শিক্ষা হচ্ছে মানব জীবনের স্বর্গীয় অনুভূতি। জীবনকে মানবিক গুণে গুণান্বিত করার অন্যতম হাতিয়ার হচ্ছে শিক্ষা। শিক্ষা মানুষের মনুষ্যত্ববোধকে জাগ্রত করে। সভ্যতাকে বিকশিত করে। শিক্ষা জীবনের আঁধার দূর করে আলোর পথ দেখায়। বিচার বিবেচনাবোধ সৃষ্টি করে। শুভ-অশুভ ও ভাল-মন্দের মাঝে দেয়াল তুলে দেয়। শিক্ষা হৃদয়ের জানালা খুলে দেয়। সুশিক্ষা নীতি-নৈতিকতার পথ দেখায়। সর্বোপরি আদর্শ সমাজ গঠনে মূল নিয়ামক হিসেবে কাজ করে। এই পথ ধরেই একসময় আদর্শ জাতি ও রাষ্ট্র গড়ে উঠে।¬¬¬আদর্শ সমাজ গঠনে সুশিক্ষার প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম। কেননা একটি আদর্শ সমাজ গঠনের জন্য যে সকল মৌলিক উপাদান প্রয়োজন সেগুলোর সাথে সুশিক্ষা ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। সুশিক্ষার অন্যতম উপাদান নীতি-নৈতিকতা, যা কওমী মাদরাসার শিক্ষা ব্যবস্থার অন্যতম ভূষণ। তবে কীভাবে আদর্শ সমাজ গঠনে কওমী মাদরাসা ভূমিকা রাখে তা বুঝতে এবং জানতে হলে সমাজ, আদর্শ সমাজ, তার উপাদান এবং সুশিক্ষা নিয়ে বিশ্লেষণ করতে হবে। তাহলেই বুঝে আসবে আদর্শ সমাজ গঠনে কওমী মাদরাসার অবদান কী। বক্ষমান প্রবন্ধে বিষয়গুলো সংক্ষেপে বিবৃত হল।
# সমাজ কাকে বলে
বহুলোক যখন কিছু উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে সংঘবদ্ধভাবে বসবাস করে তখন তাকে সমাজ বলা হয়। সমাজ বিজ্ঞানী জিসবার্ট এর মতে, ‘সমাজ হলো সামাজিক সম্পর্কের জটিল জাল, যে সম্পর্কের দ্বারা প্রত্যেক মানুষ তার সঙ্গীদের সাথে সম্পর্কে যুক্ত।’ এ ছাড়া ডেভিড পোপেন, ডুর্খেইম ও কোভালোভস্কীর মত আধুনিক সমাজ বিজ্ঞানীরাও সমাজের কাছাকাছি সংজ্ঞা দিয়েছেন। তবে স্বাভাবিকভাবে সংঘবদ্ধ জনসমষ্টি এবং পরষ্পরের ভাবের আদান-প্রদানের মাধ্যমে একটি সমাজ গঠন করা সম্ভব। কিন্তু একটি আদর্শ সমাজ গঠন সম্ভব নয়। কেননা, এক্ষেত্রে শুধু সংঘবদ্ধ জনসমষ্টিই যথেষ্ট নয়। বরং আরো কিছু মৌলিক উপাদান জরুরী। যথা-
এক.
একটি সামগ্রিক ও সার্বজনীন আদর্শ চেতনা ও বিশ্বাস।
দুই.
