আমার মন খারাপ হলে সবচেয়ে যে কাজটি করতে বেশী ইচ্ছে করে তা হল রেল লাইনের স্লীপার দিয়ে হাঁটতে। হাঁটতে- হাঁটতে ক্লান্ত হলে পরে ষ্টেশনের চা দোকান থেকে একটি চা পান করি।চা পান করতে- করতে শত -শত যাত্রির গন্তব্যর উদ্দশ্যে গাড়ির জন্য অপক্ষো করা দেখি। বরাবরের মতো আজ আমার মন খারাপ তাই রেল লাইনের স্লীপার দিয়ে হাঁটছি ,হাঁটতে -হাঁটতে অনেকটা দূর চলে আসছি ,সামনে রেল গেইট।গাড়ি আসবে গেইট আটকে দিচ্ছে গেইট ম্যান। দু’পার্শ্বে যানগুলো অপেক্ষা করছে ট্রেন আসার। ট্রেন চলে গেলে ওরা যেতে পারবে।
এমন সময় পেছন থেকে একটি মৃদকন্ঠ 'স্যার দুইডা ট্যাকা দিবেন?' আলতো করে শরীরের বাম পার্শ্বে ছোট্ট একটি হাতের নরম স্পর্শ অনুভব হল। ফিরে তাকাতেই দেখলাম একটি ১০/১১ বছররে ছোট্ট খুকি তার বাম হাতের মুঠোয় কিছু টাকা ডান হাতে আমার কাছে চাচ্ছে। আমি মেয়েটির দিকে তাকাতেই দেখতে পেলাম অসহায়ত্বের করুণ ছাপ তার সমস্ত্য মূখজুড়ে।উজ্জ্বল চেহেরাটি মলিন , ক্ষুদায় মুখটি ছোট্ট হয়ে আসছে , কথা অস্পষ্ট।
আমি পকেট থেকে দশ টাকার একটি নোট দিয়ে বললাম ১০ টাকায় খাওয়া হবে?
মেয়েটি বলছে ,
-জি অইবো ,আপনি যা দিছেন আর আমারগুলান আম্মাকে দিলে আম্মা চাল কিন্না রান্না কইরা দিবো। আমাগোর খাওন অইয়া যাইবো।
আমি হতচকিয়ে গেলাম এই মেয়ে বলে কি !এমনিতে মেয়েটি ক্ষুদায় চলতে পারছেনা। এখন তার আরো সময় অপক্ষো করতে হবে দিনের প্রায় দুই তৃতীয়াংশ সময় শেষ !মেয়েটির হাত ধরে বললাম।
- চল আমার সাথে। আমি তোমাকে খাওয়াবো।একটি ভাল হোটেলের মজার -মজার খাবার । মেয়েটি কোন মতইে রাজি হচ্ছেনা। তার দশ টাকাই চাই এর বেশী দরকার নাই । আমি অনেক জুরা জুরি করছি ।
মেয়েটি বলছে স্যার,
-মা কইছে কোন পুরুষ মানুষ একলা কোন খানে যাইতে কইলে যাওন নাই।পুরুষ মানুষগুলাইন ভালা অয়নাগো স্যার।
আমি মেয়েটির মুখে পুরুষ ভীতির কথা শুনে চমকে যাই।মেয়েটির মায়ের দেওয়া হুশিয়ারী আমাকে মনে করিয়ে দেয় টিভি , পত্র পত্রিকায় আসা নানান বয়সের শিশু নির্যাতনের খবর গুলো । সত্যিই এই সমাজের হায়েনাগুলো ওতপেতে বসে আছে সুযোগে ছিড়ে খাবে এই নি:ষ্পাপ শিশুদের দেহ। ছি: ছি: ছি :মেয়েটির কাছে নিজের পুরুষ পরিচয়টি ঘৃন্নিত লাগছে।
তারপরেও মেয়েটিকে বুঝিয়ে বললাম সামনেই একটা ভাল হোটেল আছে। চল ওখানে অনেক মানুষ আছে ,সমস্যা নাই । তুমি সবার মতো খেয়ে বের হয়ে যাবে । টাকা আমি দিব। অাজ আমি তোমাকে খাওয়াবো। তুমি আমার কথাটা রাখ । আমি খারাপ কেহ নয়।
পরে ক্ষুদার জ্বালায় অসহায় মেয়েটি রাজি হল। আমি তাকে নিয়ে সামনেই একটি ভাল হোটেলে সুজা চলে গেলাম।মেয়েটিকে নিয়ে একটি টেবিলে বসলাম। আজ আমার ইচ্ছামতো মেয়েটিকে ভাল খাবার পরিবেশন করব। যেমনটি আমি আমার প্রেমিকা হলে করতাম।ওয়েটারকে ঢাকতে একটি মেনু নিয়ে হাজির বলছে ’স্যার চয়েজ করে ওর্ডার করুন। আমি মেয়েটিকে বলছি কি কি খাবে বল?
মেয়েটি কিছুই বলছেনা, ভয়ে না হয় লজ্জায় ।
কি বসে থেকে লাভ কি? হোটেলে যখন আসছ খেতে হবে এখন বল কি খাবে?
মেয়েটিকে দেখে মনে হচ্ছে এমন আদোর করে এই প্রথম কেহ তাকে আপ্যায়ন করছে ,চেহারায় কিছুটা পুলক লক্ষ্য করা যাচ্ছে।
আমি বললাম না তুমি খাবে তুমি পছন্দ কর।
ভাত অইলে অইব।
শুধু ভাত খাবে ! ভাতের সাথে আর কিছু না?
