১.

আলেয়া তখন মাধ্যমিকে পড়ে, বয়স সবে ষোল।

বিংশ শতাব্দীর এই শেষ ভাগে শিক্ষা-দীক্ষায় মেয়েরা অনেক এগিয়ে, স্বাধীনতার দিক দিয়েও ছেলেদের ছুঁই ছুঁই। মাঠে-ঘাটে, অফিসে-আদালতে তাদের অবাধ বিচরণ। এ স্বাধীনতা দেখে অতি হুজুরেরা লজ্জায় মুখ ঢাকে। অন্যদিকে প্রগতিশীলরা একে নতুন যুগের সূচনা মনে করে।
আলেয়া ক্লাসে মনযোগী এবং ভালো ছাত্রী। তার বাবা আরমান খান একজন নামী মানুষ, হজ করায় লোকেরা তাঁকে আরমান হাজী বলে ডাকে, অতি পরিচিতরা "হাজী সাহেব" সম্বোধন করে। হাজী সাহেব বেশ ঠাণ্ডা মেজাজের মানুষ। ছোট্ট মফস্বল শহরের বেশীর ভাগ মানুষ তাঁকে এক নামে চেনে। গ্রামে তাঁর আছে বিঘার পর বিঘা জমি, শহরে বাংলো ধাঁচের বাড়ি। শহরের বাড়ির সাথে একটি বড় শান বাঁধা পুকুর আর আম-কাঁঠালের বাগান। দুপুরে আশে-পাশের মেয়ে-মহিলারা গোসলে আসে পুকুরে। বেশ এলো মেলো ভাবেই গোসল করে তারা, তবু তাদের দিকে বদ নজরে তাকাতে লজ্জাবোধ করে পুরুষেরা। বলা যায়, এখানকার পুরুষের এই লজ্জা এবং শালীনতা সব সমাজকে হার মানায়।

প্রতিদিন ভোরে ঘুম থেকে ওঠে আলেয়া। মা সালেহা বেগমের সাথে নামাজ পড়ে, অতঃপর কুরআন তেলওয়াতে বসে। তারপর মা আর ভাবীকে রান্না-বাড়ায় সাহায্য করে। এটা-ওটা এগিয়ে দেয়, সাথে ঝাল নুনের হিসাব-নিকাশ শিখে নেয়। এভাবে সে একদিন হয়ে উঠবে একজন পাকা রাঁধুনি।
রান্না হয়েছে কিনা আরমান সাহেব দু'একবার উঁকি দিয়ে দেখেন। প্রতিদিন সকালে উঠোনে বসে বেতারে খবর শোনেন তিনি। খবরের যে অংশটা জন্য তিনি উদগ্রীব থাকেন, তা হল ইরাক-ইরান যুদ্ধের খবর। এই খবরের সময় পাশে বসা কেউ ভুলে কথা বললে, তাকে ধমক খেতে হবে নিশ্চিত।

রান্না-বাড়া শেষ হলে সবাই একসাথে খেতে বসে আলেয়ারা। আলেয়া আর সালেহা বেগম খাবার পরিবেশন করে। দুই ভাই সোহান- আরিফও থাকে ভোজসভায়। সোহান আলেয়ার চেয়ে ছোট। আলেয়া তাকে অনেক আদর করে। খাবার সময় ভালো খাবারগুলো সোহানের পাতে তুলে দেয়। আর আরিফ ভাই বিবাহিত। আরিফ ভাইয়ের বউকে ভাবী বলে ডাকে আলেয়া। ভাবী খুব সরল প্রকৃতির মানুষ। এছাড়া তার এক বড় বোন আছে, যার নাম আবেদা। তার বিয়ে হয়ে গেছে তিন বছর আগে। তাই সে এখন শ্বশুর বাড়িতে থাকে, সংসার করে।

খাওয়া শেষ হলে স্কুলে যাবার জন্য বই-পত্র গোছায় সে। তারপর চুল বেঁধে কালো বোরকা পরে । বোরকাতে তার চোখ ছাড়া কিছু দেখা যায় না। যাবার সময় মাকে বলে বের হয় সে, মা মনে মনে তার শুভকামনা করে বলে, ‘সাবধানে যাস। মন দিয়ে ক্লাস করিস।’

দু'বাড়ি পরেই শাহানাজদের বাড়ি। শাহানাজকে ডেকে নিয়ে দু'জনে গল্প করতে করতে স্কুলে রওনা দেয় আলেয়া। শাহানাজ তার সবচেয়ে প্রিয় বান্ধবী।
স্কুল বেশী দূরে নয়, তাই কয়েক মিনিটে তারা স্কুলে পৌঁছে যায়। স্কুলটি ছিল শুধু মেয়েদের জন্য বিশেষায়িত, মানে বালিকা বিদ্যালয়। নারী শিক্ষার জন্য এরকম অনেক বিদ্যালয় আছে এখন দেশে।
ক্লাসে সবসময় আলেয়া আর শাহানাজ এক বেঞ্চে বসে। সে মনোযোগ দিয়ে ক্লাস করে। শিক্ষকদের সব উপদেশ মেনে চলার চেষ্টা করে। ভালো ছাত্রী হওয়ায় স্যার-ম্যাডামেরা তাকে অনেক পছন্দ করত।
রাবেয়া ম্যাডাম তাকে অনেক বেশী পছন্দ করত এবং তাকে মাঝে মাঝে ক্লাস শেষে কাছে ডেকে নিত। তিনি তাকে পড়াশুনা করে বড় হবার জন্য উৎসাহ দিতেন। সে সব কথা আলেয়া শুনত আর স্বপ্ন দেখত বড় হবার।

ক্লাস শেষে তারা বাড়ির পথে পা বাড়ায়। বাড়ি পৌঁছে গোসলে যায়। আলেয়া আগে আসলেও শাহনাজের অপেক্ষায় শান বাঁধা পুকুরের সিঁড়িতে বসে থাকত। শাহনাজ আসলে পানকৌড়ির মত ডুব সাঁতারে শেষ হত তাদের গোসল।

বিকেলে শাহানাজ আসত তাদের বাড়িতে। গল্প-গুজব করে, মাঝে মাঝে প্রতিবেশীদের বাড়িতে ঘুরে বিকেলটা কাটত। ভাবী-খালামনিদের জ্বালাতন করা ছিল তাদের কাজ। কোন ভাবী অথবা খালামনি কি রান্না করলো? এক কেজি চালে কতটুকু পানি দিতে হয়? কোন সময়ের ঝালে ঝাঁঝ বেশী? ইত্যাদি নানান প্রশ্নের জ্বালাতন।

এরপর মাগরিবের আজান হলে শাহানাজ তার বাড়িতে চলে যায়। আলেয়া মাগরিবের নামাজ পড়ে পড়তে বসে। এশার আজান হলে পড়া ছেড়ে নামাজ পড়ে, সবাই একসাথে রাতের খাবার খায়। তারপর আবার পড়তে বসে আলেয়া।

