গত ২৫ অক্টোবর ঘটে যাওয়া একটা অসুবিধার কথা দিয়ে শুরু করা যাক । আমার অগ্রজ মেরিন প্রকৌশলী । এবার দেশে আসার জন্য জাহাজ থেকে ভিয়েতনামে নামবে । সিঙ্গাপুর হয়ে দেশে ফিরবে ২৫তারিখ রাতে । অজ্ঞতা বের হতে হলো সন্ধ্যায় । মোহাম্মদপুর থেকে এয়ারপোর্ট যেতে যে কষ্ট ও দুর্ভোগ আমাকে পোহাতে হলো তাতে কাওকেই না দুষে নিজের ভাগ্যকেই দোষারোপ করা ছাড়া আমার উপায় ছিল না । আমাদের এই দেশের সব ভালো কিন্তু শাসক ও নীতিনির্ধারকদের ব্যর্থতা আমাদের পিছিয়ে দেয় । ইতিহাসে প্রত্যেক সফল শাসকের পৃথিবীতে রয়েছে কিছু ভুল আর কিছু দোষ । সেটা আমাদের দেশের রাজাদের মেনে নেওয়ার প্রবণতা এখনও তৈরী হচ্ছে না । এটা দুঃখজনক । ইতিহাস যে কোন কথা ভুলে যায় না । সচেতন প্রবীন নাগরিকদের অসম্মানিত হওয়ার ভয়ে নিশ্চুপ থাকাও এখন সাপেবর । বাইরের দেশের মানুষ(রাষ্ট্রদূত)কে দেদারছে বলতে দিচ্ছি অনেক কিছুই কিন্তু নিজেদের প্রবীণ যে কেও বললেই মিডিয়া ও সামাজিক যোগাযোগের সাইট সহ সব খানে নোংরা আক্রমন খুবই বেদনাদায়ক । সবার সব কথা পছন্দ না হওয়াই স্বাভাবিক তাই বলে তাকে আক্রমনটাও হওয়া উচিত রুচিবোধ রেখে , উপযুক্ত সম্মান রেখে । যার মুরুব্বী নেই তার ধ্বংস অনিবার্য হয়ে দাড়ায় ।
মোঘলদের শাসন নিয়ে বলি । আমি লাহোর গিয়ে দেখেছি মোঘলদের সেই শাসনের রঙ্গমঞ্চ , দেখেছি শিশমহল , দেখেছি বিশাল রাজবাড়ির পাশেই উপমহাদেশের বৃহত পতিতালয় হীরামন্ডি । শাসকের সমস্যা থাকবেই তাই বলে গনতন্ত্রের এই সহবস্থানের দিনে নিজেকে বেশী চতুর ভাবাই যে কত বোকামী তা বুঝা যায় অনেক পরে ।
আমার এক বিদেশী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকের একটা লাইভটাইম উক্তি বলে রাখি । তিনি ১৯৯২ দিকে একবার , ২০০৪ এ একবার এবং ২০০৮ এ একবার এই দেশে এসেছিলেন । তিনি বলেছিলেন “তোমাদের দেশে একটা যাদু ঘটে গিয়েছে । তোমরা টের পাওনি হয়তো । সব দিক দিয়ে এতো ইতিবাচক অর্জন অনেকটা মিরাকলের মত” । আমি হেসে বলেছিলাম দেখেন এখন পাকিস্তানের কি অবস্থা ??? ১৯৭১ এর পর আমাদের অর্জন ও তাদের অর্জন দেখলে বুঝা যায় কি পেয়েছি আমরা । অর্জন অনেক । অর্জন এর মাঝে বিসর্জন হলো নৈতিক অবস্থার ।
