খোদাকে কতো ভাবে যে ডাকে মানুষ। এক ভদ্রলোকের ছোট্ট মেয়ে তার কাছে জানতে চাইল, বাবা খোদা কী গোসল করেন? ভদ্রলোক নাউযুবিল্লাহ বলে জানতে চাইলেন-মা এমন প্রশ্ন কেন করলে? মেয়ে খুব স্বাভাবিকভাবে বললো, প্রতিদিন সকালে মা একটু সময় নিয়ে গোসল করলে তুমি কেন বলো ‘ও খোদা তোমার গোসল এখনও শেষ হয়নি?’
খোদাকে ডাকা কখনও শেষ হবে না এবং ডাকার উপায়ও ভিন্ন হবে। বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল বড় আফসোস নিয়ে খোদাকে ডেকেছিলেন। জানতে চেয়েছিলেন-
‘খোদার ঘরেতে কে কপাট লাগায় কে দেয় সেখানে তালা?
সব দ্বার খোলা রবে, চালা হাতুড়ি শাবল চালা।
কাজী নজরুল কি এই প্রশ্নের উত্তর জানতে পেরেছিলেন? সব প্রশ্নের উত্তর কি পাওয়া যায়? নাকি কিছু মিলিয়ন ডলার প্রশ্ন থাকে যা নিয়ে বছরের পর বছর বিতর্ক চলে কিন্তু কোনও উত্তর বা সমাধান মেলে না। এদেশের মিলিয়ন ডলার কোশ্চেন নিয়ে আগে কয়েকবার লিখেছি, আবারও প্রসঙ্গটা সামনে চলে এসেছে। বঙ্গবন্ধু যদি ২৫ মার্চ ১৯৭১ এ গ্রেফতারবরণ না করতেন তাহলে কী হতো? ১৬ ডিসেম্বর আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে আতাউল গনি ওসমানী উপস্থিত ছিলেন না অথবা উপস্থিত হতে পারেননি কেন? জীবদ্দশায় জিয়াউর রহমান নিজেকে স্বাধীনতার ঘোষক দাবি করেননি কেন? ঠিক তেমনি খোদা ও মানুষের কাছে জানতে ইচ্ছে করে পিতার অপরাধে (যদি তিনি আসলেই অপরাধ করে থাকেন!) পুত্রকেও অপরাধী বলা যাবে কিনা।
পিয়াস করিম মারা যাবার পর জানা গেল তিনি অতি বড় রাজাকার ছিলেন। জীবদ্দশায় তাকে কেউ রাজাকার বলেছে এমন শুনিনি। তবে কিছু বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলে টক শোতে অংশ নিতে দেখেছি। এই সব টকশোতে তিনি সরকারের সমালোচনায় মুখর থাকতেন। ব্যক্তিগতভাবে আমি তাকে যে কয়বার টকশোতে দেখেছি তাতে তিনি ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের তীব্র সমালোচনা করেছিলেন। গনজাগরণ মঞ্চের (তখন তিন টুকরা কিংবা ব্রাকেটবন্দি হয় নি) বিরোধিতা করতেন এই বলে- তারা যে রাস্তা আটকে ফাঁসি চাচ্ছেন স্বাধীনতাবিরোধীদের, সেটা তো আদালতের কাজ। আদালতকে কোনও না কোনওভাবে প্রভাবিত করা ঠিক না। মানবতাবিরোধীদের বিচার নিয়ে এই বলে প্রশ্ন তুলতেন যে, তড়িঘড়ি করে বিচার করা হচ্ছে। বিচারটা স্বচ্ছ কিনা সেটা নিয়েও প্রশ্ন তুলতেন। আর হেফাজতের আন্দোলনের দিন রাতে বহু মানুষকে হত্যা করা হয়েছে বলে দুই তিনবার বলেছিলেন। যদিও এই জায়গা থেকে তিনি পরবর্তীতে সরে এসেছেন বলেই আমার মনে হয়েছে। এই হচ্ছে টকশোর পিয়াস করিম যা তাকে এক ধরনের জনপ্রিয়তা এনে দিয়েছিল। সব বুদ্ধিজীবী কিংবা টকশোজীবী যে সরকারি দলের হতে হবে এমন কোনও কথা নেই। সব পথ আর মতের সহাবস্থান নাকি গণতন্ত্র?