হারিকেনের টিমটিমে আলোতে পড়তে পড়তে তার সবচেয়ে বেশী মনে পড়ে বৈদ্যুতিক বাতির কথা। একবার বড়মামার বাসায় বেড়াতে গিয়ে বৈদ্যুতিক বাতি দেখেছিল সে। কত সুন্দর আলো! সারা ঘরময় বিস্তৃত সেই আলো। স্পস্ট দেখা যায় সবকিছু। মনে হয় যেন দিনের আলো। তার কাছে, বৈদ্যুতিক আলো মানে ‘রাতের সূর্য’।
তার বান্ধবীরা বইতে বৈদ্যুতিক বাতি সম্পর্কে পড়েছে, তবে বাস্তবে তা কেমন কেউ জানত না। তাই স্কুলে গেলে কোন আলাপচারিতায় বিদ্যুতের কথা আসলে, সবাই আগ্রহ ভরে তার কাছে জানতে চেত বৈদ্যুতিক বাতির কথা। তারা তাকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জিজ্ঞাসা করত, আলোর রং কি? আলোতে শরীরের লোম দেখা যায় কিনা? ইত্যাদি। আলেয়া তাদের বলত, ‘রং হলুদ মত, একদম দিনের আলোর মত আলো দেয়। সব কিছু দিনের মত পরিষ্কার দেখা যায়।’
তার বান্ধবীরা তার কথায় অবাক হত।

পড়া শেষ করে রাতে ঘুমোতে ঘুমোতে সাড়ে দশটা-এগারটা বেজে যায়। চাঁদনী রাতে আরো বেশী বাজে। চাঁদনী রাত তার ভালো লাগে। চাঁদনী রাতে রুমের জানালা খুলে চাঁদের সৌন্দর্য দেখত সে।
ছোটবেলায় এই চাঁদ নিয়ে কত কথা শুনেছে দাদীর কাছে। দাদী বলত, ‘ঐ যে দেখছিস চাঁদ, ভালো করে দেখ, চোখ সরাবি না, ঐখানে বসে আছে চাঁদের বুড়ি, বুড়ি দুধ দোয়াচ্ছে এক গাভীর, আর ঐ দেখ বুড়ির মাথার উপরে একটা বিরাট বটগাছ।’
সে চাঁদের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকত। সত্যি সত্যি ওরকম আবয়ব দেখে অবাক হত। তার মনে হত, চাঁদে সত্যি সত্যি একটা বুড়ি আছে, আরো আছে বটগাছ।
তার বয়স যখন দশ সে বছরই দাদা-দাদী দু’জনই পরপারে চলে গেলেন। দাদীর কথা মনে পড়লে অনেক কষ্ট হয় তার। তাকে অনেক ভালোবাসত তার দাদী। অনেক রাতে দাদীর কোলে মাথা রেখে ঘুমাত, শুনত নানা রকম রূপকথা। সে সব রূপকথার বেশীর ভাগ ছিল রাজা-রানী অথবা রাজকুমার-রাজকুমারীর গল্প। দাদী তাকে বলত, তোর বিয়ে দেব রাজকুমারের মত এক ছেলের সাথে। দাদী তাকে ভূত-প্রেতের গল্পও শোনাত। ভূতের গল্প শুনে আলেয়া ভয়ে কাঁপত, দাদীকে জড়িয়ে ধরত। গল্প শুনতে শুনতেই কখন যে ঘুমিয়ে পড়ত তার ঠিক ছিল না।

এখন তাকে কেউ আর গল্প শোনায় না, তবু সে ঘুমায়। ভোরে প্রতিদিনের মত মায়ের ডাকে ঘুম ভাঙে তার,‘আলেয়া! আলেয়া! উঠে পড়। আজান হয়ে গেছে। উঠে পর। আলেয়া! আলেয়া! নামাজ পড়তে হবে।...'
'


২.

‘কি? কি হয়েছে আপুর?’ কথাটা বলে কাঁদতে কাঁদতে মাকে জড়িয়ে ধরে আলেয়া।

তার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে সালেহা বেগম বলেন, ‘আল্লাহ! আল্লাহ! কর।’
সালেহা বেগমের চোখেও স্পষ্ট নোনা জল।

সেদিন বিকালে স্কুল থেকে বাড়ি ফিরে আলেয়া দেখে বাড়িটা কেমন জানি খালি খালি। বাড়ির কাজের লোকের কাছে জানতে পারে সে ঘটনা।
কাজের লোক তাকে জানায়, তার বোন আবেদার সন্তান হবে তাই ক্লিনিকে গেছে সবাই। ওখানে নাকি আবেদার সিজার হবে।
এ সংবাদ শুনে আলেয়ার মন অজানা শঙ্কায় ভরে ওঠে। ক্লিনিকটা বেশী দূরে নয়, এইতো তাদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে ডানে গিয়ে যে মোড়টা আছে ওখান থেকে মেইনরোড ধরে সোজা কিছুদূর গেলেই ইমরান মেডিক্যাল ক্লিনিক। সে সময় নষ্ট না করে ক্লিনিকের দিকে যেতে থাকে। সে চলছে তো চলছে। আজ এই একটুখানি পথ ফুরাতে চাচ্ছে না তার কাছে। আশে পাশে কিছু হচ্ছে কিনা তাও বলতে পারবে না সে। অথচ রাস্তার দুই পাশে ব্যস্ত দোকানপাট, আর রাস্তায় রিক্সা-ভ্যান-সাইকেল চলাফেরা করছেই। রাস্তা দিয়ে ট্রাক বা ট্র্যাক্টরও চলে যায়, তবু আলেয়া কিছু বুঝতে পারে না। আসলে ব্যক্তি বিশেষে কখনো কখনো সময় থমকে দাঁড়ায়। তখন বাইরের জগত বলতে কিছু থাকে না ব্যক্তিটির। তার পৃথিবী তখন তার চিন্তা-ভাবনা, আশা-নিরাশা, দুঃখ-কষ্টে ভর করে। সময়ের প্রসারণ তার কাছে আইনস্টানীয় তত্ত্বে রূপ নেয়।
ক্লিনিকে পৌঁছে সে জানতে পারে আবেদা অপারেশন থিয়েটারে। ওয়েটিং রুমে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে আরমান সাহেব, সালেহা বেগমসহ আবেদার শ্বশুর বাড়ির লোকজন। আবেদার স্বামী মখলেছও সেখানে উপস্থিত।

কিছুসময় পর অপেরাশন থিয়েটার থেকে এক ডাক্তার বের হয়ে আসেন। তিনি আরমান সাহেবকে চুপি চুপি কি যেন বলে গেলেন। এরপর আরমান সাহেব আরো পেরেশান হয়ে ওঠেন।

আরমান সাহেবের মুখের অবস্থা দেখে তার কাছে গিয়ে হাতে নাড়া দিয়ে সালেহা বেগম জিজ্ঞাসা করেন, ‘ডাক্তার কি বললেন?’

আরমান সাহেব যেন স্তব্ধ, কিছু বলেন না তিনি। কিই বা বলবেন তিনি। তাকে যে জানিয়ে যাওয়া হল এক আগাম শোক বার্তা। ডাক্তার তাকে গোপনে বলে গেলেন, ‘একজনকে বাঁচানো যাবে। তবে কাকে তা বলা যাচ্ছে মুশকিল।’

আরমান সাহেব ডাক্তারকে অনুরোধ করেন যাতে তার মেয়েটাকে বাঁচানো হয়। ডাক্তার তাকে আশ্বাস দিলেন। তবে এ আশ্বাসে কি আর চিড়ে ভিজে! মনের গহীনে অশ্রুমালা ঝরতে লাগল আরমান সাহেবের।

এত নিশ্চিতভাবে কোন অপারেশন শেষ হবার আগে ডাক্তাররা এরকম ভবিষৎবাণী কিভাবে করেন তা অনেকের কাছে অজানা। বেশীর ভাগ সময় মৃত্যুর কারণ হয় অদক্ষ সার্জন। একজন এম,বি,বি,এস পাশ করা ডাক্তারের হাতে যে কত লাশের দাগ লেগে থাকে তা শুধু সেই ডাক্তারই জানেন।