দুইটি বৃহত শক্তির সাথে ছোট ছোট দল নিয়ে যে দুটো জোট তৈরী হয়েছে তাতে দুই পক্ষ ছাড়া আর কিছুই দৃশ্যমান হচ্ছে না । নীতির সাথে বার বার হেরে যাচ্ছে শাসনে যারা আসছে তাদের দুর্নীতির কাছে । তৃনমূল থেকে উপর পর্যন্ত শুধু অর্থবিত্তের প্রতি ছুটা । মুক্তিযুদ্ধের চেতনাই ছিল সম-অধিকার প্রতিষ্ঠা করা যেটা থেকে আমরা দূরে সরে এসেছি । মুক্তিযোদ্ধাদের কি দিতে পারছি জানি না কিন্তু চাকরী ক্ষেত্রে নাতিপুতির কোটায় মেধাবীরা ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে কিনা ভাবার সময় হয়েছে । আমি নিজেও একজন মুক্তিযোদ্ধার সন্তান। আমার পিতার এই অদদানের জন্য মন থেকে শ্রদ্ধা কিন্তু বাবার কর্মের জন্য আমাকে নয় আমার পিতাকে পুরস্কৃত করলেই বেশী খুশি হবো আমরা তরুন প্রজন্ম । আর মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে ব্যবসা করাটা খুব কষ্ট দেয় আমাকে ।
আমার অগ্রজ ঘুরে এলেন এবার রাশিয়া , চীন এবং ভিয়েতনাম । তিনটি দেশেই সোস্যালিজমে বিশাসী । তাদের রাষ্ট্রিয় অর্জনে বড়ভাই উচ্ছসিত । আমরা পুজিবাদীও হলাম না আবার সম অধিকার প্রতিষ্ঠা থেকে দূরে রইলাম । বিপ্লব যেন বেহাত হয়ে যাচ্ছে । আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর ইগো সমস্যার কারনে দেশ যে কি পরিমান ক্ষতিগ্রস্থ হয় প্রতিবার । কোথায় যেন বারবার ভুল হয় আমাদের । মার্কা দেখেই পাগল হয়ে যাওয়ার প্রবণতা ভাল মানুষগুলোকে দূরে ঠেলে দেওয়ার নামান্তর ।
আমাদের নেতা পছন্দ করা অযোগ্যতা আমাদের পিছিয়ে দেয় বারবার । কবে আমরা নিজেদের ভালটা বুঝতে শিখব কে জানে । অন্যের পেট ভরাতে নিজেরাই লড়ি, নিজেরাই মরি ।
সাধারন নাগরিক হিসেবে আমাদের চাহিদাটি আদায় করে নেওয়ার দায়িত্ব আমাদেরই । যে দেশের জনগন যেমন শাসক চায় তারা সেরকমই শাসক পায় । আমদের জনগনের চাওয়া পাওয়ার ফারাকটা তাই এতো বেশী মনে হয় ।
চায়ের দোকানে এক চাচা বলে ফেললেন
“পাটা পোতার ঘষাঘষি , মরিচের জান লইয়া টানাটানি”
(মরিচ যেই শীল ও পাটায় বাটা হয় তাতে মরিচের জান যায় , পাথরের কিছুই হয় না) ।
“ঐক্য, শ্রম ও ত্যাগ – এই তিনের সংযোগে গনতন্ত্র মানবজাতির ইতিহাসে এক প্রভাবশালী মতবাদ।” বলেছেন রিচার্ড ই বায়ার্ড । এই তিনটি গুনই আমাদের গনতন্ত্রে অনুপস্থিত । ঐক্য প্রায় অস্মভব , শ্রম শুধু এক পক্ষ দিবে মধু খাবে আরেক দল । আর ত্যাগ আমাদের ইগোর কাছে প্রতিবার হেরে যায় ।
