কথোপকথন - ১
কথোপকথন --৪
- যে কোন একটা ফুলের নাম বল
- দুঃখ ।
- যে কোন একটা নদীর নাম বল
- বেদনা ।
- যে কোন একটা গাছের নাম বল
- দীর্ঘশ্বাস ।
- যে কোন একটা নক্ষত্রের নাম বল
- অশ্রু ।
- এবার আমি তোমার ভবিষ্যত বলে দিতে পারি ।
- বলো ।
- খুব সুখী হবে জীবনে ।
শ্বেত পাথরে পা ।
সোনার পালঙ্কে গা ।
এগুতে সাতমহল
পিছোতে সাতমহল ।
ঝর্ণার জলে স্নান
ফোয়ারার জলে কুলকুচি ।
তুমি বলবে, সাজবো ।
বাগানে মালিণীরা গাঁথবে মালা
ঘরে দাসিরা বাটবে চন্দন ।
তুমি বলবে, ঘুমবো ।
অমনি গাছে গাছে পাখোয়াজ তানপুরা,
অমনি জোৎস্নার ভিতরে এক লক্ষ নর্তকী ।
সুখের নাগর দোলায় এইভাবে অনেকদিন ।
তারপর
বুকের ডান পাঁজরে গর্ত খুঁড়ে খুঁড়ে
রক্তের রাঙ্গা মাটির পথে সুড়ঙ্গ কেটে কেটে
একটা সাপ
পায়ে বালুচরীর নকশা
নদীর বুকে ঝুঁকে-পড়া লাল গোধূলি তার চোখ
বিয়েবাড়ির ব্যাকুল নহবত তার হাসি,
দাঁতে মুক্তোর দানার মত বিষ,
পাকে পাকে জড়িয়ে ধরবে তোমাকে
যেন বটের শিকড়
মাটিকে ভেদ করে যার আলিঙ্গন ।
ধীরে ধীরে তোমার সমস্ত হাসির রং হলুদ
ধীরে ধীরে তোমার সমস্ত গয়নায় শ্যাওলা
ধীরে ধীরে তোমার মখমল বিছানা
ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টিতে, ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টিতে সাদা ।
- সেই সাপটা বুঝি তুমি ?
- না ।
- তবে ?
- স্মৃতি ।
বাসর ঘরে ঢুকার সময় যাকে ফেলে এসেছিলে
পোড়া ধুপের পাশে ।
কথোপকথন - ১১
-- তুমি আজকাল বড্ড সিগারেট খাচ্ছ শুভন্কর।
-- এখুনি ছুঁড়ে ফেলে দিচ্ছি...
কিন্তু তার বদলে??
--বড্ড হ্যাংলা। যেন খাওনি কখনো?
-- খেয়েছি।
কিন্তু আমার খিদের কাছে সে সব নস্যি।
কলকাতাকে এক খাবলায় চিবিয়ে খেতে পারি আমি,
আকাশটাকে ওমলেটের মতো চিরে চিরে,
নক্ষত্রগুলোকে চিনেবাদামের মতো টুকটাক করে,
পাহাড়গুলোকে পাঁপর ভাজার মতো মড়মড়িয়ে,
আর গঙ্গা?
সে তো এক গ্লাস সরবত।
--থাক। খুব বীরপুরুষ।
--সত্যি তাই...
পৃথিবীর কাছে আমি এই রকমই ভয়ন্কর বিস্ফোরণ।
কেবল তোমার কাছে এলেই দুধের বালক,
কেবল তোমার কাছে এলেই ফুটপাতের নুলো ভিখারি,
এক পয়সা, আধ পয়সা কিংবা এক টুকরো পাউরুটির বেশী আর কিছু চিনিয়ে নিতে পারিনা।
--মিথ্যুক..।
--কেন?
--সেদিন আমার সর্বাঙ্গের শাড়ি ধরে টান মারনি?
-- হতে পারে।
ভিখারিদের কি ডাকাত হতে ইচ্ছে করবে না একদিনও??
