আমাদের দেশে একজন্ সদ্য পাশ করা গ্রেজুয়েট ছাত্র/ছাত্রীর সাথে বেশ কিছু নির্মম রসিকতা করা হয়। যেমন ধরুন, মাত্র পাশ করা একটি ছেলে/মেয়ে যখন কোথাও চাকুরীর জন্য অ্যাপ্লিকেশন করে তখন তাকে বলা হয়, সংশ্লিষ্ট কাজের কোন অভিজ্ঞতা আছে কিনা? যদি বলা হয় মাত্র পাশ করেছি স্যার, কিভাবে কাজের অভিজ্ঞতা থাকবে? তবে ভার্সিটি জীবনে টুকটাক কিছু পার্টটাইম করেছি। তখন নিয়োগ দাতা নিমের রস খাওয়ার মত মুখ করে বলেন, ওহ পার্ট টাইম! না না, এটা আমরা কাউন্ট করি না। আমাদের দরকার অভিজ্ঞ একজনকে।
স্যার, আমি অনেক তাড়াতাড়ি শিখে নিতে পারব।
আরে তোমাকে শেখানোর টাইম কোথায়? যাও বাবা অন্য কোথায় চেষ্টা কর। এইখানে তোমার হবে না।
আহা যদি কোন চাকরীপ্রার্থী এই ধরনের নিয়োগদাতার মুখের উপর বলতে পারত, 'আরে বাইন****, একজন সদ্য পাশ করা ছাত্রের ফুলটাইম কাজের অভিজ্ঞতা কোথা থেকে আসবে? সব কিছুতে খালি অভিজ্ঞতা খুজিস? কাজ না দিলে অভিজ্ঞতা পাবো কোথায়? নিজের বিয়ের সময়ও কি তুই বিবাহিত জীবনে অভিজ্ঞ মেয়ে খুঁজেছিস?
একজন সদ্য পাশ করা তরুন এমনিতে অনাগত নতুন জীবনের প্রত্যাশার চাপে অনেক আতংকিত থাকে। আর আতংক মানুষকে ভীতু বানিয়ে দেয়। একজন ভীতু মানুষের পক্ষে এহেন অন্যায় কথার প্রতিবাদ করতে পারে না। তাই তারা একরাশ হতাশা নিয়ে চুপচাপ বের হয়ে চলে আসে।
তারপর দেখুন, হয়ত কোন একটি প্রতিষ্ঠানে জুনিয়র একজন অফিসার নিয়োগ করা হবে, যে পদটির হয়ত তেমন কোন কঠিন দায়িত্বই নেই, সাধারন একজন উচ্চমাধ্যমিক পাশ করা ছাত্রই কাজগুলো করতে পারবে, সেখানে চাওয়া হয় এমবিএ পাশ করা ছাত্র। সাথে আবার লেখা হয় সংশ্লিষ্ট কাজের অভিজ্ঞদের অগ্রাধিকার দেয়া হবে। ভালো কথা। তা বেতন কত? এই কথা জিজ্ঞেস করলে সংশিষ্ট নিয়োগকর্তা হয়ত বলেন, উত্তর সর্ব সাকুল্যে দশ থেকে বার হাজার। আর ভাব করেন, যেন অনেক বেশি বলে ফেলেছেন।
আপনারা হয়ত ভাবছেন আমি বানিয়ে বানিয়ে বলছি? উত্তর মোটেই না। এইগুলো সবই বাস্তবের গল্প। আমি এমনও দেখেছি বুয়েট থেকে পাস করা একজন ছাত্র মাত্র আট হাজার টাকায় তার প্রথম চাকুরী শুরু করেছিলেন। ২০০৫ সালে আট হাজার টাকা কি খুব আহামরি কিছু ছিল??