উক্ত চেতনা বিশ্বাস ও আদর্শের ভিত্তিতে ব্যক্তি গঠন এবং ঐক্যবদ্ধ জনসমষ্টি সংগঠিতকরণ। তিন. ভবিষ্যতে এই ধারা অব্যাহত রাখতে উপযোগী নেতৃত্ব গঠন করা। উপরোক্ত বিষয়গুলোর আলোকে যদি একটি সমাজ বা সামাজিক ব্যবস্থাকে গড়ে তোলা যায় তাহলেই কেবল তা আদর্শ সমাজ হিসেবে বিবেচিত হবে। সাধারণভাবে সমাজ গঠন খুব সহজ। কিন্তু আদর্শভিত্তিক সমাজ গঠন একটি পরিকল্পিত ও সুগঠিত কর্মপদ্ধতির উপর নির্ভরশীল।
আদর্শ সমাজ গঠনসমাজের প্রধান উপাদান ব্যক্তি। তাই আদর্শ সমাজ গঠনে ব্যক্তিগঠনই সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ কাজ। কোন আদর্শ বা চেতনা যত সুন্দরই হোক, যদি সেই আদর্শ অনুযায়ী ব্যক্তিগঠন না করা হয় তাহলে আদর্শ সমাজ গঠনের স্বপ্ন একসময় ধুলোমলিন হয়ে যাবে। সেই সাথে তার বাস্তবায়নও হয়ে পড়বে অসম্ভব এবং সুদূরপরাহত বিষয়। আদর্শ সমাজ গঠন করতে হলে এ ব্যাপারে যার অভিজ্ঞতা রয়েছে, সকলের সামনে যিনি এর মডেল উপস্থাপন করেছেন- প্রথমে তার শরণাপন্ন হতে হবে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পুরো পৃথিবীর সামনে শ্রেষ্ঠ আদর্শ সমাজের মডেল উপস্থাপন করেছেন। তাই আমরা যদি রাসূলের সীরাতকে সামনে রেখে তার সমাজ গঠন প্রক্রিয়া ও পদ্ধতির দিকে তাকাই তাহলে দেখতে পাব যে, তিনি ব্যক্তিগঠনের ক্ষেত্রে কয়েকটি মৌলিক নীতি ও কর্মপদ্ধতি গ্রহণ করেছেন। যার আলোকে গড়ে উঠেছে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিত্ব। নীতি ও কর্মপদ্ধতিগুলো নিম্নরূপ-
এক.
তাওহীদ তথা একত্ববাদের বাণী ব্যক্তির হৃদয়ে প্রতিষ্ঠা করা। যেন শত প্রভুর গোলামির জিঞ্জির তথা শিরক থেকে মুক্ত হয়ে সে এক আল্লাহর দাসত্বে বিশ্বাসী হয়ে উঠে। তাওহীদের সঠিক চেতনা ও বিশ্বাস মানুষকে আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো কাছে মাথা নত না করতে শিক্ষা দেয়। তাওহীদ আদর্শ ব্যক্তিত্ব গড়তে সহায়তা করে। সর্বোপরী সমাজের একতা ও ভ্রাতৃত্ববোধের মূল প্রেরণা ও ভিত্তি হিসেবে কাজ করে তাওহীদ বা এক আল্লাহর উপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস।
দুই.
রিসালাত তথা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল্লাহর বান্দা ও রাসূল। তিনি সর্বশেষ নবী। তাওহীদের বাণীর পাশাপাশি তার রিসালাতের মর্মও ব্যক্তির হৃদয়ে প্রতিষ্ঠিত করা। অর্থাৎ আমার সবকিছু আল্লাহর জন্য নিবেদিত। তবে তা হবে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পথ ও পাথেয় অনুসরণ ও অনুকরণের মাধ্যমে। এতে আমার প্রবৃত্তির কোন প্রভুত্ব থাকবে না। থাকবে না কোন কায়েমী স্বার্থবাদীদেরও কর্তৃত্ব।
তিন.
আখেরাতের বিশ্বাসের সরল পাঠ। অর্থাৎ, প্রতিটি মানুষের মৃত্যু পরবর্তী আরেকটি জীবন রয়েছে। পরকালীন জীবন। যেখানে তার ভাল-মন্দ কাজের প্রতিদান দেয়া হবে। জবাবদিহি করতে হবে প্রত্যেক কৃতকর্মের। সেখানে আছে অনিন্দ্য সুখের জান্নাত। আছে দুঃখ ও কষ্টে ভরা জাহান্নাম। পার্থিব জীবনে আমার কৃতকর্ম ভাল হলে আমলনামা দেয়া হবে ডান হাতে। পুরস্কার হিসেবে আবাসস্থল হবে জান্নাত। কর্মফল ভাল না হলে আমলনামা দেয়া হবে বাম হাতে। শাস্তি হিসেবে আমার বাসস্থান হবে জাহান্নাম। সুতরাং এই জীবনেই আমাকে সতর্ক ও সচেতন হয়ে জীবন-যাপন করতে হবে। পরকালের প্রয়োজনীয় পাথেয় এখান থেকেই সংগ্রহ করে নিতে হবে। ব্যক্তিগঠনের ক্ষেত্রে এমন বোধ ও বিশ্বাস ব্যক্তির মাঝে প্রতিষ্ঠিত করা ছিল ব্যক্তিগঠনের ক্ষেত্রে রাসূলের অন্যতম নীতি।
চার.
