প্রতিদিনের অভ্যাসের সাথে সামঞ্জস্য রেখে, দেহঘড়ির প্রাকৃতিক সতর্কবার্তায় যখন সবেমাত্র চোখ খুলে কিছুটা তাড়াহুড়ায় বিছানায় উঠে বসতে যাচ্ছি ঠিক তখনই মনে পড়ল, আজ শুক্রবার! আমার বহুল প্রত্যাশিত সাপ্তাহিক ছুটির দিন!! অন্তত আজকের দিনটা আমাকে মানুষের ভীড় আর ট্রাফিক জ্যামের সাথে যুদ্ধ করে শুরু করতে হবে না। সারারাত স্বপ্নের সাদা ক্যানভাসে রং তুলির সামান্য আঁচড় দিতে ব্যর্থ হওয়ার ক্লান্তিঘুম ভেঙেও আমাকে ছুটতে হবে না সেই চিরচেনা দুর্বিষহ নাগরিক জীবনে- আকস্মিক প্রাপ্তির এই আবেশে আমার দু'চোখ বুজে আসতে চাইল। কিন্তু আমার মত যে সকল চাকরীজীবি মানুষ, এই শহরে একা বাস করেন তাদের একমাত্র ছুটির দিনের সকালটিও নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে কাটানোর উপায় নেই। সারা সপ্তাহ জুড়ে ক্রমাগত বসবাসের অযোগ্য হয়ে উঠা ফ্ল্যাটটিকে কিছুটা মনুষ্য বাসের উপযুক্ত করার প্রক্রিয়াটি সেই সকাল থেকেই আমাকে শুরু করতে হয়।
ইতিমধ্যে কানে ভেসে আসা মৃদু গুমগুম শব্দ জানান দিচ্ছে দারোয়ান মোটর ছেড়েছে। দৈনিক তিন কিস্তি পানির প্রথম কিস্তি আমাকে উল্লেখ্যযোগ্য পরিমানে সংগ্রহ করতে হবে। নইলে ঘর মোছা, কাপড় ধোয়া এবং সর্বপরি রান্না করার মত গুরুত্বপূর্ন কাজটি ঠিকভাবে শেষ করা যাবে না। রান্না বিষয়টা আমার জন্য বেশ গুরুত্বপূর্ন কারন 'হোটেলের খাবার' আমার খুব একটা সহ্য হয় না এবং আমি ঠিক পোষাতেও পারি না। ফলে ছুটির দিনের রান্না দিয়েই আমাকে সপ্তাহের বাকি দিনগুলো মোটামুটি পার করতে হয়। তাই কিছুটা বাধ্য হয়েই আমি একটা দীর্ঘ আড়মোড়া ভেঙে বিছানায় উঠে বসলাম! তারপর দ্রুততার সাথে বাথরুম এবং রান্নাঘরের কলের নিচে খালি বালতি আর ড্রামগুলোর লাইন লাগিয়ে দিলাম। কলে পানি আসতে কিছুটা সময় লাগে। এই ফাঁকে চুলোয় চা এর পানি চড়িয়ে দিয়ে বারান্দায় এসে দাঁড়ালাম। এখানে শখের বসে আমি কিছু ফুলের গাছ লাগিয়েছি। কিন্তু সারা সপ্তাহজুড়ে চলমান কর্মযজ্ঞে এই গাছগুলোকে পরিচর্যা করার তেমন সুযোগ আমার হয় না। তাই প্রথম দর্শনে ধুলোয় ম্রিয়মান ধুসর গাছের পাতাগুলো আমাকে এক সুক্ষ অভিমানের বার্তাই দিল। শুধু তাই নয়, আমাকে আরো তীব্র অপরাধবোধে দগ্ধ করার পাঁয়তারায় গাছগুলো টবের বাগানে ফুটিয়ে ফেলেছে কি অদ্ভুত চমৎকার সব ফুল।
