১৯১৯ সালের কথা। পৃথিবীবাসী তখন উপলব্ধি করছে সদ্য শেষ হওয়া প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহতা। এই যুদ্ধে প্রাণ হারিয়েছে ২ কোটিরও বেশি মানুষ। ইউরোপের অবস্থা তখন সবচাইতে নাজুক। গোটা ইউরোপজুড়ে এমন কোন পরিবার খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না, যাদের পরিবারের সবাই বেঁচে আছে। প্রায় প্রতিটি পরিবারই গড়ে একজন করে প্রিয় মানুষকে হারিয়েছে। খোঁজ নিয়ে দেখা গেল, সারা বিশ্বে যেখানে যত হানাহানি হয়েছে, সেখানেই সবচাইতে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে শিশুরা, অকালে প্রান হারিয়েছে কয়েক লক্ষ শিশু। আর যারা বেঁচে ছিল, তাদের অধিকাংশকেই মুখোমুখি হতে হয়েছিল নির্মম শারীরিক ও মানসিক বিপর্যয় এবং সর্বপরি আশ্রয়হীনতার।
ইংল্যান্ডের শ্রপসিয়ারের এলসমেয়ার নামক একটা ছোট্ট শহর আছে। সেই শহরে একটি বনেদী পরিবারের মেয়ে ছিলেন ইগল্যানটাইন জেব। পেশা হিসেবে প্রথম জীবনে তিনি স্কুল শিক্ষকতাকেই বেছে নিয়েছিলেন। কিন্তু যুদ্ধ বিধ্বস্ত পরিস্থিতিতে হাজারো অসহায় ও দুস্থ শিশুদের দুরবস্থা তাকে ভীষন ভাবে আলোড়িত করে আর তখনই তিনি সিদ্ধান্ত নেন এই সকল অধিকার বঞ্চিত শিশুদের পাশে দাঁড়াবার। শিশুদের প্রতি তার এই অকৃত্তিম ভালোবাসা আর সাহায্যের মনোভাব তাকে বাইরের জগতের কাছে পরিচিত করে তোলে, ‘হোয়াইট ফ্লেম’ হিসেবে। এই মহৎ কাজে তাঁর পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন তাঁর প্রিয় বোন ডরোর্থি বাক্সটন। পরবর্তীতে ১৯১৯ সালের ১৫ই এপ্রিল জেব এবং তাঁর বোন ডরোর্থির হাত ধরেই মূলত যাত্রা শুরু করে ‘সেফ দ্য চিলড্রেন’ নামক একটি ফাউন্ডেশন। শিশুদের অধিকার রক্ষার ব্যাপারে এই দিনটি ঐতিহাসিকভাবে বেশ গুরুত্বপূর্ন। বর্তমানে বিশ্বের প্রায় ১২০ টি দেশে এই ফাউন্ডেশনটি তাদের সম্প্রসারিত কার্যক্রমের মাধ্যমে শিশুদের অধিকার রক্ষার লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে।
শিশু অধিকারকে আলাদা করে গুরুত্ব আরোপ করার কারনে ১৯২৪ সালে প্রতিষ্ঠিত ‘‘Convention of Legue of Nation” বা জেনেভা কনভেনশনে উল্লেখ্য করা হয়েছিল, ‘‘মানব জগতে সর্বোত্তম যা কিছু দেওয়ার আছে তা শিশুরাই পাওয়ার যোগ্য।’’ কিন্তু একটি প্রজন্ম এই বিপর্যয় থেকে পুরোপুরি মুক্ত হবার আগেই আবারও শুরু হয়ে যায় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। আবারও সেই যুদ্ধের বিভৎসতার শিকার হয়ে প্রাণ হারায় কয়েক হাজার শিশু এবং অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে ধাবিত হয় প্রায় কয়েকলাখ কচি প্রাণ।
১৯৪৫ সালের ২৪শে অক্টোবর জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠার পর ১৯৫৯ সনে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে শিশুদের জন্য প্রথমবারের মত দশটি অধিকার ঘোষিত হয়। পরবর্তীতে এই ধারাগুলোকে কিছুটা পরিমার্জন এবং পরিবর্ধন করে ১৯৮৯ সালের ২০ই নভেম্বর চারটি মূলনীতির উপর ভিত্তি করে চুয়ান্নটি ধারা সম্বলিত একটি সনদ সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়। এর নাম দেয়া হয় ‘শিশু অধিকার সনদ’। তার পরের বছর অর্থাৎ ১৯৯০ সালে এই সনদটিকে আন্তর্জাতিক আইনের আওতায় আনা হয়। একটি ছোট গর্বের বিষয় হচ্ছে, ১৯৯০ সালের ৩রা আগষ্ট বিশ্বের প্রথম যে ২২টি দেশ এই সনদে স্বাক্ষর করেন বাংলাদেশ তার মধ্যে অন্যতম একটি।