কথোপকথন - ২১
-তোমাদের ওখানে এখন লোডশেডিং কি রকম?
-বোলো না। দিন নেই, রাত নেই, জ্বালিয়ে মারছে।
-তুমি তখন কী করো?
-দরজা খুলে দিই
জানালা খুলে দিই
র্প দা খুলে দিই।
আজকাল হাওয়াও হয়েছে তেমনি ফন্দিবাজ ।
যেমনি অন্ধকার, অমনি মানুষের ত্রিসীমানা ছেড়ে দৌড়
-তুমি তখন কি করো?
-গায়ে জামা-কাপড় রাখতে পারি না।
সব খুলে দিই,
চোখের চশমা, চুলের বিনুনি, বুকের আঁচল লাজ-লজ্জ্বা সব ।
-টাকা থাকলে তোমার নামে ঘাট বাঁধিয়ে দিতুম কাশী মিত্তিরে
এমন তোমার উথাল - পাতল দয়া।
তুমি অন্ধকারকে সর্ বস্ব, সব অগি্নস্ফুলিঙ্গ খুলে দিত পার কত সহজে।
আর শুভঙ্কর মেঘের মত একটু ঝুঁকলেই
কি হচ্ছে কি?
শুভঙ্কর তার খিদে- তেষ্টার ডালপালা নাড়লেই
কি হচ্ছে কি ?
শুভঙ্কর রোদে - পোড়া হরিণের জিভ নাড়লেই
কি হচ্ছে কি?
পরের জন্মে দশদিগন্তের অন্ধকার হব আমি।
স্মৃতি বড় উচ্ছৃঙ্খল
পুরনো পকেট থেকে উঠে এল কবেকার শুকনো গোলাপ |
কবেকার ? কার দেওয়া ? কোন্ মাসে ? বসন্তে না শীতে ?
গোলাপের মৃতদেহে তার পাঠযোগ্য স্মৃতিচিহ্ন নেই |
স্মৃতি কি আমারও আছে ? স্মৃতি কি গুছিয়ে রাখা আছে
বইয়ের তাকের মত, লং প্লেইং রেকর্ড-ক্যাসেটে
যে-রকম সুসংবদ্ধ নথীভুক্ত থাকে গান, আলাপচারীতা ?
আমার স্মৃতিরা বড় উচ্ছৃঙ্খল, দমকা হাওয়া যেন
লুকোচুরি, ভাঙাভাঙি, ওলোটপালটে মহাখুশি
দুঃখেরও দুপুরে গায়, গাইতে পারে, আনন্দ-ভৈরবী |
আকাঙ্খার ডানাগুলি মিশে গেছে আকাশের অভ্রে ও আবীরে
আগুনের দিনগুলি মিশে গেছে সদ্যজাত ঘাসের সবুজে
প্রিয়তম মুখগুলি মিশে গেছে সমুদ্রের ভিতরের নীলে |
স্মৃতি বড় উচ্ছৃঙ্খল, দুহাজার বছরেও সব মনে রাখে
ব্যাধের মতন জানে অরণ্যের আদ্যোপান্ত মূর্তি ও মর্মর |
অথচ কাল বা পরশু কে ডেকে গোলাপ দিল কিছুতে বলবে না |
ফটিক টিং
দেখতে মানুষ চামড়াধারী
নাকের ফুটো, দাঁতের মাড়ি,
কিন্তু বাপু হঠাত্ কেন মাথায় দুটো লম্বা শিং ?
— আজ্ঞে আমি ফটিক টিং ।
শিং দিয়ে কি গুঁতোও নাকি ?
মেজাজ বুঝি আগুন খাকি ?
কিন্তু বাপু পানে সঙ্গে গিলছ কেন খাবলা হিং ?
— আজ্ঞে আমি ফটিক টিং ।
বেশ তো দেখি হাসতে পারো
যক্ষা কাশি কাশতে পারো
কিন্তু বাপু লেখার সময় লিখছ কেন পিঁপড়ে ডিম ?
