ব্লগারদের 'বিচারক' নির্বাচন করতে অনুরোধ করেছিলাম। ব্লগাররা যাদের নাম সাজেস্ট করছেন, তাঁরা কেউই নানা ধরনের সমস্যার কারণে বিচারক হিসাবে দায়িত্ব পালন করতে চাইছেন না। ভালো একটা বিপদ হলো!
আমরা চাইলে এই সমস্যাটির সমাধান খুব সহজেই করতে পারি। কিন্তু আমরা চাই ব্লগাররা সামগ্রিক বিষয়ে একমত হয়ে একটি সিদ্ধান্তে আসুক। আমরা ছোট একটি কমিউনিটি- এখানেই যদি আমরা নির্বাচন কমিশন ঠিক করতে না পারি, তাহলে ১৬ কোটি দেশের মানুষের নির্বাচন কমিশন কিভাবে কাজ করবে?
আমরা এবার ব্লগারদেরকে বিচারক প্যানেল নির্বাচন করতে দিয়েছি - কারণ আমরা চাই ব্লগাররা এই ধরনের প্রক্রিয়ার সাথে সম্পৃক্ত হোক। এটা একটি অভিজ্ঞতা, যা ব্লগারদের ব্যক্তিগত জীবনেও কাজে দিবে। পাশাপাশি, আরো একটি কারণ হচ্ছে, ইতিপূর্বে ব্লগ টিম থেকে মনোনীত বিচারক প্যানেল নিয়ে অনেকেই প্রকাশ্যে এবং অপ্রকাশ্যে সমালোচনা করেছেন যা অধিকাংশই "ইন-বক্স" কেন্দ্রিক। আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি - এই ধরনের ইন-বক্স কেন্দ্রিক সমালোচনা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ইতিবাচক কিছু সৃষ্টি করে না। উল্লেখ্য যে, আলোচ্য বিচারিক প্যানেল থেকে ব্লগ দিবস উপলক্ষে পাঠানো লেখা সমূহের ব্যাপারে অসন্তোষ প্রকাশ করা হয়েছিলো যা কারণে আমরা ব্লগ স্মরণিকা প্রকাশকে আপাতত স্থগিত রেখেছি। এই বিষয়টিকে আমাদের অনেক ব্লগার ব্যক্তিগতভাবে নিয়েছেন যা আমাদের জন্য কষ্টদায়ক।
একটি বিষয় আমাদেরকে মনে রাখতে হবে - আমরা এখানে যারা লেখালেখি করছি, তাদের বড় একটা অংশ শখের বসে লেখালেখি করি এবং এটা একটি কমিউনিটি ব্লগ। ফলে এখানে খুব ভালো মানের লেখা যেমন প্রকাশিত হবে তেমনি খুবই কাঁচা লেখাও প্রকাশিত হবে। যারা ভালো লিখেন, তাদের দেখে বাকিরা শিখবে। এটা একটি চলমান প্রক্রিয়া। বছর জুড়ে নানা ধরনের প্রতিযোগিতা করা হয় মূলত এই উদ্দেশ্যে। ভালো লেখকদের দেখে কিভাবে শেখা যায়? খুব সহজ ভাবে বলি, পুরানো অনেক ব্লগারদের প্রথম দিকের লেখাগুলো খুঁজে বের করে পড়ুন আর লক্ষ্য করুন সময়ের সাথে তাদের লেখা কিভাবে পরিবর্তিত হয়েছে।
