ক্লিওপেট্রা
৪৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দে ক্লিওপেট্রা যখন রোমে অবস্থান করছিলেন আর একজন রানী হয়ে তাঁরই অধঃস্তন এক জেনারেলের সঙ্গে রাজপ্রাসাদে একত্র বসবাস ভালো কিছু বয়ে আনতে পারলোই না বরং চারদিকে কানাঘুঁষা চলতে লাগলো। তিনি নানাদিক থেকে চরম মুসিবতে পড়ে গেলেন। ক্লিওপেট্রা নিজেকে দেবী নতুন ‘আইসিস’ বা নারীকূলের মাতৃত্ব নিয়ন্ত্রক (দেব ওসিরিস-এর স্ত্রী ও ভগ্নী, মৃত্যুপরবর্তী বিচারক) বলে ডাকতে শুরু করলেন। এনিয়ে সমাজে ব্যাপক সমালোচনা হতে লাগলো। এমনিতেই তিনি অতিউচ্চস্তরের বিলাসিতার মধ্যে থাকতে ভালোবাসতেন। সিজারকে বলে নিজের একটা স্বর্ণমূর্তি গড়ে ভেনাস জেনেট্রিক্স মন্দিরে স্থাপনের ব্যবস্থাও করলেন। আর সিজার প্রকাশ্যেই বলে বেড়াতে লাগলেন যে, সিজারিওঁ তাঁরই সন্তান। অনেকেই ভাবলেন, এটা সিজারের এক ধরণের চক্রান্ত, তিনি একেতো একজন বিদেশী তার ওপর বিবাহিত হয়েও ক্লিওপেট্রাকে বিয়ে করতে চাইছেন যা কোনও নিয়মের মধ্যে পড়ে না!
সিজারের বৃটেন আক্রমণ
যাহোক, ৪৪ খ্রিস্টপূর্বাব্দের কোনও এক উৎসবের দিনে সবকিছুর পরিসমাপ্তি ঘটলো। রোমের সিনেট বিল্ডিংয়ের সন্মুখ চত্ত্বরে সিজার ছুরিকাঘাতে নিহত হলেন। ব্রুটাস-এর নেতৃত্বে কেসিয়াস, ট্রিবোনিয়াস, কেস্কাসহ ৬০ জন সিনেট সদস্যের প্রাসাদ-ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে তিনি মারা গেলেন। তাঁর দেহে ৩৬টি ছুরিকাঘাতের চিহ্ন পাওয়া গেলো যার মধ্যে ২৩টিই গুরুতর। অধিকাংশ সিনেটর ভাবতেন, তিনি ছিলেন রিপাবলিকের শুভাশুভের প্রতি হুমকিস্বরূপ। কেউ কেউ এটাও ভাবলেন, সিজার নিজেকে রাজা ঘোষণা দেবার মতলব আঁটছিলেন। সিজারের হত্যাকান্ডের পর ক্লিওপেট্রা রোম থেকে পালিয়ে জন্মভূমি আলেকজান্দ্রিয়ায় প্রত্যাবর্তন করেন। মৃত্যুর আগে সিজার কখনো স্বীয় পুত্র বা ক্লিওপেট্রাকে কোনও উইল করে যেতে পারেন নি; কাজেই তিনি তো গেলেনই, তাঁর পুত্রের জীবনও চরম বিপদজনক পরিস্থিতির মধ্যে নিপতিত হলো।
সিজারের মৃত্যু
আলেকজান্দ্রিয়ায় প্রত্যাগমনের কালে, ক্লিওপেট্রার থাকার মধ্যে থাকলো শুধু তাঁর দ্বিতীয় স্বামী অর্থাৎ পরবর্তী ভাই টলেমি-১৪; সেও এক সময় নিহত হলো এবং সিজারিওঁই শেষপর্যন্ত ৪ বছর বয়সে পরবর্তী রাজা হিসেবে উত্তরাধিকারপ্রাপ্ত হলেন। তিনি ফিরে এসে দেখলেন, সমগ্র আলেকজান্দ্রিয়া দুর্ভিক্ষ আর মহামারীতে ছয়লাব হয়ে যাচ্ছে। তাঁর অনুপস্থিতিতে