— আজ্ঞে আমি ফটিক টিং ।
লিখছ লেখ ভাবনাটা কই ?
চাইছ মুড়কি হচ্ছে যে খই,
কিন্তু বাপু বেচবে কাকে তোমার এসব ইড়িং বিং?
— আজ্ঞে আমি ফটিক টিং ।
বৃক্ষের ভাগ্যকে ঈর্ষা করি
বৃক্ষের ভাগ্যকে ঈর্ষা করি।
নিজের বেদনা থেকে নিজেই ফোটায় পুস্পদল।
নিজের কস্তুরী গন্ধে নিজেই বিহ্বল।
বিদীর্ণ বল্কলে বাজে বসন্তের বাঁশরী বারংবার
আত্মজ কুসুমগুলি সহস্র চুম্বনচিহ্নে অলংকৃত করে ওষ্ঠতল।
আমি একা ফুটিতে পারি না।
আমি একা ফোটাতে পারি না।
রক্তের বিষাদ থেকে একটি আরক্তিম কুসুমও।
আমাকে বৃক্ষের ভাগ্য তুমি দিতে পারো।
বহুজন্ম বসন্তের অম্লান মঞ্জুরী ফুটে আছো।
নয়নের পথে দীর্ঘ ছায়াময় বনবীথিতল
ওষ্ঠের পল্লব জুড়ে পুস্প বিচ্ছুরন।
আমাকে বৃক্ষের ভাগ্য তুমি দিতে পারো।
তুমি পারো করতলে তুলে নিতে আমার বিষাদ
ভিক্ষাপাত্র ভরে দিতে পারো তুমি অমর সম্ভারে
সর্বাঙ্গ সাজিয়ে আছো চন্দ্রালোকে, চন্দনের ক্ষেত।
আমার উদগত অশ্রু অভ্যথর্না করে নিতে
পারো না কি তোমার উদ্যানে?
মোহিনীরা স্বভাবে নির্মম।
আর যারা ভালোবাসে
তারা শুধু নিজেদের আত্মার ক্রন্দনে ক্লিষ্ট হয়।
যে টেলিফোন আসার কথা
যে টেলিফোন আসার কথা সে টেলিফোন আসেনি।
প্রতীক্ষাতে প্রতীক্ষাতে
সূর্য ডোবে রক্তপাতে
সব নিভিয়ে একলা আকাশ নিজের শূন্য বিছানাতে।
একান্তে যার হাসির কথা হাসেনি।
যে টেলিফোন আসার কথা আসেনি।
অপেক্ষমান বুকের ভিতর কাঁসরঘন্টা শাখেঁর উলু
একশ বনের বাতাস এসে একটা গাছে হুলুস্থুলু
আজ বুঝি তার ইচ্ছে আছে
ডাকবে আলিঙ্গনের কাছে
দীঘির পাড়ে হারিয়ে যেতে সাঁতার জলের মত্ত নাচে।
এখনো কি ডাকার সাজে সাজেনি?
যে টেলিফোন বাজার কথা বাজেনি।
তৃষ্ণা যেন জলের ফোঁটা বাড়তে বাড়তে বৃষ্টি বাদল
তৃষ্ণা যেন ধূপের কাঠি গন্ধে আঁকে সুখের আদল
খাঁ খাঁ মনের সবটা খালি
মরা নদীর চড়ার বালি
অথচ ঘর দুয়ার জুড়ে তৃষ্ণা বাজায় করতালি
প্রতীক্ষা তাই প্রহরবিহীন
আজীবন ও সর্বজনীন
সরোবর তো সবার বুকেই, পদ্ম কেবল পর্দানশীন
স্বপ্নকে দেয় সর্বশরীর, সমক্ষে সে ভাসে না।
যে টেলিফোন আসার কথা সচরাচর আসে না।
হে স্তন্যদায়িনী
তোমার দুধের মধ্যে এত জল কেন ?
