এমরান চাচা তার সাথে আমার বহুদিনের চলাফেরা। সেই কবে থেকে, যখন আমি হাইস্কুলে পড়ি একদিন আমাকে রাস্তায় দেখে বলে,
-তুমি এমুক ভাইয়ের ছেলে না?
আমি বলি -জি আমি আপনার ওমুক ভাইয়ের ছেলে। নাম অনিক ।
সেই থেকে মাঝে মধ্যে আমার পড়াশুনার খবর নিতেন। আমাদের বাড়ি এসে অনেক গল্প করতেন। বলতেন ওনার বাবা সবসময় আমাাদের বাড়ি আসা যাওয়া করতেন। অনেক ভাল মানুষ আমার দাদী তাই ওনার বাবাকে ভাই ডেকেছিলেন। আসলে কোন দিন না খেয়ে যেতে দিতেন না এইসব গল্প করতেন। ওনার বাবার যখন খুবি অভাব যাচ্ছিল তখন আমার দাদী ওনার বাবাকে সহযোগিতা করতেন। এইসব নাকি ওনি সবি জানেন। ওনার মা ওনাকে সবি বলেছে। তাই ওনি আমার দাদীকে দেখতে প্রায়ই আসতেন। তারি সাথে আমার সাথে বেশ খাতির জমিয়ে আড্ডা মারতেন। সবাই ওনাকে এমরান পাগলা ডাকে। অামি চিন্তা করতে থাকলাম আমি একজন পাগলের সাথে বন্ধুত্ব করে যাচ্ছি এমন করা কি ঠিক! এই অাগর বাগর অনেক চিন্তা করে মাঝে মধ্যে ওনাকে এড়িয়ে চলতাম। আমি যতই ওনাকে এড়িয়ে যেতে চাই ততই ওনি আমাকে কাছে টেনে নিতে চায়। ওনার কথাতে ছিল যাদুমাখা। আবার অনেককে বলতে শুনেছি ওনার সাথে জীন আছর করে আছে। আমি আমার দাদীকে জিজ্ঞেস করলে দাদী বলেছিল, 'তার সাথে জীন-টিন এসব কিছু নেই' কড়া ব্রেইন ছিল কিন্তু মিস ইউজে নাকী মাথায় একটু গোলমাল হয়ে গেছে।
অামার সামনে এস এস সি পরিক্ষা পড়ার অনেক চাপ হঠাৎ একদিন এই পাগলা চাচা রাতে এসে হাজির। বলে
-আজ প্রার্থনা করা লাগবে।
আমি বলি,
-কিসের প্রার্থনা? আমিতো নামাজ পড়িই আর কি প্রার্থনা করবো!
-আরে আছে মারেফতি কিছু প্রার্থনা এগুলো তুই বুঝবি না। আমি বাজার করে নিয়ে এসেছি হিচুরি পাকানো হবে। আমরা প্রাথর্না করে এই হিচুরি কতেকের মধ্যে ভন্টন করে দিব।
ঠিক ঠিকিই এই কাজটি ওনি সেই দিন করেন। তারপর থেকে আমি বুঝতে পারি তিনি ফকিরি লাইনে হাটছেন। আমার পরিক্ষা শেষ হয় আমি গ্রাম ছেড়ে ঢাকাতে চলে যাই। ওনার সাথে তেমন যোগা-যোগ হয়না। তাতে কি ওনি সর্বদায় বাড়ি এসে আমার খবর রাখেন। আমার ভাল রিজাল্ট কামনা করেন। একদিন আমার রিজাল্ট হয় ওনি রিজাল্ট শুনে অনেক খু'শি।
