১
‘দিদি, কথা ছিল তুমি রমনা পার্কে আসবে, তবে তুমি আসলে না। তুমি আমার হাত ধরে হাঁটলে না। জানো দিদি, আমি রমনা পার্কে গিয়েছিলাম। একা একা বসেছিলাম, কত রমণী আমার সামনে দিয়ে চলে গেল তবু আমার কাউকে ভালো লাগে নি। তুমি তো জানো দিদি আমি শুধু তোমাকেই ভালোবাসি। আমার যে তুমি ছাড়া আর কেউ নেই। দিদি, তুমি জানো না তোমার যেদিন বিয়ে হয়েছিল, আমি কী করেছিলাম। কেন তুমি আমাকে ছাড়লে দিদি?’, আয়নার সামনে এভাবেই প্রলাপ বকতে থাকে সৌমিক দা।
সৌমিক দা-কে কেন তার দিদি ছেড়ে গেল তা সবাই জানে তবে সৌমিক দা আজো জানে না। কি হয়েছিল সৌমিক দা আর তার দিদির মধ্যে? অথচ এই সৌমিক দা আর দিদির ভিতর ছিল গলায় গলায় ভাব। একজন একজনকে ছাড়া থাকতেই পারত না। ক্যাম্পাসে, ক্যান্টিনে, ক্লাসে এবং পানির গ্লাসে তারা ছিল যেন অবিচ্ছেদ্য। যেখানে সৌমিক দা, সেখানেই তার দিদি। দিদির হাত ধরে সৌমিক দা রমনা পার্ক, সোহরাইয়ার্দী উদ্যান, সিনে প্লেক্স কিংবা চন্দ্রিমাতে কত যে ঘুরেছে তার হিসেব নেই। মাঝে মাঝে তারা ঘুরতে চলে যেত ঢাকার বাইরে। সেখানে তারা এক রুমে থাকত, এক বিছানায় ঘুমাত, অথচ তাদের বন্ধু মহলের কেউ কখনো টু শব্দটি করে নি। দিদি যে তার রক্তের কেউ ছিল তা নয় অথবা তার চেয়ে বয়সে অনেক বড় ছিল তাও নয়। দিদি ছিল তার সমবয়সী। তাদের সম্পর্ক ঠিক কী পর্যায়ে পৌঁছেছিল তা ততদিনে কেউ আঁচ করতে পারে নি। যদি কেউ আঁচ করতে পারত তাহলে যে তা সমাজময় হত এটা নিশ্চিত।
এরপর হঠাৎ করেই সৌমিক দা আর দিদির সম্পর্কে টানা-পোড়ন শুরু হল। শেষমেশ তাদের ভিতর সামান্য কথা বলাও বন্ধ হয়ে গেল। এই সম্পর্কের বিচ্ছেদ অতি সাধারণ ছিল না। বিচ্ছেদের পরেই তা প্রকাশিত হল। সোমিক দা পাগলের মত প্রলাপ বকতে শুরু করে দিল। বন্ধুমহলের এর কাছে ওর কাছে গিয়ে সৌমিক দা বলতে লাগল, ‘তোরা আমাকে বাঁচা। দিদিকে ছাড়া আমি বাঁচব না।’
বন্ধুমহল প্রথমে কিছুই টের পায় নি, তারা ভাবল, সৌমিক দা আর দিদির বন্ধুত্বের বিচ্ছেদে সোমিক দা খাপছাড়া হয়ে গেছে। তা ভাবারও কারণ ছিল। কেননা ক্লাসে তাদের মত বন্ধুত্ব যে আর কারো ছিল না। কেউ কেউ তাদের বন্ধুত্ব দেখে হিংসেও করত।
ব্যাপারটা ওরকম ছিল না। খুব দ্রুতই সব প্রকাশিত হল। সবাই জেনে গেল, সৌমিক দা দিদিকে ভালোবাসে।
