বছর দুয়েক আগের কথা। আমার এক দূর সর্ম্পকের মামার বিয়ে। বিয়েটা হবে গ্রামের বাড়িতে। সময়টা সুবিধাজনক সময় হওয়াতে পারিবারিক ভাবে সবাই সিদ্ধান্ত নিল বিয়েতে যাওয়ার। আমাদের পরিবারটা ঠিক যৌথ পরিবার না হলেও একটা যৌথ পরিবারের আমেজ আছে। সবাই আমরা পাশাপাশি বিল্ডিং এ বা একই বিল্ডিং এর উপরে নিচে থাকি। ঈদে বা অন্য সময় গ্রামে গেলে সবাই সাধারনত একসাথেই যাই। তো এবারও আমরা একসাথেই গেলাম। মুরিব্বীরা এক গাড়িতে আর আমরা পোলাপাইন সব এক গাড়িতে।
অনেকটা উৎসব মূখর পরিবেশে আমরা সেই মামার বাড়িতে পৌঁছলাম। গিয়ে দেখি পুরো বাড়ি গম গম করছে। সেখানে আমাদের অন্য কাজিনদের সাথেও দেখা হলো। সবাই মিলে অনেক মজা করলাম। ছবি তুললাম, রং ছোঁড়াছুঁড়ি হলো এক পর্যায়ে গিয়ে পরিনত হলো কাঁদা ছোঁড়াছুঁড়িতে।
আমাদের প্ল্যান ছিল, বিয়ে বাড়িতে মজা টজা করে আমরা আমাদের গ্রামের বাড়িতে ফিরে এসে ঘুমাবো। কিন্তু আসতে দিতে মামা কোন ভাবেই রাজি হলেন না। বললেন, বিয়ে বাড়ি হচ্ছে হইচই আর আমোদ ফূর্তির জায়গা। এখানে সবাই থাকবে, নানা রকম আমোদ ফুর্তির করবে তাহলেই না মজা। তাই কারোই যাওয়া চলবে না। তিনি যত্নের চুড়ান্ত করেছেন। সবার জন্য থাকার ব্যবস্থা হয়েছে। মুরুব্বীদেরকে বিছানা আর রুম দেয়া হলো। আর আমাদের জন্য মাটিতে গণ বিছানা।
ঢাকায় তখন শীত না পড়লেও গ্রামের দিকে বেশ ভালোই ঠান্ডা ছিল। আমি আর অন্য দুই খালাত ভাই রায়হান আর জহির মিলে একটু বাইরে হাটাহাটি করতে গিয়েছিলাম। ঠান্ডা দেখে ফিরে আসলাম। রুমে ঢুকে দেখি সব জায়গাই মোটামুটি দখল। বড় মামা কোথায় যায়গা না পেয়ে শেষমেশ আমাদের এই রুমেই আশ্রয় নিয়েছেন। কিন্তু মামার সাথে ঘুমালে আর ঘুমাতে হবে না। কারন একজন মানুষ যে এত জোড়ে নাক ডাকতে পারে আমার তা আগে ধারনা ছিল না। বড় মামাকে দেখার পর তা জেনেছি। মামা ঘুমালে আমি ঢাকায় আমার রুম থেকে বুঝতে পারি মামা ঘুমাচ্ছেন। তিনি যদিও আমাদের পাশের বাসায় থাকেন। আমার ধারনা, আমার বড় মামী বধির হয়ে গিয়েছেন। তা না হলে তিনি কিছুতেই বড় মামার সাথে ঘুমানো সম্ভব না।
যাই হোক, বাইরে এসে সমস্যা কথা জানাতেই শিপন মামা এক গাল হেসে আমাদেরকে অন্য ব্যবস্থা করে দিলেন। ওহ! বলতে ভূলে গিয়েছি, যে মামার বিয়ে খেতে এসেছি তার নাম শিপন মামা। মামার তার এক গ্রাম সর্ম্পকের ভাগ্নের বাড়িতে আমার থাকার ব্যবস্থা করলেন। আমার অন্য দুই মামাত ভাই বড় মামার সেই আজাবের কথা জানে। তাই রুম থেকে আমাকে বের হতে দেখেই তারা আমার মতলব বুঝে আমার পিছু নিয়েছিল। ফলে আমাদের তিন জনের শোবার ব্যবস্থা শিপন মামার সেই ভাগ্নের বাড়িতেই হলো।
