যতক্ষণ পর্যন্ত না পর্যাপ্ত প্রমাণ বা তথ্যাদি আমাদের কাছে না আসছে ততদিন পর্যন্ত আমাদের নির্ভর করতে হবে জেনেটিক্সের উপর। এখন পর্যন্ত প্রমাণিত বাংলায় প্রথম মানুষের বিচরণ ছিল ২০,০০০ বছর আগে (সূত্র- দ্য টেলিগ্রাফ)। তবে ‘আউট অব আফ্রিকা’ মডেল থেকে ধারণা করা হয় ভারতীয় উপমহাদেশে প্রথম মানুষ এসেছিল ৭০,০০০ থেকে ৫০,০০০ বছর পূর্বে। যদিও প্রত্মতাত্বিক প্রমাণে তা ৩০,০০০ বছরে এখনো আবদ্ধ।
আদিম মানুষ কত বছর আগে একটা ভূখন্ডে বিচরণ করেছিল এ ধারণা পাল্টে দিতে পারে একটি পাথর খন্ড অথবা একটি কঙ্কাল এমনকি কয়েকটি দাঁত। সম্প্রতি চীনে কয়েকটি দাঁত পাওয়া গেছে, যার বয়স প্রায় ৮০,০০০-১,২০,০০০ বছর। এই দাঁতগুলোই এখন আউট অব আফ্রিকা মডেলকে পাল্টে দিচ্ছে। আগে ধারণা করা হত আফ্রিকা থেকে আদিম মানুষেরা বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়া শুরু করে ৭০,০০০ থেকে ৫০,০০০ বছর পূর্বে। এখন এ ধারণা পাল্টে বলা হচ্ছে হয়তো আফ্রিকা থেকে আদিম মানুষেরা বের হয়েছিল ১,০০,০০০ বছর আগে।
এখানে একটি ম্যাপ সংযোজন করেছি যেটি আদিম পৃথিবীর মানুষের ছড়িয়ে পড়ার গতিবিধি দেওয়া আছে ডিএনএ টেস্টের উপর ভিত্তি করে। এটা মুটামুটি নিশ্চিত ধারণা করা যায় যে পৃথিবীতে প্রথম মানুষেরা বসবাস করত আফ্রিকায়। সেখানে Homo sapiens বা আধুনিক মানুষেরা বসবাস করত ২,০০,০০০ বছর আগে। Homo sapiens-দের পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ার আগে পৃথিবীতে Homo erectus বা শিম্পাঞ্জীর মত দেখতে মানুষেরা বসবাস করত। এরা ৭০,০০০ বছর আগেও পৃথিবীতে ছিল বলে ধারণা করা হয়। জাভা মানব সবচেয়ে প্রাচীন Homo erectus। এরা বিচার বুদ্ধিতে কখনোই আধুনিক মানুষদের মত ছিল না।
যাই হোক ডিএনএ টেস্টের মাধ্যমে আদি মানুষেরা কত বছর আগে কোথাও বিচরণ করেছে তা নির্ধারণে হ্যাপলোগ্রুপ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এই হ্যাপলোগ্রুপের আবার নানান ভাগ আছে। মূলত এই হ্যাপলোগ্রুপ দিয়েই ধারণা করা হয় ভারতে ৭০,০০০-৫০,০০০ বছর আগে মানুষের বিচরণ ছিল। বাংলায় মানুষ এসেছিল তারও পরে। এসব হ্যাপলোগ্রুপের ভিতর বাংলাদেশের মানুষের ভিতর খুঁজে পাওয়া যায় ওয়াই হ্যাপ টি (Y hap T) এবং এম টু এ (M2a)। ডিএনএ টেস্টে সবসময় Y ক্রমোজোমের এবং মাইট্রোকন্ড্রিয়ার ডিএনএ নেওয়া হয়ে থাকে। অনেকে মনে করতে পারেন X ক্রমোজোম কেনো নেওয়া হয় না। এর পিছনে বিস্তর যুক্তি বিদ্যমান। মাইট্রোকন্ড্রিয়ার ডিএনএ সাধারণত পরিবর্তিত হয় না। আর Y ক্রমোজোম শুধু পুরুষদের থাকে যার ভিতর মাত্র ৫ ভাগ পরিবর্তিত হয় বাকী ৯৫ ভাগ অপরিবর্তিত থাকে।
এখন আমাদের জানতে হবে এই M2a-ধারী মানুষেরা কত বছর আগে পৃথিবীতে বিচরণ করেছে। বাংলার প্রাচীন ইতিহাস সম্পর্কে জানতে গেলে সবচেয়ে বড় সমস্যাটা হল বেশিরভাগ সময় তা ভারতের সাথে মিশে গেছে ভূতের মত। এ কারণে বাংলার শেকড় অন্বেষণ করা কঠিন কাজ। তবে M2a-এর ক্ষেত্রে এমনটি হয় নি। স্পষ্টরূপে তথ্য পেলাম যে M2a এর প্রভাব বাংলাদেশে বিদ্যমান (M2a – most common in Bangladesh-Wikipedia-Article-Haplo Group M)। এই M2a-রা পৃথিবীতে বিচরণ করেছে ৪০,০০০-৫০,০০০ বছর আগে।
