, ২০২৪ রাত ৯:০২




জলবায়ূ পরিবর্তনের ফলে বেড়েছে তাপমাত্রা। এতে স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যাহত হচ্ছে। তাই উত্তপ্ত এই পৃথিবীকে শীতল করার জন্য বায়ুমণ্ডলে ছড়ানো হতে পারে ৫০ লাখ টন হীরার ধূলিকণা।... ...বাকিটুকু পড়ুন

×