সাল ২০০৬
চার বন্ধু মিলে সিদ্ধান্ত নিলাম রোজার ঈদে দার্জিলিং যাবো। জীবনে প্রথম দেশের বাইরে যাবো। চরম উত্তেজনা চার জনের মধ্যেই। সবার-ই পাসপোর্ট আছে। এখন শুধু ইন্ডিয়ার ভিসা নিতে হবে। ভিসা নেবার জন্য সকাল ৮টায় পৌছে গেলাম গুলশানের ইন্ডিয়ার অ্যাম্বাসিতে। কিন্তু ইন্ডিয়ার অ্যাম্বাসির সামনে শত শত লোককে বিধ্বস্ত অবস্থায় লাইনে দাড়িয়ে থাকতে দেখে হতবাক হয়ে গেলাম। জানতে পারলাম লাইনে দাড়িয়ে থাকা লোকেদের কেউ আগের দিন বিকালে কেউ বা আগের দিন সকাল থেকে লাইনে দাড়িয়ে আছে। লাইনে প্রায় দুই থেকে তিন'শ জন দাড়িয়ে আছে। তাদের মধ্যে শুধু প্রথম ৭০ থেকে ৮০ জন শুধু ফাইল জমা দিতে পারবে। লাইনে দাড়িয়ে কোন লাভ হবে না দেখে দালাল শ্রেণী কাউকে খুঁজছিলাম, পেয়েও গেলাম একজন কে কিন্তু টাকার পরিমান শুনে দমে গেলাম। পরিকল্পনা করলাম বিকাল থেকে লাইনে দাঁড়াবো। যাতে পরেরদিন সকালে প্রথম ৭০ জনের ভিতর থাকতে পারি।
রোজার দিন তাই সবাই বাসায় চলে গেলাম। পরিকল্পনা করলাম ২ জন বিকালে থেকে রাত ১টা পর্যন্ত বাকী ২জন রাত ১টা থেকে পরদিন সকল পর্যন্ত লাইনে দাঁড়াবো। বিকাল ৪ টা দিয়ে এসে দেখি পরদিনের জন্য লাইন তৈরি হয়ে গেছে সামনে শুধু ১৫ জন। আমরা ১৫ জনের পিছনে দেখে মনে আনন্দে লাইনে দাড়িয়ে গেলাম। লাইনেই ইফতার সেহেরী করলাম।
পরদিন সকাল ৭.৩০ মিনিট সামনে মাত্র ১৫ জন আর আমাদের পিছনে প্রায় ৩০০ জন লোক লাইনে। গর্বে আর আনন্দ আছি। আজ আমাদের ফাইল জমা দিতে ঠেকায় কে ? কিন্তু অল্প সময়ের মধ্যেই দ্রুত অবস্থার পরিবর্তন হতে শুরু করল। এক শিখ ব্যক্তি এসেই এক গাড়ি পুলিশ ডেকে আনল। আর পুলিশকে বলল এখান থেকে সব লোক সরিয়ে দিতে। পুলিশ এসেই লাইনের সব লোককে লাঠি নিয়ে দৌড়ানি দিল। অ্যাম্বাসির ভিতর থেকে ২/৩ জন সিকিউরিটি গার্ড এসে বলল যারা ৫০০ টাকা দিতে রাজি আছেন শুধুই তারাই ফাইল জমা দিতে পারবেন। পুলিশের ভয়ে কেউ কোন কথা বলতে পারল না। নতুন আরেকটি লাইন তৈরি হল গার্ডরা ৫০০ টাকা সহ ফাইল নিয়ে সেই শিখ ব্যক্তি হাতে দিল। উনি ফাইলের উপর একটি সাইন করে দিল। যাদের ফাইলে সাইন আছে শুধু তারাই ভিতর ঢুকতে পারল, ফাইল জমা দেবার জন্য। আর দূর থেকে বিধ্বস্ত বাকীরা এই দূর্নীতি দেখতে থাকলো।
সাল ২০১৪
প্রায় ১০ বছর পর ইন্ডিয়ার ভিসার জন্য এখন আর সারা রাত লাইনে দাড়িয়ে পরদিন পুলিশেরও দৌড়ানি খেতে হয় না। সেই সময় বিশেষ কিছু নির্দিষ্ট সময় ইন্ডিয়ার ভিসা পাওয়া নিয়ে দূর্নীতি হোত। এখন সবকিছুই অনলাইন ভিত্তিক, তাই ভাবলাম এখন হয়তো দূর্নীতি হবার সুযোগ নেই। কিন্তু এখনকার ইন্ডিয়ার ভিসা নিয়ে দূর্নীতির অবস্থা আরও ভয়াবহ। এখন কেউই টাকা ছাড়া ভিসা জমা দেবার ডেট পায় না। ইন্ডিয়ার অ্যাম্বাসির কতিপয় কর্মকর্তারা সিন্ডিকেট করে রেখেছে। তাদের মাধ্যম ছাড়া কেউ ডেট নিতে পারে না। এখন ডেট নিতে হলে ক্ষেত্রবিশেষ ১০০০-৩০০০ টাকা দিতে হয় ।
প্রতিদিন দিন গড়ে প্রায় ৩০০০ ভিসা ফাইল জমা পড়ে। ফাইল প্রতি নূন্যতম ১০০০ টাকা দিলে, গড়ে দৈনিক ৩০,০০,০০০/= (ত্রিশ লক্ষ) টাকার দূর্নীতি হচ্ছে। যা মাসে দাঁড়ায় ৬,৬০,০০,০০০/= (সাড়ে ছয় কোটি) টাকা এবং বছরে যা প্রায় ৮০ কোটি টাকার দূর্নীতি।
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৪ রাত ১০:২৬