এর মধ্যে ভালো প্রতিষ্ঠান যে নেই তা বলব না। অবশ্যই আছে। সেখানে হয়ত ভাগ্যবানরা তাদের মেধার কিছুটা হলেও দাম পাচ্ছেন। কিন্তু বাকিদের কথা কি কেউ ভেবে দেখেছেন? বাকিরা কোথায় যাচ্ছে, কি করছে? না, কেউ ভেবে দেখেন না। এই ব্যস্ত শহরে নিজের জন্যই সময় পাওয়া যায় না। পিছিয়ে পড়াদের জন্য সময় কোথায়? পিছিয়ে পড়াদের দায়ভার কেউ গ্রহন করতে চায় না। না সমাজ, না দেশ কেউ না, এমনকি পরিবারও না। সবাই শুধু পারে আমাদেরকে স্বপ্ন দেখাতে। বড় বড় স্বপ্ন। কারন কি জানেন? কারন স্বপ্ন দেখাতে টাকা লাগে না, পয়সা লাগে না, ভাত কাপড় কিচ্ছু লাগে না। ভাবতে অবাক লাগে কর্মক্ষম এবং পরিশ্রমী একটা জাতির তরুন প্রজন্মকে শুধু স্বপ্ন দেখিয়ে বড় করা হয়েছে।
আহ! স্বপ্ন। সেই ছেলেবেলা থেকে কত স্বপ্নই না আমরা দেখেছি। কত শুনেছি, লেখাপড়া করে যে, গাড়ি ঘোড়া চড়ে সে- তাই ভালো করে লেখাপড়া কর। আমরা অনেকেই বাবার হাতে, মায়ের হাতে কত মার খেয়েছি এই লেখাপড়ার জন্য। বেশি মেরে ফেললে বাবারা আদর করে মাথায় হাত দিয়ে বলেছেন, খোকা তোকে পড়াশুনা করে মানুষের মত মানুষ হতে হবে। আমি যা করতে পারিনি তোকে তা করে দেখাতে হবে। তোকে নিয়ে আমাদের অনেক স্বপ্ন।
এত সব স্বপ্নের দায়ভার নিয়ে আমরা আরো বড় বড় স্বপ্ন দেখি। কিন্তু বাস্তবে এসে যখন আমাদের এই স্বপ্ন গুলো কিছু নির্মম রসিকতায় নষ্ট হয়ে যায়, তখন বলতে ইচ্ছা করে প্রিয় বাবা, পড়ালেখা ঠিকই করেছি, মানুষও হয়ত হয়েছি কিন্তু গাড়িতে চড়তে পারি নি। চাকরী খুঁজতে খুঁজতে স্যান্ডেলের তলা যখন ক্ষয়ে যায় তখন বাবা সত্যি ভীষন গাড়িতে চড়তে ইচ্ছা করে। মানুষ হয়েও ঘোড়ার মত ভারবাহী জীবন ভালো লাগে না।
আমাদের দেশে দুইদিন পরপর শিক্ষানীতি পরির্বতন করা হয়। যে সরকারই ক্ষমতায় আসুক না কেন, বেকারত্ব দূর করার জন্য নানা রকম পদক্ষেপ তারা হাতে নেন। সব সরকারই বলে থাকেন, তারা একটি যুগ উপযোগী শিক্ষানীতি প্রনয়ন করেছেন। বিরোধীদল সব সময় বলে, দেশের শিক্ষাব্যবস্থা ধ্বংস করা হয়েছে। শিক্ষার মত একটি জাতীয় গুরুত্বপূর্ন বিষয়ে কোন দল একমত হতে পারেন না। একটা জাতির ভবিষ্যত প্রজন্মকে নিয়ে কেউ রাজনীতি করতে দ্বিধা করছেন না। বেকারত্ব দূর করার জন্য সত্যিকারের কোন পদক্ষেপ তেমন দেখিনি। এই লজ্জা রাখি কোথায়?
