বাংলা সাহিত্যের নবজাগরণের পথিকৃত বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। তাকে বাংলা সাহিত্যের প্রথম আধুনিক ঔপন্যাসিক হিসেবে গন্য করা হয়। বাংলা গদ্য ও উপন্যাসের বিকাশে তার অসীম আবদানের জন্য তিনি বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে অমরত্ব লাভ করেছেন। ‘কমলাকান্ত’ ছদ্মনামে সাহিত্য জগতে পর্দাপণ করে তিনি একাধারে তিনি গীতার ব্যাখ্যদাতা ও বিশেষ সাহিত্য সমালোচক হিসেবে খ্যতি লাভ করেন। তিনি বাংলা সাহিত্যের আদি সাহিত্য পত্রিকা বঙ্গদর্শনের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক ছিলেন।
আজকের এই দিনে মানে ২৬শে জুন, ১৮৩৮ পশ্চিম বঙ্গের উত্তর চব্বিশ পরগনা জেলার নৈহাটি শহরের নিকটস্থ কাঁঠালপাড়া গ্রামে তিনি জন্ম গ্রহন করেন। দিনটি ছিল বাংলা ক্যালেন্ডারের পাতায় ১৩ই আষাঢ়। তাদের আদিনিবাস ছিল হুগলী জেলার দেশমুখো গ্রামে। মাতামহের সম্পতি পেয়ে বঙ্কিমচন্দ্রের প্রপিতামহ কাঁঠালপাড়ায় বসবাস শুরু করেন।
কুল-পুরোহিত বিশ্বম্ভর ভট্টাচার্যের কাছে কাঁঠালপাড়াতেই বঙ্কিমচন্দ্রের বিদ্যাশিক্ষার হাতেখঁড়ি হয়। শিশু বয়সেই তার অসামান্য মেধার পরিচয় পাওয়া যায়। জানা যায় তিনি এক দিনেই বাংলা বর্ণমালা আয়ত্ম করেন। তবে গ্রামের পাঠশালায় তিনি কোনদিনই যাননি। পাঠশালার গুরুমশাই রামপ্রাণ তাদের বাড়িতে গৃহশিক্ষক নিযুক্ত হন। তবে রামপ্রাণের কাছে পাঠ গ্রহন তার কাছে উপভোগের ছিল না। তিনি লিখেছেন, “সৌভাগ্যক্রমে আমরা আট দশ মাসে এই মহাত্মার হস্ত হইতে মুক্তিলাভ করিয়া মেদেনীপুর গেলাম”।
মেদেনীপুরেই তার প্রকৃত শিক্ষার সূচনা হয়। ১৯৪৪ সালে এফ টিড ‘র ইংরেজি স্কুলে শিক্ষা গ্রহন শেষে ১৯৪৯ সালে আবার কাঁঠালপাড়ায় ফিরে এসে শ্রীরাম ন্যায়বাগীশের কাছে বাংলা ও সংস্কৃতের পাঠ নেন। পণ্ডিত হলধর তর্কচূড়ামণির কাছে নিয়মিত মহাভারত শ্রবণ করে শিক্ষা গ্রহন করেন, “শীকৃষ্ণ আদর্শ পুরুষ ও আদর্শ চরিত্র”। তার পরবর্তি জীবনে রচিত অনেক রচনায় এই শিক্ষার প্রতিফলন দেখা যায়।
কবিবর ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের “প্রভাকর” ও “সংবাদ সুধারঞ্জণ” নামক সংবাদপত্র দুটি তার সাহিত্য বিকাশের ক্ষেত্রে অনন্য আবদান রাখে। কাঁঠালপাড়ায় থাকাকালিন সময়ে তিনি এই পত্রিকায় প্রকাশিত কবিতাগুলো মুখস্থ করতে আবৃত্তি করতে পছন্দ করতেন। তিনি একজন খুব ভালো আবৃত্তিকারকও ছিলেন।
পরবর্তিতে হুগলী কলেজে পড়াশুনার সময়ে তিনি প্রভাকর ও সংবাদ সুধারঞ্জনে গদ্য ও পদ্য রচনা শুরু করেন। হুগলী কলেজে সাত বছর পড়াশুনা শেষে তিনি কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজে আইন পড়ার জন্য ভর্তি হন। আইন বিষয়ে প্রবেশিকা পরিক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম বারের মতো অনুষিতব্য বি.এ পরিক্ষায়ও পাশ করেন তিনি। তারপর বাবার মতো যোগ দেন সরকারী চাকরীতে। ডেপুটি ম্যজিষ্ট্রেট ও ডেপুটি কালেক্টর পদে তিনি অত্যন্ত নিষ্ঠার সাথে তার দ্বায়িত্ব পালন করে বৃটিশ সরকারের কাছ থেকে "রায় বাহাদুর" ও "কম্প্যানিয়ন অফ দ্যা মোস্ট এমিনেন্ট অর্ডার অফ দ্যা ইন্ডিয়ান এম্পায়ার" খেতাব অর্জন করেন।