এবার আসা যাক Y hap T –তে। আসলে Y hap T পৃথিবীতে এখনো প্রকট প্রভাব বজায় রেখে চলেছে। এরা আছে ইথিওপিয়াতে যেখানে পৃথিবীর সবচেয়ে প্রাচীন মানুষের হাড়গোড় পাওয়া গেছে যা ১,৬৫,০০০ বছর আগের। এরা আছে ওমানে, এরা আছে ইউরোপের উপকূলীয় বিভিন্ন দেশে। আর ভাগ্য ভাল এই Y hap T-এর কিছু ডিএনএ নমুনার তথ্য খুঁজে পাওয়া যায়, যা থেকে স্পষ্ট হওয়া যায় Y hap T বাংলায় একসময় প্রভাব বিস্তার করে রেখেছিল। পশ্চিমবঙ্গের বাউরি উপজাতিতে Y hap T-এর প্রভাব প্রকটরূপে দেখা যায় এবং এদের ভাষাও বাংলা। এছাড়া পশ্চিমবঙ্গের মাহেলি উপজাতি যাদের ডিএনএ-তেও Y hap T পাওয়া গেছে। আর এই Y hap T-এর বয়স ৩৯,৩০০-৪৫,১০০ বছর (সূত্র-Wikipedia- Haplo group T-M184)।
এই গেল ডিএনএ বিশ্লেষণ। এবার আসা যাক অন্য বিষয়ে। বাংলার আদি অধিবাসী হিসেবে একরকম নিশ্চিতভাবে ধরা হয় আদি-অস্ট্রেলীয়দেরকে (আদিঅস্ত্রাল)। এর অর্থ বাংলায় প্রথম যারা এসেছিল তারা ছিল অস্ট্রিকভাষী। অষ্ট্রিকভাষী ওই মানুষগুলো দেখতে ছিল কালো, বেঁটে, চুল কোঁকড়া।
তাহলে কী আফ্রিকার বাইরে অস্ট্রেলিয়ায় আদি মানব ছিল? তা না হলে বাংলায় আদি মানব অস্ট্রেলিয়া থেকে আসল কীভাবে? না, তা একদম নয়। ধারণা করা হয় ৪৬,০০০ বছর আগে আফ্রিকার মানুষেরা পায়ে হেঁটে অস্ট্রেলিয়া গিয়েছিল এবং সেই আদি অস্ট্রেলিয়ার মানুষেরা পরবর্তীতে বাংলায় আসে। বাংলায় আসে এটা নিয়ে কোন সমস্যা নেই, তবে তারা কীভাবে এসেছিল? পায়ে হেঁটে নাকি কোন জলযানে? এটা নিয়ে বিতর্ক আছে। কারো কারো মতে সে সময় অতি সাধারণ জলযান তৈরির মত জ্ঞানও মানুষের ছিল না। তবে অনেকে মনে করেন সেসময় অতি সাধারণ জলযান তৈরির ক্ষমতা হয়তো সবার ছিল না তবে Y hap T ডিএনএ-ধারীদের ছিল। এর পিছনে উপযুক্ত যুক্তিও বিদ্যমান। কেননা Y hap T গ্রুপের বিস্তৃতি লক্ষ করলে দেখা যায় এদের বিস্তার ঘটেছে উপকূলবর্তী দেশসমূহে। ধারণা করা হয় সে সময় সমুদ্রের উচ্চতা অনেক কম ছিল এবং সমুদ্র এতটা উত্তাল ছিল না। সুতরাং অতি সাধারণ জলযান দিয়েও তখন সাগর পাড়ি দেওয়া সম্ভব ছিল। আর Y hap T যে বঙ্গোপসাগরের উপকূল ধরে পরবর্তীতে ভারতে ছড়িয়ে পড়ে এটা অনেক যুক্তিযুক্ত।(সূত্র-https://anthropology.net/2010/01/29/the-great-southern-migration-theory-some-thoughts-on-y-hap-t-and-boating-technology-by-terry-toohill/)
সুতরাং ডিএনএ নমুনা এবং আউট অব আফ্রিকা মডেল অনুযায়ী এটা অনুমান করে নেওয়া যায় প্রাচীন বাংলায় বা বাংলাদেশে প্রথম Homo sapiens বা মানুষের পদচিহ্ন পড়েছিল প্রায় ৪০,০০০ বছর পূর্বে।
সর্বশেষ এডিট : ৩১ শে মে, ২০১৬ সকাল ৯:০০