তখন সবে ssc পরীক্ষা দিব।সালটা ছিল ১৯৯৬। বাবা ছিলেন সরকারি কর্মকর্তা।চাকরী করতেন পূর্ত মন্ত্রণালয়ে।সে সময় আমার বাবার নামে নতুন বিল্ডিংয়ে সরকার একটা নতুন ফ্লাট বরাদ্দ দেয় কিন্তু তখনো বিল্ডিংটির কোন বাসায় গ্যাস সংযোগ না থাকাতে আমরা পুরো পরিবার আমাদের পুরোনো সরকারী ফ্লাটেই থাকতাম।নতুন ফ্লাটটি তাই ফাকা।তখন বাবা আমাকে আর আমার এক বন্ধুকে এই নতুন ফ্লাটেই থাকতে দিলেন যাতে আমরা ssc এর জন্য ভালভাবে পড়তে পারি।
নতুন ফ্লাটটির সামনে কোন বিল্ডিং নাই।বাসার পিছনের দিকে একটা বিল্ডিং ছিল।সেই বিল্ডিংয়ের সব বাসিন্দারা সরকারের যুগ্মসচিব বা ওই পর্যায়ের কর্মকর্তা।আর ওই বিল্ডিং এর পিছনের দিকটা ছিলো আমাদের বিল্ডিংয়ের পিছনের দিকের একবারে মুখোমুখি।আমাদের নতুন বিল্ডিংটির সব বাসাতেই সামনে ও পিছনে বারান্দা ছিলো কিন্তু পিছনের বিল্ডিংটির সব বাসায় শুধু পিছনের দিকটিতেই বারান্দা ছিলো।
আমাদের ssc পরীক্ষা শুরু হয় ২৯সে মার্চ থেকে।আমারা ১৫ই মার্চ থেকে নতুন বাসাতে উঠলাম।যেদিন উঠলাম ওই দিন রাতের বেলায় বন্ধুসহ গেলাম পিছনের বারান্দায় ।পিছনের বিল্ডিংয়ে কে কে থাকে তা নিয়ে মজার গবেষণা করার জন্য।
আমারা থাকতাম ৩য় তলাতে।রাত তখন ১২ টা।পাশের বিল্ডিং সব ফ্লাটেই তখনো আলো। এক তলা থেকে আমাদের গবেষণা শুরু হলো।পাশের বিল্ডিং এর এক তালাতে রান্নাঘরে একটা ছেলে কাজ করছিলো।আমার প্রতি বন্ধুর প্রশ্ন ছিলো বলতো ওই ছেলেটা এই বাড়ির কাজের ছেলে হবে নাকি বাড়ির মালিকের ছেলে হবে?আমি ছেলেটির গায়ের জামা দেখে বললাম ছেলেটি কাজের ছেলেই হবে।নতূবা এত রাতে কাজ করে নাকি?এখন আমি বন্ধুকে ২য় তলার এক মহিলাকে দেখিয়ে বললাম ‘বলতো ওই মহিলা বাড়ির কে হবে।বন্ধু বলল কাজের মেয়েই হবে।দুই জনই হেসে দিলাম কারন ওই মহিলা আসলে কাজের লোক ছিলেন না।যা হোক মহিলা তো আর শুনতে পায়নি।এখন আমাদের সরাসরি ৩য় তলাতে এক মেয়ে তখন খাওয়া শেষ এ প্লেট ধোয়ার জন্য রান্না ঘরে আসল।আমার বন্ধু আমাকে বল্ল ‘ বলতো দোস্ত ওই মেয়ে এই বাড়ির কে?’ আমিও চোখ বুজে বলে ফেললাম কে আবার? কাজের মেয়ে হবে।বাসা সরাসরি হওয়াতে ওই মেয়ে কথাটা শূনে ফেল্ল। আমরা তো হাসছিলাম।কিছুক্ষন পর ওই মেয়ে তার মা কে ডেকে আনলো।আমাদের দেখিয়ে বল্ল মা ওই ছেলেরা আমাকে কাজের মেয়ে বলেছে।ওর মা আমাদের কিছুক্ষন দেখে চলে গেলেন।ওর মা ছিল একটা সরকারী হাই স্কুল এর প্রধান শিক্ষিকা।আমরা আর কিছুক্ষন থেকে চলে গেলাম।পরদিন ই আমার বাবা বাসায় আসলেন।আমাদের পিছনের বারান্দাতে যেতে নিষেধ করে গেলেন।আমারা এই নিষেধ এর কোনো কারণ খুজে পেলাম না।
