চিরদিনই মূল স্রোতের বিপরীতে সাঁতার কেটেছেন ফরহাদ মজহার। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালে যুক্ত হয়েছিলেন বাম রাজনীতির সাথে। আর সত্তুরের দশকের শুরুতে ভারতের নকশাল আন্দোলনে অনুপ্রাণিত হয়ে সিরাজ সিকদারের নেতৃত্বে যুক্ত হয়েছিলেন বাংলাদেশের সর্বহারা বিপ্লবে। এরপর আমেরিকাতে প্রায় এক দশক স্বেচ্ছা-নির্বাসন শেষে দেশে ফিরে এসে মাওবাদী দলগুলোকে এক করার উদ্দেশ্যে গঠন করেছিলেন 'ঐক্য প্রক্রিয়া'। কিন্তু বাংলাদেশে সমাজতন্ত্রীদের ঐক্য স্বপ্নই থেকে গেছে। ইতিহাসের স্বপ্নভঙ্গের মতোই ফরহাদ মজহারের সমাজতান্ত্রিক আদর্শের মোহভঙ্গ ঘটেছে।
মূল স্রোতের যতই বাইরে সাঁতার কাটুন না কেন- ফরহাদ মজহার সবসময়ই ছিলেন উচ্চকিত, একরোখা আর নিজ যুক্তিতে অটল। ফরহাদ মজহার এখন দলীয় রাজনীতির সাথে জড়িত না থাকলেও তিনি বরাবরের মতোই রাজনীতির আঙ্গিনাতেই শয্যা পেতে আছেন। ১৯৯৪ সালে, বিএনপি শাসনামলে বাংলাদেশে আনসার বিদ্রোহের সমর্থনে তার নিজের পত্রিকা 'পাক্ষিক চিন্তা'য় একটি নিবন্ধ রচনা করে কারাবন্দী হন। তিনি আনসার বিদ্রোহে 'শ্রেণী সংগ্রাম'-এর মৌলিক উপাদানগুলো লক্ষ্য করেছিলেন। আন্তর্জাতিক চাপে ফরহাদ মজহারকে দ্রুত মুক্তি দিতে বাধ্য হয় বাংলাদেশ সরকার। ফরহাদ মজহার বিএনপি'র ডান ঘেঁষা রাজনীতির তীব্র সমালোচনা করেছেন এককালে। আর গণতান্ত্রিক আন্দোলনের নামে আওয়ামী লীগের সাথে জামায়াতে ইসলামীর আঁতাতকে কচুকাঁটা করেছেন তাঁর কলামগুলোতে। ফরহাদ মজহার অনেক ঘাটের জল ঘোলা করে এখন ইসলামী বিপ্লবের স্বপ্ন দেখছেন। তাঁর আজকের এই অবস্থান কি স্ববিরোধী, নাকি যেকোন উপায়ে সামাজিক পরিবর্তনকে দেখতে চাওয়ার আজন্ম স্বপ্ন?
সাম্রাজ্যবাদী মার্কিন মুল্লুকে এক দশক পার করলেও ফরহাদ মজহারের মনে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী একটি চেতনা দিন দিন দানা বেঁধেছে। বাম রাজনীতির সুবাদে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধীতায় তাত্ত্বিক জ্ঞানের অভাব ঘটেনি তাঁর। ফরহাদ মজহারের এই সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী মানসিকতা এতোটাই প্রকট আকার ধারন করেছে যে, উচ্চ ফলনশীল ধানবীজ কিংবা বাংলাদেশে বার্ড-ফ্লু'র বিস্তারকেও দাতাদেশগুলোর চক্রান্ত বলে মনে করেন তিনি। বাংলাদেশের ধর্মীয় মৌলবাদের বিস্তাররোধে যে মূহুর্তে খুব জরুরী ভূমিকা গ্রহন করা উচিত- ফরহাদ মজহার তখন 'মাদ্রাসার এতিম ছাত্রদের' নিয়ে স্বপ্ন দেখেন মার্কিন আগ্রাসন প্রতিরোধ করার। আর এরই সূত্রধরে, যে ব্যক্তি নারী মুক্তির জন্য উবিনিগ, প্রবর্তনা, নারীগ্রন্থ প্রবর্তনা'র মতো প্রতিষ্ঠানের জন্ম দিয়েছেন- তিনি সম্পদে নারীর সমঅধিকার দানকে উস্কানীমূলক বলে প্রচার করেন। বেশ কিছুদিন ধরে চালবাজ কাঠমোল্লাদের সাথে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশে ইসলামী শাসন কায়েমের স্বপ্নও বুনছেন ফরহাদ মজহার। আর অবাক করা কাণ্ড, আমি নিশ্চিত যে ফরহাদ মজহার নিজেও বুঝতে পারছেন না তাঁর 'এবাদতনামা' তিনি নিজেই উল্টোদিক থেকে পাঠ শুরু করেছেন হঠাৎ।
ফরহাদ মজহার সাম্রাজ্যবাদ বিরোধীতার নামে মৌলবাদকে ধারন করেছেন, মৌলবাদকে উৎসাহিত করছেন এবং মৌলবাদের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরছেন প্রচার মাধ্যমে। শুধু তাই নয়, তিনি মনে করছেন যে সকল ব্যক্তি বাংলাদেশে ধর্মনিরপেক্ষতায় বিশ্বাসী তারা বুশ-ব্রাউনের এজেণ্ট। ফরহাদ মজহারের ভাষায়, 'এদেরকে ধর্মনিরপেক্ষ বলা আর গলায় সাপকে ফুলের মালা বলা একই কথা'। বাংলাদেশের হাজার বছরের সাংস্কৃতিক চেহারা, আর্থ-সামাজিক আচার, আর ধর্মীয় চেতনা আর যাই হোক পাশ্চাত্য থেকে আমদানী হয়নি। ফরহাদ মজহার আজ যাদের সাপ বলে অভিহিত করতে চাইছেন, তারাই তাঁর এককালের ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশ বিনির্মানের সহযোদ্ধা ছিলেন। ইউরোপের চার্চ থেকে পৃথক হওয়া রাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থাকে ফরহাদ মজহার ঐতিহাসিক বিবেচনায় সমর্থন করলেও- বাংলাদেশে আসন্ন ইসলামী বিপ্লবের অনিবার্যতাকে তিনি এড়াতে পারেন না। তিনি ধর্মনিরপেক্ষতাকে কিছুটা ঘুরিয়ে ফ্যাসিবাদ বলে ভাবেন এবং মনে করেন, বাংলাদেশে ইসলামের যুদ্ধটা এই ফ্যাসিবাদ আর পরাশক্তির সমর্থকদের সাথেই ঘটবে।
ফরহাদ মজহার একটি জনযুদ্ধের স্বপ্ন দেখছেন আজীবন। সব কিছু দেখে শুনে মনে হয়- তাঁর কাছে আজ যুদ্ধটিই একটি প্রধান বিষয়। তিনি ভুলে গেছেন, যে বাম মতাদর্শকে আজ তিনি পচনশীল মনে করছেন এবং কাল্পনিক প্রতিপক্ষ দাঁড় করে ইসলামী বিপ্লবের স্বপ্ন দেখছেন সেটি তাঁর অসংখ্য চিন্তার বৈপরিত্যের নমুনামাত্র। একদিন তিনি জোর গলায় ঠিক এর উল্টোই প্রচার করেছেন। একথা সত্য যে, বাংলাদেশে মৌলবাদীদের মনোরঞ্জনে তিনি এখন অদ্বিতীয়; আর মৌলবাদের প্রথম শিকারটিও তিনিই হবেন।