যেতে যেতে মামার সেই ভাগ্নের সাথে কথা বলছি। তার নাম খলিল। স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বার। সদ্য বিবাহ করেছেন। মামার বাড়ী থেকে একটু দূরে তার বাড়ী। হেঁটে যেতে মিনিট দশেকের মত লাগে। খুব সুন্দর দোচালা টিনের বাড়ী। এত বড় বাড়িতে তেমন কেউই নেই। ভাবীর সাথে দেখা হলো। খুবই চমৎকার মিষ্টি চেহারার মেয়ে। বয়স আনুমানিক ২২/২৩। সন্ধ্যা বেলা রং খেলার সময় উনার সাথে অনেক দুষ্টামী করেছি। বুঝতে পারিনি তিনি বিবাহিতা। আমি ভাবছিলাম দীর্ঘশ্বাস ফেলব, কিন্তু তার আগেই আমার পাশে জহির দীর্ঘশ্বাস ফেলল। আমি বিরক্ত হয়ে বললাম, কি সমস্যা। জহির আরো বিরক্ত হয়ে বলল, 'তোর যে সমস্যা, আমারো সেই একই সমস্যা'।
এই সমস্যা কোন সমাধান নেই বিধায় আমরা হাতমুখ ধূয়ে ঘুমাতে গেলাম। হঠাৎ ঘুম ভেঙ্গে গেল। দেখি জহির আমার গায়ে তা পা তুলে দিয়েছে। ধাক্কা দিয়ে তাকে সরিয়ে দিলাম। ও আমার দিকে পিছন ফিরে ঘুমাচ্ছে। কিছুক্ষন পর দেখি কেমন একটা বাজে গন্ধ। একটু সময় লাগলো ব্যাপারটা বুঝতে। তারপর যখন বুঝতে পারলাম কি হয়েছে, তখন জহিরের পাছায় একটা কঠিন লাথি মেরে আমি বিছানা ছেড়ে উঠে রুমের বাইরে আসলাম। এত কঠিন লাথি খেয়েও ব্যাটার কোন বিকার নেই। ঘুমাচ্ছে। আমি নির্ঘাত ব্যাটার পেট পচে গিয়েছে।
রুমের দরজা খুলে দিলাম, যেন বিষাক্ত বাতাস বের হয়ে যেতে পারে। আমি দরজার সামনে বসে আছি। মহা বিরক্ত লাগছে। ঘুমানোর ব্যাপারে আমার একটি ছোট সমস্যা আছে। কেউ বেশি নড়াচড়া করলে কিংবা গায়ের মধ্যে হাতপা তুলে দিলে আমার ঘুম ভেঙে যায়। তখন আর সহজে ঘুম আসে না। এখন আমার আর ঘুম আসছে না। কিন্তু কিছু করার নেই। তাই বাধ্য হয়ে চুপচাপ শুয়ে রইলাম। একটু চোখ লেগে আসছিল। হঠাৎ কেমন যেন ফিসফাস শব্দে আমার ঘুম ছুটে গেল। প্রথমে ভাবছিলাম আমার সাথে ঘুমাতে আসা কোনএকটা ফোনে তার গার্লফ্রেন্ডের সাথে কথা বলছে। চরম রুদ্রমুর্তি নিয়ে আমি মোবাইলের লাইট জ্বালালাম। কিন্তু দেখি তারা মরার মত ঘুমাচ্ছে। এবার একটু জোরেই কথা শুনলাম। দেখি খলিল ভাইয়ের গলা। সাথে সাথে লাইট নিভিয়ে দিলাম। ভালো করে শুনে দেখি শব্দটা পাশের রুম থেকে আসছে। এত রাতে আবার কোন সমস্যা হলো কিনা ভেবে আমি কান খাড়া করে শুনছিলাম। কিন্তু তারপর যা শুনলাম তাতে আমার আক্কেল গুড়ুম। আমি কিছু অংশ বিশেষ তুলে দিলাম একে বারে আঞ্চলিক ভাষাতে।
ভাবী বলছেন, ' ধুর! অ্যাঁই হাইত্তামন। তুঈ এইক্কা কর কা? দেলী দেলী এই কলা। ( ধুর আমি পারব না, তুমি এমন কর কেন? প্রতিদিন এই জিনিস।)
তারপর খলিল ভাই আরো কি যেন বললেন। আবার দুইজনের খুনশুটি, হাসাহাসি। ভাবি বললেন, ' এ্যাইম্মা বেশরম বেডা অ্যাঁই জীবনে দেখিন। পাশের রুমে হেতারা ঘুমাই রইসে, হেতারা উডি গেলে? ( এই রকম বেশরম লোক আমি জীবনে দেখিনি। তারা পাশের রুমে ঘুমিয়ে আছে, যদি উঠে যায়?)