আমরা নিয়মিত পিছনের বারান্দাতে যেতাম।ওই মেয়েও আসতো।মাঝে মাঝে চোখে চোখ পড়তো।তখন মাঝে মাঝে সে হাসতো।এই অবস্থা দেখে এইবার আমার বন্ধুও আমাকে পিছনের বারান্দাতে যেতে নিষেধ করা শুরু করলো।আমি বলতাম আমার বারান্দাতে আমি আছি তাতে কার কি?ওই মেয়ের পাশের বাসাতে আমাদের এক বন্ধুর বন্ধু থাকতো। তার কাছ থেকে জানতে পারলাম ওই মেয়ে ৭ম শ্রেনীতে পড়ে।আমারা ssc পরিক্ষা দিবো। তাই রাত ২ টা পযন্ত পড়তাম।আমরা সকাল ১০ টা পযন্ত ঘুমাতাম কিন্তু মেয়ে প্রতিদিন ই রাত ২ টা পযন্ত পড়তো আবার সকালে স্কুল যেত।।রাত ২ টা থেকে ৩ টা পযন্ত আমরা পিছনের বারান্দাতে যেতাম।হাওয়া খেতাম।ওই মেয়েও তাদের পিছনের বারান্ধাতে এত রাতে আসতো।আমরা যতক্ষন থাকতাম সেও ততক্ষন থাকতো।আমরা বন্ধুর মাধ্যমে জানতে পারলাম ওই মেয়ে রাত ২ টা পযন্ত সবসময় পড়ে।সে মতিঝিল আইডিয়েল স্কুল এর student।
এভাবে প্রতিদিন রাত ২ টা থেকে ৩ টা পযন্ত আমরা পিছনের বারান্ধাতে যেতাম।সেও আসতো। আমরা শুধু একে অপর কে দেখতাম।১ম সপ্তাহে দিনে পড়তাম আর রাত ২টা পার হলেই কেনো যেন পিছনের বারান্দা আমাদের ডাকতো।২য় সপ্তাহ থেকে দেখি দিনের বেলাতেও ওই মেয়ে স্কুল থেকে এসে গোসল করে পিছনের বারান্দাতে দাড়াতো।ওর বারান্দা থেকে আমরা ঘরের ভিতর কি করছি তা দেখা যেতো কারন নতূন বিল্ডিং হওয়াতে আমাদের বাসাতে জানালায় কোন পর্দা ছিলো না।এখন দুপুর ১ টায় যখন ওই মেয়ে সদ্য গোসল করে পিছনের বারান্দাতে আসতো তখন আমরা ওর কিশোরী দেহের রুপ দেখে মুগ্ধ হতাম আর পড়া ভুলে যেতাম।এই সপ্তাহ পরেই যে আমাদের ssc পরীক্ষা সেটাই ভুলে যেতাম।
এতদিনে বন্ধুর বোনের কাছ থেকে সে ও জেনে গেছে আমাদের সামনে ssc পরীক্ষা।২৩ শে মার্চ ১৯৯৬।ওই দিন দুপুর বেলাতে আকাশে প্রচন্ড কালোমেঘ জমলো ।আমি ছোট বেলা থেকেই বৃষ্টিতে ভিজতাম। বৃষ্টির জলকণা মুখের ভিতরে পড়লে কেমন জানি সুখের একটা অনুভূতি হতো সারা শরীর জুড়ে। তাই ওই দিনের মেঘ দেখে আমার মন আনন্দে নেচে উঠল।আমি পিছনের বারান্দাতে বৃষ্টির জন্য অপেক্ষা করছিলাম।আকাশের রুপ দেখে মনের মধ্যও চলছিলো রোমান্টিকতা। এর মধ্য পিছনের বারান্দাতে আসলো ওই কিশোরী।সে সাথে আসলো প্রছন্ড বৃষ্টি ।আমি পরীক্ষা ভুলে পিছনের বারান্দাতে বৃষ্টিতে ভিজছিলাম আর আমার বন্ধুকেও বলছিলাম বৃষ্টিতে ভেজার জন্য ।ও ssc পরীক্ষার কথা চিন্তা করে রুম এর ভিতরে ছিলো।এই সময় দেখি ওই কিশোরীও মনের আনন্দে বৃষ্টিতে ভিজছিলো। হঠাত সে আমাকে কি যেন বলে উঠল। প্রচন্ড বৃষ্টির জন্য আমি শুনতে পারলাম না যে সে কি বল্ল।