১৭ এপ্রিল বাঙালি জাতির এক অবিস্মরণীয় দিন। ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন পলাশীর আম্রকাননে বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজ-উদ-দৌলার পরাজয়ের মাধ্যমে বাংলার স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত হয়েছিলো। এর ২১৪ বছর পর পলাশীর আম্রকাননের অদূরে ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলা আম্রকাননে বাংলাদেশের স্বাধীনতার নতুন সূর্য উদিত হয়।
৭-ই মার্চের ভাষণ
মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম প্রধান সংগঠক ও নবগঠিত বাংলাদেশ সরকারের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজ উদ্দীন আহমদ ১৯৭১ সালের ৩০ মার্চ চুয়াডাঙ্গা সীমান্ত দিয়ে ভারত গমনের সময় দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল রণাঙ্গণের নেতৃবৃন্দের সাথে আলাপ আলোচনার মাধ্যমে এ এলাকার নিরাপত্তা ও ভৌগলিক অবস্থা সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়ার পর ১৪ এপ্রিল শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানের তারিখ নির্ধারণ করেন। প্রথম দিকে চুয়াডাঙ্গায় শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠিত হওয়ায় কথা থাকলেও যুদ্ধ পরিস্থিতির নাটকীয় পরিবর্তনের ফলে নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে শপথ গ্রহণের স্থান চুয়াডাঙ্গার পরিবর্তে ইপিআর-উইং’র অধীন মেহেরপুর সীমান্ত এলাকা বৈদ্যনাথতলাকে নির্ধারণ করা হয়।
মন্ত্রীসভা
দিনের পর দিন মুক্তিযোদ্ধারা মরণপণ যুদ্ধের পরও স্বীকৃতি না পেয়ে যখন তাদের মনোবল ভাঙতে শুরু করে ঠিক এমনই এক সংকটময় মুহূর্তে ভারতীয় বিএসএফ’র ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা গোলক মজুমদার ও ৭৬ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লে. কর্নেল চক্রবর্তী বৈদ্যনাথতলায় এসে স্থানীয় সংগ্রাম কমিটি এবং তৎকালীন মহকুমা প্রশাসক তৌফিক-ই-এলাহীসহ আওয়ামী নেতৃবৃন্দের সাথে কথা বলে বৈদ্যনাথতলায় (বর্তমান মুজিবনগর স্মৃতিসৌধ) জায়গা দেখিয়ে মঞ্চ তৈরির প্রস্তুতি সম্পন্ন করতে বলেন। আপামর জনতা স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণের মাধ্যমে ১৬ এপ্রিল সকাল থেকে সারারাত ধরে মঞ্চ তৈরি, বাঁশের বাতা দিয়ে বেস্টনি নির্মাণ এবং স্থানীয়ভাবে ভাঙা চেয়ার-টেবিল দিয়েই আয়োজন সম্পন্ন করে। আনুষঙ্গিক সরঞ্জাম আসে ভারতের হৃদয়পুর বিএসএফ ক্যাম্প থেকে। অত্যন্ত গোপনীয়তার সাথে আয়োজন সম্পন্ন করা হয়।
১৭ এপ্রিল ১৯৭১’র সেই মাহিন্দ্রক্ষণে তাজ উদ্দীন আহমদ ও সৈয়দ নজরুল ইসলাম অন্য নেতৃবৃন্দকে সাথে নিয়ে সকাল ৯টার দিকে বৈদ্যনাথতলায় পৌঁছান। দেশি-বিদেশি শতাধিক সাংবাদিক এবং ভারতীয় নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরাও আসেন। তার মধ্যে ছিলেন ব্রিটিশ সাংবাদিক মার্ক টালি ও পিটার হেস। বহু প্রতীক্ষিত শপথগ্রহণ অনুষ্ঠান শুরু হয় বেলা ১১টায়।
মেজর আবু উসমান চৌধুরীর পৌঁছাতে বিলম্ব হওয়ায় ক্যাপ্টেন মাহবুব উদ্দীন আহমেদ ইপিআর আনছারের একটি ছোট্ট দল নিয়ে নেতৃবৃন্দকে অভিবাদন জানান। অভিবাদন গ্রহণের পর স্থানীয় শিল্পীদের জাতীয় সঙ্গীত পরিবেশনের মধ্য দিয়ে সৈয়দ নজরুল ইসলাম বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন। গৌরীনগরের বাকের আলীর কোরআন তেলাওয়াত এবং ভবরপাড়া গ্রামের পিন্টু বিশ্বাসের বাইবেল পাঠের মাধ্যমে শুরু হয় আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম। এরপর আওয়ামী লীগের চিফ হুইফ অধ্যাপক মো. ইউসুফ আলী বাংলার মুক্ত মাটিতে স্বাধীনতাকামী কয়েক হাজার জনতা এবং শতাধিক দেশি-বিদেশি সাংবাদিকের সামনে দাঁড়িয়ে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ করেন। ঐতিহাসিক সেই স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে প্রদত্ত ক্ষমতাবলে চিফ হুইফ অধ্যাপক ইউসুফ আলী রাষ্ট্রপ্রধান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অনুপস্থিতিতে উপরাষ্ট্র প্রধান হিসেবে সৈয়দ নজরুল ইসলামকে শপথবাক্য পাঠ করান।
