একটা ছাউনিবিহীন আর্মি জীপগাড়িতে আমরা আট-দশজন তরুণ ও যুবশ্রেনীর লোকজন স্বশস্ত্র অবস্থায় প্রায় সারাদিন-সারারাত ঈশ্বরদী উপজেলার সম্ভাব্য সকল রাস্তায় টহল দিই। আমাদের এই দলের নেতৃত্ব দেন আওয়ামী লীগের উপজেলা কমিটির প্রচার সম্পাদক আব্দুল লতিফ বিশ্বাস (পরে দৈনিক ইত্তেফাকের ঈশ্বরদীস্থ সংবাদদাতা)। তার হাতে একটা দো-নালা বন্দুক যা আসলে তার বাবার, অন্যদের কারো হাতে পয়েন্ট ২২ বোরের রাইফেল, ইয়ারগান, ঢাল-তলোয়ার, সড়কি, বর্শা কিংবা তীর-ধনুক। আমার হাতে শক্ত করে ধরা একটা মাছ মারা ট্যাটা, বুকে যেন দুর্বার সাহস। সাড়া মাড়োয়ারী হাইস্কুলের নবম শ্রেনীর ছাত্র, কিন্তু বছরের শুরুতে রাজনৈতিক ডামাডোল শুরু হয়ে যাবার পর স্কুলও অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ হয়ে গেছে। সহপাঠি বন্ধুরা কে কোথায় তা জানি না। এর আগে আমাদের গ্রাম বড়ইচারার স্কুলমাঠে প্রতিদিন বিকালে লাঠিচালনা শিখেছি পিটি-প্যারেড। মজিদ ভাইয়ের নির্দেশ ছিল থুৎনি সমান উচ্চতার শক্ত লাঠি জোগাড় করতে। নিজেদের বাঁশঝাড় থেকে নিজেই দা দিয়ে বাঁঁশ কেটে লাঠি তৈরি করেছি। গাড়িটির চালক পাকশীর একটা ছেলে (নাম স্মরণ করতে পারছি না)। এই জীপগাড়িটা ঈশ্বরদী বিমান বন্দরে ডিউটিতে নিয়োজিত পাকিস্তান এয়ারফোর্সের একটি সেকসন আগে ব্যবহার করতো। ১০ জনের ওই সেকসন বিক্ষুব্ধ জনতার কাছে আ্ত্মসমর্পনের পর তাদেরকে থানায় সোপর্দ করা হয় আর গাড়িটির আপাতত দখল চলে আসে আওয়ামী লীগের হাতে। পাবনার আদালত বন্ধ, রোডও স্থানে স্থানে কেটে দেওয়া ও বড় বড় গাছ কেটে বেরিকেড বসানো; সুতরাং বন্দীদের কোথাও পাঠিয়ে দেবার সুযোগ নেই বলে থানা হাজতেই আটকাবস্থায় রাখা আছে। থানা পুলিশও এদের নিয়ে চিন্তিত, তারা জানে না এদেরকে কী করা হবে। থানার ভেতরে-বাইরে দু'এক শ লোক দিন-রাত সব সময়ই দেখা যা জটলা করতে। প্রায় সকলের চোখে-মুখে উত্তেজনা, কখন যে কী হয়! এসব জটলার মধ্যে স্থানীয় নেতাদের প্রায় সকলকে দেখি ভাবলেশহীন দাড়িয়ে থাকতে আর যেন অপেক্ষাকৃত তরুণরাই সদাব্যাস্ত, তাদের গোসল-খাওয়া, ঘুমানো সময় নেই কারো।
১৯৭১-এ ৭ মার্চে ঢাকার রেসকোর্স মাঠে মুজিবের ভাষণের পর থেকে পুর্বপাকিস্তানের বাঙালিরা শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। যে কোনোদিন যে কোনো মুহূর্ত থেকে সামনা-সামনি যুদ্ধ শুরু হয়ে যেতে পারে এমন একটা পরিস্থিতি তৈরি হয়। শাসকগোষ্ঠী আগেই বলে দিয়েছে যে, শেখ মুজিবের ৬-দফার কোনোটিই মেনে নেয়া সম্ভব নয়। কেননা, তাদের দৃষ্টিতে ওগুলো মানা আর পাকিস্তানের পূর্ব-পশ্চিম সম্পুর্ণ আলাদা হয়ে যাওয়া একই কথা। ডিসেম্বরের সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের অভূতপুর্ব বিজয়ের পর প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ও ভুট্টো মিলে ক্ষমতা হস্তান্তরে শুরু করেন টালবাহানা। আজ নয় কাল, কাল নয় পরশু এভাবে দিনের পর দিন চলে যায় কিন্তু ক্ষমতা হস্তান্তর আর হয় না; ইয়াহিয়া খান পদত্যাগও করেন না। ২৫ মার্চে ঢাকায় পাকবাহিনীর গণহত্যা শুরু হয়ে গেলে তা প্রথমেই ছড়িয়ে পড়ে বাঙালি অধ্যুষিত সেনাছাউনি, পুলিশ, ইপিআর ও মিলিশিয়া বাহিনীর অবস্থানগুলোতে, দেশের সর্বত্র।
ঈশ্বরদী ফায়ার ব্রিগেড অফিসটাই তখন সরকার বিরোধী জনতার কন্ট্রোল রুম। ওই অফিসের ৩০৩ নম্বরের টেলিফোনটা তখন বলতে গেলে সংগ্রামীদের দখলে। আর পাবনা, রাজশাহী বা রাজধানী ঢাকার সাথে যোগাযোগ ও খবরাখবর জানতে এছাড়া আর কোনো বিকল্প নেই। দিনে দু'একবার অমি নিজেও সেখানে গিয়ে বসি দল-বলের সাথে। আমরা কখন বাড়ি যাই, কখন খাই, কখন ঘুমাই তার কোনো হদিস নেই। সব রাস্তায় একবার টহল শেষ হলে এই কন্ট্রোলরুম চত্ত্বরে আমাদের গাড়িটা ফিরে আসে। অন্য আরেকটা গ্রুপ তাতে লাফিয়ে ওঠে বের হবার জন্য।
এসব ঘটনা ১১ এপ্রিল '৭১ ঈশ্বরদীর পতনের পুর্বক্ষণ পর্যন্ত অব্যাহত ছিল।
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে মার্চ, ২০১৫ সকাল ৮:৪৭