আমি কলেজে ভর্তি হয়ে পড়াশুনা করছি। এখন ওনি আমার পিছু আরো বেশী করে লেগে গেলেন। বলছেন কাউকে অন্তর থেকে ভাল বাসলে তাকে খেয়াল রাখতে হয়। আমি কোথায় কোন বন্ধুদের সাথে মিশি, কোন প্রেম-ট্রেম করি কিনা এগুলোর খিয়াল রাখা এখন তার দায়িত্ববোদের এক অংশ। তাতে আমার আর তাকে ভাল লাগছেনা। আমি তার সঙ্গ চাচ্ছিনা যে চাচ্ছিনা। কিন্তু সেতো আমাকে ছাড়ার বান্দা নয়। আমার পিছু লেগেই আছে। ঠিক তারি মাঝে আমার সবচেয়ে বেশী খেয়াল রাখার ব্যক্তিটি যিনি আমার প্রিয় দাদী মারা যান। আমি প্রিয়জন হারানো ব্যথায় কাতর। তখনো এই পাগল চাচাটি আমার পাশ্বে থাকেন। আমাকে শান্তনা দেন।
এর পর আবার ঢাকাতে চলে গেলে তখন বেশ কিছুদিন পর-পর বাড়ি আসতাম। ওনার খবর জিজ্ঞেস করলে বাড়ি থেকে বলতো এখন ওনি আর তেমন আমাদের বাড়ি আসেন না। রাস্তায় আমার চাচাদের বা ভাই বোনদের কাউকে পেলে আমার খবর নিতেন। আমি নিজেই অনুধাবন করতে পারি সে আমার দাদীকে ভাল বাসতেন। আমি যখন ওনার সাথে দেখা করি ওনি দাদীর জন্য কান্না করে দোয়া করতেন। একটি পাগল আমার দাদীর জন্য দোয় করছে, আমি খুশি হতাম।
তারপর একদিন আমি দেশ ছেড়ে বিদেশে পারিজমাই। সুদূর প্রবাসে এসেও ওনাকে স্বরণ করেছি, চিঠিতে ওনার কথা জিজ্ঞেস করতাম। অন্যান্য বন্ধু বান্ধবদের জিগাইলে ওর খবর দিত। বলতো পাগলা আজো সেই পাগলাই রয়ে গেল এখন বিভিন্ন মাজার -মাহফিলে ঘুরে ফিরে।কখনো সিলেট শাহজালাল, কখনো নাকি চট্টগ্রাম শাহ আমানত এর মাজারে চলে যায়। আবার কোন হিন্দু বোষ্টমিতেও। ওনার অনেক হিন্দু বন্ধু আবার মসজিরেদ ইমাম। কিংবা পাড়ার যোবক ছেলে পেলে সবার সাথেই তার বন্ধুত্ব।
আমি বিদেশ থেকে প্রথম বার ৯ বছর পর দেশে যাই তখন এই পাগলা চাচাটির কথা একেবারেই মনে নেই। ওনার জন্য একটি চকলেট পযর্ন্ত নেইনি। কিন্তু আমি যাওয়ার ২৪ ঘন্টার মধ্যেই পাগল চাচাটি আমাকে দেখার জন্য চলে এলেন অামাদের বাড়ি। আমি ওনাকে দেখে একটু লজ্জায় পরে যাই । আমি খাবার যোগ্য যা ছিল তা দিয়ে বলি,- চাচা তোমার জন্য একটা কিছু আনতে পারিনি এতে আমি লজ্জিত।কিন্তু ওনি হাসতে হাসতে বলেন,
- তুমি যে মাঝে মধ্যে অমার খবর নিয়েছ তাতেই অামি খুশি।
এখনো দেশে গেলে ওনার সাথে দেখা করি, ওনার সাথে বসে আড্ডা করি। ওনি মারেফতি আড্ডা করেন আমি মনোযোগ দিয়ে শুনি যদিও আমি ওনার টপিকে ততো ইন্টারেষ্ট নয়। তবো প্রিয় মানুষের প্রলাপ ও মধুর হয়। তাই।