এতোদিন যাবত নীল নদের মোহনা খননকাজের অভাবে পুরো নদের নাব্যতাই হারিয়ে গেছে যার জন্যে চাষাবাদ বলতে গেলে প্রায় বন্ধই হয়ে পড়েছে। কৃষিকাজের এই অব্যবস্থা চললো এক নাগাড়ে তিন বছর। সিজারিওঁর স্বীকৃতি ও নিরাপত্তা চেয়ে তিনি চারজন পদাতিক সৈন্যকে সিজারের প্রাক্তন এক লেপটেন্যান্ট ‘দোলাবেলা’ বরাবর পাঠালেন যার সুপারিশপত্র সিজারই এক সময় মিশরে ফেলে রেখে গিয়েছিলেন। কিন্তু সেই চিঠি দোলাবেলার কাছে পৌঁছেনি। পথিমধ্যে ওই চারজন পদাতিককে ‘কেসিয়াস’ নামে সিজারের এক হত্যাকারী আটক করে, ফলশ্রুতিতে দোলাবেলা আত্মহ্ত্যার পথ বেছে নেন। ঘটনাটা ঘটে ৪৩ খ্রিস্টপূর্বাব্দের গ্রীস্মের সময়। কোনও উপায়ান্তর না দেখে ক্লিওপেট্রা বিশাল এক নৌবহর সাজিয়ে মার্ক এন্টনি ও অক্টাভিয়ানের উদ্দেশ্যে নোঙ্গর তোলেন। কিন্তু দুর্ভাগ্য যে, সেই যাত্রা পথেই সমাপ্ত হয় প্রবল ঝড়ের কবলে পড়ে।

ব্রুটাসের মৃত্যু
ক্লিওপেট্রা গভীর দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করছিলেন, কে হতে যাচ্ছেন রোমের পরবর্তী কর্ণধার, তাঁর ওপর। ব্রুটাস এবং কেসিয়াস নিহত হলে, এন্টনি, অক্টাভিয়ান ও লেপিডাসই হবেন পরবর্তী বিজয়ীরা। আর ক্লিওপেট্রা ভালোভাবেই বুঝতে পারছিলেন যে, এদের মধ্যে কার সাথে তাঁর পড়তা পড়বে! অক্টাভিয়ান ভীষণ অসুস্থ হয়ে এক সময় ইটালিতে ফেরত গেলেন, কাজেই এন্টনি থাকলেন তার পর্যবেক্ষণে। কিন্তু প্রধান বিবেচ্য বিষয় ছিল, অক্টাভিয়ানকে প্রমোশন দেয়া হয় কিনা। কিন্তু বিজয়ীরা সকলেই দোলাবেলার প্রতি ক্লিওপেট্রার পুরস্কার সম্বন্ধে অবগত ছিলেন।
৪১ খ্রিস্টপূর্বাব্দে মার্ক এন্টনির পক্ষ থেকে টারসাস সফরের দাওয়াত পেলেন ক্লিওপেট্রা। ইতিমধ্যে তিনি এন্টনিকে কীভাবে পেতে হবে সে সম্পর্কে ভালোভাবেই জেনে গিয়েছিলেন ক্লিওপেট্রা। তিনি আরও জানতেন যে, এন্টনির কৌশল ও কর্মপরিকল্পনা যাকিছু সবই সীমিত আর শরীরেও নীলরক্ত, সুরায় আসক্তি, নারীলোভী, উচ্ছৃঙ্খলতা আর উচ্চাভিলাস। তা সত্ত্বেও মিশর ছিল অর্থনৈতিক দুরবস্থার শেষসীমায় উপনীত; ক্লিওপেট্রা ব্যাপক এক সংবর্ধনার আয়োজন করলেন এন্টনির সৌজন্যে। আর সেই যাত্রাকেও এমনভাবে সাজালেন যা কোনওদিন কেউ দেখেনি, নিজেও সেভাবেই সাজলেন ঠিক যেন প্রেমের দেবী আফ্রোদিতি’র মতই। শহরে প্রবেশটা ছিল অত্যন্ত পরিকল্পনামাফিক, ভালগারে পরিপুর্ণ, অর্দ্ধোলঙ্গ নারীদের ডিসপ্লে যা একজন ভালগার-মানুষকে আকৃষ্ট করতে ছিল যথেষ্ট। এন্টনি নিজে একজন ব্লু-ব্লাডেড হয়ে আরেকজন ব্লু-ব্লাডেড টলেমিয় রমনীর ধ্যান-ধারণা তো পছন্দ করবেনই। এন্টনির সাবেক স্ত্রী বা বর্তমান স্ত্রী ফুলভিয়া সবাই তো অত্যন্ত মধ্যবিত্ত শ্রেনী থেকে আগত।
