গ্রাম অঞ্চলে সৎ, মেধাবী এবং আর্থিকভাবে দরিদ্র একজন মানুষ বেশ জনপ্রিয় একটি চরিত্র। অবস্থা সম্পন্ন ব্যক্তিদের আভিজাত্য ও দানশীলতা প্রকাশের ক্ষেত্রে এই ধরনের মানুষ বেশ গুরুত্বপূর্ন ভূমিকা পালন করে। এই সব চরিত্রদের নাম লজিং মাস্টার বা জায়গীর মাস্টার। বাড়ির সামনে বাগান আর বাইরের ঘরে লজিং মাস্টার যুগ যুগ ধরে একটি অবস্থা সম্পন্ন বাড়িরই প্রতিচ্ছবি
আমি ঠিক তেমনই এক বাড়ির শোভা বর্ধনকারী চরিত্র, নাম জাহিদ। এখন পর্যন্ত জানি, আমি স্থানীয় একটি সরকারী কলেজের শেষ বর্ষের ছাত্র, আমার বাবা মা, ভাই বোন বা পরিবার আছে কিনা তাও জানি না। জানবই বা কিভাবে, যে ভদ্রলোক আমার চরিত্র অংকন করছেন তিনি এক লাইন লিখছেন আর কাটছেন। মাঝে মাঝে তিনি ছুড়ে ফেলে দিচ্ছেন আমার সমগ্র অস্তিত্ব ও পরিচয় বহনকারী সাদা মসৃন পৃষ্ঠাটিকে। খুবই বিরক্তকর এবং একঘেয়েমি একটি ব্যাপার। আগে কখনও আমার সাথে এমনটা হয় নি। ভদ্রলোক খুব সম্ভবত রাইটার্স ব্লক জাতীয় একটি ব্যাপারে আক্রান্ত হয়েছেন। রাইটার্স ব্লক যতখানি না লেখকের সমস্যা তার চেয়ে বেশি সমস্যা আমাদের মত চরিত্রগুলোর জন্য। কেননা লেখকের লেখার পূর্ণতা ছাড়া আমাদের অস্তিত্বের কোন পূর্ণতা নেই। আমরা শুধুই কিছু এলোমেলো অক্ষর আর শব্দের অর্থহীন এক অদ্ভুত জট। এই সময়টা আমি ভীষন অপছন্দ করি, ভীষন রাগও হয়। অবশ্য যে চরিত্রের জীবন মরন অন্যের কলমের খোঁচায় নির্ধারিত, তার এত অনুভূতি থাকা ঠিক নয়।
আমাকে ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করতে হয়। আমি জানি একবার লেখা শুরু করলে, এই লেখক ভদ্রলোক গল্পের চূড়ান্ত পরিণতির আগে থামবেন না। তিনি অবশ্য চেষ্টা কম করছেন না। আন্তরিক প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে তিনি রুমে চমৎকার একটি লেখার পরিবেশ সৃষ্টি করেছেন। রুমের লাইটগুলো বন্ধ করে জ্বালিয়েছেন টেবিল ল্যাম্প, পর্দা সরিয়ে খুলে দিয়েছেন দখিনের জানালাটিকেও, মাঝে মাঝে সেখান থেকে আসছে একটা শীতল ঝিরিঝিরি হাওয়া। কিন্তু তা স্বত্তেও তিনি খুব বেশি একটা সফল হতে পারছেন না। গত কয়েক ঘন্টায় এই ভদ্রলোক অনেকগুলো চরিত্রকে দুমড়ে মুচড়ে নৃসংশভাবে হত্যা করে ছুঁড়ে ফেলেছেন মেঝেতে। সাদা কাগজের কাফনে মোড়া অসম্পূর্ন চরিত্রগুলোর লাশগুলো দেখে অনেকেই হয়ত ভোরে ঝরে পড়া শিউলি ফুলের সাথে মিল খুঁজলেও খুঁজতে পারেন। কিন্তু তার সৃষ্ট একজন চরিত্র হিসেবে আমি এমন কোন মিল খুঁজে পাই না বরং আমার কাছে তা ডাস্টবিনে ছুঁড়ে ফেলা অবৈধ শিশু ভ্রুনের মত একটি নিষ্ঠুর ও অমানবিক দৃশ্য ছাড়া আর কিছুই নয়।