সালেহা বেগমের বার বার জিজ্ঞাসায়, আরমান সাহেব তাকে সান্ত্বনা সূচক এক বাক্য বলেন, ‘তেমন কিছু না, সব ঠিক হয়ে যাবে।’

তার কথার রেষ সালেহা বেগমের মাথায় থাকতে থাকতে খবরটা বাইরে আসে, চাপা খবর তবে তা চেপে রাখা যায় না। কথা রাখতে পারে নি ডাক্তার। তার মেয়ে যে আজ নিশ্চল, শ্বাস নিতে তার মানা আজ থেকে। মুহূর্তে শোকপুরীতে পরিনত হয় ওয়েটিং রুম।

ক্লিনিকের পাশের চায়ের দোকান থেকেও শোনা যায় সে শোকের আর্তনাদ। চায়ের দোকানে বসা একজন বলে,

‘মনে হয় কেউ মারা গেছে।’

‘তাই হবে, গত বৃহস্পতিবারও একজন মেরেছিল এরা।’, আরেকজন বলে।

‘মূর্খ ডাক্তার, আন্দাজে চিকিৎসা করে। সেদিন আমার বউকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেলাম তো চার রকমের ওষুধ দিল। গতকাল নিয়ে যেতে সব ওষুধ পাল্টে অন্য ওষুধ দিল।’, গোফওয়ালা এক বয়স্ক লোক বলে।

‘বুঝলেন, সব একদম ভুয়া। শুধু প্রেস্ক্রিপশন লেখে আর টাকা নেয়।’, চায়ের দোকানওয়ালা তাদের সমর্থনে বলে।

সাধারনের এসব কথা থেকে বোঝা যায় তারা কিভাবে ডাক্তারের প্রতি অনাস্থা জ্ঞাপন করে। বোধহয় এসব কারণে ভন্ড কবিরাজদেরকে কেউ কেউ বিশ্বাস করে বসে, অথবা ভন্ড পীরের মুরিদ হয়।

চায়ের দোকানের কেউ আবার যেয়ে নিশ্চিত হয়ে আসে কি হয়েছে। একজন এসে বলে, ‘হাজী সাহেবের মেয়েটা মারা গেছে সন্তান প্রসবের সময়। ভিতরে কাউকে ঢুকতে দিচ্ছে না।’

এ বার্তায় সবাই দুঃখিত হয়। কারো কারো চোখে জল টলমল করে। হয়তো আরমান হজীর মেয়ে তাদের কারো মেয়ে অথবা আপনজন নয়, তবু তারা শোকাহত হয় একটা তাজা প্রাণ চলে যাবার শোকে।

এরপরের ঘটনা সবার জানা। একটু পরে সশব্দে পুলিশের একটা জীপ এসে দাঁড়ায় ক্লিনিকের সামনে। ওসি সহ তিনজন ক্লিনিকের ভিতরে ঢোকে। ওসি আরমান সাহেবকে ডেকে বলেন, তিনি খুব দুঃখিত। আরমান সাহেব শুধু ওসির দিকে তাকিয়ে থাকেন। ওসির মতি গতি পরিমাপ করে স্তব্ধ হয়ে যায়। এই শোকের মুহূর্তে কিভাবে যে এরকম নিষ্ঠুর হয় এরা ভেবে অবাক হয় আরমান সাহেব। তিনি চান না তার মেয়ের মরদেহটাকে কেটে ছিন্নভিন্ন করা হোক। তাই সিক্ত হাত পকেটে ঢুকিয়ে বের করে দেয় এক বান্ডিল কাগজ।

এই কাগজের মূল্য এই পৃথিবীতে অনেক। এরি জন্য মানুষের জীবনের লড়াই চলতে থাকে বছরের পর বছর। এই কাগজের জন্য একজন আরেকজনকে হত্যা করে। এই কাগজের ক্ষমতা বর্তমান পৃথিবীর ক্ষমতা হিসেবে পরিচিত। আজব এই কাগজ! সত্যিই আজব! অবাস্তব এ কাগজের ক্ষমতা।

এরপর ডাক্তারদের চেম্বারে হামলা করে ওসি। কড়া গলায় বলেন, ‘কি সব ডাক্তার রাখেন ক্লিনিকে? এরকম করলে তো আপনাকে গ্রেফতার করা ছাড়া উপায় থাকবে না।’

ক্লিনিকের মালিক ড. ইমরান বলেন, ‘স্যার, এটা ইমারজেন্সি কেস ছিল। কোনভাবে বাঁচানো সম্ভব ছিল না উনাকে।’

‘এসব বললে কি আর হবে, গত সপ্তাহেও একজনকে মারলেন। আমাদের তো জবাবদিহি করতে হয়।’, ওসি চড়া গলায় বলেন।

‘স্যার, সন্ধ্যায় থানায় আপনার সাথে দেখা করব। দয়া করে লাশটাকে বাইরে বের করার ব্যবস্থা করুন। ক্লিনিকে আরো অনেক রুগী আছে, এরকম চিল্লা-চিল্লি হলে রুগীদের ক্ষতি হতে পারে।’, ড. ইমরান বলেন।

এই দেখা করার অর্থ ওসি ভালোমতই বোঝেন, তাই তিনি বলেন, ‘ওকে! ঠিক আছে। ভবিষ্যতে সাবধানে করবেন সবকিছু। সন্ধ্যায় দেখা হচ্ছে তাহলে।’

নীরব-নিথর দেহটাকে বের করা হয় ক্লিনিক থেকে। পিছন পিছন বের হয় একদল শোকার্ত মানুষ; একদল আর্তনাদ। আশ-পাশের দোকানপাট হতে কেউ কেউ ছুটে আসে মরদেহ দেখার জন্য। তাদের মনেও শোক হয়, চোখ টলমল করে ওঠে। কেউ কেউ আল্লাহর কাছে তার বেহেশত নসীবের জন্য দোয়া করে।

এশার নামাজের আগে আম-কাঁঠালের বাগানে স্থান হয় আবেদার। নির্জন সে জায়গাই এখন থেকে তার নিবাস।

তারপর হাজী বাড়ির উঠোনে দেখা যায় আরিফ ভাইয়ের সাথে তার কিছু বন্ধু লাঠি হাতে দাঁড়িয়ে আছে। আরিফ ভাইয়ের এক বন্ধু বলে, ‘ঐ ডাক্তারই আবেদা আপুকে মেরেছে। চল আজ উড়িয়ে দেব ক্লিনিক।’
আর সবাই তার কথায় সাঁয় দেয়। তারা ক্লিনিকে ভাংচুরের পরিকল্পনা করে।
তবে আরমান সাহেবের কানে কথাটা যেতেই তিনি তাতে বাঁধ সাধলেন। তিনি জানেন এই রক্ত গরম ছেলেদের থামানো সহজ নয়। নানা রকমভাবে বোঝানোর চেষ্টা করেন তিনি। বলেন, ‘যে গেছে, যা গেছে তা তো আমারই গেছে। তোরা যা করবি তাতে কি তাকে ফিরে পাব?’