ক্লিওপেট্রা ও মার্ক এন্টনি
ক্লিওপেট্রা আর এন্টনি ৪১ খ্রিস্ট পূর্বাব্দ ৪১-৪০ পর্যন্ত শীত মৌসুম আলেকজান্দ্রিয়াতে কাটালেন। অন্যান্য বেশকিছু সূত্রে জানা যায়, ক্লিওপেট্রা চাইলে সবকিছুই পেতে পারতেন যা মনে চাইতো এমনকি তাঁর বোন আরসিনোর মৃত্যু পর্যন্ত। কিন্তু পরে এন্টনির ওপর ক্লিওপেট্রা খুব বেশি প্রভাব বিস্তার করতে পারেননি। এন্টনি সাইপ্রুস’এর নিয়ন্ত্রণ আদায় করে নেন। প্রকৃতপক্ষে ক্লিওপেট্রা হয়ে পড়েছিলেন একেবারেই বিভ্রান্ত। এন্টনি চেয়েছিলেন অর্থসম্পদ আর ক্লিওপেট্রা উদারতা ছিল মূলতঃ যেখানে লাভের ব্যাপার থাকতো।
৪০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের বসন্তকালে, মার্ক এন্টনি আলেকজান্দ্রিয়া ত্যাগ করে স্বদেশে ফিরে যান। এভাবে ৪ বছর কেটে গেলো, আর দেখা হয়নি দু’জনের। এন্টনির স্ত্রী ফুলভিয়া সেখানে অক্টাভিয়ানের বিরুদ্ধে জমিজমা ইজারা সংক্রান্ত বিরাট একটা আন্দোলনের মুখে পড়েন। ফুলভিয়া এসব দেখে গ্রীস-এ চলে যান এবং এন্টনির সঙ্গে বৈঠকে খুবই তিক্ত অভিজ্ঞতা লাভ করেন। এই ঘটনার পর ফুলভিয়া খুবই অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং সেখানেই মারা যান। এন্টনি ঘটনার গুরুত্ব অনুধাবন করে সেই শরতেই অক্টাভিয়ানের বোন অক্টাভিয়াকে বিয়ে করেন। অক্টাভিয়া খুবই সুন্দরী ও বুদ্ধিমতি রমনী ছিলেন এবং খুব অল্পদিন আগে তিনি বিধবা হন। আগের পক্ষে তিনটি সন্তানও ছিল। আর সেই মুহূর্তেই আলেকজান্দ্রিয়ায় ক্লিওপেট্রা মার্ক এন্টনির ঔরসে ছেলে-মেয়েসহ যমজ সন্তান প্রসব করেন। আর এন্টনি-অক্টাভিয়া দম্পতির প্রথম সন্তান হলো মেয়ে। যদি অক্টাভিয়ার গর্ভে পুত্রসন্তানের জন্ম হতো তাহলে বোধহয় ঘটনা অন্যদিকে মোড় নিতে পারতো। এন্টনি রাস্ট্রীয় কোষাগারের খবর রাখতেন, তা থেকে নিজের জন্য কত প্রয়োজন তারও হিসেব করতেন। আর যখনই তিনি ট্রেজারির পরিচালনার দায়িত্ব পেলেন তখন পাবলিক ইন্টারেষ্ট শতকরা ১২ ভাগ থেকে নেমে ৪ ভাগে এসে দাঁড়ালো।