আমি ব্যক্তিগত ভাবে মনে করি আমাদের দেশে আধুনিক শিক্ষার অভাব বেশি। পুঁথিগত শিক্ষার পাশাপাশি এখানে কর্মমূখী শিক্ষার প্রচন্ড অভাব রয়েছে। দুঃখজনক হলেও সত্য আমাদের দেশে কর্মমূখী শিক্ষা বলতে এখনো শুধু রেডিও ফ্রীজ ঠিক করা, এসি ঠিক করা ইত্যাদি কাজকেই মূলত বুঝে। কিছু দিন আগে ইউএস এইড ফান্ডেড একটি এনজিও অফিসে গিয়েছি। সেখানে একটি পোষ্টে লোক নেয়া হচ্ছে। এইচআর অফিসে গিয়ে দেখি সামান্য একটা পোষ্টের জন্য তারা মাস্টার্স পাশ করা লোক চেয়েছে। আর সেই পোষ্টের জন্য প্রায় ৩০০-৩৫০ সিভি জমা পড়েছে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, এত হাই কোয়ালিফাইড লোক কেন চেয়েছেন? আপনাদের তো এত বাজেট নেই আর এত হাই কোয়ালিফাইড লোকও তো দরকার নেই। এই কাজের জন্য এইচ.এস.সি পাশ হলেই চলবে।
আমাকে একগাল হেসে হেড অব এইচ.আর. বললো, আরে ভাই, আপনি কি পাগল হলেন নাকি? এইচ.এস.সি পাশ করা একটা ছেলেকে যদি পনের হাজার টাকা বেতন দেই, এটা দেখতে কেমন লাগবে? এই প্রতিষ্ঠানের একটা লেভেল আছে না?
বললাম, আপনাদের প্রতিষ্ঠানে যে ড্রাইভার আছে, সে কত পায় আর তার যোগ্যতা কি? তিনি খানিকটা চোখ সরু করে আমার প্রশ্নের ভিতরের রহস্য বুঝার চেষ্টা করলেন। তারপর বললেন, ড্রাইভারদের ওভারটাইম সহ মাসে প্রায় বার হাজার টাকার মত পড়ে। আর ড্রাইভারদের শিক্ষাগত যোগ্যতা হিসেবে তারা সাধারনত তারা মেট্রিকপাশ চান।
মেজাজ খারাপ করে জিজ্ঞেস করলাম, তাহলে একজন মাস্টার্স পাশ করা ছেলে আর ড্রাইভারের যোগ্যতার মধ্যে পার্থক্য কি? একজন লোক ১০ বছর পড়াশুনা করে বেতন পাবে ১২ হাজার টাকা আর একজন প্রায় ১৮ বছর পড়াশুনা করে পাবে ১৫ হাজার টাকা?
জবাবে তিনি যা বললেন তা অনেকটা এই রকম, আরে ভাই পোলাপাইন চাকরী পায় না। কম কোয়ালিফিকেশন দিলে অনেক অ্যাপ্লিকেশন আসবে। এত গুলো থেকে বাছাই করা অনেক ঝামেলার কাজ। আপনি যখন কম দামে ভালো জিনিস পাচ্ছেন, তখন নিতে সমস্যা কোথায়। এতে প্রজেক্টর কিছু খরচ বাঁচে।
নিজের ক্ষমতার অপব্যবহার করতে ইচ্ছা করেনা। কেন যেন সেদিন করতে ইচ্ছা হলো। আমি তেমন কিছু না বলে অফিসে ফিরে এলাম। ফিরে এসে বসকে নেগেটিভ রিপোর্ট করলাম। কিছুক্ষনের মধ্যেই সেই এনজিওতে একটি ফ্যাক্স গেল, নিয়োগসংক্রান্ত ব্যাপারটি স্থগিত করা নিয়ে। বলা হলো, প্রতিষ্ঠানের কর্মচারীদের মধ্যেই যেন ওভার টাইমের ভিত্তিতে কাজটি ভাগ করে দেয়া হয়।