ঐ ফেলে দেয়া মৃত চরিত্রগুলোর মাঝে অষ্টাদশী এক তরুনীর চরিত্র আমার বেশ পছন্দ হয়েছিল। চরিত্রের শুরুতেই লেখক মেয়ে চরিত্র ধারনকারী আমার চরিত্রটির বেশ যৌন রগরগে একটা দৈহিক বর্ননা দিয়েছিলেন। সেই সাথে ছিল একটা ড্যাম কেয়ার ভাবও। আমি ভেবেছিলাম, এই গল্পে বুঝি আমাকে কোন এক আধুনিক মেয়ের চরিত্র হিসেবে কাজ করতে হবে। হয়ত দেখা যাবে, কোন এক তরুনের সাথে পাল্লা দিয়ে অবাধ যৌনতার মাধ্যমে আমি লড়াই করছে আধুনিকতার স্বাধীনতা অর্জনের জন্য। কিন্তু আবারও আমার মনোভাবকে থোড়াই কেয়ার করলেন ভদ্রলোক। তার কলমের কাছে আবারও নিজেকে আত্মসমর্পণ করতে হলো। ফলে অচিরেই আমি হয়ে গেলাম এক চির হতাশাগ্রস্ত তরুনীর চরিত্র, যে কিনা হতাশার মাঝেই মুক্তির তীব্র আনন্দ খুঁজে পায়। স্বামীর প্রবল বৈরী আচরনের সাথে নিষ্ঠুর লড়াই এ আমি প্রতিবারই পরাজিত হয়েছিলাম। আমার একটি গোপন আশ্রয়কেন্দ্র ছিল। যেখানে ছিল ভালোবাসার গভীর স্পর্শ, সুন্দর জীবনের এক বাস্তব দৃশ্যপট। মাঝে মাঝে আমার যখন প্রচন্ড লোভ হত, তখন আমি সেই আশ্রয়কেন্দ্র ভ্রমনে যেতাম। কিন্তু আমি ছিলাম অস্পর্শ অশুচি। আমার দেহ ছিল ঠিকই কিন্তু প্রান ছিল না। কিছু নোংরা লোভী হাত আর হায়েনা আমাকে জুয়ার বাজি হিসেবে ছিঁড়েখুড়ে খেয়েছিল। তাই আমি চাই নি আমার স্পর্শে সেই পবিত্র আশ্রয়কেন্দ্রটি অপবিত্র হোক। অথচ ভালোবাসাগুলো খুব চাইত আমাকে স্পর্শ করতে, আমাকে নতুন করে গড়ে তুলতে। কিন্তু আমি চেয়েছিলাম মৃত্যুতে পুড়ে যাক আমার সকল গ্লানি, সকল ক্ষোভ। নির্বিকার ভাবে ভালোবাসাকে নিষ্ঠুরতা প্রদর্শনের মধ্য দিয়ে হত্যা করার যে কঠিন পদ্ধতিটি আমি শিখেছিলাম, তা প্রয়োগ করার লোভ আমি সামলাতে পারতাম না। গলাটিপে হত্যা করতাম নতুন ভাবে বেঁচে উঠার প্রচেষ্টাকে।
চরিত্র হিসেবে আমি সবে মাত্র যখন “ক্যারেক্টারের” গভীরতা উপভোগ করা শুরু করেছিলাম, ভীষন উত্তেজিত হয়ে অপেক্ষা করছিলাম শেষ পরিণতির জন্য ঠিক তখনই আবারও আমার জন্য অপেক্ষা করছিল সেই একই পরিনতি। লেখক প্রচন্ড ক্ষোভে আমাকে আবারও ছিঁড়ে কুচি কুচি করে ফেলে দিলেন মেঝেতে। পা দিয়ে পিষে ধরলেন আমার কাগজের বুকটিকে। দাঁতে দাঁত চেপে যন্ত্রনা সহ্য করার পাশাপাশি আমি তখন লক্ষ্য করেছি কিছু দীর্ঘশ্বাস, ফোঁপানি, দূর্বোধ্য শব্দমালার অস্পষ্ট উচ্চারন এবং প্রত্যাশিত তীব্র অন্ধকার। কিছুক্ষন পর লেখক আবারও টেনে নিলেন নতুন একটি সাদা পৃষ্ঠা। কলমের স্পর্শে তৈরী হতে লাগল আমার আরও একটি নতুন জীবনের প্রেক্ষাপট। আমার বড্ড হাসি পেল। আসলেই এই লেখকগুলো বড্ড বোকা। এই ভাবে ছিড়ে ফেলে চরিত্রকে ধ্বংস করা যায় না। অনাগত চরিত্রের ছায়া হিসেবে পুরানো চরিত্রগুলো থেকেই যায়। এই মানুষগুলো বুঝে না লেখকের সৃষ্ট চরিত্রদের কোন মৃত্যূ নেই, তারা জগতের দূর্ভাগা এক অমর সৃষ্টি।
