জাহাজে আমার কাজ কি??? দেশে গেলে এটা আমার কাছে সব থেকে কঠিন প্রশ্ন।
তুমি কি জাহাজ চালাও??? ক্যামনে বুঝামু জাহাজরে বাস ট্রাক এর মতো হাতে স্টিয়ারিং ধরে চালানো লাগে না।
তাইলে জাহাজ ক্যামনে চলে??? মুন চাই হাত পা ছুইড়া কান্দি। ম্যাপ রে যে আমরা চার্ট বলি এইড়া বুঝাইতে গেলেইতো হাঁপানি উঠে জাপান যাইতে হইবো আর কম্পাস জিপিএস ক্যামনে বুঝামু।
সংক্ষেপে কই আমরা তিনজন নেভিগেটিং অফিসার চব্বিশ ঘন্টা জাহাজটা ওয়াচ করি।
উল্টা প্রশ্ন, ওয়াচ? মানে খালি দেখলেই চলে?? কই হু খালি দেখলেই চলে। সব অটোমেটিক সিস্টেম ঠিকমতো কাজ করছে কিনা দেখলেই চলে।
যদিও আমি নিজে জানি এইডা ডাহা মিথ্যা কথা। জাহাজে মুষ্টিমেয় কিছু কাজ অটোমেটিক্যালি হয়।
কৌতুহলি জনতার কাছে ব্যাপারটা ক্লিয়ার হয় না। আমি আর একটু বলি।
আমার কাজ হচ্ছে রুট প্লান করা। জিপিএস থেকে জাহাজের অবস্থান দেখে সেই রুট ধরে ধরে এগিয়ে যেতে হয়।
ক্যাপ্টেন অভারঅল কমান্ডে, চীফ অফিসার কার্গো লোডিং আর থার্ড অফিসার হল সেফটি। এইভাবে জাহাজ চলে। জনতা মাথা চুলকায়।
প্রশ্ন করে এত্ত বড় জাহাজ। সব কিছু কোত্থেকে দেখো। আমি কই 'ব্রীজ থাইক্যা'।
-কোন ব্রীজ??? হেই ব্রীজ কি যমুনা ব্রীজের থেকেও বড়???
ওরে কেউ আমারে ধর। ক্যামনে বুঝাই এই ব্রীজ হেই ব্রীজ না। এইড়া হইলো জাহাজের কন্ট্রোল রুম।
এটা আমার জাহাজী জীবনে প্রতিবার জাহাজ থেকে নামার পরের ফেসবুকের স্ট্যাটাস। জানি আমাদের জীবনটা সকলের থেকে একটু অন্যরকম। আর অন্যরকম জীবনের অধিকারী মানে অন্যজাতের মানুষ। আর তাই স্বীকার করি সবাইকে আমাদের জীবন সম্পর্কে ধারনা দেয়া আমার দায়িত্বের মধ্যেও পড়ে। আমি একজন মেরিনার হিসেবে সামুতে আছি। আমার বিভিন্ন বিভিন্ন লেখায় ঘুরে ফিরে জাহাজ প্রসঙ্গ চলে আসে। এখনেও অনেকে আগ্রহ প্রকাশ করেছেন জাহাজী জীবন সম্পর্কে। তো চলুন দেখি ছবি ও গল্পে আপনাদেরকে ঘুরিয়ে নিয়ে আসি জাহাজ থেকে।
আমি জাহাজ থেকে নেমে স্পিড বোর্ট থেকে এই ছবিটি তুলছিলাম। জাহাজটি মিশরের সুয়েজ ক্যানেল ট্রানজিটের মুখে নোঙর করে আছে। ওখানে একটা নির্দিষ্ট সময়ে কয়েকটা জাহাজকে গ্রুপ করে ক্যানেল পার করানো হয়। এই গ্রুপকে কনভে বলে। গ্রুপ করার কারন হচ্ছে সুয়েজ ক্যানেল দিয়ে একসাথে দুই পাশ দিয়ে জাহাজ চলাচল করতে পারে না। এইজন্য একএকটা কনভে তৈরির জন্য জাহাজগুলোকে অপেক্ষা করতে হয়।
সুয়েজ পার হচ্ছে আমাদের জাহাজ।
জাহাজের যে কন্টোল রুমের কথা বললাম এই সে কন্টোল রুম। প্লেনে এটাকে ককপিট বলে আর জাহাজে বলে নেভিগেশন ব্রীজ(Navigation Bridge) । ছবিটি যেখান থেক তোলা সেই জায়গার নাম ব্রীজ উইং। মানে হল ব্রীজের ব্যলকনি। আর JINDAL VARAD হল জাহাজটির নাম।