এবার তার বাবার প্রসঙ্গে আসা যাক। ভদ্রলোকের নাম ছিল এম এ করিম এবং পেশায় তিনি উকিল ছিলেন। ভদ্রলোক শান্তি কমিটির সদস্য ছিলেন এবং স্বাধীনতা ও মানবতাবিরোধী নিকৃষ্টতম এক কাজ করেছিলেন। যে মহান মানুষটি বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার প্রয়াসে বিষয়টি সংসদে তুলেছিলেন তার নাম ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত। ৮৬ বছর বয়স্ক এই মহান মানুষটিকে উকিল এম এ করিম তুলে দিয়েছিলেন পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে। কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে পাকিস্তানি সেনারা প্রথমে দত্ত সাহেবের দুই পা ভেঙ্গে দেয়। এরপর দুই হাত। নারকীয় এক যন্ত্রণা ভোগ করতে করতে মহান ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত মৃত্যুর কোলে ঢলে পরেন। বাম রাজনীতির সঙ্গে জড়িত এমন কিছু মানুষ আমাকে জানিয়েছেন স্বাধীনতার পর করিম উকিলের দালাল আইনে বিচার শুরু হয়েছিল, যদিও তারা নিশ্চিত করে আর কিছু জানাতে পারেন নি। তাহলে আপনি কিংবা মানুষই বলুক পিতার অপরাধে পুত্রকে দায়ী করা যাবে কিনা?
এবার পিয়াস করীমের টক শো প্রসঙ্গে আসা যাক। স্বাধীনতা তথা মানবতাবিরোধীদের রক্ষার জন্য সরাসরি তিনি কোনও টকশোতে কোনও কথা বলেছেন কিনা কেউ নির্দিষ্ট করে জানাতে পারেননি। এই বিশ্বায়ন ও মিডিয়া নির্ভরশীলতার যুগে কেউ কোনও অনুষ্ঠানের ফুটেজ কিংবা কোনও টকশোর ভিডিও দেখিয়ে জানাতে পারেননি যে পিয়াস করিম কত বড় রাজাকার ছিলেন।
এদিকে তার লাশ শহীদ মিনারে নেওয়া যায় কী যায় না সেটা নিয়ে বিতর্কের ঢোল বাজানো হচ্ছে। কেউ কেউ তার লাশ শহীদ মিনারে নেওয়ার বিরোধিতা আবার কেউ কেউ লাশ শহীদ মিনারে আনলে সেই উদ্যোগ প্রতিহত করার ঘোষণা দিয়েছেন। ফেসবুকে এটা নিয়ে পক্ষ বিপক্ষে স্ট্যাটাস দেবার ধুম পড়েছে, বেসরকারি টেলিভিশনগুলোও কম যাচ্ছে না। সাধারণত মরে যাবার পর দুটো ঘটনা ঘটে। যিনি মারা গেলেন তার যদি কোনও শেষ ইচ্ছা থাকে সেটার বাস্তবায়ন করা হয়। পরেরটি কোনও সংস্থাকে দিয়ে দেওয়া হয় যারা সাধারণত লাশের সৎকার করে থাকেন। এদেশে তেমন সংস্থা গড়ে ওঠেনি, যদিও আঞ্জুমানে মফিদুল ইসলাম একেবারেই গরিব মানুষের সৎকার করে থাকে।
যত দূর জানা যায়, পিয়াস করিম তার মৃতদেহ শহীদ মিনারে নিয়ে যাওয়া হোক- এমন কোনও ইচ্ছা তার প্রিয়জন বা পরিচিত ঘনিষ্ঠজনদের বলেননি বা তার পরিবারের কাছ থেকেও জানা যায় নি। তাহলে লাশ শহীদ মিনারে নিয়ে যাবার প্রশ্নটি এলো কেন বা কারা এটা সামনে নিয়ে এলো? কোন পক্ষ?
