সিরাজ সাহেব চা বাগানটার এসিস্ট্যান্ট জেনারেল ম্যানেজার। ষাটের কাছাকছি বয়স। চা বাগানের এজিএম শুনলে যেমন কঠোর কঠিন কিন্তু সুখে আপ্লুত একটা মানুষের মুখ ভেসে ওঠে, সিরাজ সাহেবকে দেখলে ঠিক বিপরীতই মনে হয়। শরীরের মেদ বলতে কিছু নেই বরং একটু বেশী পরিমানে ঝরে শুকনা চেহারা নিয়েছে। দু'পাশের গাল দেবে হনুর হাঁড় বের হয়ে এসেছে। এই শীতে শার্টের নীচে মোটা সোয়েটার পরাতে একটু যেন স্বাস্থ্যবানই লাগছে তাঁকে। আবার মাথাটাকে মাফলার দিয়ে পেঁচিয়ে শীতকে ঠেকানোর প্রানান্ত চেষ্টা।
চা বাগান, প্রকৃতি, পাখি, পানি, নিঃস্তব্ধতা, শ্রমিক-এসব নিয়েই চারপাশ। গল্পে গল্পে জানা গেল সিরাজ সাহেব তাঁর জীবনের পুরোটাই এই পেশাতেই কাটিয়েছেন। বাগানের সবকিছু মিলে তাঁর ভালই লাগে। এই পারিপার্শ্বিকতা তাঁর নিত্যদিনের সখা।
সিরাজ সাহেব মিসুক মানুষ। মানুষ পেলে গল্প করতে ভালবাসেন। বাগানটাতে সন্ধ্যা নামতেই হুস করে লাফ দিয়ে শীত নেমে আসে। বাংলোর বারান্দায় বসে শীতে কাঁপতে কাঁপতে সিরাজ সাহেবের সাথে কথা হয়। তিনিও তাঁর গল্পের ঝাপি খুলে ধরেন।
বলেন চা ব্যবসার ভিতরের কথা, বাগানের-গাছের পরিচর্যার কথা, শ্রমিকের কথা। এক ঘেয়েমি জীবনে ঢেউ তরঙ্গের অনুপস্থিতির কথা, শ্রমিকের নিত্যদিনের মদাভ্যাসের কথা। সিরাজ সাহেব চেষ্টা করেন শ্রমিকদের জীবনে কিছু আনন্দ যোগ করতে। নিজ উদ্যোগে তাই ১৬ ডিসেম্বর সবাইকে সাথে নিয়ে আয়োজন করে ফেলেন বাগানে মেলা, শ্রমিক শিশুদের জন্য খেলা, গান বাজনা, থাকে পুরুস্কারও! সারাদিন কাটে অন্য ঢঙে। হঠাৎ আনন্দের এই ঝলকানি বাগানে, সমস্ত শ্রমিক পাড়ায় চলে দিন সাতেক। সিরাজ সাহেবের এতেই আনন্দ। যদিও তিনি জানেন এই আনন্দের পিছনের কষ্টের অনেক ইতিহাস। শ্রমিকের অল্প আয়ূর ইতিহাস, তাদের প্রতিদিন সন্ধ্যার মদাভ্যাসের ইতিহাস, অনেক ছেলে পুলে হওয়ার ইতিহাস - সব জেনেই সিরাজ সাহেব ভালইবাসেন এই বাগান, শ্রমিকদের সহজ সরল জীবন দর্শন-সব মিলে এই পেশাকেই।
অনেক গল্পের মধ্যেই জানা গেল আদিবাসী মুন্ডাদের দর্শনের কথা। মুন্ডাদের দর্শন শোনার পর মনে হল আমার চেয়ে ওদের মানবিক বোধবুদ্ধি অনেক উন্নত। কত সরলভাবে জীবনকে দেখা যায় তা বোধ করি মুন্ডাদের কাছ থেকে শেখা যায়।
মুন্ডারা চা বাগানের আর সব আদিবাসীদের মতই আরো একটি সম্প্রদায়। অন্যান্য আদিবাসীদের মত ওরাও উড়িষ্যা অথবা কেরালা থেকে এসেছে, তারপর থেকে গেছে এখানে এদেশে। আসুন আপনাদের সেই মুন্ডাদের একটা গল্প শুনাই।
চা গাছ ৪০ ইন্চি লম্বা হয় অর্থাৎ আমাদের দেশের মেয়েদের কোমর বা তার চেয়ে কিছুটা উপর পর্যন্ত। সারা বছরই চা বাগানে পাতা তোলা চলে তবে বর্ষা থেকে শুরু হয় চা বাগানের পিক সিজন্। আর চা গাছ, বর্ষাকাল, জোঁক - এ যেন অনেকটা জাপানি হাইকু কবিতা। সরাসরি জড়িত। এইরকম বর্ষায় 'একটি কুঁড়ি ,দুটি পাতা' কুড়ানি মানুষেরা ঝাঁপিয়ে পড়ে চা পাতা তুলতে। সুতরাং কোমর পর্যন্ত চা গাছের মধ্যে শরীর ডুবিয়ে পাতা তোলার সময় সারা শরীর জুড়ে জোঁক জেঁকে বসে। কিন্তু পাতা তোলার সময় এরা খুঁজতেও যায় না জোঁককে। কেন খোঁজে না তার পিছনেও আছে শত বছরের কারন। খুঁজতে গেলেই দিন শেষের পাতা তোলার হিসাবে যে পিছিয়ে পড়ার ভয় আছে! তার উপর বোঝা মুশকিল কোনটা জোঁকের কামড় আর কোনটাই বা চা গাছের ডালের খোঁচা। সুতরাং না খোঁজাই সব বিবেচনায় ভাল।
দিন শেষে সবাই যখন পাতার হিসাবে বসে তখন অন্যান্য আদিবাসীরা যা করে তা আপনি আমিও করি। জোঁককে টান দিয়ে উঠিয়ে ফেলে দেয়, ব্যস ল্যাটা চুকে গেল। অল্প কিছু রক্ত, আর কিছুদিনের জন্য ঘা-পাচড়ার ঝামেলা এই তো।
কিন্তু মুন্ডারা তা করে না। বাগানের বাবু জোঁক দেখে বলেন 'ফেলে দে'! 'ফেলে দে'র উত্তরে মুন্ডারা যা বলে তা থেকেই ওদের মানবিক মূল্যবোধকে বোঝা যায়, শেখা যায়। মুন্ডারা অন্যদের চেয়ে শরীর স্বাস্থ্যে সুঠাম হয়। জোঁকগুলো ফেলে দেয় না, বলে, 'না রে বাবু, ওরা তো আর হামার বাড়ি আসেনি, হামি তো গিয়াছি উয়াদের বাড়ি। গিয়ে বিরক্ত করিচি। আর রক্তই তো উয়াদের খাদ্য। ভগবান আমার গায়ে উকে দিয়াছে, খাওয়ার জন্যি, খাওয়া শেষ হলে এমনিই চলে যাবে। ফেলে দিলে পাপ হবে বাবু।'
রক্ত খেয়ে টোবা টোবা হয়ে জোঁকগুলো টুপটাপ করে ঝরে ঝরে পড়ে যায়।
...........সিরাজ সাহেবের কাছে আরো জানা গেল মুন্ডাদের শরীরে জোঁকের কারনে ঘা পাচড়া হয় না।
কি জানি ভগবান ওদের দর্শনে আস্থা রাখেন হয়ত...
সর্বশেষ এডিট : ১০ ই এপ্রিল, ২০১৩ বিকাল ৩:০৪