ব্রীজের কয়েকটি ভেতরের ছবি নিচে দেয়া হল। মাঝখানে দাড়িয়ে দুই পাশের ছবি নেয়া। চর্তুদিকে গ্লাসে মোড়ানো ব্রীজ থেকে জাহাজের সামনে পিছে সব দিক দেখা যায়।
জাহাজ চালানোর জন্য ব্যবহৃত স্টিয়ারিং হুইল। তবে এই স্টিয়ারিং এর ড্রাইভার কোন আরামদায়ক সিটে বসে স্টীয়ারিং করে না। তাকে দাড়িয়েই থাকতে হয়। জাহাজের স্টিয়ারিং এর জন্য নিদির্ষ্ট লোক থাকে যাকে হেলমসম্যান বলে। একটা জাহাজে তিনজন হেলমসম্যান থাকা আবশ্যক। মজার ব্যাপার হল জাহাজের স্টিয়ারিং করতে হলে সামনে তাকানোর কোন প্রয়োজন নেই। একটা কম্পাসই হল জাহাজের পথ চলার নির্দেশক। টাইম টু টাইম হেলমসম্যানকে স্টিয়ারিং এর নির্দেশনা দেয়া হয়। তবে হাতে স্টিয়ারিং করার প্রয়োজন পড়ে যখন একটা জাহাজ কোন দেশে এপ্রোচ করে। গভীর সমুদ্রে হাতে স্টিয়ারিং কোন দরকার নেই। সেজন্য আছে অটো পাইলট। এই পাইলট কম্পাসে ডিউটি অফিসারের সেট করে দেয়া কোর্স অনুযায়ী জাহাজ চালাতে থাকে।
এটি একটি কম্পাস রিপিটার। জাহাজের বিভিন্ন জায়গায় কম্পাসের রিপিটার বসানো থাকে। তবে একটা জিনিস বলে রাখি। প্রাক্টিক্যালি জাহাজে যে কম্পাস ব্যবহার করা হয় সেটা ম্যাগনেটিক কম্পাস নয়। ইলেকট্রিক। একে বলে জাইরো কম্পাস(Gyro compas)। এটি প্রচন্ড একটা ঘুর্ননের মাধ্যমে ট্রু নর্থ মানে উত্তর দিক খুজে বের করে। আর ম্যাগনেটিক কম্পাস জাহাজে থাকে ইমার্জেন্সির জন্য। ইন কেজ জাইরো কম্পাস নষ্ট হয়ে গেলে কাজ চালানোর জন্য।
এটিই হল একটা জাহাজের পথ চলার রাস্তা। যাকে বলা যায় পেন্সিলে আকা পথ। এই ম্যাপকে আমাদের জাহাজী পরিভাষায় বলা হয় নেভিগেশন চার্ট। WHO মানে ওয়ার্ল্ড হাইড্রোগ্রাফিক অর্গানাজাইশেন পুরো পৃথিবীর প্রত্যকটা জায়গার জন্য এরকম চার্ট বানিয়ে রেখেছে। একটা চার্টে পানির গভীরতা সহ সমুদ্রের তলদেশ ও আশেপাশের ল্যান্ডের সমস্ত তথ্য দেয়া থাকে। এই চার্ট আবার বছরে বছরে আপডেট করা হয়। তাছাড়া প্রতি সপ্তাহে নোটিশের মাধ্যমে জানানো হয় কোন চার্টে কোন ধরনের পরিবর্তন আসছে কিনা।
পেন্সিলের পথটাতে দেখবেন ঘণ্টায় ঘণ্টায় জাহাজের অবস্থান বসানো হয়েছে। জায়গাটা থাইল্যান্ড আর ইন্দোনেশিয়ার মধ্যবর্তী মালাক্কা প্রনালি। ছবিতে আরো ইন্টারেস্টিং যে ব্যপারটা দেখা যাচ্ছে তা হল আমরা এই পথে যাবার সময় পূর্বনির্ধারিত পথ থেকে একটু থাইল্যান্ডের দিকে সরে গেছি। কেন বুঝতে পারছেন? মোবাইল নেটওয়ার্কের জন্য। আমাদের জাহাজে অনেকের কাছে থাইল্যান্ডের সিম কার্ড থাকাতে আমরা পথিমধ্যের এই সুবিধাটা থেকে বঞ্চিত হতে চাইনি। এই আনঅফিশিয়াল ব্যপারটাকে আমরা বলে থাকি সেলফোন নেভিগেশন।
যাইহোক জাহাজী জীবনের ছবি আর গল্প বলে শেষ করা যাবে না। তবে আজকে এই পর্যন্তই। আপনাদের ভালো লাগলে ধারাবাহিকতা রক্ষা করবো।
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই জুলাই, ২০১৪ রাত ১১:১৩