খুব নির্লিপ্ত ভংগীতে আমি তাকে বললাম- "দেখুন তো, আমার গায়ে জ্বর কি না!"
সে বেশ অবাক হলো- স্পর্শ সংক্রান্ত আমার এলার্জি তার অবিদিত নয়! তবু কাঁপা কাঁপা হাতে আমার কপাল ছুঁয়ে আরো বেশী অবাক দৃষ্টি নিয়ে বলল- "কই? কপাল তো একদম ঠান্ডা!"
কোন অনুভূতি হল না আমার, তাই আগের চেয়ে বেশী নিরাসক্ত দৃষ্টিতে সামনে দ্রুত চলে যাওয়া গাড়ীর সারির দিকে তাকিয়ে বললাম- "ঘাম দিয়ে ছেড়ে গেছে বোধ হয়!"
খুব ছেলেমানুষী একটা খেলা খেলে বুঝতে পারলাম- এভাবে ছল করে স্পর্শ নিয়ে তা থেকে ভালবাসা মাপা যায় না! তার ভালবাসা নিয়ে তো কোন সন্দেহ নেই, এই ছল না করে যদি খুব স্বতঃস্ফূর্তভাবে তার হাত ছুঁতে পারতাম তবেই হয় তো বুঝতাম ভালবাসতে পারার সেই বিরল গুণটা আমার আছে!
আমার পাশে বসে থাকা মানুষটা আচমকা আমার এই আচরণে কেমন যেন হত-বিহবল হয়ে গেল! আমি খুব মজা পাচ্ছি তার লাজুক হত-বিহবল চেহারা দেখে!আমরা বসে আছি টি এস সি- তে, ডাসের পেছনের লো-হাইট ওয়ালটাতে রাস্তার দিকে মুখ করে পা ঝুলিয়ে- আমার খুব প্রিয় জায়গা। লোকে আমায় আড়ালে এমনকি বন্ধুরা সামনা-সামনিও রোবট ডাকে, হয় তো আমি তা-ই অথবা শুনতে শুনতে এক সময় নিজেই বিশ্বাস করে ফেলেছি। শুধু পাশে বসে থাকা মানুষটাকে বিশ্বাস করাতে বেশ বেগ পেতে হচ্ছে, যদিও চেষ্টার কোন ত্রুটি থাকছে না আমার পক্ষ থেকে। এহেন অবস্থায় আমি যদি তাকে বলি গা ছুয়ে জ্বর দেখতে সে তো বিভ্রান্ত হবেই!
কে যেন একবার বলেছিল- আমি হলাম ঝিনুকের মতো, বাইরের শক্ত খোলসের ভেতরে খুব নরম একটা মানুষ। কেউ যদি খুব ভালবাসা নিয়ে সেই খোলসটাকে ভাংগতে পারে তবেই সে মূল্যবান মুক্তো পাবে! তবে খোলসের আঘাতে জীর্ণ হওয়া সহ্য করার মতো শক্তি-সাহস তার থাকতে হবে! এই কথায় মুগ্ধ হয়ে গলে যাওয়ার মতো মেয়ে আমি নই, যে বলেছিল সে আমার রোষদৃষ্টি থেকে সেদিন মুক্তি পায় নি বটে তবে আজ মনে হচ্ছে- এই যে তার এত প্রকাশ ভালবাসার তা কি সত্যি? সেই ভালবাসার জোরে কি এই খোলসটাকে সে ভাংগতে পারবে? আর ভেঙ্গে যাওয়া ধারালো ঝিনুকের আঘাত সহ্য করার মতো ধৈর্য কি সে দেখাতে পারবে?
জানি, তার ঝুলিতে অনেক ভালোবাসা- তার ভালবাসার ইশকুলে ছাত্রীর অভাবও ছিল না কখনো! একমাত্র আমিই নাকি অনাগ্রহী ছাত্রী, যার সেই ভালবাসার পাঠ নেওয়ার ইচ্ছে তো নেই-ই, স্কুলে ভর্তি হওয়ার ইচ্ছেটুকু পর্যন্ত নেই! কথা সত্য! ভালবাসার শিক্ষায় অপটু আমাকে ঠিক ঠাক লাইনে আনতে তার কাল ঘাম ছুটে যাচ্ছে কিন্তু ঠিক সুবিধে করতে পারছে না- তা দেখে আমার বন্ধু-বান্ধব যতই তার প্রতি সহমর্মী হয়ে উঠুক না কেন পাষাণ হৃদয় আমার তার কাছে পুরনো হয়ে যাওয়া আর আমার কাছে একদমই নতুন এই পাঠে একদমই মন নেই! মাস্টার মশায়ের বার বার হাল ছেড়ে দেওয়া করুণ আর উদাস চেহারা দেখতেই মাঝে মাঝে স্কুলের পাশ দিয়ে হেঁটে যাই তার জোরাজুরিতে, ভেতরে ঢোকার কথা মনে আসে না একবারও!
বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়ে বন্ধুরা বলত- আমার পাশে যে আসবে সে না কি আমাকে রাগিয়ে খুব মজা পাবে, তার সারাটা সময় কাটবে খুনসুটিতে, আমাকে হুটহাট রাগিয়ে; এর চেয়ে নির্মল আনন্দ না কি আর হতে পারে না! অথচ আমি দেখছি ঘটনা পুরো উলটো- যে আমাকে সবাই দা'য়ের আগায় রাখতে মজা পায় সেই আমি সারা জগতে কথায় কথায় ঘায়েল করার জন্যে একমাত্র তাকেই পেলাম! খুনসুটি-র পর লাজুক লাজুক মুখে সে যখন টেনে টেনে আমার নাম ধরে ডাকে- তার তখনকার চেহারা দেখার চেয়ে আনন্দদায়ক আর কিছু হতে পারে না! মাঝে মাঝে যখন কৌতুক মুখ করে জিজ্ঞেস করি,-"তা আপনার ইশকুলে নতুন কজন ছাত্রী পেলেন? কী কী ছড়া শেখালেন তাদের নতুন?" সে বেশ আহত দৃষ্টিতে বলে,- "মিশু, আপনার কি ধারণা আমি বাড়ী বাড়ী ছাত্রী খুঁজে বেড়াই?" তার কপট ক্ষোভ দেখে আমিও কপট হাসিতে ভেঙ্গে পড়ি, উত্তর দেয়া হয় না!
মাঝে মাঝে ভয় হয় যে ক্ষোভটাকে আমি কপট বলে উড়িয়ে দেই, তা কি আসলেই কপট? সে কি সত্যিই তার ভালবাসার ইশকুলে আমার মতো অনভিজ্ঞ অনাগ্রহী অমনোযোগী কাউকেই পেতে চায়? তার আহত চক্ষু বার বার যা বলতে চায় আমি কি তা দেখেও চোখ বুজে আছি? আমার মতো অস্থির, ইজি কাজে সারাক্ষণ বিজি মানুষের মাথায় চিন্তাটা স্থায়ী হয় না বেশীক্ষণ! আর তার অভিমান দেখে হেসে মরি, এমন বয়স্ক একটা মানুষ যখন বাচ্চাদের মতো আধো আধো বোলে (আধেক কথা পেটে রেখে) ভালোবাসার কথা বলে আর আমি তা বুঝি না বলে গাল ফুলিয়ে অভিমান করে হাসি কি আর চাপানো যায়! আমি হৃদয়হীনা এটা তো সেই জানে সবচেয়ে ভালো!
সে আমায় ভালোবাসা শেখাতে ব্যাকুল আর আমি আপাদমস্তক পক্ষপাতদুষ্ট এই মানুষটাকে পক্ষপাতহীনতার গল্প শোনাই- "শিক্ষককে হতে হবে পক্ষপাতিত্বের ঊর্ধ্বে, নইলে ছাত্র-ছাত্রীদের সাথে অন্যায় করা হবে যে! এই যে ধরেন, আপনার স্কুলে আপনি কোন ছাত্রীকে পক্ষপাতদুষ্ট হয়ে বেশী শেখাতে শুরু করেন, অন্যেরা বঞ্চিত হবে না?" আমার নির্মম রসিকতায় সে চুপ হয়ে যায় কিন্তু কথাটা আমার বিশ্বাস থেকেই বলেছিলাম- আমি শিক্ষকতা করি, ছাত্র-ছাত্রীদের পক্ষপাতিত্বের ঊর্ধ্বে উঠে শিক্ষা দেয়া-ই যে আমার কাজ! তবে ভালবাসার স্কুল তো ভিন্ন হওয়ার কথা, যেখানে অদ্ভুত নিয়মে পড়া লেখা হওয়ার কথা- শিক্ষক একজন, ছাত্র বা ছাত্রীও একজনই হওয়ার কথা, পক্ষপাতিত্বের প্রশ্নই তো আসার কথা নয়! সে তা বোঝে, আমি-ই হয় তো অবুঝ! অথবা তার স্কুলের জন্যে উপযুক্ত ছাত্রীর সন্ধান আমায় বিভ্রান্ত করে!