চারিত্রিক নৈতিকতার প্রশিক্ষণ প্রদান। ব্যক্তিগঠনের ক্ষেত্রে নৈতিকতা শিক্ষাদানের বিকল্প নেই। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সাহাবায়ে কেরামকে হাতে-কলমে নৈতিক চরিত্র অর্জনের প্রশিক্ষণ দান করেছেন। নীতিহীন কাজ আর নৈতিকতাহীন মানুষের কোন মূল্য নেই। কোন ব্যক্তি জ্ঞানের সাগর বা পন্ডিত হতে পারেন, কিন্তু তিনি যদি নৈতিক চরিত্রের অধিকারী না হন, তাহলে তিনি সমাজে একজন ভালো মানুষ হিসেবে পরিচিতি লাভ করতে পারবেন না। তাই নৈতিকতার বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
চারিত্রিক নৈতিকতার দুটি দিক রয়েছে।
এক.
ইতিবাচক দিক বা অর্জনীয় গুণসমূহ। যথা- তাকওয়া ও খোদাভীতি, তাওয়াক্কুল ও আল্লাহ ভরসা, বিনয় ও নম্রতা, স্নেহ ও মায়া, দয়া ও সহমর্মিতা, সবর ও শোকর, ক্ষমা ও উদারতা, অল্পেতুষ্টি ও দানশীলতা, ইহসান ও লজ্জাশীলতা, সততা ও সত্যবাদিতা, আমানতরক্ষা ও ন্যায়পরায়ণতা এবং ত্যাগ ও কুরবানী ইত্যাদি।
দুই.
নেতিবাচক দিক বা বর্জনীয় গুণসমূহ। যথা- অহংকার ও আত্মগর্ব, ক্রোধ ও লৌকিকতা, লোভ ও লালসা, হিংসা ও বিদ্বেষ, গীবত ও পরনিন্দা, চোগলখুরি ও পরশ্রীকাতরতা, মিথ্যা ও অপবাদ, খেয়ানত ও মন্দ ধারণা, অশ্লীলতা ও কামাসক্তি, কৃপণতা ও জুলুম এবং কোন মুমিনকে অপমান করা ইত্যাদি।চারিত্রিক নৈতিকতার এই অর্জনীয় ও বর্জনীয় গুণগুলোর মাঝে সমন্বয় ঘটানো ছাড়া একজন মানুষ নৈতিক চরিত্রের শীর্ষচূড়ায় পৌঁছতে পারবে না। গঠিত হবে না আদর্শ ব্যক্তিসত্ত্বাও। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নবুওয়াতের সুদীর্ঘ ২৩ বছর সাহাবায়ে কেরামকে নৈতিকতার প্রশিক্ষণের মাধ্যমে আদর্শ ব্যক্তিরূপে গড়ে তুলেছেন। তিনি বলেছেন, ‘আমি উন্নত চরিত্রের পূর্ণতা বিধানের জন্য প্রেরিত হয়েছি।’ উপরোক্ত চারটি নীতি বা কর্মপদ্ধতির মাধ্যমে আদর্শ ব্যক্তিগঠন করা সম্ভব- একথা নির্দ্বিধায় বলা যায়। যেমনটি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দেখিয়েছেন। তার পথকে অনুসরণ করে পরবর্তীতে সাহাবায়েকেরাম, তাবেয়ীন, তাবে তাবেয়ীন ও সালাফে সালেহীনগণ ব্যক্তিত্ব গঠন করেছেন। পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় কাঠামোতে ব্যক্তিই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। কেননা কয়েকজন ব্যক্তি মিলে গঠিত হয় পরিবার। কয়েকটি পরিবার মিলে গঠিত হয় সমাজ। আর বহু সমাজের সামষ্টিক রূপ হলো-রাষ্ট্র। তাই আদর্শ সমাজ গঠনে ব্যক্তির বিকাশ ও গঠনের গুরুত্ব অপরিসীম।