এন্টনি গ্রীস ছেড়ে ইটালি গমন করলেন পার্থিয়ানের সঙ্গে বোঝাপড়া করবার জন্য। ইতোমধ্যে অক্টাভিয়া আরও একটি কন্যাসন্তানের জন্ম দেন। এন্টনি জানালেন, মেয়ে সন্তান জন্মদানের ব্যাপারটি তিনি মেনে নিয়েছেন কারণ তাঁর ভাই অক্টাভিয়ানের সঙ্গে এখনো শান্তি স্থাপনে অনেক করণীয় রয়ে গেছে। তাই রোমে অবস্থান করাই তাঁর জন্য যুক্তযুক্ত হবে। কিন্তু এন্টনি প্রথম যেটি করলেন তা ছিল ক্লিওপেট্রার জন্য। তাদের যমজ সন্তান অফিসিয়ালি স্বীকৃত ছিল এন্টানির নামেই, নামও দেয়া হয়েছিল সেভাবেই - আলেকজান্ডার হেলিওস ও ক্লিওপেট্রা সেলিনি। মার্ক এন্টনি বিশাল কৃষিক্ষেত্র দিলেন ক্লিওপেট্রাকে যা মিশরের জন্য খুবই প্রয়োজন ছিল। এন্টনি দিলেন সাইপ্রুস, সিলিসিয়ান বেলাভূমি, ফোনিসিয়া, কোয়েলি-সিরিয়া, জুদিয়া এবং আরব ভূখন্ড। এই অনুদান মিশরকে নিজের পায়ে দাড়ানোর মত ব্যবস্থা করে দিল, এবং বিশাল নৌবহর গঠন করতেও সমর্থ হলো। এন্টনির পরিকল্পনা ছিল পার্থিয়ানের বিরুদ্ধে জনমত তৈরি করা। এজন্য এন্টনির প্রয়োজন ছিল ক্লিওপেট্রার সাপোর্ট; কিন্তু ৩৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দে পার্থিয়ানের সঙ্গে যুদ্ধে তিনি হেরে গেলেন। এজন্য ক্লিওপেট্রার প্রতি তাঁর ঋনের পরিমাণ আগের যেকোনও সময়ের তুলনায় আরও বাড়লো। আর তাঁদের তৃতীয় সন্তানেরও জন্ম হলো তখন।

বেগুনী রঙে প্রাচীন মিশরীয় সাম্রাজ্য
তাঁরা যখন সিরিয়া প্রত্যাবর্তনের পথে, ক্লিওপেট্রা সেনাবাহিনীর ভরণপোষন, কাপড়-চোপড়, খাবার-দাবার, বেতনভাতা ইত্যাদি নিয়ে তাঁর সাথে সাক্ষাত করলেন। ৩৫ খ্রিস্টপূর্বাব্দের প্রথম দিকে এন্টনি ক্লিওপেট্রাকে নিয়ে আবার মিশরে ফিরে এলেন। ওদিকে এন্টনির স্ত্রী অক্টাভিয়া তখন এথেন্স-এ সরবরাহ ও পুনর্গঠন নিয়ে ব্যস্ত দিন কাটাচ্ছিলেন আর স্বামীর জন্য প্রতীক্ষায় দিন গুণছিলেন। এন্টনি তাঁকে একটা চিঠি পাঠালেন, তিনি যেন কোনওভাবেই মিশরে না আসেন। অক্টাভিয়ার ভাই অক্টাভিয়ান নানাভাবে উস্কানী দিয়ে যাচ্ছিলেন এন্টনির সঙ্গে কোনওমতে একটা যুদ্ধ বাধানোর জন্য, যেটা একপ্রকার অলঙ্ঘনীয় হয়ে পড়েছিল। এন্টনিও হয়তো কোনও উপায় খুঁজে বের করতে পারতেন যদি অক্টাভিয়া ও তাঁর ভাই অক্টাভিয়ানকে রোমে পেতেন। আর ক্লিওপেট্রা এন্টনিকে আলেকজান্দ্রিয়ায় রেখে ভালোই করেছিলেন। এসব সত্ত্বেও অক্টাভিয়া এন্টনির প্রতি ছিলেন পুর্ণ বিশ্বস্ত।
(ক্রমশ)
-----------------------------------
সকল পর্ব:
প্রথম পর্ব | দ্বিতীয় পর্ব | তৃতীয় পর্ব | চতুর্থ(শেষ) পর্ব
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে মে, ২০১০ রাত ৩:২৫