এসব কথায় ছেলেদের মন শান্ত হয় না। তবু হয়তো আরমান সাহেবের কথার প্রতি সম্মান জানাতে তারা এ কাজ থেকে নিবৃত্ত হয়।

এদিকে আবেদার সন্তানের পরিচর্যায় ব্যস্ত তার শ্বশুর বাড়ির লোকজন। মাতৃহারা এই ছেলে সন্তান যে আবেদার একমাত্র স্মৃতি। তাই সালেহা বেগমও তার শোককে দমন করে তার কাছে যায়, তার পরিচর্যা করে।

আলেয়াতো সেই কখন থেকে চোখের জল ফেলে যাচ্ছে। শাহানাজ তাকে থামানোর চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়। যে আপু বাড়িতে আসলে তার জন্য নিয়ে আসত নানান রকম চকলেট অথবা উপহার দিত রং-বেরং এর পোশাক, তার কথা সে কিভাবে ভুলবে? তার হাসি, তার কথা যেন বার বার এই রাতে তার সামনে-পিছন, ডান-বাম থেকে তার শুভ্র হৃদয়ের চারপাশে ঘুরঘুর করে। একেকটা স্মৃতি তার কান্নার গভীরতা বাড়িয়ে দেয়। এভাবেই পার হয় রাত।

সকালে রান্না ঘরে আগুন জ্বলে নি। ইরাক-ইরান যুদ্ধে কতজন মারা গেল সে খবরও রাখে নি এ বাড়ির কেউ।

৩.

‘তোর বিয়ে।’

‘বিয়ে মানে? কীসের বিয়ে?’ ভাবীর কথায় চমকে উঠে বলে আলেয়া।

‘হ্যাঁ, সত্যিই তোর বিয়ে।’

‘কিন্তু আমি বিয়ে করব না। তুমি তো জানো, আমি অনেকদূর পড়তে চাই। মানুষের মত মানুষ হতে চাই।’
মানুষের মত মানুষ! অথবা মহামানুষ, সে কি কোন মেয়ে হতে পারে? ব্যাপারটা কি অতটা সহজ!
এসব ভাবতে ভাবতে ভাবী বলে, ‘বাবা-মা যে তোর বিয়ে ঠিক করে ফেলেছে।’

‘আমাকে না জানিয়ে!’ তারপর উৎসুকভাবে বলে, ‘কোথায়? কার সাথে?’

‘তোর দুলাভাইয়ের সাথে।’

স্তব্ধ হয়ে গেল আলেয়া। তার মাথায় যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়ল। সে উৎকণ্ঠিত ভাবে বলে, ‘না! না! মাথা ঝিম ঝিম করছে।’

ভাবী বলে, ‘এতে আমারও মত নেই। তবু আর কোন উপায় নেই।’

আলেয়া দৌড়ে মায়ের কাছে যায়, বলে, ‘মা, ভাবী এসব কি বলছে? আমার নাকি বিয়ে ঠিক করেছ।’

বার বার জিজ্ঞাসার পরও সালেহা বেগম কিছু বলেন না। মাথা নিচু করে চাল ঝাড়তে ব্যস্ত থাকেন। কিছু বুঝতে আর বাকী থাকে না আলেয়ার। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে নিজের ঘরে চলে যায়। যে আবেদার জন্য এ ক’দিন সে শোকাচ্ছন্ন ছিল, সেই আবেদার জন্য মুহূর্তে তার মন থেকে শোক উবে যায়। তার মৃত্যু তাকে শেষ অবধি সংকটে ফেলে দিল। মুহূর্তে তার মনের যেন মৃত্যু হয়ে গেল। ঝড় যেমনি প্রকৃতির গাছ-পালার ডাল-পালা ভেঙ্গে দেয় অথবা মূল উৎপাটিত করে, তেমনি তার হৃদয়ের প্রকৃতিতেও ঝড় ওঠে। ক্ষত-বিক্ষত হয় তার হৃদয় প্রকৃতির উপাদান।

প্রকৃতির পরিবর্তন এমনই, নিজের রূপ যখন তখন পাল্টাতে পারে। তাই এক সপ্তাহের ব্যবধানে প্রকৃতি পাল্টে গেল।
আরিফ ভাই তাকে সেদিন সন্ধ্যায় বলে, ‘দেখ, ও তো চলে গেল। আমরা কি কিছু করব না ওর জন্য? বাচ্চাটার দিকে তাকিয়ে দেখ, কত ফুটফুটে হয়েছে। দেখলেই মায়া লাগে। আর মখলেছ মানুষটাও খারাপ না। তা না হলে তোর বোন কি পারে ওর সাথে পাঁচ বছর সংসার করতে? রাজী হয়ে যা তুই।’

শান্ত মেয়ের মত চুপ করে আলেয়া সব শোনে, প্রতিবাদ করে না। এ ক’দিনে নোনা জলও শেষ হয়ে গেছে তার। এখন শুধু মনে হয়, তারা নিষ্ঠুর সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

পরদিন রাতে আলেয়ার মনে আশার আলো জাগে সোহানের কথায়। সোহান তাকে চুপি চুপি বলে, ‘তুই চিন্তা করিস না। আমি কিছুতেই হতে দেব না এসব।’

আলেয়া সোহানের কথায় কেঁদে ফেলে, এ কথা তাকে কষ্ট দেয় নি- তবু সে কাঁদে। কেননা দুঃখ মানুষকে যতটা না কাঁদায় আশা মানুষকে তার চেয়ে বেশী কাঁদায়।

শাহানাজও বিরোধিতা করে। বলে, ‘চাচা এ কি করছেন, একদম ঠিক করছেন না তিনি।’
ক্ষণিকের আশার আলো ডুবে যায় ক্ষণিকে। বাতাসের গতির মত হঠাৎ সুর পাল্টে গেল। মখলেছ এসে কি যেন বুঝিয়ে গেল সবাইকে। সোহানের সুরও পাল্টে গেল। আলেয়া অবাক হল যখন শাহানাজ তাকে বলল, ‘রাজী হয়ে যা।’

আরমান খান তাকে ডেকে বলে দিলেন, ‘কাল থেকে তোমার স্কুল যাওয়া বন্ধ।’

সে যাকে এত বছর দুলাভাই বলে ডেকেছে, দুলাভাই বলে মেনেছে, তাকে সে কি করে গ্রহণ করবে? এছাড়া তার বয়সের দ্বিগুণেরও বেশী দুলাভাই। তবু আলেয়ার কথা শোনার মত কেউ থাকল না। মা সালেহা বেগম তাকে ডেকে অনুরোধ করে বলেন, ‘শুধু ঐ দুধের বাচ্চাটার দিকে তাকিয়ে রাজী হয়ে যা। আমি জানি যা করছি তা ঠিক নয়, তবু সময়ের প্রয়োজনে করতে হয়।’

আলেয়ার মন তবু সাঁয় দেয় না। সময়ের প্রয়োজন অসময়ে হলে একটি মনের মৃত্যু হয়, একটি মানুষের মৃত্যু হয়, তা কতজনে বা মানে! তাই তার মনে হয়, তার কাছ থেকে আনন্দ কেড়ে নেবার ষড়যন্ত্রে মেতেছে সবাই। স্কুলে ছুটাছুটির কথা, বান্ধবীদের কথা খুব মনে পড়ে তার। রাবেয়া ম্যাডামের বলা স্বপ্নের কথাও ঘুরে ফিরে আসে তার মনে। দাদীকেও ইদানিং বেশী মনে পড়ে। দাদী বেঁচে থাকলে হয়তো কখনো এই বিয়ে মেনে নিত না। ঠিকই তার জন্য রাজপুত্রের মত ছেলে খুঁজে নিয়ে আসত। জীবনের নিয়মই এরকম- কেউ বর্তমানে যখন আশা খুঁজে পাবে না, অতীতের আশা তার মনে জাগ্রত হবে। এতে সে আরও হতাশ হতে পারে, কেননা অতীতের আশাকে সে ধরার চেষ্টা করলেও ধরতে পারবে না। আশা এরকমই। মানুষ আশাকে জড়িয়ে ধরে হাসতে চাই, আশাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে চাই। আসলে এটাই মানুব মনের সাধারণ প্রকাশ।

৪.