# কওমী মাদরাসার প্রয়োজনীয়তা কেন
কওমী মাদরাসা ঐশী চেতনা ও বিশ্বাসের বাতিঘর। হেরাগুহার যে নূর আসহাবে সুফফার মাঝে বিতরণ হয়েছিল কাল পরিক্রমায় সেই নূরের ধারক ও বাহক হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে কওমী মাদরাসা। এখানে রাত-দিন তাওহীদ ও রিসালাতের সুমহান বাণী উচ্চারিত হয়। সকাল-সন্ধ্যা আখেরাতের সরল ও শীলিত পাঠদান করা হয়। এক এক করে হাতে-কলমে প্রশিক্ষণ দেয়া হয় চারিত্রিক নৈতিকতার অর্জনীয় ও বর্জনীয় গুণগুলোর। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন সমাজ পরিশুদ্ধ করার পরিকল্পনা বাস্তবায়ন শুরু করেছেন, তখন কিন্তু আরবের মানুষগুলো ছিল পৃথিবীর সবচেয়ে অজ্ঞ, অনৈতিক, অশালীন ও অশুভ চরিত্রের মানুষ। সর্বগ্রাসী অন্ধকার যুগের মানুষ। আদর্শ ব্যক্তিগঠনের যে চারটি মৌলিক নীতি ও কর্মপদ্ধতি উল্লেখ করা হলো সেগুলো তাদের হৃদয় মনন ও ব্যক্তি জীবনে প্রতিষ্ঠা করলেন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। এতে করে তাদের জীবনের গতিপথ বদলে গেল। হৃদয়ের বিশুষ্ক কাননে ফুলেল হাওয়া বইতে লাগল। যে মানুষগুলো ছিল পৃথিবীর সবচেয়ে কুখ্যাত ও দুর্ধর্ষ চরিত্রধারী, যাদের কথা শুনলে দূরাগত মানুষের হৃদয় কেঁপে উঠত সেই মানুষগুলো হয়ে উঠলেন পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ চরিত্র ও অনুপম আদশের অধিকারী। তাদের ব্যক্তি জীবন হয়ে উঠল আদর্শ। পারিবারিক জীবন হয়ে গেল অনুসরণীয়। সামাজিক জীবন হল অনুকরণীয়।
চারিত্রিক নৈতিকতার পাশাপাশি সামাজিক শিষ্টাচারও শিক্ষা দিয়েছেন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। প্রতিবেশীর অধিকার সম্পর্কে অত্যধিক গুরুত্বারোপ করেছেন। এছাড়া অন্নহীনকে অন্ন দান, বস্ত্রহীনকে বস্ত্র প্রদান, আশ্রয়হীনকে আশ্রয় দান, অসুস্থ ব্যক্তিকে সেবা প্রদান, বিপদগ্রস্থের সাহায্যে এগিয়ে আসা, এতীম ও অসহায়ের লালন-পালনের ভার বহন করা, ধর্ম-বর্ণ-গোত্র নির্বিশেষে সকল মানুষকে ভালবাসা, পরষ্পরে ভাই-ভাই হয়ে থাকা এবং পশু-পাখির প্রতি সদয় হতে সকলকে উদ্বুদ্ধ করেছেন। যখন সাহাবায়ে কেরামের ব্যক্তিজীবনে এই গুণগুলো প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তখনই তাদের মাধ্যমে সমাজ বদলাতে শুরু করেছে। একসময় তারা সকলের জন্য মডেল হিসেবে উপস্থাপিত হয়েছেন।
# আদর্শ ব্যক্তিগঠনের বিশ্বস্ত কেন্দ্র
ব্যক্তিগঠনের যে চারটি মৌলিক কর্মপন্থাকে উপজীব্য করে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদেরকে এমন উচ্চ মার্গে নিয়ে এলেন- সেগুলো কওমী মাদরাসার ভূষণ। এই বিষয়গুলো কওমী মাদরাসায় অত্যন্ত সুচারুভাবে শিক্ষা দেয়া হয়। পরিকল্পিত ও পরিশীলিত অনুশীলনের মাধ্যমে তাওহীদ ও রিসালাতের সুগভীর ও সুদৃঢ় ভিত গড়ে দেয়া হয়। মিতব্যয়ী জীবনে ফুটে উঠে আখেরাত ভাবনা। নিয়মিত দেয়া হয় চারিত্রিক নৈতিকতার বিশুদ্ধ পাঠ। ফলে প্রতি বছর এখান থেকে ব্যক্তিত্ব গঠন করে সমাজের বুকে ছড়িয়ে পড়ে হাজার হাজার আলেম।