এরপর গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তাজ উদ্দীন আহমেদের নাম ঘোষণা করেন এবং প্রধানমন্ত্রীর সাথে পরামর্শক্রমে মন্ত্রী পরিষদের সদস্য আইন, সংসদ ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে খন্দকার মোশতাক আহমদ, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে এএইচএম কামরুজ্জামান এবং অর্থমন্ত্রী হিসেবে ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলীকে পরিচয় করিয়ে দেন এবং শপথ পাঠ করান।
মন্ত্রিপরিষদের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান সেনাপতি হিসেবে কর্নেল এম এ জি ওসমানী এবং সেনাবাহিনীর চিফ অফ স্টাফ পদে কর্নেল আব্দুর রবের নাম ঘোষণা করা হয়। এরপর প্রধানমন্ত্রী তাজ উদ্দীন আহমেদ উপস্থিত সকলের সামনে ৩০ মিনিটের এক উদ্দীপনাময় ভাষণ দেন। তিনি বলেন, "আজ থেকে স্বাধীন বাংলাদেশের রাজধানী হবে এ বৈদ্যনাথতলা এবং এর নতুন নাম হবে মুজিবনগর।" তিনি বিশ্ববাসীর কাছে নতুন রাষ্ট্রের স্বীকৃতিদান ও সামরিক সাহায্যের আবেদন জানান। সেদিন থেকেই বৈদ্যনাথতলা মুজিবনগর নামে পরিচিত হয়।
শপথ গ্রহণ শেষে কয়েকজন দেশি-বিদেশি সাংবাদিকের উপস্থিতিতে ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম তার ঐতিহাসিক ভাষণে বলেন, ‘আজ এই আম্রকাননে একটি নতুন জাতি জন্ম নিল। আমরা আমাদের দেশের মাটি থেকে পাকিস্তানি হানাদারদের বিতাড়িত করবোই। এ লড়াইয়ে আমাদের জয় অনিবার্য। আমরা আজ না জিতি কাল জিতবোই। আমাদের রাষ্ট্রপতি জনগণনন্দিত ক্ষণজন্মা মহাপুরুষ নির্যাতিত মানুষের মূর্ত প্রতীক শেখ মুজিব বাংলার মানুষের অধিকারের জন্য সংগ্রাম করে আজ বন্দি। তার নেতৃত্বে আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রাম জয়ী হবেই হবে।’
বক্তৃতা এবং শপথগ্রহণ পর্ব শেষে নেতৃবৃন্দ মঞ্চ থেকে নেমে এলে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতিকে গার্ড অব অনার প্রদান করেন মেজর আবু উসমান চৌধুরী। উপস্থিত জনতার মূহুর্মূহু জয়বাংলা ধ্বনিতে মুখরিত হয়ে ওঠে মুজিবনগরের আম্রকানন। সব মিলিয়ে ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যে অনুষ্ঠান শেষ হয়।
স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম অস্থায়ী রাজধানীর ঐতিহাসিক গুরুত্বকে স্মরণীয় করে রাখতে এখানে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে মুজিবনগর মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতি কমপেস্নক্স। অস্থায়ী সরকারের শপথ গ্রহণের এই স্থানে নির্মাণ করা হয়েছে একটি স্মৃতিসৌধ। স্মৃতি কমপেস্নক্সের ভেতরে মানচিত্রের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন সেক্টরকে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। ঐতিহাসিক ছয় দফার রূপক হিসেবে তৈরি করা হয়েছে ছয় ধাপের গোলাপ বাগান। মুক্তিযুদ্ধকালীন বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাকে ভাস্কর্যের মাধ্যমে উপস্থাপন করা হয়েছে এখানে। কমপ্লেক্সের বাইরে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ, মুজিবনগর সরকারের শপথ গ্রহণ, পাক বাহিনীর আত্মসমর্পণসহ বিভিন্ন ঘটনার ভাস্কর্য স্থাপন করা হয়েছে।
স্থাপনাগুলোর কিছু অংশঃ
১৯৭১-এর অস্থায়ী সরকারের শপথ গ্রহণসহ মুক্তিযুদ্ধের নানান ঘটনাকে চিরস্মরণীয় করে রাখতে ১৯৮৭ সালের ১৭ এপ্রিল মুজিবনগরে উদ্বোধন করা হয় এ স্মৃতিসৌধের। স্মৃতিসৌধটির নকশা করেন স্থপতি তানভীর করিম। সৌধটির স্থাপত্যিক বৈশিষ্ট্য হলো ১৬০ ফুট ব্যাসের গোলাকার স্তম্ভের উপর মূল বেদীকে কেন্দ্র করে ২০ ইঞ্চি পুরু ২৩টি দেয়াল রয়েছে। যা উদীয়মান সূর্যের প্রতিকৃতি ধারণ করে। সৌধের ২৩টি স্তম্ভ ১৯৪৮ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত ২৩ বছরের সংগ্রমের প্রতীক। ৩০ লাখ শহীদের স্মৃতিকে স্মরণ করে রাখতে বসানো হয়েছে ৩০ লাখ পাথর।
*লেখা ও ছবি সংগৃহীত