সত্যিফুল মিথ্যেভুল : ঋষিকা মৌসুমী এবং আনন্দপাঠ
লিখেছেন : মৌসুমী কাদের
১.
বারান্দাটা ঠিকঠিক বারান্দা ছিল না-- একচিলতে ঘর আর বারান্দার উপমা। মুখোমুখি ছিল বাবার বাগান। অনেক গাছ ছিল বাবার। দোলনচাঁপা, গোলাপ, শিউলী, বেলী, পাতাবাহার, ব্রিথিং হার্ট, ‘ফরগেট মি নট’, লিলি আরো কত কি। বাড়িতে জায়গা নেই। যতটুকু আছে, পাঁচ ভাইবোন তাতে আটেনা। তাই মেয়েটির জায়গা হোল ওই বারান্দায়। আসলে ওটা একা থাকবার সাধ… খোলা আকাশকে কাছে পাওয়ার ইচ্ছে, বৃক্ষঘ্রাণ দেহের ভেতরে জোরেসোরে ঢুকিয়ে দেবার তাড়া, আর হাত বাড়ালেই মাটি ছোঁবার টান। কিন্তু এতসব বুড়োদের সইবে কেন? মেয়েমানুষ একা বারান্দায় শুলে জ্বর আসে, বড় বড় ইউক্যালিপ্টাস লোভে পড়ে, তাই এটি শোভন নয়, এই হোল সার কথা। তাই বারান্দা জুড়ে প্লাই-উডের স্লাইডিং উইন্ডো লাগানো হল। তাতে করে পুরো বারান্দা হুড়মুড় করে শোকে ভরে গেল। শুধু একটি বড় জানালা এপাশ ওপাশ করা যায় বলে… তবু রোদ্দুর এসে পড়ে, গাল লাল হয়, গাছেরা বাতাস দিলে বালিকা শব্দ করে হাসে…এইসব সময় পাখিরা গ্রীলে এসে বসে, আর মাঝে মাঝে গান গায়, প্রজাপ্রতিদের গান, কলাপাতার গান…একাত্তুরের গান। মেয়েটি শুয়ে শুয়ে সেই গান শোনে আর ভাবে, একদিন সে বড় গায়িকা হবে।
এঘরে বড় বাতিটা কখনো জ্বালানো হয়না। টেবিলের উপর ছোট্ট বাতিটা অনেকটা আঁধার আর কিছুটা আলোর যৌথতায় মন্ত্রমুগ্ধ। সিংগেল খাটটির পাশের লাগোয়া জানালাটি কাঠদিয়ে সিলগালা করা। যাতে মানুষতো দূরের কথা, কোন প্রাণীও ভীড় জমাতে না পারে সেখানে। কিন্তু প্রবল আপসোস। পোকামাকড়, কালো কালো মোটা বিছা আর তেলাপোকারা গাছে গাছে দুলে দুলে শেষ পর্যন্ত সেই ঘরেই ঠাই নেয়। চড়ুই আর টুনটুনিরা ভেন্টিলেটারে বাসা বাঁধে। দিনে দিনে তারা ভয়হীন হতে থাকে। আর মেয়েটিও অভ্যস্ত হয়ে উঠে প্রকৃতির অবসরে।
মেয়েটি বারান্দাঘরটির নাম দিল ‘উপবন’।
উপবন ও মুখোমুখি পাঁচতলা দালান। মাঝখানে সমান্তরাল সমন্ধপথ। এ দালান থেকে ও দালানে যাবার রাস্তা। এই পথটির মাঝে আবার আরেকটি যৌথ পথ। যার নাম পিনুংসুলান। সামনের দালানের তিনতলার বারান্দায় ছেলেটির বাগান। সে যখন তখন গাছে জল দিতে আসে। টবে তার একমাত্র নয়নতারা ফুল। বাকিসব পাতাবাহার। তাই নিয়ে সে জলখেলায় মত্ত থাকে। রাত হলে এই খেলা বাড়ে। তখন সে ঘুমঘুম চোখে থাকুক বা না থাকুক, ঘাস তুলতে ভালোবাসে আর উপবনের দিকে তাকিয়ে হাসে।
দিনের বেলা সারাদিনই পিনুংসুলান আর সমন্ধপথে ফেরিওয়ালাদের হাঁক টুকরো টুকরো হয়ে ফিরে ফিরে আসে। কখনো সেই চিকন স্বরের বিকট শব্দ শুনে দলবদ্ধ শালিকেরা ভয়ে পালায়। ওদের পাখার ঝপাৎ ঝপাৎ শব্দে মেয়েটি ঘুরে তাকায় উপরে। বাবা তখন বাগানে হাঁটেন। তাই দেখে ছেলেটি ভারী মোটা কালো কাঁচের চশমা খুলে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে শুনিয়ে শুনিয়ে বলে, ধ্যাত…ধ্যাত, ফরমুলাটা মিলছেই না…!!!