ওনি অসাভাবিক একজন মানুষও যে কিনা সংসার ধর্ম কিছুই বুঝেন না। আমি ওনার সম্পর্কে যা জানতাম ওনি একটি ক্যাডেট স্কুলে পড়াশুনা করা কালিন অষ্ট শ্রেনী থেকে নবব শ্রেনীতে উর্তিন্ন হউন তবে প্রথম হতে পারিননি বলে গলায় রশির ফাস দিয়ে মরে যাওয়ার চেষ্ট করলে আত্নীয়দের কেহ দেখে ফেলেন। ওনি আত্নহত্যা করতে পারেনি কিন্তু স্বাভাবিক জীবনে আর ফিরে আসতে পারেন নি তাই সবাই এমরান পাগলা ডাকে তাকে আজ।
এইবার ছুট্টিতে দেশে ছিলাম যখন একদিন ওনার সাথে আড্ডা করছি এমন সময় ওনি বলতে শুরু করলেন দেখ অনিক, সময় মানুষের কিভাবে গড়িয়ে যায়,দেখতে- দেখতে জীবনের কতোগুলো বছর চরে গেল! মনে হয় এইতো সেই দিন তোমার সাথে পরিচয় হয়েছিল।
আমি বলি,
- জি। জীবনতো তাকেই বলে। কৈশরে আপনার সাথে পরিচয়, তাই না?
- হ্যা। কতো বছর হল হিসেব করতো?
- ধরেন ২৫/২৬ বছর।
অবাক হয়ে বলেন
-২৫ বছর অনিক তুমি একজন পাগলকে মনে রেখেছ!
আমি বলি,- অবাক হওয়ার কি আছে চাচা, আপনি পাগল কে বলেছে! আমার কাছেতো আপনি একজন চাচা।
-না অনিক তুমি অনেক বড় মনের অধিকারী তাই আমাকে মনে রেখেছ, তুমি ওলি মানুষ..........
এই সেই নানান বিশেষনে ভূশিত করা শুরু হয়ে গেল তার।
আমি বলছি,- এখন কফি চলুক, না অন্য কিছু খাবেন?
- না। কফিই ভাল হবে।
আমি কফি সপ থেকে কফি অর্ডার দিতে গেলাম ওখানে গিয়ে দেখি এক বৃদ্ধলোক কুজো হয়ে বসে আছে, পড়নে ছিন্ন পোশাক, কতো দিন না খেয়ে আছে কে যানে। এমন করে বসেই থাকলে কেউ কি খাবার দিয়ে যাবে লোকটাকে! খাবারতো চাইতে হবে, আমি তার কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করি,-
চাচা কিছু খাবেন?
- না।
কেন খাবেন না,কিছু কি খেয়েছেন?
জবাব একটাই -না।
আশ্চার্যতো লোকটি কিছু খায়নি, এখন খাবেও না! আমি এমরান চাচার কাছে গিয়ে ঘটনাটি বলি।ওনি বলেন,
- তুমি লোকটিকে চিননা। লোকটি পাগল ভিক্ষুক না তাই চেয়ে খাবে না। তুমি যা দিতে চাও কিনে নিয়ে বল এগুলো খেয়ে নিন।
আমি ওনার কথা তাই করি। লোকটিকে কিছু ফাস্টফুড আর একটি জুস কিনে দিয়ে বলি এগুলো খেয়ে নিন। খাবার গুলো ওনার হাতে দিতেই ওনি অধিক আগ্রহে খাবারগুলো আমার হাত থেকে নিলেন। এমনিতে খেতে শুরু করলেন সত্যিই মনে হল অনেক সময় থেকে না খেয়ে আছেন লোকটি। আমি আর এমরান চাচা কফি খাচ্ছি গল্প করছি ফাকে-ফাকে বৃদ্ধ লোকটিকে দেখছি।
এমরান চাচা বলছেন,
-পাগলকে ভাল বাসা যেমন তেমন কাজ নয় ভাতিজা। তুমার জন্য দোয়া করি।