এই কাজটি করে যে আমি সমগ্র বেকার সমাজের জন্য বিশাল বড় কিছু করলাম তা নয়। আমার মনে হয়েছে, আমি একটি শিক্ষিত তরুনকে অপমানের হাত থেকে বাঁচিয়েছি। কিন্তু বাস্তবতা হলো, প্রতিনিয়ত আমাদের দেশের শিক্ষিত তরুনরা এইভাবে অপমানের শিকার হয়ে যাচ্ছেন। নিজের যোগ্যতার চেয়েও অনেক নিচু কাজ তাদেরকে করতে হচ্ছে। আর যার জন্য দায়ী আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা। আমাদের দেশে কর্মমূখী শিক্ষা যদি থাকত এবং সরকার যদি তা প্রয়োগ করতে পারত, দেশে উচ্চ শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা অনেক কমে যেত। যেমন অস্ট্রেলিয়াতে, টেফ কোর্স করানো হচ্ছে। এটা এক ধরনের ডিপ্লোমা টু গ্রাজুয়েশন কোর্স। প্রথম বছর ডিপ্লোমা, দ্বিতীয় বছরকে এ্যাডভান্স ডিপ্লোমা এবং তৃতীয় বছর অনেক সময় ক্ষেত্র বিশেষে চতুর্থ বছর কমপ্লিট করাকে গ্রাজুয়েশন ডিগ্রী হিসাবে গ্রহন করা হয়। এতে মেধার মূল্যায়ন হয়। ছেলে পেলেরা আত্মবিশ্বাসী হয়ে গড়ে উঠে। যেমন মনে করুন, একজন ব্যাংকার যিনি কিনা জেনারেল ব্যাংকিং দেখেন কিংবা ক্যাশ কাউন্টার দেখেন। এই কাজ করার জন্য গ্রাজুয়েশন বা মাস্টর্স পাশ করার প্রয়োজন নেই। তার জন্য একটি ব্যাংক ম্যানেজমেন্টের উপর একটি এ্যাডভান্স ডিপ্লোমাই যথেষ্ঠ। এতে সে যেমন তার ক্যারিয়ার অনেক আগে থেকে শুরু করতে পারবে, তেমনি একজন স্বনির্ভর হিসেবে বেকারত্বের কবল থেকেও মুক্তি পাবে।
যাই হোক, এইগুলো নিয়ে অনেক কথাই বলা যাবে। শেষ হবে না। আর আমার এই লেখা দায়িত্বপ্রাপ্ত কোন ব্যক্তির পড়া তো দূরে থাক, এই সামুর নির্বাচিত পাতায়ও যাবে কিনা যথেষ্ঠ সন্দেহ আছে। তবে আমাদের নিজেদের সচেতন হবার দরকার আছে। এটা পড়ে কোন একজন নিয়োগদাতাও যদি একটু পজেটিভ ভাবে ভাবতে পারেন, তাহলে সেটাই হবে সাফল্য। আমি কোন ভাবেই হতাশাবাদীদের দলে নই। আমি চাইও নি হতাশামূলক কোন লেখা লিখতে। কিন্তু লেখা শেষে মনে হচ্ছে, আমি হতাশা নিয়ে রচনা লিখেছি। আমি দুঃখিত সবাইকে হতাশ করার জন্য। আমি চাই মানুষ সচেতন হোক। আমরা সচেতন হই। সবাই একটি প্ল্যাটফর্ম গড়ে তুলি। যেখানে আমাদের আগামী প্রজন্ম একটি ভালো কর্মমূখী শিক্ষার পরিবেশ পাবে। আর যাই হোক, বেকার জনশক্তি নিয়ে একটা দেশ কখনও এগিয়ে যেতে পারে না।
------------------------------------------------------------------------------------
উৎসর্গঃ
একজন চমৎকার মানুষ ও কবি অনুজপ্রতিম প্রিয় ব্লগার "একজন আরমানকে"। সদ্য গ্রাজুয়েট হিসাবে যাকে অনেক ধরনের বিচিত্র অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যেতে হচ্ছে।
সর্বশেষ এডিট : ১০ ই জুন, ২০১৪ রাত ৮:০৬