কোন একটি প্ল্যাটফর্ম বা ব্লগ তখনই একটি স্মরণিকা বা ম্যাগাজিন প্রকাশ করার সিদ্ধান্ত নেয় যখন যে বিশ্বাস করে, এই প্ল্যাটফর্মের অনেক গুনি এবং মেধাবী লেখক রয়েছে। এই সকল লেখকদের লেখা প্রকাশের মাধ্যমে একটি প্ল্যাটফর্ম তার নিজস্ব ব্র্যান্ডিং করে, বিজ্ঞাপন করে মানুষদের জানায় - দেখো আমার এখানে চমৎকার সব লেখক আছে, তুমি যদি নিয়মিত এমন লেখা পড়তে চাও তাহলে আমাদের ব্লগে এসো, তুমিও লিখো। ফলে আমাদের এই প্ল্যাটফর্ম থেকে একটি সময় অপর বাস্তব নামের একটি ম্যাগাজিন বের করা হতো, ব্লগাররাই এর উদ্যোগ নিয়েছিলো, নিজেরা সম্পাদনা করত। তখন সেই ম্যাগাজিনে লেখা ছাপা হওয়া ছিলো একটি মর্যাদার বিষয়, আনন্দের বিষয়। পাশাপাশি ব্লগে সেরা পোস্টের বিভিন্ন তালিকা হতো। কারো কোন পোস্ট সেরা পোস্টের তালিকায় স্থান পেলে ব্যক্তিগত ভালোলাগার পাশাপাশি, আত্মবিশ্বাসও বৃদ্ধি করত। এই যে আমি লিখতে পারছি, এটা সেই আত্মবিশ্বাসেরই ফলাফল। সবচেয়ে বড় কথা, আমরা একটা সময়ে ব্লগারদের মধ্যে ভালো লেখা প্রকাশ করার জন্য একটি অলিখিত প্রতিযোগিতা দেখতাম, কিন্তু এখন সেটা তেমন চোখে পড়ে না।
অনেকেই হয়ত বলবেন, পরিস্থিতি পালটে গেছে, আগের দিন এখন আর নেই। কিন্তু আমি এর সাথে সহমত প্রকাশ করি না। আমাদের ব্লগে এখনও যে পরিমাণ মেধাবী ও সৃজনশীল ব্লগার রয়েছেন তা বাংলাদেশের অন্য কোন লেখক ফোরামে নেই। ফেসবুক লেখক গ্রুপ আর ব্লগ এক জিনিস নয়। ফেসবুক অল্প সময়ের জন্য সেলিব্রেটি বানায়, লেখক বানাতে পারে না। অন্যদিকে ব্লগ লেখক তৈরি করে যা আপনাকে দীর্ঘমেয়াদীর জন্য সেলিব্রেটি বানাবে। আপনি আমি এখনও ব্লগে আছি, সময় দিচ্ছি কারণ আমরা ব্লগকে এখনও ভালোবাসি। ব্লগ এখনও আমাদের দৈনন্দিন জীবনের একটি প্রয়োজনীয় অঙ্গ। আমরা একটু মনযোগী দিলেই আমাদের নিজেদের লেখালেখির ক্ষুধা বাড়াতে পারি, লেখার বৈচিত্রময়তা বৃদ্ধি করতে পারি।
আমি মাঝে মাঝে বলে থাকি - ব্লগ সাধারণ ধর্ম প্রচারের জায়গা নয়। আমার এই কথাটি নিয়ে অনেক ব্লগার নানা রকম জটিলতা সৃষ্টির চেষ্টা করেছেন এবং হাস্যকর কথাবার্তা প্রচার করেছেন। যার ফাঁদে পড়ে একজন ব্লগার খুবই অপরিপক্ব ভাবে আমাকে ফেসবুক ম্যাসেঞ্জারে জিজ্ঞেস করেছেন যে তিনি যদি বেশি বেশি আলহামদুলিল্লাহ বা ইনশাআল্লাহ শব্দ ব্যবহার করেন, তাহলে কি তিনি রেস্ট্রিকশন পাবেন কি না?
আমি টানা দশ মিনিট নির্বাক ছিলাম, এই ম্যাসেজ পেয়ে। এই ম্যাসেজটি তিনি যার কাছ থেকে পেয়েছেন বা যারা ছড়িয়েছে তারা উক্ত ব্লগারকে ধারনা দিয়েছেন, আমি ধর্ম বিদ্বেষী বা সামহোয়্যারইন ব্লগে ধর্ম নিয়ে লেখা যায় ইত্যাদি। যিনি এই তথ্যটি দিয়েছেন বা যার কাছ থেকে উক্ত ব্লগার এই তথ্যটি জেনেছেন তিনি নিঃসন্দেহে ধর্মকে ভালোবাসেন এবং ধর্মের ব্যাপারে তিনি খুবই স্পর্শকাতর। অথচ দেখুন কি দুর্ভাগ্য! ধর্মকে জয়ী করতে গিয়ে