যেদিন থেকে বিএনপির নেত্রী ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া ১৫ আগস্ট জন্মদিন পালন করতে শুরু করেন, সেদিন থেকেই এ নিয়ে বিভিন্ন মহলে সমালোচনা হয়ে আসছে। কিন্তু বিএনপির নেতা-কর্মীরা সেটি আমলে নিচ্ছেন বলে মনে হয় না। অনেকে প্রশ্ন তুলেছেন, ১৫ আগস্টই তাঁর জন্মদিন কি না?
স্কুলে ভর্তির রেকর্ড অনুযায়ী তাঁর জন্মদিন ১৯৪৫ সালের সেপ্টেম্বরে। ১৯৯১ সালে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পরেই প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর থেকে প্রথম জানানো হয়, ১৫ আগস্ট খালেদা জিয়ার জন্মদিন। যেহেতু ক্ষমতায় আসার আগে বিএনপির নেত্রী কখনোই ১৫ আগস্ট জন্মদিন পালন করতেন না, সেহেতু সমালোচনার দিকটি একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
অবশ্য তাঁর রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের দাবি, ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে হত্যা হয়েছে বলেই খালেদা জিয়া এই দিনটিকে তাঁর জন্মদিন হিসেবে বেছে নিয়েছেন। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর এটি জাতীয় শোক দিবস হিসেবে পালিত হচ্ছে। একবার জাতীয় শোক দিবসে বিরোধী দলের নেতার সরকারি বাসভবনে জাতীয় পতাকা অধর্নমিত না রাখা নিয়েও বিতর্ক হয়েছিল।
আমরা সেই বির্তকে যেতে চাই না। আমরা বেগম খালেদা জিয়াকে প্রশ্ন রাখতে চাই, রাষ্ট্রপালিত একদল ঘাতকের হাতে যেদিন বাংলাদেশের স্থপতি খুন হলেন, সেদিন এভাবে ঘটা করে কেক কেটে জন্মদিন পালন করা কতটা সমীচীন? প্রতিবেশীর বাড়িতে কেউ মারা গেলেও মানুষ তার প্রতি সহমির্মতা দেখায়, আনন্দ অনুষ্ঠান বজর্ন করে। বিএনপির নেতা-কর্মীরা অবশ্য দাবি করেন, ১৫ আগস্টই তাঁর প্রকৃত জন্মদিন। আমরা তাঁদের এ দাবি নাকচ করছি না। ১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবস বলে কেউ জন্ম নিতে পারবেন না, তাতো নয়। কিন্তু সেই যেদিনটিতে বাংলাদেশের স্থপতি শেখ মুজিবুর রহমানকে নিমর্মভাবে খুন করা হলেন সেদিনটিতে আড়ম্বর করে জন্মদিন পালন না করলেই কি নয়?
এ ব্যাপারে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মওদুদ আহমদের অনুভূতিটি আমরা তুলে ধরছি। কারাগারে কেমন ছিলাম ২০০৭-২০০৮ বইয়ের ৩২৪ পৃষ্ঠায় তিনি লিখেছেন,
‘আজ জাতীয় শোক দিবস। ১৯৭৫ সালের এই দিনে বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর ধানমন্ডির বাড়িতে স্ত্রী ও পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের সঙ্গে খুন হন। জাতির ইতিহাসে এ এক মহাশোকের দিন। বিতর্কিত একটি জন্মদিনের হিসেবে আজ বেগম জিয়ার ৬৩তম জন্মদিন। সঠিক হলেও আমি হলে আমার জন্মদিন বোধ হয় একদিন আগে বা পরে পালন করতাম ও শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যা দিবসের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতাম। এটা একটা রুচিবোধের বিষয়। বেগম জিয়া তা করলে তিনি সব শ্রেণির জনগণের কাছ থেকে আরও বেশি শ্রদ্ধা অজর্ন করতে পারতেন।’
গত বছর অক্টোবরে নির্বাচনকেন্দ্রিক অচলাবস্থা কাটাতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বিরোধী দলের নেতা খালেদা জিয়ার মধ্যে যে টেলিফোন সংলাপ হয়েছিল, তাতেও বিষয়টি উঠে এসেছিল। শেখ হাসিনা অভিযোগ করেছিলেন, ‘আমাকে কষ্ট দেওয়ার জন্যই খালেদা জিয়া ১৫ আগস্ট কেক কেটে জন্মদিন পালন করেন।’
৫ জানুয়ারির পর দেশের পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে যখন খালেদা জিয়া বারবার সমঝোতামূলক রাজনীতির কথা বলছেন, তখন আশা করা গিয়েছিল তিনি এবার জন্মদিনে কেক কাটবেন না। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম একাধিক সভায় বিএনপির নেত্রীর প্রতি জাতীয় শোক দিবসে জন্মদিন পালন না করার জন্য আহ্বান জানিয়েছিলেন। তিনি ব্রিটেনের রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের উদাহরণ টেনে বলেছিলেন, তিনি দুটো জন্মদিন পালন করেন-একটি সরকারি আর একটি ব্যক্তিগত। সরকারি জন্মদিনটিই আনুষ্ঠানিকভাবে পালন করা হয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক আসিফ নজরুল ১ আগস্ট ‘আনন্দমেলা! একটি কল্পকাহিনি!’ শিরোনামে প্রথম আলোয় লিখেছিলেন, ‘শেখ হাসিনা কিছুক্ষণ হতবাক হয়ে গেলেন খবর শুনে। খালেদা জিয়া ঘোষণা দিয়েছেন, তিনি আর কখনো জন্মদিন পালন করবেন না। তিনি আরও অবাক হলেন এটি ভেবে যে এই ঘোষণার কথা তাঁর গোয়েন্দারা ঘুণাক্ষরেও আঁচ করতে পারল না। ...১৫ আগস্ট তাঁর জন্মদিন তিনি কখনোই পালন করবেন না, বিএনপির সকল পর্যায়ের নেতা-কর্মীদেরও তিনি একই র্নিদেশ দিয়েছেন।’
আসিফ নজরুল লেখাটি লিখেছেন ১ আগস্ট। অনেকেই ভেবেছিলেন বিএনপির নেত্রী এবার একটি নজির দেখাতেও পারেন। কিন্তু পারলেন না খালেদা জিয়া। বৃহস্পতিবার রাত ১২টা এক মিনিটে বিএনপির চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে নেতা-কর্মীদের নিয়ে তিনি কেক কেটে মহাসমারোহে জন্মদিন পালন করলেন, যখন জাতীয় শোক দিবসের আনুষ্ঠানিকতাও শুরু হয়েছে মোমবাতি প্রজ্বালনের মধ্য দিয়ে।
শেষমেষ আসিফ নজরুলের কল্পকাহিনি কল্পকাহিনিই রয়ে গেল। সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের অনুরোধ এবং দেশবাসীর আশা প্রত্যাখ্যাত হলো।
সুত্রঃ প্রথম আলো