চাকরীজীবনের সাফল্যে তার ব্যক্তিজীবন উজ্জল করলেও ইতিহাসে তিনি অমর হয়ে আছেন তার সাহিত্য সাধনা দিয়ে। দুর্গেশনন্দিনী ‘র মতো প্রথম বাংলা সাহিত্যের সফল উপন্যাস রচনা করে তিনি অমরের খাতায় নাম লিখিয়েছেন সেদিনই। এরপর কপালকুণ্ডলা, কৃষ্ণকান্তের উইল, বিষবৃক্ষ, আনন্দমঠ, দেবী চৌধুরানী’ ‘র মতো কালজয়ী উপন্যাস সৃষ্টি করে তিনি বাংলা ভাষাভাষীকে তাঁক লাগিয়ে দেন। তার সাহিত্য সাধনা ছিল বাংলা গদ্যে বিপ্লবের সূচনা।
জন্মবার্ষিকীতে তার কয়েকটি উপন্যাসের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি তুলে ধরা হল।
১. দুর্গেশনন্দিনী ( Daughter of the Feudal Lord)
ষোড়শ শতাব্দীর শেষভাগে উড়িষ্যার অধিকারকে কেন্দ্র করে মোঘল ও পাঠানের সংঘর্ষের পটভূমিতে রচিত এই উপন্যাস বঙ্কিমচন্দ্র চব্বিশ থেকে ছাব্বিশ বছর বয়সে রচনা করেন। তার রচিত প্রথম এই উপন্যাসটি প্রকাশের পরে বাংলা কথা সাহিত্যের ধারায় এক নতুন যুগ প্রবর্তিত হয়। এটিকে বাংলাসাহিত্যের প্রথম সফল উপন্যাস হিসেবে ধরা হয়। তবে কোন কোন সমালোচক এখানে ওয়াল্টার স্কটের ‘আইভানহো’ উপন্যাসের ছায়া ছায়া লক্ষ্য করেছেন।
২. মৃণালিনী
তুর্কী সেনাপতি ইখতিয়ার উদ্দিন মুহম্মদ বিন বখতিয়ার খলজী ‘র বাংলা আক্রমনের পটভূমিতে স্বদেশপ্রেমকে বিষয়বস্তু করে লেখা এটি একটি ঐতিহাসিক উপন্যাস। আলিপুর থাকাকালিন সময়ে রচিত উপন্যাসটি বঙ্কিমচন্দ্র তার বন্ধু বিশিষ্ট নাট্যকার দীনবন্ধু মিত্র কে উৎসর্গ করেছিলেন তিনি। রাজপুত্র হেমচন্দ্র এবং মৃণালিনীর প্রেমকাহিনীকে কেন্দ্র করে উপন্যাসটি আবর্তিত হয়েছে।
৩. বিষবৃক্ষ
এটি একটি সামাজিক উপন্যাস। উপন্যাসের বিষয়বস্তু ছিল সমসাময়িক বাঙালি হিন্দু সমাজের প্রধান দুটি সমস্যা- বিধবা বিবাহ ও বহু বিবাহ প্রথা। উপন্যাসের পটভূমি বিধবাবিবাহ আইন পাশ হওয়ার সমসাময়িক কাল। এই উপন্যাসের নায়িকা বিধবা কুন্দনন্দিনীর চরিত্রটি তার কনিষ্ঠা কন্যার ছায়া অবলম্বনে রচিত বলে ধারনা করা হয়। উপন্যাসে তিনি বিধবা বিবাহের কুফল দেখিয়েছেন। এ সম্পর্কে অসিতকুমার বন্দোপাধ্যায় লিখেছেন, “কেবল বিধবাবিবাহের সামাজিক কুফল দেখানোর জন্য বঙ্কিমচন্দ্র এ উপন্যাস রচনা করেননি। তা যদি করতেন তা হলে তাঁকে প্রশংসার বিল্বদলে পুজার প্রয়োজন হতোনা। তা হলে এটি নিছক উদ্দেশ্যমূলক উপন্যাস হতো। পুরুষের দূর্বল হৃদয়ের পরাজয় এবং সেই পতন থেকে আত্মরক্ষার কথা এই উপন্যাসে বর্ণিত হয়েছে”। বঙ্কিমচন্দ্রের জীবদ্দশায় এই উপন্যাসের আটটি সংস্করণ সহ হিন্দুস্থানী, ইংরেজি ও সুইডিশ ভাষায় অনুদিত হয়।
মোট কথা তার উপন্যাসগুলোতে যেমন ছিল সাহিত্যের রসের সাথে বৌদ্ধিক রসের মিসেল তেমনি সমসাময়িক জাতীয়তাবাদের ঝড়ো হাওয়া। এছাড়া তার রচিত প্রবন্ধগুলোও ছিল অসামান্য। কমলাকান্তের দপ্তর, লোকরহস্য, কৃষ্ণ চরিত্র, সাম্য তারই উদাহরণ।