এই চরম সত্য জেনে বন্ধুমহল কেঁপে উঠলো। তারা সৌমিক দার দিকে আড় চোখে তাকাতে লাগলো আর গোপনে প্রচার করতে লাগল, ‘এর সাথে না, ওর সাথে না, শেষ পর্যন্ত দিদির সাথে। এ কি মানা যায়।’ এভাবেই বিষয়টা সমাজময় হল। দিদি তো লজ্জায় মুখ দেখাতে পারে না। কেননা, সে জানে গত শীতের সুন্দরবন ট্যুরে যা হয়েছিল তা সমাজময় হয়েছে। দিদি আজ বড্ড আফসোস করে আর ভাবে যা হয়েছে তা শুধু তার ভুলের জন্যই হয়েছে। আজ যত কানাঘুষো সেটা তার বোকামীর ফল ছাড়া কিছু নয়। মাঝে মাঝে দিদি এও ভাবে, নম্র-ভদ্র সৌমিক দার ভিতর যে পশুত্ব লুকিয়ে আছে তা কী তার এ জন্মে জানা ছিল। উপায়োন্তর না দেখে দিদি বন্ধুমহলকে পাশ কাটিয়ে চলতে থাকে, এছাড়া দিদির কিছু করার ছিল না।
২
এতদিন পরে, এতদিন পরে সৌমিক দা দিদিকে পত্র লিখেছে। দিদি পত্রটা পেয়ে বিশ্বাসই করতে পারছিল না। কেননা এ যুগে কেউ এখন পত্র লেখে না। পত্রটা পেয়ে দিদির মন উসখুস করতে লাগল , ‘বেচারা আমার কথা এখনো মনে রেখেছে।’
নানান প্রশ্ন তার মনে দানা বাঁধতে লাগল। সৌমিক দা এখনো কী তাকে আগের মত ভালোবাসে? এখনও কী তাকে ভাবে? নাকি সৌমিক দার পাগলামী ঠিক হয়ে গেছে। সৌমিক দা কী বিয়ে করেছে?
আসলে সৌমিক দার পক্ষে দিদিকে ছাড়া কাউকে ভাবা সম্ভব কিনা তা নিরূপণ করা কঠিন ছিল। তবু পত্রে দিদি যা দেখলো তাতে তো দিদির চোখ ছানাবড়া। সৌমিক দা নাকি ডাক্তারের কাছে গিয়েছিল, এখন সে ভালো হয়ে গেছে, দিদিকে সে এখন আর ভালোবাসে না। তবে শেষবারের মত একবার সৌমিক দা দিদির সাথে দেখা করতে চাই, একবারের জন্য দিদির দু’হাত ধরে ক্ষমা চেতে চায়। সৌমিক দা নাকি তার ভুলের প্রায়শ্চিত্ত করতে চায়। দিদি আজ আর না যেয়ে পারে না, সে যে তাকে অনেক কষ্ট দিয়েছে। কত রাত তার জন্য সৌমিক দা চোখের জল ফেলেছে তা দিদির আজানা নয়। তাই দিদি সিদ্ধান্ত নিয়েছে তার পরিবার ফেলে একটা দিন সে আবার সৌমিক দাকে দেবে। তবে সৌমিক দার মনে কী ছিল তা দিদির জানা ছিল না। সৌমিক দা তখনও দিদিকে আগের মতই ভালবাসত, আগের মতই দিদিকে কাছে পেতে চেত। সে জানে দিদি আজ অন্যের, তবে দিদি তার ছাড়া আর কারো হতে পারবে না। সৌমিক দা সমাজের নিকুচি করে অপেক্ষায় আছে কবে দিদি তার সাথে শেষবারের মত দেখা করতে আসবে আর সে তার মনের সব কথা খুলে বলবে। এই পত্রটি যেন সৌমিক দার অপেক্ষার প্রহর শেষ করতে চললো।
৩