কোমল বরণ এ কিশোরী লাল বেনারসি পরে। কানে দুল, কপালে টাইরা, চোখে মাশকারা, গলায় হার, হাতে মেহেদী অথবা পায়ে আলতা দেওয়া হয়নি তার। শুধু হাতে আংটি ছিল।
ভাবী বলেছিল, ‘পরে নে সব গয়না।’
তবে আলেয়া সে গয়না পরতে পারে নি। তাতে যে আবেদার দাগ লেগে আছে। তার চল্লিশার এ দিনে কেমন করে সে ঐ গয়না পরবে। তবু ক্ষীণ এ সাজেও আলেয়া অপরুপা সুন্দরী।

সকালে ভাবী আর শাহানাজ মুখে হাসি নিয়ে তার সামনে হাজির হয়। হাতটা নিয়ে আঙ্গুলের মাপ নেয় ভাবী। আলেয়া বলে, ‘কি হবে মাপ নিয়ে?’

ভাবী কোন কথা বলে না, নিখুঁতভাবে মাপ নিতে ব্যস্ত। শাহানাজ বলে, ‘আজকে।’

এ ষড়যন্ত্র বুঝতে বাকী থাকে না আলেয়ার। চল্লিশা উপলক্ষে এমনিতে বাড়িতে আত্মীয় সজনের সরব উপস্থিতি। এক ঢিলে যে দুই পাখি শিকারের পরিকল্পনা হয়েছে তাও বোঝে সে। তবু কিছু বলে না, কেননা যা তার কাছে দুর্বিষহ তাই সবার কাছে পরিতৃপ্তি।

সেদিন দুপুরে ভাবী তাকে বলেছিল, ‘কোন সাগরে যাচ্ছিস জানি না, দোয়া করি সুখে থাকিস।’

অবশেষে শোক পালনের সন্ধ্যাতে কাবিননামা খোলা হল। তারপরকবুল বলার সময় আসলে, আলেয়া স্তব্ধ হয়ে যায়। তার কাছে অবাক লাগে, এই একটি শব্দ তার জীবনকে বুঝি ফেলে দেবে অথৈ সাগরে। মা, ভাবী এবং অনেকে তার কাছে অনুরোধ করে ‘কবুল’ বলতে। তবে আলেয়ার মুখ সরে না। অবশেষে যখন হাজী সাহেব এসে বলেন, ‘মা, কবুল বল।’

আলেয়া একবার মাত্র অস্পষ্ট স্বরে ‘কবুল’ বলে ভাবীর বাহুতে ঢলে পড়ে।

জ্ঞান ফিরে পেলে, আলেয়া দেখে সে তখন বাসর ঘরে। বিয়েটা রাতে হওয়ায় বাসরের ব্যবস্থা আলেয়াদের বাড়িতে হয়েছিল। তার ঘরই এখন বাসর ঘর। জ্ঞান ফিরে আসতেই সে টের পায় তার মাথায় কে যেন হাত বুলাচ্ছে। মুখ ফিরিয়ে দেখে মা বসে আছে।

স্বাভাবিক হতে বেশী সময় লাগে না তার। শাহানাজ তার জন্য শরবত নিয়ে আসলে আলেয়া শাহানাজের দিকে তাকায়, বলে, ‘তুই এখনো যাস নি?’
শাহানাজ অপরাধীর মত মাথা নিচু করে থাকে। কিছুসময় পর ভাবী তাদের ডেকে নিয়ে যায়।

আলেয়া একা বসে থাকে তার ঘরে, তার বাসর ঘরে। বিছানায় বসেই ঘরটাতে চোখ বুলায় সে। আয়নার দিকে তাকাতে না তাকাতে তার মন কেঁপে ওঠে, এইতো সেদিনও স্কুল যাবার আগে এই আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে সে চুল বাঁধত, বোরকা ঠিক-ঠাক করত। পাশের বইয়ের তাকগুলো যেন তাকে বলছে, আমাকে ছেঁড়ে যেও না, তুমি ছাড়া যে আমি একা হয়ে যাব। তার ঘরের জানালাও তাকে অনুনয় বিনয় করে, তুমি ছাড়া চাঁদনী রাতে কে খুলবে আমায়? ঘরের মেঝে যেন বলছে, আমাকে চাঁদের আলো মাখাবে কে?

সব কল্পনার শব্দ ছাড়িয়ে পায়ের শব্দ শুনতে পায় আলেয়া। ঘরে প্রবেশ করে মোখলেছুর রাহমান মখলেছ, একজন এনজিও কর্মী, আলেয়ার সদ্য বিবাহিতা স্বামী।

আজ স্বামী মখলেছের দিকে তাকিয়েই আলেয়া বোঝে, এ পুরুষ তার প্রতি নির্মম হবে। তার মুখাবয়ব, চোখ যেন দৈত্য-দানোর মত।

আলেয়ার ভাবনার ব্যতিক্রমও হয় না। প্রথম আলাপচারিতায় মখলেছ তাকে বলে, ‘আমরা কিন্তু আগামী আট বছর কোন সন্তান নিচ্ছি না।’

এছাড়াও নানা বিধি আরোপ করে মখলেছ। যেমন তার অনুমতি ছাড়া বাইরে যেতে পারবে না। তাকে না বলে বিশেষ কিছু করতে পারবে না।

এসব নিয়ম আলেয়ার কাছে জেলখানার নিয়ম মনে হয়। সে শুধু তার কথা পাথরের মত শোনে। কোন অভিযোগ করে না। নিউটনের পরম স্থিতি যে ভর করেছে তার মনে, কি করে সে তার অসার মনকে আজ জাগাবে!

অবস্থা বুঝতে পেরে এ রাতে বেশী দূর এগোয় না মখলেছ। তবু ভোর রাতে হঠাৎ ঘুম ভেঙ্গে যায় আলেয়ার। তার পাশে শোয়া স্বামীকে তেলাপোকা অথবা সাপের চেয়ে বেশী ভয় পায়। সাবধানে বিছানা থেকে উঠে দরজা খুলে বাইরে আসে। মায়ের ঘরের দরজায় ধাক্কা দেয় সে। মা সালেহা বেগম তখনও জেগে ছিলেন, তিনি ঘরের দরজা খুলে দেন। আলেয়া ভিতরে ঢুকে দরজা লাগিয়ে মাকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে। সালেহা বেগম বলেন, ‘কি হয়েছে মা? কি হয়েছে তোর? কাঁদছিস কেন?’