ভাতের সাথে তরকারি দিতনা , অইডা অইব।
বিরানী খাবা , নাকী অন্য কিছু?
না , সাদা ভাত চলবো। লগে তরকারী যেইডা অয় ।
গরুর মাংস বুনা , মুরগীর রোস্ট খাবেতো?
মেয়েটি মুচকি হাসল আমি তার দিকে তাকিয়ে দেখছি ,তার পুলকিত মুখখানা। আমার অনেক ভাল লাগছে। এ যেন একটি পরীর হাসি।দাঁতগুলো ঝক-ঝকে সাদা ,অল্প ফর্সা মেয়েটির চেহেরাতে একটি নিশ্চিত প্রশান্তির রেখাপাত হচ্ছে ।এতক্ষনে তার ভয়টি কেটে গেছে পুরো-পুরি।আমাকে তার আপন মনে হচ্ছে।
ওয়েটার আসতইে তাকে বললাম মুরগীর রোস্ট একটি , গরুর মাংস বুনা এক প্লেট আর সাদা ভাত ।
ওয়েটার খাবারগুলো আমার সামনে এনে দিয়ে গেল ।মনে করছে এগুলো আমার জন্য ,মেয়েটি কাজের মেয়ে হয়তো শুধু দেখবে আর আর আমি খাব।আমি খাবারগুলো মেয়েটির কাছে সরিয়ে দিয়ে বললাম ,খাওয়া শুরু কর।
আপনে খাইতনে না?
না আমি খাবনা । তুমি খাও। আমি দেখছি।
না আপনে ও খান আমার লগে।
আরে আমার ক্ষুদা নেই , একটু আগেই খেয়েছি। আমি শুধু চা খাব। তুমি খাও ।
মেয়েটি খাচ্ছে মজা করে আর চুপি চুপি আমার দিকে তাকাচ্ছে।আমার অনেক ভাল লাগছে। আমার ভাগ্য কত ভাল একটি পথশিশুর এক বেলার অন্ন দিতে পারছি।প্রশান্তিতে আমার হৃদয় ভরে যাচ্ছে।এমন করে মেয়েটি আর কোনদিন খেতে পেরেছে কি না জানিনা।
মেয়েটির খাবার শেষ হলে । আমি বলছি আর কিছু নিব ।
না । আর কোন লাগবো না।
এই ওয়েটার ভাই একটা সেভেন আপ দিনতো ।
মেয়েটি স্ট্র মুখে দিয়ে টান দিতেই বলে উঠল, টেল্খাআআ।
আমার হাসি পেল ।
হাসলেন কিরে?
না এমনিতে।
খাবার খাওয়া শেষ এখন বিল দিয়ে বের হয়ে যাব। মেয়েটিকে জিজ্ঞেস করি তোমার নামতো জানা হল না , কি নাম তোমার?
মেয়েটি বলল ,চম্পা ।
বাহ্ চম্পা ।
সুন্দর নামতো তোমার।
আচ্ছা তোমার বাসায় কে কে আছে ?
আমাগো তিন বইন, কোন ভাই নাই। এই লাইগ্যা আমার আব্বা আামার মা'রে ছাইড়া চইলা গেছে।
আমরা রেল লাইনের অইখানে বস্তিতে থাকি।অামার চোখের কোনে জল এসে গলে। হায়রে দুনিয়া। নিজের সন্তানকে ছেড়ে চলে যায় বাবা । এ কেমন বাবা! মেয়ে আর ছেলে কি সবইত সমান। সবাইতো সন্তান।
আচ্ছা চম্পা খাওয়াতো শেষ হল এবার উঠা যাক। তুমি এখন চলে যাও তোমার মায়ের কাছে।
কিছু টাকা দিয়ে চম্পাকে বিদায় দিলাম। আর চেয়ে থাকলাম চম্পার চলে যাওয়া পথটি ধরে , চম্পা ছোট্ট -ছোট্ট পায়ে এক পা - দু’পা করে সামনে চলে যাচ্ছে আর মাঝে মধ্যে আমার দিকে ফিরে তাকাচ্ছে। আমিও তার দিকে তাকিয়ে আছি এক দৃষ্টিতে, তার চলে যাওয়া আমার কষ্ট হচ্ছে , মনে হচ্ছে মেয়েটি যদি আমার আপন কেহ হতো তাহলে তাকে যেতে দিতামনা না। কিন্তু সেত পথের কেহ তাকে থাকতে হবে তার মায়ের কাছে । মেয়েটিকে বিদায় দিতে -দিতে মনে পড়ল আমার এক মেয়ে বন্ধু সোহাগীর কথা। প্রত্যেক বার তার সাথে দেখা করার পর রিক্সা করে তার বাসার সামনে নামিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতাম তার চলে যাওয়া পর্যন্ত। যতক্ষন দেখা যেত দাঁড়িয়ে তাকিয়ে থাকতাম , সে ও তাকাতো ফিরে ফিরে। এখন আর তার সাথে তেমন যোগা যোগ নেই। আর হবওে কিনা জানি না। চম্পাও চলে যাচ্ছে ,আস্তে আস্তে মিলিয়ে যাচ্ছে অনেক মানুষের ভীরে , তাকে আর দেখা যাচ্ছে না। আমি দূরে ষ্টেশনের দিকে তাকিয়ে চম্পাকে খুঁজছি লোকের ভীরে সে যেন বেলা শেষে সূর্যের মতো হারিয়ে গেল অন্ধকারে।