‘এসেছ যখন, বাড়ির দিকে যেতে হবে কিন্তু। আমার হাতের চা না খেয়ে যেতে পারবে না।‘, সৌমিক দার কথায় কোন সন্দেহের গন্ধ খুঁজে পেল না দিদি, এমন নিপুণ অভিনয়টাই করেছিল সৌমিক দা। সৌমিক দা দুহাত জোর করে দিদির কাছে ক্ষমা চেয়েছিল পূর্বের ভুলের জন্য। রমনা পার্কে ঘুরাঘুরির সময় এমনকি দিদির হাতটাও ধরে নি সৌমিক দা। তাই সন্দেহের কোন জায়গা ছিল না। সৌমিক দার আচার-আচরণে তাকে সাধ্যি পুরুষই মনে হয় আজ।
দিদি রাজী হয়ে যায়। এত দিন পর ছেলেটা একটিবারের জন্য ডেকেছে, তার বাড়িতে অন্তত পা রাখা যায়। অথচ খুব শীঘ্রই দিদির সব ধারণা ভুল হতে চলল। সৌমিক দার বাড়িতে পা দেবার পাঁচ মিনিটের মাথায় দিদি বুঝতে পারলো সে বড্ড ভুল করেছে, সৌমিক দার পশুত্ব তখনো যায় নি বরং তা বহুগুণে বেড়েছে। পুরো ঘরময় শুধু দিদির ছবি।
কিছুক্ষণ ধস্তাধস্তির পর দিদি আর পেরে দেয় না সৌমিক দার শক্তির কাছে। দিদিকে চেয়ারে বসিয়ে হাত-পা বেঁধে ফেলে সৌমিক দা। কোথা থেকে একটা চাকু এনে দিদির সামনে ধরে শাসায় আর বলে, ‘বল। তুই আমার হবি। তুই জানিস না তুই ছাড়া আমার কেউ নেই।‘
একটু দম ছেড়ে বলে, ’তুই শুধু আমার সাথে থাকবি, আমার সাথে ঘুরবি, আমার সাথে শুবি। তুই জানিস না এই কটা বছর কত কষ্টে গেছে আমার। আমি ঘুমাতে পারি নি। আর ওদিকে তুই বিয়ে করে বড্ড সুখে আছিস। তোর সুখ আমার সহ্য হয় না। আমাকে দুখী রেখে তুই সুখী থাকবি এ আমি হতে দেব না।’
চাকুটা গলার কাছে এনে দিদির টুঁটি ধরে বলে, ‘বল, তুই আমাকে ভালোবাসিস। বল, না হলে চাকু বসিয়ে দেব গলায়।’
দিদি কিছু বলে না, সে জানে, সে যদি বলে সে সৌমিক দাকে ভালোবাসে তাহলে কী হবে। আর এ কী করে সম্ভব, সে কী করে বলবে। সে বললে যে তার আর সৌমিক দার ভিতর কোন পার্থক্য থাকবে না। সৌমিক দা আরো কিছুক্ষণ ধ্বস্তাধস্তি করে দিদির গলার কাছে চাকুটা ধরে, দিদির চোখ ঝাপসা হয়ে আসে। আচমকা ঘটে যায় ব্যাপারটা, দিদির গলা দিয়ে ফিনকি দিয়ে রক্ত বের হয়ে আসে। তার লোমশ বুকে রক্ত গড়িয়ে পড়ে। দিদির মাংসল বাহুটাও ভিজে যায় রক্তে। গলা কাটা মোরগের মত ছটফট করতে থাকে দিদি। টাই-শার্টেও রক্তের ছোপ। পকেট থেকে বেরিয়ে পড়া সিগারেটে রক্তের বিন্দু লেগে এক নতুন ব্র্যান্ডের সৃষ্টি করেছে যেন। এ দৃশ্য দেখে এক পৈশাচিক আনন্দ পায় সৌমিক দা, পাগলের মত হাসতে থাকে। দিদির খোঁচা-খোঁচা দাড়িতে চাকুটা মুছে নেয় সৌমিক দা।
দিদি যে শুধু সৌমিক দার দিদি, সে আর কারো দিদি নয়।
সর্বশেষ এডিট : ১১ ই নভেম্বর, ২০১৫ সকাল ১১:৩৮