শহীদ মিনার আসলে কী? বাঙালি তথা বাংলা ভাষাভাষীদের চেতনার কেন্দ্রবিন্দু তথা সকল অপরূপ দ্রোহ এবং নির্মোহ সত্যের প্রতীক। এই চেতনার কেন্দ্র কার দখলে থাকে? কে দেয় সেখানে তালা? কে সার্টিফিকেট দেবে কার লাশ আনা যাবে সেখানে আর কারটা আনা যাবে না?
শ্রদ্ধেয় লেখক হুমায়ুন আহমেদ, মুহম্মদ জাফর ইকবাল এবং আহসান হাবীবকে শ্রদ্ধা জানিয়ে বলি তাদের নানা অর্থাৎ আয়েশা ফয়েজের বাবাকে নিয়েও বিতর্ক ছিল এবং আছে। তাই বলে এদের কাউকে দোষারোপ করা উচিত হবে? শ্রদ্ধেয় ভাষা মতিন ১৯৭১ সালে যে দলের সঙ্গে জড়িত ছিলেন সেই দল পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টি (এম-এল) স্বাধীনতার বিপক্ষে ছিল না কোনওক্রমেই। এই দলের অনেকেই প্রত্যক্ষভাবে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন। তবুও এই মহান মানুষটিকে নিয়ে বিতর্ক তোলা হয়েছে। এই দুজন মানুষের (আয়েশা ফয়েজ ও ভাষা মতিন) মৃতদেহ তবুও আনা হয়েছিল শহীদ মিনারে।
অন্যদিকে যার পরিবারের পক্ষ থেকে এমন কোনও অভিলাষই নেই তার মৃতদেহ শহীদ মিনারে নেওয়া হবে কী হবে না সেই বিতর্কে দেশ ভাসিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এখন সবার কাছে আরেকটি মিলিয়ন ডলার কোশ্চেন এই যে, কার মৃতদেহ শহীদ মিনারে নেওয়া হবে আর কারটা নেওয়া হবে না সেটা কে বা কারা নির্ণয় করবেন? এটা নিয়ে সংঘাত তৈরি হলে আমরা কোন পক্ষে যাব?
আর সরকারবিরোধিতা মানেই কী রাজাকারিত্ব? সরকারের কোনও কার্যক্রমের বিরোধিতা করলেই কি তার গায়ে রাজাকারের তকমা লেগে যাবে?
সবশেষে প্রিয় বিতার্কিক, প্রিয় উপস্থাপক আবদুন নুর তুষার- এর কথার উপমা দিয়ে লেখাটা শেষ করি। আবদুন নুর তুষার বলেছেন, “তার (পিয়াস করিমের) সঙ্গে আমি একই অনুষ্ঠানে অংশ নিয়েছি। তার সঙ্গে আমি বহু বিষয়ে একমত হইনি। সুন্দর কথা দিয়ে আমি তার মতের বিরোধিতা করেছি, তার যুক্তি খণ্ডন করতে চেয়েছি। সেটাই বীরত্ব্, বলা যাবে বাঘের বাচ্চারা তেমনই করে। এটাই সর্বস্বাভাবিক। যারা পিয়াস করিমের মৃত্যুর পর তাকে নিয়ে কথা তোলে তারা আসলে নোংরামিই করে। মৃত মানুষকে নিয়ে কোন বিতর্ক কিংবা লড়াইতে যাওয়াটাই কাপুরুষতা!”
বাঙালি বীরের জাতি। তারা বীরবেশে থাকুক সেটাই কামনা করি এবং সে কারণেই আসুন খোদা তাআলাকে ডাকি।
আহসান কবির
লেখক: সাহিত্যিক ও রম্য লেখক।