মিথ্যার আশ্রয় নিতে হলো। ধর্মকে যখন মিথ্যার শক্তিতে বিজয়ী করতে হয়, তখন সেটা ধর্মভীরুতা থাকে না, সেটা হয় ধর্মের নামে ভণ্ডামি এবং শো অফ। যা আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে খুবই স্বাভাবিক একটি ব্যাপার। অথচ আমার সাথে যারা ব্যক্তিগতভাবে যোগাযোগে আছেন তাঁরা জানেন, আমি ব্যক্তিজীবনে কেমন ধর্মকর্ম পালন করি বা আমার চিন্তা ভাবনা ও আমার দর্শন। আমার ব্যক্তিজীবন আর পেশাদার জীবন এক নয় এবং এটা হওয়াও উচিত নয়।
ব্লগ সাধারণ ধর্ম প্রচারের জায়গা নয় - কথাটির ব্যাখ্যা হচ্ছে, ব্লগে ধর্ম প্রচার বা প্রসার করতে গিয়ে কেউ যেন অন্যের ব্যক্তিগত স্বাধীনতা বা বিশ্বাসে অপ্রয়োজনীয় হস্তক্ষেপ না করেন। দ্যাটস ইট! আমাদের উদ্দেশ্যে আলোচনার প্রেক্ষাপট তৈরি করা। যে বিষয়ে আলোচনার কিছু নেই, সেটা নিয়ে লেখার কোন মানে নেই।
পুরানো প্রসঙ্গে আবার ফিরে আসি। বর্তমানে আমরা নতুন নতুন লেখক সৃষ্টির জন্য নতুন নিবন্ধনকৃত ব্লগারদের প্রথম পাতায় দ্রুত সুযোগ দিচ্ছি। নুন্যতম মানসম্পন্ন লেখা বা লিখতে পারবেন বা শিখে নিতে পারবেন মনে হলেই আমরা সুযোগ দিচ্ছি। যদিও একটা সময় এটা অকল্পনীয় ছিলো। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতির সাথে খাপ খাওয়াতে এবং নতুনদের ব্লগিং এ আগ্রহ সৃষ্টির জন্য আমরা এই উদ্যোগ নিয়েছি। কিন্তু আমরা যখন এই বই প্রকাশ করি বা উদ্যোগ গ্রহণ করি, তখন কিন্তু চাইলেই একজন নতুন লেখক সেখানে অংশ গ্রহণ করতে পারবেন না। লেখার সুনির্দিষ্ট মান সম্পর্কে যথেষ্ট ইতিবাচক মনোভাবের পরেই আমরা কোন ম্যাগাজিনে সেই নতুন লেখকের লেখা ছাপাবো। এটাই সঠিক পদ্ধতি।
দুঃখের বিষয় হচ্ছে, বর্তমান সময়ে ব্লগে ইতিবাচক সমালোচনার প্রেক্ষাপটটি খুবই সংকীর্ণ হয়ে এসেছে। আরো সংকীর্ণ হয়েছে নিজের লেখাকে ঘষামাজা করে উন্নত করার স্বদিচ্ছা বা তাগিদ। আমি এমন অনেক ব্লগারকে দেখেছি যারা পাঁচ বছর আগে যেমন লিখতেন, এখনও তেমন লিখছেন। লেখা নিয়ে নতুন কোন এক্সপেরিমেন্ট নাই, নতুন কোন ক্ষুধা নাই। এমনও অনেক ব্লগার আছেন যাদের লেখা মান যথাযথ হবার আগেই তারা বই প্রকাশ করে ফেলেছেন। অনেক সময় ব্যক্তিগত উদ্দীপনা এবং লেখক হবার তীব্র বাসনা থেকেই আমরা এমনটা করি। কিন্তু সঠিকভাবে প্রস্তুত না হয়ে বিশাল সাগরে পা দিলে আপনি খুব সহজেই হারিয়ে যাবেন।
এই বিষয়গুলো নিয়ে কম বেশি আলাপ করেছি। অনেকেই বলেছেন, আমি কি এমন লিখি যে অন্যদের ব্যাপারে সমালোচনা করি? আমি কি খুব ভালো লিখি?