সবাই বলেন লেখকরা নাকি খুব অনুভূতিপ্রবণ ব্যক্তি কিন্তু আমি তা মনে করি না। নির্বিচারে চরিত্র হত্যা যিনি করেন সৃজনশীলতার আনন্দ খোঁজেন তার অনুভূতির ব্যবচ্ছেদ করে আমি নিষ্ঠুর পাষান এক হৃদয়েরই প্রতিচ্ছবি দেখি। এই যেমন তিনি কিছুক্ষন আগে নির্বিকার ভাবে একটি সিগারেট ধরালেন। চরম নিষ্ঠুরতা প্রদশর্নের জন্য মাদকতার হয়ত একটি প্রচ্ছন্ন ভূমিকা আছে। এটাকে আমি সৃষ্টির প্রয়োজনে আপাতত ইতিবাচক হিসেবেই দেখছি। কিছুটা অস্থিরতা থাকা স্বত্তেও তিনি স্বাভাবিক ভাবেই সিগারেট টানছেন। বুক ভর্তি করে একরাশ ধোঁয়া ছেড়ে টেবিল ল্যাম্পের দিকে একদৃষ্টিতে কিছুক্ষন তাকিয়ে রইলেন। দেখে মনে হচ্ছে টেবিল ল্যাম্পের আলোয় তিনি কোন এক দৃশ্য অবলোকন করছেন। হাতের সিগারেটটা ছাইদানীতে রেখে, আবারও কলম হাতে নিলেন। অস্বীকার করার কোন উপায় নেই এই সময়টাতে আমি লেখককে অনেক ভালোবাসি। কাগজের সাথে কলমের এই স্পর্শ আমাকে তীব্র আনন্দ দেয়। প্রতিটি শব্দে নিজের অস্তিত্বকে আবিষ্কারের এক উত্তেজনাপূর্ন খেলা। নিস্তব্ধতা, কাগজ কলমের খসখস শব্দে আমার পথ চলা...
নীলা যখনই স্বামীর বাড়ি থেকে রাগ করে তার বাবার বাড়িতে ফিরে আসে, প্রতিবারই জাহিদের মনে অদ্ভুত এক আনন্দের শিহরন বয়ে যায়। বুকের সবচেয়ে দূর্গম অঞ্চলে লুকিয়ে থাকা প্রত্যাশাগুলো বিদ্রোহ করে জানান দেয়, এবার আর নিশ্চয় নীলা ফিরে যাবে না, একটা মাদকাসক্ত, বেকার স্বামীর কাছে বার বার ফিরে যাওয়ার কি বা আছে? দুপুরবেলা যখন ট্রেন থেকে নীলাকে নামতে দেখল জাহিদ এবারও তার ব্যতিক্রম হলো না। আবারও বাস্তবতার সাথে সেই নিষ্ফল পুরানো প্রত্যাশার এক ঘেয়েমি যুদ্ধ এবং বুকের বা পাশে চিন চিন ব্যথার অনুভূতি। জাহিদ একটা ক্লান্তিকর নিঃশ্বাস ফেলে আকাশের দিকে মুখ তুলে তাকায়, খুঁজে ফিরে নিজ হৃদয়ের প্রতিচ্ছবি। যে আকাশটা মেঘলা থাকার কথা ছিল সেখানে আজ পূর্ন সূর্যলায়ের প্রবল খরতাপ।
এইপর্যন্ত এসে ভদ্রলোক আবারও থেমে গেলেন। আমি কিছুটা আঁতকে উঠলাম। এবারও কি তিনি আমাকে ছুঁড়ে ফেলে দিবেন? আবারও কি আমাকে নিজের সম্পর্কে নতুন করে ভাবতে হবে? কিছুই বুঝতে পারছি না। ভদ্রলোক উঠে দাঁড়ালেন। পাশের টেবিলে রাখা জগ থেকে একগ্লাস পানি খেলেন। কিছুক্ষন ইতস্তত করে আবারও তুলে নিলেন কলমটিকে-