তাদের মাধ্যমে বদলে যেতে থাকে সমাজের চিত্র। আলেমদের সান্নিধ্য ও সংস্পর্শে তাওহীদ, রিসালাত ও নৈতিক চরিত্রের দীক্ষা পেয়ে পরিবর্তিত জীবনে উদ্বুদ্ব হয়ে উঠে সমাজের মানুষ। বর্তমান সমাজের সাধারণ মানুষ এই দীক্ষা পাওয়ার সবচেয়ে বড় মাধ্যম হলো দাওয়াতে তাবলীগের মেহনত। এই মেহনতের মাধ্যমে লক্ষ লক্ষ মানুষ হিদায়াতের পথ পাচ্ছে। কাফের থেকে মুসলমান হচ্ছে। বেনামাজি থেকে নামাজিতে পরিণত হচ্ছে। নিত্যকার শেভ করা ব্যক্তির গালে সুন্নতি দাঁড়ি শোভা পাচ্ছে। এক সময় যাদের হাতে অস্ত্র থাকত তাদের হাতে উঠে আসছে তসবীর ছড়া ও মিসওয়াক। দীনি আলোচনা বা ধর্মীয় বিধি-বিধান শুনলে যাদের গা শিরশির করত, তারাই ধর্মের জন্য আত্মোৎসর্গী হয়ে উঠছে। জীবনকে আমূল পরিবর্তনকারী এই মেহনতের প্রবক্তা হযরত মাওলানা ইলিয়াস কান্ধলভী রহ.। তিনি ভারত উপমহাদেশে প্রকৃত দীন প্রচারের কেন্দ্র, কওমী মাদরাসার সূতিকাগার দারুল উলুম দেওবন্দের সন্তান। এর পাশাপাশি হক্কানী পীর-মাশায়েখগণও আত্মশুদ্ধির মাধ্যমে সমাজের বহু বিভ্রান্ত মানুষকে আলোর পথে নিয়ে আসছেন। তাদের প্রায় সকলেই কওমী মাদরাসার সন্তান। আল্লাহর দরবারে মাকবুল এই মেহনতগুলোর মাধ্যমে একেকটি ব্যক্তিজীবন বদলে যাওয়ার মধ্য দিয়ে বদলাতে থাকে সমাজ। ‘দূষিত’ তকমাধারী সমাজ এক পর্যায়ে হয়ে উঠে আদর্শের প্রতীক হিসেবে। যে সমাজ বা এলাকায় কোন কওমী মাদরাসা আছে এবং দাওয়াতের এই মেহনতগুলো চালু রয়েছে সেই সমাজ বা এলাকা হতে পারে এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ।
# সমাজ ও রাষ্ট্র বিনির্মাণে নেপথ্যের কারিগর
আদর্শ সমাজ ও রাষ্ট্র গঠনের নেপথ্য শক্তি কওমী মাদরাসা। প্রসঙ্গত, কওমী মাদরাসা কোন বিজ্ঞানী জন্ম দেয়নি। এখান থেকে পড়াশোনা করে কেউ ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার বা সচিব হয়নি। কাউকে দেখা যায়নি বিচারপতি বা মন্ত্রীত্বের চেয়ারেও- এমন কোন অভিযোগ বা মন্তব্য কেউ করলে তা মেনে নিয়েই বুঝতে হবে কওমী মাদরাসা শিক্ষার উদ্দেশ্য ও শিক্ষাব্যবস্থা সম্পর্কে তার পরিষ্কার ধারণা নেই। কওমী মাদরাসার শিক্ষার উদ্দেশ্য হলো- নীতি ও নৈতিকতাবোধসম্পন্ন আদর্শ মানুষ তৈরি করা। কোন প্রতিষ্ঠানে চাকুরী করবার মত যোগ্যতাসম্পন্ন করে তৈরি করা নয়।
কওমী মাদরাসায় আদর্শ মানুষ তৈরির কর্মপন্থাগুলোকে ধারণ করে মৌলিক চারটি বিষয় শিক্ষা দেয়া হয়।
১. বিশুদ্ধভাবে কুরআন পাঠ।
২. আত্মশুদ্ধি অর্জন।
৩. কুরআনের সহীহ ব্যাখা প্রদান।
৪. হিকমাত তথা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সুন্নাতের বাস্তব অনুশীলন।