খুব ধীরে ধীরে সে আমার মাঝে ভালবাসার স্বপ্ন বুননের অভিযানে নামল যেন। গভীর রাতে পাশাপাশি বসে এক কাপ কফি, বা জোছনায় হাতে হাত রেখে হাঁটা অথবা বানের জলের মতো আসা ভালবাসায় ভেসে গিয়ে কিচ্ছুটি না বলে কাছাকাছি বসে থাকা- কী যত্নেই না দৃশ্যকল্পগুলো আমার চোখের সামনে আনতে চাইল একের পরে এক ভালবাসার গান শুনিয়ে! আমি বড্ড কূটতর্ক করি, তার এই কথাগুলো হেসে-ই উড়িয়ে দিই, মাঝে মাঝে ঘুম না আসা গভীর রাতে হয় তো ভাবি ভালবাসায় ভেসে যাওয়ার এই আহবান কি এই ভীষণ ছটফটে, বেয়াড়া, ড্যাম-কেয়ার যা মুখে আসে তা-ই বলে ফেলা 'আমি'র জন্যে, না কি সে যে কেউ হতে পারে- ইনা, মিনা বা ডিকা! তাকে যদি ফিরিয়ে দিই বা আমি যদি অভিমানভরে চলে যাই- সে কি তার ভালবাসার ঝুলি ভরা গান আমার জন্যে তুলে রাখবে, না কি অন্য কেউ তার দাবীদার হয়ে যাবে!
ঝুলি উপচে পড়া ভালবাসা নিয়ে আমার কাছে আসা মানুষটাকে ভালবাসতে না পারার দুঃখে আমি ম্যুহ্য হয়ে যাই! মাঝে মাঝে মনে হয় ভালবাসা চিনতে বা বুঝতে না পারা আর সবচেয়ে বড় কথা ভালবাসতে না পারার এই কোন অভিশাপে আমাকে অভিশপ্ত করলেন সৃষ্টিকর্তা! উজাড় করা এই 'ভালবাসা'য় আমার কেন স্বস্তিবোধ হচ্ছে না, কেন মনে হচ্ছে না পৃথিবীটা খুব সুন্দর! যেদিন বুঝতে পারলাম অসীম এই ভালোবাসা 'আমি' মানুষটা যেরকম ঠিক সেই আমার জন্যে আমাকে ভালবাসা নয়, তার নিজের জন্যে ভালবাসা, তার ভালবাসার স্কুলকে সচল রাখার জন্যে কাউকে দরকার তাই এই ভালবাসা- আমি তাকে ফিরিয়ে দিলাম, বড্ড নিষ্ঠুরভাবে তার মুখের উপর নিজের অজান্তে একটু একটু করে গড়ে উঠা আমার মনের স্কুলের দরজাটা নির্মমভাবে বন্ধ করে দিলাম!
আমার এই নিষ্ঠুর ভাষণে বেদনাহত তার চোখ দেখে আমি বাইরে যতটা শক্ত থাকলাম, ভিতরে ঠিক ততটাই দুর্বল হয়ে পড়লাম! কিন্তু ভুল করার সাধ্য আমার ছিল না, জানতাম- ভালবাসাটা যেহেতু আমার 'আমি'র জন্যে নয়, তার নিজের জন্য; তাই এই দুঃখটাও দীর্ঘস্থায়ী নয়! কাল সকালেই সে হয় তো তার ঝুলি কাঁধে বেরিয়ে পড়বে নতুন ছাত্রীর সন্ধানে, এমন তো নয় যে সেই স্কুলে পড়া শেখানোর জন্যে শুধু তার আমাকেই লাগবে! কোন উদ্যমী আগ্রহী ভালবাসা'র জন্যে ব্যাকুল কোন ছাত্রী হয় তো অপেক্ষা করছে দুনিয়ার কোন এক কোণে, হয় তো খুব কাছেই!
***
সে চলে গেল!
ভালবাসার ঝুলিতে ফের ভালবাসা'র বইগুলো পুরে সে চলে গেল!
কিন্তু জানতেও পারল না- সেই কলসের ঘর্ষণে শান বাঁধানো ঘাটের পাথর ক্ষয়ে যাওয়ার গল্পের মতো আমার মনের দরজায় তার বারেবারে করা মৃদু কড়াঘাতও একসময় ফাঁক তৈরী করে ফেলবে! পক্ষপাতহীনতার গল্পে মত্ত আমাকে সে তার নিজের অজান্তে পক্ষপাতিত্বের শিক্ষা দিয়ে গেল যে- আমার মনের ভালবাসার স্কুলে ভর্তির জন্যে নিরপেক্ষ ভর্তি পরীক্ষার মাধ্যমে ভালো যোগ্য সব প্রার্থী থেকে সব চেয়ে উপযুক্ত জনকে বেছে না নিয়ে তাকেই একমাত্র ছাত্র হিসেবে পেতে চাইছে! মিথ্যে আশা করে মন আমার ভাবছে- আমি যেমন আছে ঠিক এমন 'আমি'টাকে পাওয়ার জন্য সে ফিরে আসবে, এই বেয়াড়া অমনোযোগী ছাত্রীটিকেই সে শুধু তার স্কুলে ভালবাসার পাঠ দিতে চায়, আর কাউকেই নয়......
