ভারতচন্দ্ররায় গুনাকর সেই মধ্যযুগে এক চরিত্রের মাধ্যমে প্রার্থনা করেছিলেন, 'আমার সন্তান যেন থাকে দুধে-ভাতে।'
মধ্যযুগের অন্যতম শ্রেষ্ট এই কবির প্রার্থনা কোনদিন পূর্ণ হয়েছিল কিনা জানা নেই। বাঙালী দুধে-ভাতে দিন যাপন করেছিল কিনা অত গভীর ইতিহাস না জানা থাকলেও এটা জানা আছে, ভারতচন্দ্রের প্রার্থনার পরও দুর্ভিক্ষে বাংলার লাখ লাখ মানুষ মারা গিয়েছিল।
মোদ্দাকথা হচ্ছে, 'দুধে-ভাতে বাঙালী' কিংবা 'মাছে-ভাতে বাঙালী' চিরদিন বলে আসা হয়েছে ধনাঢ্যদের আধিপত্যের কারণে। বাঙালীর যে বৃহৎ অংশ 'ডালে-ভাতে বাঙালী' কিংবা 'পান্তা-মরিচে বাঙালী' একথা বেমালুম ভুলে গেছে সবাই। বাঙালীর সংস্কৃতি এভাবেই ধনাঢ্যদের মুষ্টির বস্তু। তবে এখন বুঝি সময় এসেছে সার্বজনীনভাবে ভাবার। কেননা, আধুনিক মানুষেরা অধিক উদার।
পহেলা বৈশাখে যে 'পান্তা-ইলিশ' সংস্কৃতি নিয়ে বিতর্ক চলছে তা অত্যন্ত সমীচীন। এই বিষয় নিয়ে আলোচনা হওয়া দোষের নয়। সার্বজনীন উৎসব হিসেবে পরিচিত 'বাংলা নববর্ষে' এমন কিছু উদ্ভট সংস্কৃতি চালু করা উচিৎ নয় যা সার্বজনীন নয়। ইলিশ হয়তো একসময় বাংলার সাধারণ মানুষের ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে ছিল, সে সময় ইলিশের প্রাচুর্যও ছিল। তবে এখনকার দিনের ইলিশ আর সাধারণের খাবার নয়। ইলিশ এখন শোভা পায় বড়লোকের খাবার টেবিলে। গরীবের কানা থালায় ইলিশের স্থান নেই।
পহেলা বৈশাখের মত সার্বজনীন উৎসবের এই দিনে বাংলার ক্ষুদ্র অংশ পান্তা-ইলিশের মজা লুটবে আর বৃহৎ অংশ পান্তা-মরিচ খেয়ে আফসোসে ভুগবে তা কাম্য নয়। হয় সবাইকে ইলিশ দাও নয়তো ইলিশের এই সংস্কৃতি ছাড়ো।
এ তো গেল একদিকের কথা, অন্যদিকের কথা হলো, পহেলা বৈশাখ এমন একটি সময়ে হয়ে থাকে যে সময়টা ইলিশ ধরার জন্য উপযুক্ত সময় নয়। এর ফলে ইলিশের উৎপাদন কমে যাচ্ছে। এমনকি এই অপসংস্কৃতি চলতে থাকলে ভবিষ্যতে বাংলা ইলিশ শূন্য হতে পারে। এসব কথা মাথায় রেখে যে বাঙালী পহেলা বৈশাখের ইলিশ সংস্কৃতি ছেড়ে দেবে তা ভাবা সম্ভব নয়।
এর জন্য আমার মনে হয় বিকল্প একটি প্রস্তাবনা আনা যেতে পারে। যার ফলে, বাংলার ইলিশও রক্ষা পাবে, বাঙালীর ইলিশ ভোজনেরও উপলক্ষ হবে। সেটা হলো, যেহেতু আষাঢ়-শ্রাবণ-ভাদ্র ইলিশ আহরণের উপযুক্ত সময় সেহেতু এই সময়ের কোন সাত দিন বা একদিন (শ্রাবণ মাসের প্রথম সাত দিন/পহেলা শ্রাবণ) 'ইলিশ উৎসব' হিসেবে পালন করা হোক।
সাত দিনের কথা একারণে বলছি, কেননা এই উৎসব একদিন হলে ইলিশ নিয়ে অসাধু ব্যবসায়ীদের দৌরাত্ম বেশি থাকবে। সুবিধের কথা হলো, এই সময়ে ইলিশ আহরণে নিষেধাজ্ঞা না থাকায় জেলেরা ইচ্ছে মত ইলিশ ধরতে পারবে। ইলিশের এই ভরা মৌসুমে ইলিশের দাম কিছুটা হলেও কম থাকার সম্ভাবনা থাকে। এই উৎসবের প্রচলন করলে একদিকে যেমন পহেলা বৈশাখ থেকে ইলিশ উৎসব পৃথক হবে, তেমনি আমরা আরেকটি বাংলা মাসকে সংস্কৃতির সাথে যুক্ত করতে পারব। এছাড়া বাংলার ছোট ইলিশ বৈশাখ মাসে মুক্তি পাবে অসাধু ব্যবসায়ীদের চক্রান্ত থেকে।
সর্বশেষ এডিট : ১০ ই এপ্রিল, ২০১৬ রাত ৯:৪৫