এই বিষয়গুলো পরিপূর্ণভাবে আত্মস্থ ও বাস্তব জীবনে প্রয়োগ করতে যে সকল বিষয়ে দক্ষতা প্রয়োজন সেগুলোও যতেœর সাথে পাঠদান করা হয়। ফলে এখান থেকে প্রত্যেকেই একেকজন আদর্শ মানুষ ও সুনাগরিক হয়ে সমাজের বুকে ফিরে যায়। এটা অনস্বীকার্য যে, সমাজে বৃত্তিমূলক দক্ষতার প্রয়োজন রয়েছে। যাকে আমরা ‘কিছু একটা করে খাবার ব্যবস্থা’ হিসেবে গ্রহণ করে থাকি। কওমী মাদরাসা সামাজিক মানুষের এই চাহিদাকে মোটেও অস্বীকার করে না। কিন্তু তা কোনভাবেই শিক্ষার উদ্দেশ্য হতে পারে না। অথচ এটাই হলো পুঁজিবাদী শিক্ষাব্যবস্থার মূল উদ্দেশ্য। মাদরাসার কাজ এই নয় যে, এখান থেকে শিক্ষার নামে অফিস, আদালত, হাসপাতাল ও কলকারখানায় শ্রমিক সরবরাহের কারখানা চালানো। বরং আল্লাহ তাআলাকে সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যে সর্বোচ্চ নৈতিক গুণাবলিসম্পন্ন আদর্শ মানুষ তৈরি করাই হলো কওমী মাদরাসার কাজ, লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য।
হ্যাঁ, এই শিক্ষা ব্যবস্থায় পড়াশুনা করে কেউ হয়ত ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, সচিব বা বিজ্ঞানী হয় না। কাউকে দেখা যায় না হয়ত মন্ত্রীত্বের চেয়ারেও। কিন্তু চেয়ারধারী এই মানুষগুলো এবং অন্যান্য পদধারী ব্যক্তিবর্গ যেন ন্যায়নিষ্ঠা, সততা ও ইনসাফের সাথে সমাজ ও দেশের স্বার্থে কাজ করেন সেদিকে গুরুত্বারোপ করেন ওলামায়েকেরাম। নিজ নিজ অবস্থান থেকে কাজ করে তারা যেন কারো প্রতি জুলুম না করেন, দুর্নীতি, সুদ-ঘুষ ও দেশবিরোধী কাজে লিপ্ত না হন সেজন্য তাদেরকে সতর্ক করেন। বারবার তাদেরকে স্মরণ করিয়ে দেন আল্লাহর কথা। শরীয়তের বিধি-বিধানের কথা। হারাম-হালালের কথা। রাসূলের আনুগত্য ও নববী আদর্শের কথা। বিভিন্ন ওয়াজ মাহফিল, সভা-সেমিনার, জুমুআর দিনের বয়ান ও ধর্মীয় অনুষ্ঠানসমূহে চলে এই উপদেশ ও সতর্কবার্তার ধারাবাহিকতা। ধীরে ধীরে তাদের মধ্যে পরিবর্তন ঘটতে থাকে। একসময় এই পদধারী ব্যক্তিবর্গ আদর্শ সমাজ ও দেশ গঠনে সহযোগীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। তাদের নৈতিক চরিত্র পরিশুদ্ধতার ক্ষেত্রে নেপথ্যের কারিগর হয়ে থাকেন এই কওমী মাদরাসার ওলামায়ে কেরাম।
একজন ডাক্তারকে যেমন ইঞ্জিনিয়ারিং বিদ্যায় পারদর্শী না হওয়ার কারণে ভর্ৎসনা করা হয় না, বিচারককে যেমন বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের অভাবে তিরষ্কার করা যায় না, সচিবকে যেমন শরীয়তের বিধি-বিধান সম্পর্কে অজ্ঞতার কারণে নিন্দা করা হয় না, তেমনি একজন কওমী মাদরাসা পড়ুয়া আলেমকে সরকারী বড় বড় পদ, ডাক্তারি বা ইঞ্জিনিয়ারিং পেশায় অনুপস্থিত দেখে কোন দোষারোপ বা অভিযুক্ত করা যাবে না। কোন ব্যক্তি সচিব হয়েও যেমন লেখক হতে পারেন, ডাক্তার হয়েও আইন বিষয়ে অভিজ্ঞ হতে পারেন; তেমনি কেউ আলেম হয়েও জেনারেল কোন বিষয়ে দক্ষতার পরিচয় দিতে পারেন। অতিরিক্ত যোগ্যতার বলে সরকারী চাকুরেও হতে পারেন। তাই বলে এটা তাদের কারো মূলধারা বা মূলকাজ নয়। এর মাধ্যমে আপন মৌলিকত্বের বিকাশ ঘটবে না। সুতরাং এই বিষয়গুলো মাথায় রেখে প্রত্যেককে তার কাজের নিক্তিতে মাপতে হবে। কথা বলতে হবে তার কর্মের পরিমন্ডলকে বিবেচনায় রেখে। তাহলে সকল বিভ্রান্তি ও দোষারোপ করা থেকে বেঁচে থাকা যাবে।