প্রতিবছর ২০ই নভেম্বর সারা বিশ্বে এই দিবসটি পালিত হয়। এবারের সার্বজনীন শিশু দিবসের প্রতিপাদ্য হলো- শিশুদের উপর নির্যাতন বন্ধ করুন। বাংলাদেশেও এই দিবসটি আজকে পালিত হচ্ছে। ইউনিসেফের তথ্য অনুযায়ী, প্রতিবছর বিশ্বে প্রায় দশ লাখেরও বেশি শিশু বাড়িতে, শ্রেনীকক্ষে, কর্মক্ষেত্রে নিরব নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। সবচেয়ে ভয়াবহ ব্যাপার, পৃথিবীর অনেক দেশেই শিশুদের উপর এই ধরনের নির্যাতন সমাজে প্রচলিত জীবনব্যবস্থারই অংশ। আরো লজ্জার বিষয় বাংলাদেশও এই অভিযোগ থেকে মুক্ত নয়। বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরামের চেয়ারম্যান ইমানুল হক চৌধুরীর মতে, মোট জনসংখ্যার ৪৫ ভাগের বেশিরভাগ শিশুই তাদের সার্বিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
এই দেশে এখনও প্রায় ৭৯ লক্ষ শিশু বিভিন্ন ঝুঁকিপূর্ন কাজে নিয়োজিত। এমনিতেই দেশের বাল্যবিবাহের হার প্রায় ৬৬% অর্থাৎ প্রায় ১৮ বছর বয়স পূর্ন হবার আগেই তাদের বিয়ে হয়ে যাচ্ছে। তার উপর সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাল্যবিবাহ রোধে মেয়েদের বিয়ের বয়স কমানোর জন্য। এমন আত্মঘাতী একটি সিদ্ধান্ত সরকার কোন যুক্তিতে গ্রহন করল তা ঠিক বোধগম্য নয়। সেই সাথে বর্তমানে দেশের ৪৫ ভাগ শিশুর জন্য যে অর্থ বরাদ্দ দেয়া হয়েছে তা মোটেই যথেষ্ঠ নয়।
তবে বিশ্ব শিশু পরিস্থিতিতে পরস্পরবিরোধী একটি অবস্থা বিরাজমান থাকা সত্ত্বেও বর্তমানে বিশ্বের অন্যান্য দেশের মত বাংলাদেশেও একটি অভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি লক্ষ্য করা যায় আর তা হলো শিশু অধিকার সর্ম্পকে পূর্বেকার যে কোনো সময়ের চেয়ে আরো অনেক বেশি সচেতনতা। শিশুর প্রতি দায়িত্ববোধ এখন আর শুধু নীতিবোধের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়-বরং তা ক্রমবর্ধমান হারে বৃহত্তর সামাজিক ও আইনানুগ বাধ্যবাধকতার আওতায় চলে আসছে । পাশাপাশি অনেক ব্যর্থতা থাকা স্বত্তেও বাংলাদেশে শিশু অধিকার রক্ষায় বেশ কিছু প্রশংসনীয় কাজ করা হয়েছে। এর মধ্যে একটি শিশু আইন-১৯৭৪, বাংলাদেশ জাতীয় শিশু নীতি, শিশু একাডেমি অধ্যাদেশ – ১৯৭৬ প্রভৃতি। এখন শিশুদের উন্নয়নের জন্য সরকারের পাশাপাশি বিভিন্ন বেসরকারী স্বেচ্ছাসেবী সংঘটনও এগিয়ে এসেছে। তারাও নানান প্রতিবন্ধতার মোকাবেলা করে শিশুদের অধিকার আদায়ের জন্য কাজ করে যাচ্ছে। ফলে শিশুশ্রম হ্রাস পাচ্ছে, শিশুদের সাক্ষরতার হার বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং কিছুটা হলেও নির্যাতন কমেছে ও শিশুদের অধিকারের ব্যাপারে সচেতনতা সৃষ্টি হচ্ছে।
একটি ব্যতিক্রমধর্মী আয়োজনের কথা
বর্তমানে সুবিধা বঞ্চিত অসহায় শিশুদের অধিকার আদায়ের জন্য যে সকল স্বেচ্ছাসেবী সংঘঠনগুলো কাজ করছে তাদের মধ্যে ‘স্পৃহা’ অন্যতম। এই সংঘঠনটি রংপুরে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করছে। ব্যক্তিগতভাবে একজন স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে এই সংঘঠনটির সাথে কাজ করার সুযোগ হয়েছে। যদিও এই সংঘঠনটির মূল লক্ষ্য হলো নিপীড়ত মানুষের অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নের জন্য কাজ করা তথাপি সমাজের সবচাইতে নিগৃহীত ও অবহেলিত পথ শিশুদের নূন্যতম মানবিক সুবিধাগুলো নিশ্চিত করতে এই সংগঠনটি কাজ করে যাচ্ছে। এই লক্ষ্যে তারা প্রতিষ্ঠিত করেছে ‘রঙ্গিন পাঠশালা’ নামক একটি ব্যতিক্রমধর্মী স্কুল। সার্বজনীন শিশু অধিকার দিবসটি পালন করার লক্ষ্যে নেয়া হয়েছে বেশ কিছু কর্মসূচী। এর মধ্যে আছে,
১) খেলাধুলা,
২) ছবি আঁকা,
৩) পথ শিশুদের উপস্থাপনায় এবং অংশগ্রহনে গান কবিতা ও নাটক।
৪) শিক্ষামূলক কার্টুন প্রদর্শনী।
৫) শীতের নতুন সোয়েটার
৬) স্কুল ব্যাগ উপহার দেয়া
৭) পুরুষ্কার বিতরনী।
এই সংক্রান্ত আরো আপডেট পেতে ইভেন্ট লিংকে চোখ রাখুনঃ
সর্বজনীন শিশু দিবস উদযাপন ২০১৪
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে নভেম্বর, ২০১৪ রাত ২:১৭