কাছে গিয়ে একটা ফুলকে স্পর্শ করতেই শায়লার কথা মনে পড়ে গেল। মেয়েটা ঠিক যেন সকালে সদ্য ফোটা ফুলের মতই সতেজ এবং কোমল। যেখানে রাজহংসীর মত মসৃন বাঁকানো গ্রীবা, মাখনসম হলুদ দেহাবরনের অপূর্ব দেহ সৌষ্ঠব যেন কোন এক কামনাকাব্যের কিছু সাধারন উপমা মাত্র। দুই সপ্তাহ আগে পাঠ করা সেই কাব্যেময় উদ্দাম দুপুরের কথা মনে হতেই আমার চোখে ভেসে উঠল তীব্র আবেদনের চোখের দৃষ্টির সাথে ছোট্ট কালো তিল বিশিষ্ট ঠোঁটের বাঁকা হাসির সেই অদম্য আহবান! হঠাৎ সারা শরীরে একটা অদ্ভুত শিরশিরে অনুভব ছড়িয়ে পড়তে শুরু করল। নাকের ডগায় বিন্দু বিন্দু ঘামের অস্তিত্বে আমি বুঝতে পারলাম আমার দেহ এই সাত সকালেই উত্তেজনার আদিম সংজ্ঞা জানায় বড্ড ব্যস্ত।
দেয়াল ঘড়ির দিকে তাকালাম। সাড়ে ৯ টা বাজে। আজকে শায়লার আসার কথা। অনাবিল এক উত্তেজনায় বুকের ভেতর কেমন যেন একটা ঢেউ খেলে গেল। জীবনের ত্রিশটি বসন্ত নানা ধরনের ভীতিকর উত্তেজনায় পার করার পর এখন কেন যেন অপেক্ষাকে আমার খুব নিষ্ঠুর বলে মনে হয়। আমি আর অপেক্ষা করতে পারলাম না। শায়লাকে ফোন দিলাম। প্রথম বারে সাড়া পেলাম না। দ্বিতীয়বার আবার ডায়াল করতেই ও পাশ থেকে শায়লার আধোঘুম কন্ঠস্বর শুনতে পেলাম, হাই! গুড মরনিং বেইব!
-গুড মরনিং ডিয়ার! একি! তুমি এখনও বিছানায়?? একটা হৃদকাপানিয়া আড়মোড়ার শব্দ করে শায়লা বলল, উমমহ! হ্যাঁ বিছানায়। কাল অনেক রাত পর্যন্ত জেগেছি তো!
-ওহ, তাই বুঝি? কেন সোনা, পড়াশুনার বুঝি খুব চাপ যাচ্ছে?
-আরে না! ধেত্তরী পড়াশুনা! রাহাত কাল সারারাত আমাকে একফোঁটা ঘুমাতে দেয় নি। নিজে অস্থির হয়ে আমাকে অস্থির বানিয়েছে।
-রাহাত? রাহাতটা কে আবার? আমি কিছুটা বিরক্ত হয়ে জিজ্ঞেস করলাম।
-শীট! স্যরি ! স্যরি! তোমাকে রাহাতের কথা বলি নাই?? উফ! আমার যে কি হবে! কিচ্ছু মনে থাকে না।
-না, ঠিক আছে, বল রাহাত কে?
-আরে তুমি তো জানো না, গত কিছুদিন থেকে আমাকে বাসা থেকে বিয়ের জন্য খুব চাপ দেয়া হচ্ছে। আমাদের ফ্যামিলিতে আবার মেয়েদেরকে একটু আগেই বিয়ে দেয়ার নিয়ম। যে ছেলেটার প্রস্তাব এসেছে, তার নাম রাহাত।
-মানে? তুমি তাহলে এখন বিয়ে করতে চলেছ?
হঠাৎ মনে পড়ল শায়লার তো আবার কৌতুক করার স্বভাব আছে। একবার রাতের বেলা ফোন দিয়ে আমাকে বলল, এ্যাই শুনছ? আমি তো কনসিভ করছি, এখন কি হবে?