***
এর অনেক অনে-ক দিন পর...
তার সাথে আবার আমার দেখা, সেই একই জায়গা...
আমি-ই নীরবতা ভাংগলাম, "তা মহাশয়, কটা প্রেম করলেন এই ক'বছরে?"
সেই একই আহত দৃষ্টি নিয়ে সে আবার তাকাল আমার দিকে! একই রকম আছে সে, আমিও বোধ হয় বদলাই নি খুব একটা! শুধু তাকে খুব ক্লান্ত দেখাচ্ছিল, মুখ-ভর্তি দাড়ি-গোঁফের জঙ্গল...হঠাত করেই আমার বুকটা হু হু করে উঠল, "দেখি তো জ্বর এল কি না তোমার" বলে তার কপালে হাত রাখতেই দেখি সে হাসি হাসি মুখে তাকিয়ে আছে! মুখ ফসকে অমন করে তুমি বলে ফেলার লজ্জা ঢাকার জন্যেই যেন খুব কঠিন মুখ করে তাকে বললাম- "আর কোনদিন কোন মেয়ের দিকে চোখ তুলে তাকালে এক্কেবারে চোখ গেলে দেব, কানা চোখ আরো কানা বানিয়ে দেব!"
আমার এহেন ঝাড়ি খেয়েও দেখি সে হাসি হাসি মুখ করে তাকিয়ে আছে, তার চোখের কোণে মুক্তোর মতো ওটা কি?- অশ্রু? কী আজব, এই বয়স্ক লোকটা এখন মেয়েদের মতো ফ্যাচড় ফ্যাচড় করে কাঁদবে না কি!...
আমি মোহাবিস্ট হয়ে সেই জলে ভেজা ঝাপসা চোখের দিকে তাকিয়ে রইলাম......
[অনেকেই 'একা' এবং 'নিঃসঙ্গ' শব্দ দুটোর মধ্যে পার্থক্য করতে পারে না, গুলিয়ে ফেলে। আমি প্রথম গোত্রীয়, সংগীর জন্য আমার আকাংক্ষা নেই, নিজের একা থাকা ব্যাপারটা নিয়ে আমি খুব অবসেসড, বলা যায় আমি Loner কিন্তু Lonely না! ভালবাসা বা পিছুটান থেকে নিজেকে দূরে সরিয়েই রাখার চেষ্টা করি, কিন্তু অদ্ভুতভাবে খুব সৌভাগ্য আমার যে মানুষ বিপুল ভালবাসা দিয়ে আমাকে ভরিয়ে রাখে সব সময়। এই ভালবাসা'কেও আমার মনে হয় দু'ধরনের...কিছু ভালবাসা বা বন্ধুত্বের জন্ম হয় খুব ধীরে, তার শিকড় ছড়িয়ে যায় খুব গভীরে আর কিছু ভালবাসা আসে বানের জলের মতো, তার আবেগের স্রোতে ভাসিয়ে নিয়ে যায়- দ্বিতীয় ভালবাসা মাঝে মাঝে খূব ক্ষণস্থায়ী হয়,পলি ছাড়া ভালবাসার আর কিছুই অবশিষ্ট থাকে না! প্লাবনের মতো আসা ভালবাসায় আমি ভেসে যাই না, আমার নিজের একটা খুব গভীর শক্ত শেকড় আছে যা থেকে উপড়ানো বেশ ধৈর্য আর সময়ের ব্যাপার... ছোট্ট মুন আমার কাছে অনেক আবেগ নিয়ে আসে, ওর ভালবাসার একটা ভাসিয়ে নেয়া ব্যাপার আছে কিন্তু আমি বিশ্বাস করি- তার শেকড় ধীরে ধীরে গড়ে ওঠা বন্ধুত্বের চেয়ে একটুও দুর্বল নয়, তার intensity বা গভীরতার উঠা-নামা হয় না উজানের পানির মতো!আমার লেখা 'সে এবং আমি'ময় নামক সেই গাজাখুরি ভালবাসার গল্পের ভীষণ ভক্ত আমাকে খুব করে বলে আরো এমন লেখা লিখতে! রোমান্টিকতা আমার আসে না, তবুও মুনের জন্যে একটা রোমান্টিক ধাঁচের আবেগী গল্প লেখার ব্যাপক প্রয়াস থেকে এই লেখার জন্ম! নামকরণও তাই আগের গল্পের সূত্র ধরেই... ]
সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই জানুয়ারি, ২০১৩ রাত ১:০৮