আলেয়া শুধু কাঁদতেই থাকে। সালেহা বেগমও বোঝে তার মেয়ের মনের কষ্ট, মেয়ের অমতেই তো বিয়েটা হল। তবু কিছুই করার ছিল না তার। সালেহা বেগমও মেয়ের এ শোকের সঙ্গী হয়। দুই শোক তার বুকটাকে হাহাকার করে দেয়।
আরমান সাহেব উঠে পড়েন ঘুম থেকে। বিরক্ত হবার মত মন তার আজ নেই। চুপিচুপি উঠে উঠোনে চেয়ার নিয়ে বসেন তিনি। অন্ধকারের সাথে শোক বিনিময় করলেন কিনা তা জানা গেল না। পুরুষের শোক এরকম অন্যরকমই। নিঃশব্দে কত পুরুষ কত শোকের ঋতু পার করে তা কেউ জানতে পারে না। তাই অনেক নারীরা পুরুষকে ভুলে নিষ্ঠুর ভাবে। ফজরের আজান পর্যন্ত হাজী সাহেব উঠোনে বসে থাকেন, ওঘরে থেমে থেমে কান্না চলতে থাকে।

সেদিন সকালে আলেয়াকে যেতে হয় শ্বশুর বাড়ি। সালেহা বেগম আলেয়াকে একান্তে ডেকে অশ্রুসজল চোখে হাতজোড় করে বলেন, ‘মা, আমি তোর কাছে ভিক্ষা চাচ্ছি। তুই শুধু ঐ দুধের বাচ্চার দিকে তাকিয়ে সংসার করবি। আর কোন সমস্যা হলে জানাবি। এদিকে তো আমরা সবাই আছি।’

আলেয়া মনে মনে ভাবে, সব ভাবনা তো দুধের বাচ্চাকে নিয়েই, আমাকে ভেবে আবার হবে কি? মুখে বলে, ‘ঠিক আছে, আমাকে নিয়ে আর চিন্তা করতে হবে না।’

কি ক্ষোভে, কি দুঃখে আলেয়া তা বলল, সালেহা বেগম তা বোঝে। তবু সে যে ‘ঠিক আছে’ বলেছে, এটাই তার মনের সান্ত্বনা। তিনি আলেয়ার মাথায় হাত বুলিয়ে বুঝিয়ে দেন, সে তার লক্ষ্মী মেয়ে।

বিদায় মুহূর্তটা বিদায় মুহূর্তের মতই ছিল। তবে গ্রহণটাতে যে আগ্রহের কমতি ছিল, সে শ্বশুর বাড়ি পৌঁছেই বুঝেছে। সেখানে খুব কম জনই তার প্রতি আন্তরিক ছিল।

সে রাতে মখলেছের সাথে তার অভিজ্ঞতা খুব খারাপ ছিল। এমনিতে তার মন দ্বিমুখী শোকে পূর্ণ ছিল। সে মানসিক এবং শারীরিক ভাবে একদম প্রস্তুত ছিল না।

সেরাতে অনুমতির তোয়াক্কা করে নি মখলেছ, পুরো পাষণ্ডের মত সে আলেয়াকে ভোগ করেছে।

৫.
আলেয়া এখন ত্রিশের কোঠায়। এই ক’বছরে এদেশের ঘটেছে ব্যাপক পরিবর্তন। কেননা, পুরাতন নতুনের শ্রী। যে নতুন পুরাতন বর্জিত, সে নতুন সমাজের পরিবর্তক। নতুনের প্রতিষ্ঠাই সমাজের ধর্ম। সে নতুন খারাপ হোক বা ভালোই হোক, নতুনকে গ্রহণে সকলে উৎসাহী।

বৈদ্যুতিক বাতি, পাখা, টেলিভিশন এখন ঘরে ঘরে। মুঠোফোন নামক আজব যন্ত্রের ব্যবহার এদেশে প্রচুর। এর মাধ্যমে দূর-দূরান্তের মানুষের সাথে সহজে যোগাযোগ করা যায়। কম্পিউটার নামক গণনা যন্ত্রের ব্যবহার করতেও দেখা যায় অনেকেকে। তবে এদেশের বেশীর ভাগ ছেলে মেয়েরা কম্পিউটারকে নাটক-ছিনেমা দেখার যন্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে থাকে। কেউ কেউ আবার ইন্টারনেটের আজব পৃথিবীতে ডুবে থাকে।

এই ক’বছরে এদেশের যে কি পরিবর্তন হয়েহে তা ভাবলে আলেয়া চমকে ওঠে। চারিদিকে দালান-কোঠা ওঠার বহর দেখলেও সে তাজ্জব বনে যায়।
সে এখন একটা বড় শহরে ছোট্ট একটা ফ্লাটে থাকে। সে থাকে একা। মখলেছ পাশের আরেকটি শহরে থাকে। আর মাসুদ, আবেদার ছেলে থাকে অন্য আরেক শহরে। সেখানে সে উচ্চমাধ্যমিকে পড়ে। আলেয়াকে ছোটবেলা থেকে মা বলে ডাকত মাসুদ। তবে দিন যত যায় তার প্রতি যে মাসুদের টান কমে যায় তা বুঝতে পারে আলেয়া। মাসুদ তাকে মাসে একবার ফোন দিত আর বাড়িতে আসত কোন বড় ছুটি পেলে। অথচ এই মাসুদই সব জানার পর তাকে বলেছিল- তুমিই আমার মা। আমি আর কিছু বুঝি না।

এন জি ও-এর চাকরী অনেক বছর আগেই ছেড়েছে মখলেছ। এখন ইউ এন ডি পি-এর বিভিন্ন প্রোজেক্টে কাজ করে। প্রথম দিকে আর্থিক সংকটে থাকলেও এখন বেশ ভালো বেতন পায়। এছাড়া দুর্নীতির টাকার কথা না বললেই নয়। এদেশের অবস্থা এখন এমন যে, এখানে আপনি দুর্নীতি করবেন না বলে দুর্নীতি থেমে থাকবে তা নয়। আপনি না করলে শুধু আপনিই পিছনে পড়ে থাকবেন।
মাসে দু'বার আলেয়ার কাছে আসে মখলেছ। দু'তিন দিন করে থাকে একেকবার। আলেয়ার মনে হয় যৌনসুখ নেবার জন্যই সে আসে। এই পঞ্চাশ ঊর্ধ্ব মানুষটি আজো তার মনে ঢুকতে পারে নি। তাই আজো মখলেছের সুখ আলেয়ার প্রতি নির্যাতনই হয়ে আছে। ভাবুন, অনিচ্ছা সত্ত্বেও কোন কাজ করা কতটুকু বিরক্তিকর। যে আপনার মনে দোলা দিতে পারে না, সে কোনদিন আপনার শরীরেও দোলা দিতে পারবে না।
যাবার সময় আলেয়ার হাতে টাকা দিয়ে যেত মখলেছ। ভাবখানা এমন যেন কোন পতিতাকে দু'দিন ভোগ করে তার দাম দিয়ে গেল। অবশ্য এ সমাজে পতিতাদের দাম এখন আর কম নয়। তারা একজন কোম্পানীর কর্মকর্তার চেয়েও বেশী টাকা অনায়াসে উপার্জন করতে পারে। আলেয়ার মত কোন সুন্দরী মহিলা যদি পতিতাবৃত্তিতে নামে, তাহলে দু'দিনে সে যে অনেক বেশীই কামাতে পারবে তা নিশ্চিত।
এ ব্যাপারে আলেয়ার মনে প্রশ্ন জাগে, ‘যাকে ভালোবাসা যায় না, তার সাথে দাঁতে দাঁত চেপে ধর্ষণ যন্ত্রণা সয়ে যাওয়া যে মৃত্যু যন্ত্রণার চেয়েও অধিক এটা যার জীবন সেই বোঝে। এর থেকে সমাজের মানুষের কলঙ্কিত উপাধি মাথায় নিয়ে কোথাও দূরে গিয়ে বুক ভরে শ্বাস নিয়ে বাঁচতে চাওয়াটা কি খুব অন্যায়?’