প্রথমে আমি চমকে উঠলেও পরে প্রাণভরে দুইজনেই হেসেছিলাম। এবারও মনে হয় ও আমার সাথে দুষ্টামিই করছে। বড্ড ফাজিল একটা মেয়ে।
-তাই না? আচ্ছা খুব ভালো হয়েছে। অনেক দিন বিয়ে খাই না। তাছাড়া নিজের বিয়ের খাবার তো নিজে আরাম করে খাওয়া যায় না, তাই ম্যাডাম আপনি এখন দয়া করে বলুন, আপনি দুপুরে কি খাবেন? রান্না শুরু করতে হবে।
কিছুটা ইতস্বত করে শায়লা বলল, আমি সিরিয়াসলি বলছি। আমি বিয়ে করতে চলেছি। মাত্র দুই সপ্তাহের পরিচয়ে একটা মানুষ আরেকজন মানুষের উপরে কতখানি প্রভাব বিস্তার করতে পারে , তা রাহাতকে না দেখলে কেউ বুঝবে না। বহু বছর পর আমি জীবনের স্বাভাবিক আনন্দের স্বাদ পাচ্ছি। তাছাড়া আমাদের কথাও মানে তোমার কথাও রাহাতের সাথে আমি আলোচনা করেছি।
-কোন ব্যাপারগুলো নিয়ে তুমি রাহাতের সাথে আলোচনা করেছ শায়লা? আমি তীক্ষ্ণ কন্ঠে জিজ্ঞেস করলাম।
শায়লা কিছুটা অধৈর্য হয়ে বলল, তুমি খুব ভালো করেই জানো আমি কোন ব্যাপারটা নিয়ে ওর সাথে কথা করেছি। তাছাড়া রাহাত খুব বুদ্ধিমান এবং সাপোর্টিভ একটা ছেলে। আমাদের ব্যাপারটা ও ঠিক বুঝতে পেরেছে।
আমি কি বলব বুঝতে পারছিলাম না। গলার ভেতরটার কেমন যেন জ্বলছে। সব কিছু একনিমিষে কেমন যেন উল্টোপাল্টা লাগছে। মনে হচ্ছে আমি দুঃস্বপ্ন দেখছি।
- হ্যালো! শুনতে পাচ্ছ?
হুমম পাচ্ছি, বল শায়লা।
- দেখো তুমি প্লীজ বোঝার চেষ্টা করো, তোমার সাথে যতক্ষন থাকি ততক্ষন যে নিশ্চয়তা আর আনন্দ পাই, তা হয়ত অন্য কারো কাছেই আমি পাব না, কিন্তু..
- হ্যাঁ, এটা যে আমার জন্যও আরো সত্য এটা কি তুমি জান না?
- আমি জানি কিন্তু এটা সত্য যে আমরা ভুল করছি। রাহাত আমাকে ব্যাপারটা বুঝিয়েছে। শুধু কামনার লোভে যে ভালোবাসার শিকার আমরা হয়েছিলাম তার ক্ষতস্থান পুরনের জন্য এটা সমাধান নয় বরং তা অনেক বেশি ক্ষতিকর।
আমি চুপচাপ শায়লার কথা শুনছি। বুকের সেই উত্তেজনাময় ধুপধুপ শব্দ চাপা বিষাদে পরিনত হয়েছে চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে।
- রেবেকা আপা, তুমি প্লীজ আমাকে ভুল বুঝো না। রাহাত ছেলেটাকে খুব আমার ভালো লেগেছে। আমি হয়ত ওকে কিছুটা ভালোবেসেও ফেলেছি। খারাপ সময়ে তুমি আমাকে অনেক সাপোর্ট দিয়েছ, কিন্তু আমার পৃথিবী সেই বিবর্নই থেকে গেছে। সত্যি বলতে বহুদিন পর আমি রাহাতের হাত ধরে একটা নতুন পৃথিবীর সন্ধান পেয়েছি। আমি এই রঙিন পৃথিবী থেকে বের হতে চাই না।
আমি কিছু না বলে ফোন রেখে দিলাম। অসহ্য চাপা যন্ত্রনায় বুকের ভেতরটা ভারী হয়ে উঠেছে। বাথরুমের কল দিয়ে তীব্র বেগে পানি পড়ার শব্দ ভেসে আসছে। হঠাৎ খোলা দরজা দিয়ে বারান্দার টবগুলোর উপর চোখ পড়ল। ধুলোয় ম্রিয়মান পাতাগুলোর মাঝে সদ্য ফোঁটা সতেজ গোলাপ ফুলটাকে ঠিক শায়লার মতই লাগছে আর আমাকে লাগছে ঠিক পাতাগুলোর মতই বির্বন।