# সমাজের সবচেয়ে নিরাপদ ও আস্থার জায়গা
কওমী মাদরাসার প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম। এখানে সার্বজনীন আদর্শ, চেতনা ও বিশ্বাসের ভিত্তিতে ব্যক্তি গঠন করা হয়। নৈতিকতা ও সামাজিক শিষ্টাচারের পরিশীলিত পাঠ পেয়ে সকলেই সুনাগরিকে পরিণত হয়। গড়ে উঠে সমাজের আদর্শিক নেতৃত্বদানের যোগ্য উত্তরসূরী হিসেবে। তাদের নেতৃত্বেই ধীরে ধীরে ধর্মীয় বলয়ে গঠিত হয় আদর্শ সমাজ ও সামাজিক ব্যবস্থা। এর অন্যতম কারণ, সমাজ ও সমাজের মানুষের সাথে কওমী মাদরাসাগুলো ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। সরকারী অনুদান নয়, বরং জনগণের স্বত:স্ফূর্ত সহযোগিতায় তা চালিত হয়। সমাজের সবচেয়ে নিরাপদ ও আস্থার জায়গা এটি। এখান থেকে গ্রাজুয়েট করা মানুষগুলো চারিত্রিক নৈতিকতার শীর্ষে অবস্থান করেন। জাগতিক জীবনে হতাশ হয়ে তারা মাদক ও সন্ত্রাসের মত পথ বেছে নেন না। অনাহার-অর্ধাহারেও তারা নিরাশ হন না। তাদের দু’চোখে খেলা করে আখেরাতের অনিন্দময় জীবনের স্বপ্ন। সংস্কৃতির নামে অপসংস্কৃতির গড্ডলিকা প্রবাহে নিজেদের গা ভাসিয়ে দেন না। আকাশ মিডিয়ার সীমাহীন নোংরামি, অশ্লীলতা ও বেহায়াপনা থেকে নিরাপদ দূরত্বে অবস্থান করেন তারা। কোন অনুষ্ঠান বা বিনোদন কেন্দ্রে একটু সুযোগ পেলেই নারীদের উপর হায়েনার মত হামলে পড়েন না। কুরআন ও হাদীসে বর্ণিত নারী অধিকার ও মানবাধিকারের বিষয়ে জীবনভর সচেতন থাকেন। নারী স্বাধীনতার নামে নারীভোগের অবাধ অধিকার দানে তারা বিশ্বাসী নন। যে কোন প্রকারের হোক, নারী নির্যাতন ও যৌন হয়রানির কথা কেউ কল্পনাও করেন না। জঙ্গীবাদের কালোছায়া ও ছাত্ররাজনীতির দূষিত পরিবেশ কওমী মাদরাসায় নেই।
কওমী মাদরাসার দেড়শ বছরের ইতিহাস সাক্ষী, এখানে পড়তে এসে কারো সাথে কোন বিবাদে জড়িয়ে কিংবা প্রতিপক্ষের প্রতিহিংসার বলি হয়ে কাউকে লাশ হয়ে বাড়ি ফিরতে হয় নি। কখনো বেজে উঠেনি অস্ত্রের ঝনঝনানি। দুর্নীতি, টেন্ডারবাজি, শেয়ার কেলেংকারীসহ সব ধরনের চারিত্রিক কলংক থেকে তারা মুক্ত হয়ে সহজ-সরল জীবন যাপন করেন। সমাজের মানুষের কাছে আস্থার প্রতীকের নাম ‘কওমী মাদরাসা’। নানা মত ও পথের হয়েও কওমী মাদরাসার উপর কোন হস্তক্ষেপ বা বাধা এলে এলাকাবাসী নিঃসঙ্কোচে এগিয়ে আসেন। যে কোন মূল্যে তা প্রতিহত করেন। টিকিয়ে রাখতে চেষ্টা করেন মাদরাসার স্বকীয়তা ও স্বায়ত্বশাসিত চেতনা। নির্ভয়ে ও নির্ভাবনায় সমাজের মানুষ এখানে তাদের সন্তানদেরকে ভর্তি করান। স্বপ্ন দেখেন, একদিন তারা আদর্শবান মানুষ হয়ে আদর্শ সমাজ গঠন করবে। উন্নয়নশীল দেশ ও আদর্শ জাতি গঠনে অংশীদার হবে। পবিত্র চেতনায় লালিত হবে তাদের জীবন।