ভাবতে খুব অবাক লাগে নীলার মত একটা মেয়ে কিসের টানে আসিফের কাছে বার বার ছুটে যায়। এ কেমন ধরনের ভালোবাসা? অথচ জাহিদ কি নীলাকে কম ভালোবাসত বা আসিফের চেয়ে কোন অংশে কম ছিল? কিন্তু অন্ধ ভালোবাসার কাছে সকল যুক্তিই বার বার পরাজিত হয়। নীলা জাহিদের ব্যাপারটি খুব ভালো করেই জানত। কিন্তু ও নির্বিকার। মাঝে মাঝে মানুষের ভালোবাসা তার নিজের অজান্তেই এক অদ্ভুত মায়াবাসায় পরিনত হয় আর এই মায়াবাসা থেকে মুক্তি পাওয়া ভীষন কষ্টের সাপেক্ষ্য ব্যাপার। বলাবাহুল্য নীলা কখনই সে কষ্টের ভার বহন করতে পারে নি, তাই সে বার বার ফিরে গিয়েছে আসিফের কাছে। আর এই ভালোবাসার জগৎ থেকে মায়াবাসার ঐ জগতে যাওয়ার স্টেশনে জাহিদই প্রতিবার নীলাকে পৌঁছে দিয়ে আসে।
স্টেশন থেকে ট্রেন ছেড়ে যায়। জাহিদ কিছুক্ষন পাগলের মত হাত নাড়তে থাকে। নীলাও মৃদ্যূ হেসে হাত নাড়ায়। জাহিদ ট্রেনের পাশে হাঁটতে থাকে। ট্রেনের গতি বাড়ে, জাহিদের হাঁটার গতি বাড়ে। দেখতে দেখতে এই হাঁটা হয়ে যায় এক প্রাণান্ত দৌড়। প্লাটফর্মের শেষ প্রান্তই এই দৌড়ের শেষ সীমা। এটা এমন একটা দৌড়, যে দৌড়ে জয়ী হবার কোন সম্ভবনাই নেই। এটা এমন এক ট্রেন, যে ট্রেনে নীলার পাশে সহযাত্রী হবার কোন সম্ভবনা নেই।
লেখক হঠাৎ থেমে গেলেন। আমি রীতিমত চমকে উঠলাম। এই গল্প এখানে অবশ্যই শেষ হতে পারে না, আমাকে এক রাশ মানবিক কষ্টের মাঝে বন্দি করে তিনি নিশ্চয়ই নির্বিকার ভাবে বসে থাকতে পারেন না। আমি লেখকের দিকে এই প্রথম ভালো করে তাকালাম। ভদ্রলোকের কপাল জুড়ে বিন্দু বিন্দু ঘাম। তার সৃষ্ট চরিত্রের সকল কষ্টের প্রতিচ্ছবি যেন তারই চেহারায় ফুটে উঠেছে। নিষ্ফল আক্রোশে তিনি টেনে ধরার চেষ্টা করছেন মাথার চুলগুলোকে। তিনি চেয়ার ছেড়ে উঠে রুমের অপর প্রান্তে রাখা বুক সেলফের পাশে গিয়ে দাঁড়ালেন। সেখানে সারি সারি করে সাজানো আছে তার সকল প্রকাশিত বই। একটা বই টেনে বের করে কিছুক্ষন তার ঘ্রান নিলেন, গভীর মমতায় হাত বুলিয়ে দিলেন নীল রং এর সেই মলাটটিতে যেখানে লেখা আছে তার নাম। হঠাৎ লম্বা লম্বা পা ফেলে তিনি ছুটে এলেন টেবিলের কাছে। হাত দিয়ে লন্ডভন্ড করে দিলেন সমস্ত কাগজ। দুই হাতে খামচে ধরলেন আমার সাদা পাতলা কাগজের দেহটিকে। প্রবল আক্রোশে দুমড়ে মুচড়ে ছুঁড়ে ফেলে দিলেন আমাকে মেঝেতে। আমার কেন যেন নিজেকে হতাশ বা রাগান্বিত লাগছে না বরং জাহিদ আহসান নামক এই আবেগী লেখকটির প্রতি অনেক মায়া লাগছে। তিনি তার অজান্তেই আমার চরিত্রকে এবার পূর্ণতা দান করেছেন কিন্তু নিজেই রয়ে গিয়েছেন পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ লেখকের সৃষ্ট এক অসমাপ্ত চরিত্র হয়ে। সেই মহান লেখকের অনুভূতির ব্যবচ্ছেদ করার সাধ্য আমার মত সামান্য এক চরিত্রের কখনই নেই।