তোমার দুধের মধ্যে এত ঘন বিশৃঙ্খলা কেন ?
রক্ত ঝরে না ভেজালে
কোনো সুখ দরজা খোলে না ।
ময়ূরও নাচে না তাকে দু-নম্বরী সেলামী না দিলে ।
হাতুড়ির ঘায়ে না ফাটালে
রাজার ভাঁড়ার থেকে এক মুঠু খুদ খেতে
পায় না চড়ুই ।
স্বপ্নে যারা পেয়ে গেছে সচেতন ফাউন্টেন পেন
তাদেরও কলমে দেখ
সূর্য কীরণের মত কোনো কালি নেই ।
হে স্তন্যদায়িনী
তোমার দুধের মধ্যে এত জল কেন ?
তোমার দুধের মধ্যে প্রতিশ্রুত ভাস্কর্যের পাথর কেবল ।
তোমার চোখে জল কেন?
ভালবেসেছি বলে।
তোমার চোখে নেই?
শুকিয়ে গেছে।
তারপর, কি করলে এতদিন?
কাঁদলাম। তুমি?
লেখালেখি।
কবিতা? কই শুনাও।
শুনবে? তবে বলি-
'আমি যেন আর আমি নেই,
ভোর হয় আগের মতই
শুধু আমি জেগে থাকি'
কেন?
তোমাকে না কতবার রাত জাগতে বারণ করেছি।
অমাবশ্যার খেয়ালি চাঁদ, আমাকে
জাগিয়ে রাখে সারারাত।
তোমাকে ও কি তাই?
জানিনা,
তবে, আমি হারিয়ে ফেলেছি নিজেকে
তুমি ও কি তাই?
আমি বিলীন হয়ে গেছি।
কবে?
বুঝতে পারিনি,
শুধু বুঝেছে আমার ঘুমহীন দু'চোখ, আর
জেগে থাকা ঐ পাখিটা,
সাথিহারা বেদনায় যে
ক্ষণে ক্ষণে কেঁদে উঠে।
তাই? আমার সময় কাটে অস্তিরতায়।
কেন?
বুকের প্রতিটি স্পন্দন,
ভালবাসি ভালবাসি বলে চেঁচায়।
তোমার ও কি তাই?
আমি মরি নিদারুণ ঘোরে,
মনের অজান্তে ভালবেসেছি যারে,
হৃদয় পুড়ে প্রত্যহ তার তরে।
ভালবেসেছ তবে,
জানতে পেরেছ কবে?
আমি জানিনে,
শুধু জানে আমার
শুকিয়ে যাওয়া হৃদয়,
যেখানে ক্ষণে ক্ষণে আর্তি বেরোয়।
রহস্যময় স্বভাব তোমার,
একি তবে সত্য, নাকি ভেবে নেব
এও তোমার নিছক খেলা?
আমার বলার নেই কিছুই,
শুধু বলব,
জোনাকী'দের কাছে জেনে নিও
প্রতিটি সন্ধ্যেবেলা।।
উৎসর্গ: রাতের বৃষ্টির শব্দ
পুনশ্চঃ অসাবধানতা বশতঃ পূর্ণেন্দু পত্রীর কথোপকথন ১ কবিতাটির স্থলে ওয়েবে পাওয়া ব্লগার ঝরা পাতার কথোপকথন ১ কবিতাটা দিয়েছিলাম । ভুলটা শুধরানো হয়েছে । এই ভুলের জন্য সত্যি দুঃখিত । আসলে কবিতার শিরোনাম থেকে শুরু করে লেখার পুরো ঢংটাই পূর্ণেন্দু পত্রীর মতোন । সেজন্যই বিভ্রান্ত হয়েছিলাম । প্রিয় কবি পূর্ণেন্দু পত্রীর ভক্তদের কাছে করজোড়ে ক্ষমা প্রার্থনা করছি ।