খলিল ভাই বললেন, আরে হেতারা শহরইয়্যা হোলাহাইন, হারাদিন টক্কাটক্কি করি হ্যারা ছাওগৈ মরার মত ঘুমায়্যের। ( আরে তারা শহরের পোলাপাইন, সারাদিন লাফালাফি করে দেখো গিয়ে মরার মত ঘুমাচ্ছে।)
এইসব শুয়া কথা বাদ দিই, আন্নে আমার কাছে অ্যাঁইয়েন। আন্নের রুপ তো বাই বাই হড়েরর। ( এই সব কথা বাদ দিয়ে আপনি আমার কাছে আছেন, আপনার রুপ তো বেয়ে বেয়ে পড়ছে।)
ভাবী বললেন, তোয়ারর এই্যক্কা গূতাগুতি আর ভালা লাগের না। ইস ছাও ছাই কি আরের। হিসা মার, তুঈ এক্কেরে হিচাশ হই গেস। মোবাইলে ইগিন কিয়া ছাওয়ের তুঈ ? ছিঃ অ্যাঁর বমি আইয়ের। ( তোমার এই ধরনের গুতাগুতি ভালো লাগছে না। ইস! দেখ তো কি করছে? ঝাড়ু মার! তুমি একেবারে পিশাচ হয়ে গিয়েছ। এই সব কি দেখছ মোবাইলে। ছিঃ আমার বমি আসছে।)
ততক্ষনে আমার মাথায় একশ পাওয়ারের বাল্ব চিলিক দিয়া উঠল। তওবা তওবা বুঝতে পারলাম এতক্ষন আলোচনার বিষয়টা কি ছিল। বিশেষ কথাবার্তা আর নানা রকম শব্দে আমি বড়ই শরমিন্দা হইলাম। মাথা মধ্যে একটা দুষ্ট বুদ্ধি মাথা চাড়া দিয়ে উঠল। সেটা মাত্র শান দিতে দিতে ঘুমানোর চেষ্টা করলাম।
সকালে ঘুম থেকে উঠে আমরা সে বাড়িতে গেলাম। নাস্তা পানি খাবার পর পোলাপাইনের সাথে দেখা হলো। আর আইমান, তুহিন, আরিফ ভাই সহ অনেকের চোখ লাল। ঘুম কেমন হইসে জিজ্ঞেস করতেই তারা আমার দিকে এমন একটা অগ্নি দৃষ্টিতে তাকাল, যেন আমি একটা ভয়ংকর কথা বলেছি। তারপর করুন গলায় আইমান বলল বড় মামার নাক ডাকার চোটে তারা নাকি সারা রাত বারান্দায় বসে ছিল। সেখানেই বসে বসে মশার কামড় খেতে ঘুমিয়েছে। নাক ডাকা এমনই ভয়াবহ ছিল, বাড়ির কুকুর পর্যন্ত মাঝে মাঝে ঘেউ ঘেউ করে উঠেছে। এই অবস্থায় বত্রিশ দাঁত বের করে হাসা খুবই বিপদজনক। তারপর আমার বেহায়া দাঁতগুলো প্রায় বের হয়েই গিয়েছিল।
আর একটু এগিয়ে গিয়ে দেখি, জহির কোমরে হাত দিয়ে হাটছে। ঘটনা কি জিজ্ঞেস করতে বলল, কাল রাতে শোয়ার সময় মনে হয় উচু নিচু হয়ে শুয়েছিল সেই কারনে নাকি কোমরে ব্যথ্যা করছে। আবারো আমার বেয়াদপ দাঁত গুলো আমার সাথে বিশ্বাসঘতকতা করল। বহু কষ্টে আমি মুখে একটা কঠিন বেদনার ছাপ ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করলাম। আমি জানি না কত খানি সফল হয়েছিলাম। তবে হাসির কারনে জহির যে শীতল দৃষ্টিতে তাকাচ্ছিল, তা ফিরিয়ে নিল।
যাই হোক প্রসঙ্গ অন্য দিকে ঘুরানোর জন্য রাতের ঘটনাটা জহির, রায়হান আর কয়েকজন সমবয়সী কাজিনের সাথে ব্যাপারটা শেয়ার করলাম। তারা তো চরম আফসোস করল। আমি জিব কেটে আবারো বললাম তওবা তওবা। ছিঃ ছিঃ বড়দের কথা শুনতে হয় না। রায়হান বলল, এ্যাহ! আসছে আমার হুজুর। সারারাত তুমি বইয়া বইয়া মজা নিস এখন আমরা চাইলে দোষ না? এমন সময় দেখলাম ঐ ভাবি আসতেসে, সাথে আরো কিছু মেয়ে। ভাবি আমাকে দেখেই বলে, কেমন ঘুম হইসে? বিয়ে বাড়িতে এসে কেউ কি এত বেলা পর্যন্ত ঘুমায়?