যাই হোক, বাড়ির কারো সাথে তার আর তেমন ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ নেই। মাঝে মাঝে মা ফোন দিলে কিছু নির্লিপ্ত কথা হয়। ইদানীং ছোট ভাই সোহান তাকে ফোন দিয়ে বলে, 'তুই চলে আয় আমাদের কাছে। তোর দায়িত্ব তো শেষ। তোর কষ্ট আর সহ্য হয় না। তুই চলে আয়। তোর আর ওখানে থাকা লাগবে না।'

আলেয়া ম্লান হাসি হেসে বলে, 'বড্ড দেরী করে ফেলেছিস রে ভাই। আমি যে আজ থাকতেও পারি না, যাইতেও পারি না।'

আলেয়া জানে মাসুদ বড় হবার পর থেকে এ সংসারে তার কদর শূন্যের কোঠায়। এই মাসুদকে বড় করার জন্য নিজে সন্তান পর্যন্ত নেয় নি সে। নিজের প্রতি বড় নিষ্ঠুর হয়ে উঠেছে সে। কোন পাপের ফল সে ভোগ করছে তা আজো তার কাছে অজানা।

বছরে একবার বাড়িতে যায় আলেয়া। মা-বাবা-ভাই এর সাথে দেখা করতে। বাড়িতে আসলে তাকে দেখা যায় ছোট বাচ্চাদের সাথে মাস্তি করতে। বাচ্চা ছেলে মেয়েদের খুব ভালোবাসে সে। যে সব মেয়ের বাচ্চা থাকে না তাদের নাকি বাচ্চাদের প্রতি দরদ-ভালোবাসা বেশী থাকে। সে জন্যই হয়তো বাচ্চাদের প্রতি এত টান আলেয়ার।

সালেহা বেগম এ দৃশ্য দেখে গোপনে চোখের জল ফেলে, নিজেকে দোষী ভাবে মেয়ের শখ-আহ্লাদ নিজের হাতে বিনষ্ট করার জন্য।

আরমান সাহেবের অবশ্য এসব নিয়ে ভাবার সময় নেই। বয়স হলেও তার রুটিন একই আছে, তিনি এখন আমেরিকা-আফগান যুদ্ধের খবর দেখেন টেলিভিশনে। আমেরিকান সৈন্য মরলে তালেবানদের বাহবা দেন তিনি। তবে জঙ্গীদের পুরোপুরি সমর্থনও করেন না তিনি। তার মতে, তারা একটু বেশীই উগ্রপন্থী। আর আমেরিকা! সে তো পুরোপুরি খুনী রাষ্ট্র, রক্ত ছাড়া তাদের পেট ভরে না।

বাড়িতে আসলে শ্বশুর বাড়িতেও একবার যায় আলেয়া। শ্বশুরবাড়িতে গেলে তার দেবর তাকে বলে, 'ভাবী, তুমি ভাইকে তালাক দাও। পারলে নতুন করে বিয়ে কর। এভাবে আর কতদিন চলবে! ভাই যে কতটা নিষ্ঠুর তা আমি জানি।'

আলেয়া কথাগুলো শোনে। কোন জবাব না দিয়ে অন্য প্রসঙ্গে চলে যায় সে।


৬.

সেদিন ভর দুপুরে ভরা বাজারে আলেয়াকে থাপ্পড় বসিয়ে দিল মখলেছ। পছন্দের জিনিসটা কিনতে চাওয়াই তার দোষ। কোন কথাই রাখে নি মখলেছ। আট বছর পার হলেও কোন দিন তাকে বলে নি সন্তান নিতে, বরং সুযোগ পেলে তার প্রতি নির্যাতন করেছে। এসব কারণে আলেয়ার মন সেই কবে যে বরফ হয়েছে, তা কেউ গলাতে পারে নি। তবে বরফ যে অগলিত থাকতে পারে না।

বিয়ের পর তার পড়াশুনার ইতি ঘটে ঠিকই কিন্তু মাসুদ যখন বড় হয়ে গেল, আলেয়া আবার পড়াশুনা শুরু করে। এমনিতে বই পড়ার নেশা ছিল তার, গল্প-উপন্যাসের অনেক বই পড়ত সে। একে একে মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক শেষ করে সে এখন স্নাতক শেষ বর্ষে পড়ে। কয়েকমাস পরে স্নাতক ফাইনাল পরীক্ষা। তাই পড়াশুনাতে ব্যস্ত সে।

তার অগলিত বরফ মনের বরফ বিগলিত করেছিল কলেজের একটি ছেলে। দেখতে বেশ ভালো, বয়সে তার চেয়ে ৪-৫ বছর কম হবে। আলেয়া দেখত ছেলেটা কি এক রকম আবাক দৃষ্টিতে যেন তার দিকে তাকায়। এ দৃষ্টি লোলুপ ছিল না। কয়েকদিন লক্ষ করে আরো নিশ্চিত হয় সে। সে দৃষ্টিতে আলেয়া সত্য ও আবেগের ছাপ খুজে পায়। তার মন দোলা দিয়ে উঠে। কিন্তু কেন? তার উত্তর সে খুঁজে পায় না।

একদিন ছেলেটাকে ডেকে বলে, 'তুমি আমার দিকে ওভাবে তাকাও কেন?'

ছেলেটা ইতস্ততঃ হয়ে বলে, 'কই নাতো। এরকম অভিযোগ ঠিক নয়।'

তবু কথা হবার পর তাদের চোখাচোখি বেড়ে গেল। আলেয়ার চোখ মাঝে মাঝেই তার চোখকে আটকে ফেলত, আর ছেলেটি মুচকি হাসত। এভাবেই শুরু। কয়েকদিনে বেশ ভালো বন্ধু হয়ে গেল তারা।

আলেয়া তাকে সব কথা বলত। তার অতীত-বর্তমান, তৃপ্তি-অতৃপ্তি, সুখ-দুঃখ সব কিছুর কথা বলত সে। মনোযোগ দিয়ে ছেলেটা তা শুনত। তাকে সান্ত্বনা দিত, তাকে আশা দিত।
বলত, 'তোমার এ দুখের দিন শেষ হবে একদিন।'
মাঝে মাঝে কাব্য করত ছেলেটি। যা আলেয়ার মনকে আবেগী করে দেয়। নিজের মনেও কাব্য ভাসে তার। একদিন নিজের খাতায় লিখে ফেলে কয়েকটি লাইন।

শুকনো পাতার জঞ্জালে তুমি আসলে

প্রজাপতি হয়ে;

আমি রইলাম চেয়ে।

হে মানব কেনো এ বনে এই বিজনে

আসা আমা সনে;

গেছি আমি তব্ধ বনে।

কেউ আসে না এখানে আর

কেউ আসে না ভুলে,

কেউ শোনে না আমার গল্প

আমি শুকনো বলে।

আজ প্রজাপতি কেন তুমি এলে-

কেন তুমি এলে,

রাঙা রাঙা ওসব বাগান ছেড়ে

এ শুকনো ভুঁইয়ে।

এসো না এসো না আমাকে ছুঁয়ো না

আমা রুদ্রতা নিয়ো না বুকে,

যদি নাও রবে জেনে রেখো তবে

আমি উড়ে যাব তপ্ত শোকে।

সে যে দিনে দিনে ছেলেটার প্রতি দুর্বল হচ্ছে তা বুঝতে বাকী থাকে না তার।
প্রেম মানে না ধর্ম-বয়স-ভয়, এ বাক্যে বিশ্বাস আসে তার। তার হৃদয়ের কিশলয়গুলি উৎফুল্ল হয়ে ওঠে। তবে কিছু বলতে পারে না সে।

প্রথমে ছেলেটিই এক সন্ধ্যায় তাকে বলে বসল, 'আমি যে তোমায় ভালোবেসে ফেলেছি।'

দম বন্ধ হয়ে আসছিল আলেয়ার। দীর্ঘশ্বাস টেনে বলে, 'কি করে সম্ভব বল, আমি যে বিবাহিতা।'

'তাতে কি আমি তোমাকে নতুন জীবন দেব। আমরা চলে যাব দূরে কোথায়। যেথায় রব শুধু আমি আর তুমি। পরিচিতের আনাগোনা থাকবে না সেথায়।'

'এতই কি সহজ?'

