প্রায় সব দলের মধ্যে একটা না একটা করে এই ধরনের নামের মানুষ থাকে। অনেক দলের গফুরেরা হয়তো অনেক স্মার্টও হয়। কিন্তু আমাদের দলের গফুর ছিল আসলেই নিপাট গফুর। গফুর ও মহেশ গল্পের গফুরের কথা মনে পড়লে যেমন একটা দুঃখী মানুষের ছবি ভেসে উঠে মনে আমাদের গফুরের কথা মনে হলেও তেমনটি হত।
গফুরের সাথে আমার শেষ দেখা হয়েছিল প্রায় দুই বছর আগে। জাহাজ থেকে গিয়ে তখন আমি যশোরে বসবাস শুরু করেছি। সে তখনও যশোরেই থাকে। একদিন সন্ধ্যায় ওকে আসতে বললাম। দড়াটানা মোড়ে আমাদের দেখা হল সেটাও প্রায় দুই বছর পরে। ওর মাথার চুল গুলো সুন্দর করে কাটা। শেষবার যখন দেখেছিলাম তখন মাথা ভর্তি ঝাঁকড়া চুল ছিল। ওর মেসে গিয়ে দেখেছিলাম ও সুন্দর সুর করে বাঁশের বাঁশি বাজাচ্ছে। আমি অবাক হতে গিয়েও হইনি। গফুরকে দিয়ে এটা সম্ভব। বেশ কিছুদিনের তপস্যায় সে বাঁশের বাঁশি বাজানো শিখেছে। এযুগে আমরদের হাতে যখন স্মার্টফোন তখন গফুরের হাতে বাঁশের বাঁশি। ঝাঁকড়া চুলের বাঁশের বাঁশি হাতে গফুরকে দেখে মনে হচ্ছিল না সে একটা মাস্টার্স পড়া ছেলে। মনে হচ্ছিল কোন এক বাউল।
সেদিন দড়াটানা মোড়ে আমরা খুব বেশী সময় একসাথে থাকতে পারিনি। আমরা চত্তরে বসছি মাত্র রাজনৈতিক গোন্ডগোল শুরু হয়ে যায়। লোকজন ছোটাছুটি শুরু করলে আমরা একটা লাইব্রেবির মধ্যে ঢুকে পড়ি। পরিবেশ একটু শান্ত হবার পরেই সেদিন সেখান থেকে চলে এসেছিলাম। তার পরে আর গফুরের সাথে মিলিত হবার প্রগ্রাম করতে পারিনি।
ক্লাস এইটের বৃত্তি পরীক্ষার সময় গফুরের সাথে ঘনিষ্টতা হয়েছিল আমার। আমরা মার্চ মাস থেকেই স্কুলের বোর্ডিং এ থাকতাম স্পেশাল কেয়ারের জন্য। গফুরের মা মারা গেছিল সেই ছোট বেলায়। বাবা গ্রাম্য কৃষক। দৈন্যতার মধ্যে বেড়ে ওঠা গফুরের মধ্যে একটা জড়তা কাজ করতো বলে তখন মনে করতাম কিন্তু পরেও দীর্ঘ কাল ওর ঐ নির্লিপ্ত জীবন যাপন দেখে বুঝেছিলাম ওটা নিপাট ভাল মানুষী ছাড়া আর কিছুই ছিল না। গফুরের জীবন যাপন কথা বার্তা এমন ছিল আমরা অনেকস সময় ওকে গফুর চাচা বলে সম্বোধন করতাম। ওর মধ্যে কখনো কোন লোভ দেখিনি, দেখিনি কাউকে নিয়ে জেলাস হতে। দেখিনি কোন উচ্চাকাঙ্খা।
এবার দেশে থাকার সময় ওর খোঁজ নিয়ে জেনেছিলাম ঢাকাতে থেকে চাকরীর চেষ্টা করছে। হঠাৎ একদিন ফেসবুকে আবিস্কার করলাম ওকে। আমাদের কেউ একজন বলল, ফেসবুক ক্ষ্যাত হয়েছে নাকি গফুর স্মার্ট হয়েছে কে জানে?
ফেসবুকে ওর ছবি দেখলাম টাক মাথায় খালি গায়ের ছবি। বুঝলাম ওর মধ্যের বাউল ভাব তাহলে যায়নি এখনো। তবে ও চাকরি তে জয়েন করেছে জানতাম না। জানলাম কালকে। ওর চাঁদপরে পোষ্টিং ছিল। একজন কলিগের সাথে মোটর সাইকেলে কোথাও যাচ্ছিল ও। এটুকু শুনলেই আমি বলতাম, গফুর মোটর সাইকেল চালানো শিখলো কবে??????
কিন্তু শুধু এই খবরটি আমার কাছে এসে পৌছায়নি। খরবটি এসেছে আরো এক হৃদয় বিদারক ঘটনার সাথে। গফুরের মোটর সাইকেল টি নিয়ন্ত্রন হারিয়ে রাস্তার পাশের আইল্যান্ডের সাথে ধাক্কা খায়। পড়ে গিয়ে মাথায় পচন্ড আঘাত পেয়ে ঘটনা স্থালেই প্রান ত্যাগ করে আমার বন্ধু গফুর।
আর কিছু লেখার মতো হার সরছে না। জ্ঞান বুদ্ধি হবার পরে এত কাছ থেকে মিশেছি এক কাউকে হারালাম এই প্রথম। কেমন যেন অবশ হয়ে যাচ্ছে মাথার ভেতর টা। বিশ্বাস হতে চাচ্ছে না। মনে হচ্ছে আমি তো নিজের চোখে কিছু দেখিনি। আমাদের বন্ধু গফুর, ফেসবুক বিহীন গফুর, মোটসাইকেল চালাতে না জানা গফুর ঝাঁকড়া চুলে কোন এক অজানা নদীর ধারে বসে হয়তো বাঁশের বাঁশিতে সুর তুলছে এখনো। জাহাজ থেকে নেমেই খুঁজে পাবো ওকে।