# কওমী মাদরাসার বিকল্প নেই
সমাজের বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা কওমী মাদরাসাগুলো থেকে প্রতিদিন প্রতিক্ষণে ছড়িয়ে পড়ছে ঐশী নূরের পবিত্র ঝর্ণাধারা। এতে অবগাহন করে দিন-রাত উপকৃত হচ্ছে সমাজের প্রতিটি মানুষ। উপকৃত হওয়ার এই ধারাবাহিকতা চলছে জীবনের প্রতিটি ধাপে। জন্মের পূর্ব থেকে মৃত্যুর পর পর্যন্ত এই ধারাবাহিকতা চলে। গর্ভকালীন নানা সমস্যার শরয়ী সমাধান, জন্মের পর সুন্দর নাম রাখা, আকীকা করা ও বিবাহ-শাদীসহ জীবনের গুরুত্বপূর্ণ আয়োজনে কওমী মাদরাসার আলেমের প্রয়োজন পড়ে। মুমূর্ষু ব্যক্তির জন্য দুআ, জানাজার নামাজ, কাফন-দাফন ও ঈসালে সাওয়াবের কথা আলেম ব্যতীত কল্পনাও করা যায় না। সহীহ আকীদা, সব ধরনের ইবাদাত, মুআমালাত, মুআশারাতসহ যাপিত জীবনে ঘটে যাওয়া নানা সমস্যার শরয়ী সমাধানের লক্ষ্যে মানুষ ছুটে আসে কওমী মাদরাসায়। এটাকে তাদের সর্বশেষ ভরসাস্থল মনে করে। আলেমদের সান্নিধ্য ও দীনের সঠিক পথে চালিত হওয়ার মাধ্যমে বদলাতে থাকে সমাজের মানুষ। ভ্রাতৃত্বের ছায়ায় একসময় গড়ে উঠে আদর্শ সমাজ। যার নেপথ্য শক্তি এই কওমী মাদরাসা।
তাই কওমী মাদরাসা ভয়ংকর ও বিপদজনক নয়, বরং আলো, সাম্য ও সৌন্দর্যের পতাকাবাহী। জঙ্গী প্রজনন কেন্দ্র নয়, বরং আদর্শ মানুষ প্রজনন কেন্দ্র। সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রতি কওমী মাদরাসার এত বিপুল পরিমাণ অবদান থাকা সত্তে¡ও যারা এর সমালোচনা ও কটূক্তি করে তারা জ্ঞানপাপী; তারা ইহুদিদের এ দেশীয় চর ও তাদের পেইড এজেন্ট। তাদের চেহারাগুলো সকলের সামনে উন্মোচন করে দিতে হবে।
আমাদের সমাজগুলো বহুদিক থেকে কওমী মাদরাসার কাছে ঋণী। এটা যেমন ধর্মীয় জীবনের ক্ষেত্রে, তেমনি ব্যক্তিজীবন, পারিবারিক জীবন, সামাজিক জীবন এবং রাষ্ট্রীয় জীবনের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। তাই কওমী মাদরাসার প্রতি প্রতিটি মানুষের বিনম্র কৃতজ্ঞ থাকা উচিত। প্রকৃত কৃতজ্ঞতার বহিঃপ্রকাশ তখনই ঘটবে যখন আমরা মিডিয়ার এই যুগে মিথ্যা প্রোপাগান্ডার বিপরীত স্রোতে আদর্শ সমাজ গঠনে কওমী মাদরাসার চিরায়ত প্রয়োজনীয়তা উপলব্দি করব। এর প্রচার-প্রসার ও সাহায্য-সহযোগিতায় এগিয়ে আসব। যে কোন বিপদ-আপদ, দুর্যোগ ও সংকটকালীন সময়ে ইস্পাত কঠিন মনোবল নিয়ে কওমী মাদরাসার পাশে দাঁড়াব। তাহলেই আমাদের আচরণে ফুটে উঠবে কওমী মাদরাসার প্রতি প্রকৃত কৃতজ্ঞ ও কল্যাণকামী মানসধারীর পরিচয়। সেই সাথে বিধৌত বিশ্বাস ও আদর্শের পবিত্র ছোঁয়ায় আলোকিত হবে সকলের হৃদয়।
সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই মার্চ, ২০১৬ সকাল ৮:৩০