সে তখন পিছনের বারান্দা থেকে তাদের রান্নাঘরে আসলো।তার চেহারা তে প্রছন্ড ভয়। সে বল্ল আমি কেন বৃষ্টিতে ভিজছি?আমার না ৫ দিন পর ssc পরীক্ষা।আমার যদি শরীর খারাপ হয়।আমি তো অবাক।এই কিশোরী আমাকে নিয়ে চিন্তা করছে কেনো?আমি বললাম আমার মন চাইছে আমি ভিজছি।আপনার তাতে কি? ওই প্রথম ওই মেয়ের সাথে আমার কথা বলা। ওই দিন রাততো আর ঘুমাতে পারলাম না।তারপর ssc পরিক্ষা দিলাম।ওই মেয়ের সাথে প্রেম হলো। এক সঙ্গে কত দিন পিছনের বারান্দাতে গল্প করতাম। কত রাত শুধু দুইজনে দাঁড়িয়ে কাটিয়ে দিতাম।কোনো কথা হতো না।বেশী কথা বলার মন চাইলে TNT থেকে ফোন দিতাম।ও কিভাবে সারারাত দাঁড়িয়ে থেকে ভোরের দিকে একটু ঘুমিয়ে স্কুল এ যেত আমি জানিনা।মাঝে মাঝে ওকে চলে যেতে বল্লেও ও যেতো না।এক সময় ssc পরিক্ষার রেজাল্ট দিলো।১ম বিভাগ পেলাম।আমার চাইতে ওর মন খারাপ হলো বেশী।আমি কেনো star mark পেলাম না। কতো দিন আমরা এক সাথে হেটেছি।ওর জন্মদিনে একসাথে বের হতাম।এক সময় ও ssc পরীক্ষা দিলো।golden 5 পেলো।আইডিয়েল কলেজে উঠল।HSC তে golden 5 পেলো।এক সময় জাহাংগীর নগর ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হলো।আস্তে আস্তে আমাদের প্রেমও কেনো যেন শীতল হতে শূরূ করলো।
যদিও দোষ বেশীরভাগ আমারই ছিল। প্রথম প্রথম ও অনেক কেদেছিলো সম্পর্ক রাখার জন্য কিন্তু আমি কেন যেন হতাশ ছিলাম অন্যরকম হয়ে গিয়েছিলাম খারাপ বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে। ও ফিরাতে অনেক চেষ্টা করেছে। আমি ফিরিনি।এক সময় ও বৃথা চেষ্টা বাদ দিয়ে আমাকে ত্যাগ করলো।আমি তখন বুঝতে পারলাম আমি কি হারিয়েছি।আমি খারাপ পথ থেকে ফিরে আসতে চেষ্টা করলাম এবং ফিরেও আসলাম।এরপর আমি অনেক মাপ চেয়েছি কিন্তু মাপ পিইনি।আমিও কেদেছিলাম।সে আর ফিরে আসেনি।আমাদের মাঝে প্রেম থাকলেও আমি কখনো তার হাত পযন্ত ধরিনি।মাঝে মাঝে মনে হয় হাত ধরিনি বলেই হয়তো ওকে পাইনি।
আজ আমি প্রতিষ্ঠিত।ভালো চাকরী করি।আমার টাকা আছে।তার হাতটি ধরার ইচ্ছেও আছে।যখন টাকা ছিলো না তখন সে ছিলো কিন্তু এখন আমার টাকা আছে কিন্তু সে আজ অন্যর ঘরণী।এখন আর আকাশের কালো মেঘ আমাকে ডাকেনা।বৃষ্টি ভেজার সেই আনন্দময় আনুভূতিও আর নেই।এখনও মেঘ দেখলে আমি মনকে ঠিক রাখতে পারিনা।আমি ফিরে যাই ১৯৯৬ সালের সেই মেঘলা দিনে।আকাশের কালোমেঘ তখন বৃষ্টি হয়ে ঝরে যায় দুচোখ বেয়ে।
সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৪ রাত ১০:৪৪