আমি আত্মবিশ্বাসের সাথে বলতে পারব না যে, আমি ভালো লিখি। আমি অবশ্যই স্বীকার করি, আমার মধ্যে ঘাটতি আছে, লিখে মত প্রকাশে দৈন্যতা আছে। তাই তো অনেকেই বিষয়টি নিয়ে ভুল বুঝেছেন এবং প্রকাশ্যে ও অপ্রকাশ্যে আমার উপর 'গোসসা' করেছেন।
লেখক হিসাবে আমার যোগ্যতা নিয়ে যে কোন সময় প্রশ্ন তোলা যায় তবে ভালো লেখার চেষ্টা করার ক্ষুধাটি মরে যায় নি। সেই ক্ষুধা আমি টিকিয়ে রেখেছি। বিভিন্ন সময় ব্লগারদের কাছ থেকে শিখে নিজের ত্রুটি সংশোধনের চেষ্টা করেছি।
ব্লগ টিমের সাথে প্রায় সুদীর্ঘ এক যুগেরও বেশি সময় ধরে কাজ করার সুবাদে আমাকে প্রচুর লেখা পড়তে হয়েছে। ভালো না লাগলেও পড়তে হয়। ফলে লেখক হিসাবে আমার স্বীকৃতি না থাকতে পারে, কিন্তু পাঠক হিসাবে আমার স্বীকৃতি অবশ্যই আছে। সেই স্বীকৃতি থেকে আমি অবশ্যই আমার সহ ব্লগারদের লেখা উন্নয়ন করার ব্যাপারে ভালো মন্দ পরামর্শ দিতে পারি, খারাপ হলে বলতে পারি, ভালো হলে সুনামও করতে পারি - মূলত এটাই আমার কাজ। ব্লগ টিমের সদস্য হিসাবে এটাই আমার মুল দায়িত্ব। আমার দায়িত্ব ব্লগারদের উপর ছড়ি প্রদর্শন করা নয়। ফলে যারা ব্লগ প্রকাশনীর জন্য ভালো মানসম্মত লেখা খুঁজে পাইনি বলাতে রাগ বা অভিমান করেছেন, তারা যদি ঠাণ্ডা মাথায় ভেবে দেখেন, তাহলে বুঝবেন, বিষয়টি কাউকে হেয় প্রতিপন্ন করার জন্য বলা হয় নি বরং সকলের সার্বিক উন্নতির জন্যই বলা হয়েছে।
আপনারা হয়ত অনেকেই জানেন যে, বাংলাদেশের বেশ কয়েকটি প্রথম সারির পত্রিকার সাথে আমাদের একটি যোগাযোগ আছে যার মাধ্যমে আমরা ভালো কোন লেখা পত্রিকায় প্রকাশের জন্য পাঠাতে পারি এবং যা তারা প্রকাশ করবে। পাশাপাশি, তাদের জন্যও নির্দিষ্ট বিষয়ে লেখা প্রদানের জন্যও আমরা ব্লগারদের অনুরোধ করতে পারি। ২০১২ - ২০১৭ সাল পর্যন্ত নিয়মিত লেখা আমরা পাঠাতে পারতাম, আত্মবিশ্বাসের সাথে ব্লগারদের বিভিন্ন টপিকে লেখা লিখতে বলতে পারতাম যা জাতীয় দৈনিকে ছাপা হতো এবং উক্ত ব্লগাররা আর্থিক সম্মানীও পেতেন। ২০১৭ সালের পর থেকে আমরা এই বিষয়ে খুব একটি অগ্রসর হতে পারি নি।
আমরা চাই আমাদের ব্লগাররা নিজেদের আরো গুছিয়ে নিবেন, ব্লগারদের মেধা বিকাশের প্ল্যাটফর্ম হতে চাই আমরা। আমি বিশ্বাস করি, বর্তমানে আমাদের অনেক ব্লগার আছেন যাদের হাত ধরে আমাদের নতুন পদচারনা আবার শুরু হবে। পুরানোদের দায়িত্ব নিতে হবে।
ধান ভানতে শিবের গান গাইলাম। আশা করি, ব্লগাররা বুঝতে পেরেছেন সমকালীন ব্লগারদের মধ্যে থেকে বিচারক মনোনয়ন প্রক্রিয়া খুব একটা সহজ কিছু নয়। এই অভিজ্ঞতাটি আপনাদের কাজে দিবে। যাদের বিচারক হিসাবে মনোনয়ন দেয়া হয়েছিলো, তাঁরা যেহেতু অপারগতা জানিয়েছেন, তাদের সিদ্ধান্তের প্রতি আশা করি সকলে সম্মান দেখিয়ে নতুন উপযুক্ত বিচারক প্যানেলের নাম প্রস্তাব করবেন। আমরা সেই প্রস্তাবিত নাম থেকে তিনটি নাম বাছাই করে দ্রুত ফলাফল ঘোষণা করতে চাই।
পরিশেষে সবাইকে আবারও ধন্যবাদ জানাতে চাই, শৈশবের স্মৃতিচারণ মূলক লেখায় অংশগ্রহণ করার জন্য। এই টপিক ছাড়াও সাম্প্রতিক সময়ে দারুণ দারুণ সব পোস্ট আসছে। এটা নিঃসন্দেহে আনন্দের। ভালো কোন লেখা পেলে অনুগ্রহ করে আপনার ফেসবুক ওয়ালে শেয়ার করবেন। আশা করি, এতে আমাদের ভিজিট বাড়তে সাহায্য করবে।
শুভ ব্লগিং।
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই জুন, ২০২৩ ভোর ৪:৪০