ঠিক এই সময়েই ডাকপিয়ন সাইকেল চালিয়ে উপবনের সামনে এসে দাঁড়ায়। ঝোলা থেকে হলুদ একটা খাম বের করে বাগান গলিয়ে জানালার কাছে ছুটে আসে। মেয়েটি খামটির দিকে তাকিয়ে লেখা দেখেই বুঝতে পারে এটি কার চিঠি। শুধু বিড়বিড় করে বলে, খোকনদা…………
প্রতিক সাইফুল
মৌ/
প্রতিক এসেছে। আর বৃষ্টি নেমেছে। প্রতিক এলেই বৃষ্টি নামে। বৃষ্টির তীব্র ছাট জানালার শার্সিতে আঘাত করছে। দূরে পুকুর পাড়ে ইউক্যালিপটাসের পাতা আড়াল চাইছে। ওর একটি ছাতা হলে বেশ হত।
প্রতিক শুয়ে আছে গুটিশুটি হয়ে। গায়ে দিয়েছে লাল নকশি কাঁথাটা। কাল সারাদিন ঘুমিয়েছে। আজ সারাদিন গুমোবে। এই বৃষ্টির শব্দ ওর চোখে ঘুম চেপে ধরেছে।
মধ্য রাতে প্রতিকের ঘুম ভেঙে গেল। শার্ট প্যান্ট পরে রেডি। বললাম, বাইরে বৃষ্টি।
-না, বৃষ্টি থেমে গেছে।
সত্যি সত্যি বৃষ্টি নেই। থেমে গেছে অনেক আগে। তবু বৃষ্টির শব্দ জেগে আছে। জানালার শার্সিতে বৃষ্টিচিহ্ণ লেগে আছে। এর মধ্যে ডগমগ করে চাঁদ উঠেছে। ফুল ফুটেছে। পূর্ণ চাঁদ আকাশ থেকে নেমে পড়েছে মাটিতে। ছায়াতে। একটি ঝিঁঝিঁ পোকার ডানাতে। পোকাটি স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে আছে। রাত্রিফুল ভেসে আসছে।
ব্রহ্মপুত্রের দিকে হেঁটে হেঁটে যেতে যেতে প্রতিক বলল, গান ধর।
আমি গান জানি না। কিন্তু এ সময় হয়তো কোথাও সুবিনয় রায় নম্র শান্ত গলায় গেয়ে উঠছেন--
নিশিদিন মোর পরানে প্রিয়তম মম
কত-না বেদনা দিয়ে বারতা পাঠালে।
বৃষ্টিগণ্ধের মধ্যে, জায়মান জ্যোৎস্নার ভিতরে, অনন্ত তরুর সঙ্গে হেঁটে যেতে যেতে আমি গাইছি-
ভরিলে চিত্ত মম নিত্য তুমি প্রেমে প্রাণে গানে হয়
থাকি আড়ালে।।
গাইতে গাইতে প্রতিক আমাকে ছেড়ে এগিয়ে গেছে সামনে--ঘন গাছের দিকে, বাকলের ভিতর দিয়ে। প্রতিক চলে যাচ্ছে গাছের ভিতর দিয়ে জ্যোৎস্নার হাত ধরে। নির্মল নির্মমতার সাক্ষ্য রেখে। সুবিনয় গাইছেন গায়- নিশিদিন মোর পরানে…প্রিয়তম মম…কোন ব্যাকুল পরাণ নিয়ে বন্ধুটি আমার মহাবৃক্ষের ভিতর দিয়ে হেঁটে চলে যাচ্ছে—একলা ব্রহ্মপুত্রের উপর দিয়ে প্রতিক চলে যাচ্ছে…আর গাছগুলি মাথা নিচু করে পিছনে পিছনে চলেছে—গানগুলিও ছায়াপাখির মত উড়ে উড়ে যাচ্ছে। কেবল আমি ঠায় দাঁড়িয়ে রয়েছি—আর আমার সঙ্গে দাড়িয়ে আছে বেদনাটি। শান্ত। বিহ্বল। আড়ালে।
--আনন্দ
ময়মনসিংহ
১৯৮৬