'সহজ তো নয়, তবে অসম্ভবও নয়। তুমি শুধু আমার হয়ে যাও।'

এভাবেই তারা ঘনিষ্ঠ থেকে ঘনিষ্ঠতর হয়। সব বাঁধা, সব নিয়ম ভুলে যায় তারা। প্রেমের শক্তি তাদেরকে এক করে দেয়। এ প্রেম একসময় চুম্বনের রূপ ধারন করে। এ প্রেম আলেয়ার ফ্লাটে ধারন করে আরেক রূপ। এক বিছানায় তারা রাত্রি যাপন করে। আলেয়াকে এটা পরম স্বাচ্ছন্দ্য দেয়। প্রেমের লীলাখেলা যে সব যুগে সব কালে এমনই হয় তা বোধহয় আরেকবার প্রমানিত হয়।


৭.

অবৈধ! অবৈধ সম্পর্ক করেছে সে। পাপ করেছে সে। মাত্র একবার, তবু তার মনে প্রবল সংশয়। সে যা করেছে তা কি ঠিক? কখনো কখনো তার মনে হয়, সে ঠিকই করেছে। তার আবেগ প্রথমবারের মত ঠিক পথে চালিত হয়েছে। তবে, বিপক্ষের যুক্তিগুলো আরো প্রবল। যে মেয়ে বড় হয়েছে শালীন পরিবেশে, সে আজ অশালীন। যে ধর্মকে নামীয় প্রগতিশীলরা মনে করে গোঁড়ামি, সেই ধর্মের অনুভূতি তার পথে বাঁধ সাধে। ধর্ম বা সমাজ তার মনের সাধ পূরণ করাতে পারে না। তাই বলে সে সমাজের বাইরেও চলে যেতে চাই না।

সবসময় রাজধানীকে ভয় পেত আলেয়া। তার ভয় অন্যকে নিয়ে নয়, নিজেকে নিয়ে। সে বলত, 'আমার সাধ জাগে যেতে। কিন্তু আমি যে নিজেকে হারিয়ে ফেলব ওখানে। তখন আমার যে বাঁচার কোন অবলম্বনই থাকবে না।'

তবু দূরে থাকতে পারল না সে। স্নাতক রেজাল্টের পর খাপছাড়া হয়ে ওঠে তার মন। ছেলেটার আবেগ আর মখলেছের সঙ্গ ছেড়ে সে রাজধানীতে যাবার সিদ্ধান্ত নিল। এর আগেও দূর দুরান্তে পাড়ি দেবার শখ জাগত তার মনে। তবে এবার কোন আবেগ, কোন পিছুটান তাকে ধরে রাখতে পারে না।

রাজধানী একটা অন্য রকম জায়গা। মানুষের আধিক্যে হাটা-চলা করা দায়। কারো সময় নেই কোন দিকে তাকাবার। পোশাক-আশাকে দেখা যায় পাশ্চাত্যের ছোঁয়া। আর যানজটের সমস্যাতো আছেই। সব মিলিয়ে এই শহরের নতুন বাসিন্দা আলেয়ার নিজেকে মানিয়ে নিতে বেশ সময় লাগে। তারপর চাকুরীর খোঁজ করে সে। চাকুরীর প্রথম সাক্ষাৎকারের অভিজ্ঞতা তার কাছে বেশ অস্বস্তিকর ছিল। ভাইভা রুমে ঢোকার পর।

'বসুন, আপনার নাম কি?'

'আলেয়া বেগম।'

'আপনার বাসা?'

'ক'

'আপনার উচ্চতা?'

'পাঁচ ফুট চার ইঞ্চি।'

'আপনি ফেসে কোন ক্রিম ব্যবহার করেন।'

'খ'

'আপনার পছন্দের রঙ কি?'

'লাল এবং সাদা।'

'আপনার ওড়নাটা তো অনেক সুন্দর, ড্রেসটাও সুন্দর।'

'ধন্যবাদ।'

'কত দিয়ে কিনেছেন?'

এবার আলেয়া আর নিজের মেজাজ ঠিক রাখতে পারে না। সে কড়া গলায় বলে, 'আমি কি কসমেটিকসের দোকান অথবা জামা-কাপড়ের দোকানের ভাইভায় এসেছি?'

একথা বলে কোন উত্তরের আশা না করে সে বের হয়ে যায় ভাইভা রুম থেকে। সেদিন রুমের আর সবাই এ আচরণে থ' বনে গেল।

এর চেয়ে খারাপ ভাইভার অভিজ্ঞতাও তার হয় এ শহরে। সে যখন ভাইভা দিতে বসত, প্রশ্নকর্তাদের কেউ কেউ তার দিকে লোলুপ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকত।
আলেয়া এদের নাম দেয় 'শহুরে শকুন', এই শহুরে শকুনের ভয়েই সে রাজধানীতে আসতে ভয় পেত।

তবে শেষ অবধি একটা ভালো অফিসে তার চাকুরী হল। সেখানে শকুন ছিল না, তাই তার ভয়ও ছিল না।

পরের বছর মখলেছের হাতে একটা তালাকনামা পৌছায়। আজ মখলেছের প্রয়োজন তার কাছে ক্ষীণ।
কলেজের প্রেমিক ছেলেটিও রাজধানীতে এসে চাকুরী করে। আলেয়াকে মাঝে মাঝে ডেকে অনুনয় করে বলে, এসো আমার সনে।

আলেয়া বলে, যে দরজা বন্ধ হয়েছে সে দরজা কেমনে খুলি।

আলেয়ার মা-ভাইয়েরা তাকে ফিরে আসতে বলে বাড়িতে। তবু আলেয়া ফিরে যায় না। কেননা সেই সময়, সেই ঘর, সেই জানালা, সেই আলনা কিছুই আর এখন নেই।

জীবনটাকে সাজাতে অতীতের সেই সময়টাকে সে আবার ফিরে পেতে চাই। তবে অতীত বড় নিষ্ঠুর, সে আর ফিরে আসে না।

৮.

পাঁচ বছর পর।

সাত বছরের এক এতিম বালকের সাথে এখন আলেয়ার বসবাস। বালকটির নাম ইমন। বালকটি আলেয়াকে মা বলে ডাকে না, আন্টি বলেই ডাকে। এতে ক্ষোভ নেই আলেয়ার। ইমনকে ভালো একটা কিন্ডারগার্টেনে ভর্তি করিয়েছে সে। ইমনের সাথে তার সময় এখন ভালোই কাটে।

আলেয়া তাকে মায়ের স্নেহে মানুষ করে। এখনো বছরে একবার সে বাড়িতে যায়।

অথবা ছুটির দিনগুলোতে ইমনকে নিয়ে কোন পার্ক অথবা স্টেশনে চলে যায়। সেখানে পথশিশুদের সাথে গল্প করে, তাদের নিজের হাতে রান্না করা খাবার খাওয়ায়। পার্ক কিংবা ফুটপাতের শত শত শিশুদের নাম তার জানা। শিশুরাও তাকে মমতাময়ী হিসেবে জানে। এখন এভাবেই অবিরত চলতে থাকে তার বিধ্বস্ত দিনের পঞ্জিকা।

এইতো আলেয়া, এইতো আলেয়ার জীবন; আবেগ ভরে যার খোঁজ এখন আর কেউ রাখে না।


***সমাপ্ত***