আর কত এভাবে তাদের নাটক দেখবো ?? সমঝোতার জায়গা বা স্পেস রাখা হয় না । অঢেল সম্পত্তির মালিক বনে জান ৫ বছরে তারা । প্রতিবার একই ঘটনা ঘটে । ভারতে আমি সাতবার গিয়েছি । আমার উপলব্ধি হলো ভারত পাকিস্থান থেকে বাংলাদেশের অর্জন কোন অংশে কম নয় । আমার তরুন বয়সে প্রতিবছর আমার সামার ভেকেশনে ভারত পাকিস্থান ঘুরে মনে হয়েছে আমরা ভালই এগুচ্ছি তবে “কিন্তু” আছে একটা । বারবার একই “কিন্তু” এর উভ্যোদয় । সেই রাজনৈতিক অস্থিরতা । বাংলাদেশের কিছু শিল্প এতদূর এগিয়ে গেছে যে আমরা তা কল্পনা করতে পারব না । আমাদের বাংলাদেশের মাল্টি ন্যাশনাল ও সরকারি কোম্পানি তে কাজ করার সুযোগ হয়েছে আমার । আমাদের শিল্প এর গতিতে আগামির চেলেঞ্জ হলো জ্বালানী নিরাপত্তা নিশ্চিত করা । সে ব্যাপারে রাজনীতিতে আলোচনা নেই , বিশ্বে কুটনৈতিক সম্পর্ক কিভাবে আরো জোরদার করা যাবে , অর্থনীতি কিংবা গবেষণানীতি কিছুই আলোচনা হয় না এই দেশে । ছায়া মন্ত্রনালয় কাজ করতে দেখি না কখনও । এটাই দেখছি । শুধু গদিই কি সব দু দলের কাছে । ভারতে কয়েকদিন আগে খাদ্য নিরাপত্তা নিয়ে সংসদে বিল পাশ করার সময় দেখলাম গনতন্ত্র কাকে বলে । জনগনের বৃহত মঙ্গলের কথা ভেবে তারা এক হতে জানে । আমরা পারি না ।
পাল এস বাকের একটা কথা বলি । ভদ্রলোক বলেছেন
“ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় – মানুষের বিপদ ও দুঃখ দুর্দশা যেখানে কিছুমাত্র লাঘব করা হয় – কেবল সেখানেই গনতন্ত্র বিকাশ লাভের সুযোগ পায়।”
কিসের যে গনতন্ত্র আর কিসের যে রাজনৈতিক দর্শন তাই তো বুঝতে পারে নি এই নতুন প্রজন্ম । তাহলে কবে হবে নীতির খেলা । তুরুপের তাসের খেলাতে কবে “আমাদের জানমাল নিয়ে খেলা” বন্ধ হবে । তুরুপের তাস খুজতে খুজতে খেলার উদ্দেশ্যই কি ভুলে গেছি আমরা । জনগন বিচ্ছিন্ন কথা ভাল আর কতদিন লাগবে । পেয়াজ ১০০টাকা । প্রত্যেক সরকারের সময় আমরা মাসের বেতন তুলে অথৈ সাগরে ভাসি আর তারা ৫বছরে ভাসেন অগাধ সম্পদে । যেন এটাই হওয়ার ছিলো । ভাগ্য হিসেবে মেনে নিয়েছি ।
আমরা নশ্বর এই পৃথিবীতে ভুলে যাই এই আর্থিক আর বাহুবল চিরদিন থাকে না । অমর হয় গুটি কয়েক নেতা । বঙ্গবন্ধু , জিয়ার ক্ষমতা থেকেও অঢেল সম্পত্তি করেন নি কিন্তু তাদের অর্জন এখন তাদের পরিবার পাচ্ছে । এটাই নিয়ম । এদের উত্তরসূরি রা আবার ভাসানী, সোরহার্দী, শেরে বাংলা, তাজউদ্দীন সহ অনেক কেই মানেন না বা প্রকৃত সম্মান দেন না । ফাইনাল ডেসটিনেশন নিয়ে চিন্তা ভাবনাও নেই । একটুও ভাবেন না আপনি অন্য কে স্বরন না করলে আপনার অবর্তমানে আপনাকেও কেউ স্বরন করবে । ইতিহাস প্রতিশোধ নেবে ভবিষ্যতে । জেনে রাখুন ।
শুভবুদ্ধির উদয় আবশ্যম্ভাবী । নতুন সূর্য্যের নতুন কিরনের প্রতিক্ষা ফুরাবে হয়তো একদিন ।