আমি কিছু বলার আগেই জহির বলে ভাবি, ' হেতে নাকি রাইত্তে বেলা কি বলে হিচাশ দেইছে। আমনে কিছু দেইকছেন নি? ( সে রাতের বেলা নাকি কি এক পিশাচ দেখেছে? আপনি এমন কিছু দেখেছেন নাকি?)
আমি ভাবির দিকে চেয়ে মিষ্টি মিষ্টি হাসছিলাম। এই কথা শুনে আমি একে বারে চমকে উঠলাম। জহির কে চরম একটা কিল মারতে যাব, তার আগেই দেখি সে একেবারে ভাবির পিছনে গিয়ে দাঁত কেলিয়া হাসছে। ভাবি কিছুটা থতমত খেলেন। তারপর শুকনো হাসি হেসে চলে গেলেন। আমি জহিরকে মারতে গিয়েও হেসে ফেললাম। সেই থেকে শুরু, এরপর যতবারই ভাবির সাথে বা খলিল ভাইয়ের সাথে দেখা হলো ততবারই আমরা কোন না কোন ভাবে, আপনি পিশাচ হয়ে গিয়েছেন' এই ডায়লগটি বলতে লাগলাম। শেষমেষ ভাবি আমাদেরকে দেখলেই পালিয়ে যেতেন। আর খলিল ভাই দূরে শুকনা মুখে দাঁড়িয়ে থাকতেন।
বলা বাহুল্য আমরা আর সেই বাড়ীতে ঘুমাতে যাই নি। বাকি দুই রাত আমরা আড্ডা আর দুষ্টামির মধ্যেই কাটিয়ে দিয়েছিলাম। তবে ভাবির সেই কথা গুলো এখন মনে আছে। একবার আম্মু আমাকে একটা সুন্দর মেয়ের ছবি দেখিয়ে জিজ্ঞেস করলেন মেয়ে পছন্দ হইসে নাকি? মেয়ে কি করে, কই থাকে জিজ্ঞেস করতেই আম্মু বললেন, মেয়ে নাকি নোয়াখালীতে পড়াশুনা করে। সাথে সাথে আমার কিছু ডায়লগ মনে পড়ল। আমি বললাম, আমি মাফ চাই। আমি বিয়ে করব না। আম্মু বললেন, কেন? কি সমস্যা? আমি বললাম, তোমাকে বুঝিয়ে বলতে পারব না। তবে এই টুকু বলি, এই মেয়ের নিশ্চয় ভিডিও ভালো অডিও খারাপ। ( মানে দেখতে ভালো ভাষা খারাপ)
বিঃদ্রঃ নোয়াখালীর আপুরা মন খারপ করবেন না। আমার নিজের বাড়ীই নোয়াখালী। একটু মজা করলাম আর কি। আর ভাই লোগ, আমাকে কোন ভাবেই লুল ট্যাগ দিবেন না। আমি অতি নাদান এবং ভদ্র বাচ্চা। আমার ভিডিও অডিও দুইটাই ভালো।
সর্বশেষ এডিট : ১০ ই জুন, ২০১৪ রাত ৮:০৪