আন্নার সাথে সুস্থ্য অবস্থায় কোনদিন দেখা হয়নি। ব্রেনস্ট্রোক করে যেদিন ডিএমসিতে ভর্তি হলেন সেইদিন থেকে আন্নার সাথে আমার পরিচয়। কথা বলা বা ইশারা দিয়ে কিছু বুঝানোর অবস্থা উনার ছিল না,মাঝে মধ্যে মনে হত গোঙ্গানির স্বরে আমার সাথে কথা বলছেন;কিন্তু,কিছুই পরিষ্কারভাবে বুঝতাম না!
হেমরেজিক স্ট্রোক উনাকে ভিতর থেকে অনেকটাই দুর্বল করে ফেলেছিল সম্ভবত,ডাক্তার প্রথম দিকে বলেছিলেন ৪৮ ঘন্টা পার হওয়া ছাড়া কিছু বলা যাবে না।কিন্তু সেই ৪৮ ঘন্টার শেষ কোনদিন হয়নি,ঠিক যেন একুশে হলের সাবেক প্রভোস্ট এম এ মালেকের আশ্বাস দেওয়া ৪৮ ঘন্টার মত!
স্যালাইন চলে,নাকের নল দিয়ে গুড়া করে দেওয়া ঔষুধ চলে,কিন্তু আন্নার আর চল হয় না! এইভাবে একদিন যায়,দুইদিন যায়,হাসপাতালের একঘেয়ে পরিবেশের মধ্যে ওয়ার্ডের নানা প্রান্ত থেকে হঠাৎ হঠাৎ আশা কান্নার আলোড়নেই শুধু চিন্তিত আমারও বুকে চিড় ধরত,এই যে স্বজনহারানোর কান্না,মৃত্যু কান্না!
আন্নার অবস্থা মনে হত প্রতি মুহূর্তে খারাপ হচ্ছে,ওয়ার্ডের ডাক্তার ভাইয়া-আপুদের অনেক বেশী বিরক্ত করেছি।অনেকে স্বাভাবিকতার বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছেন,আবার এমনও কাউকে পেয়েছি যিনি অসহায়ত্ব দেখে বারবার আন্নার খোঁজ নিতে এসে আমাদেরকেই বিরক্ত করে ফেলেছিলেন!
আন্নাকে টেস্ট করানোর জন্য প্রায় প্রতিদিনই হাসপাতালের নানা প্রান্তে ট্রলিতে করে নিয়ে যেতে হত,কখনোবা স্যাম্পল কালেক্ট করে দিয়ে আসতে হত।কিন্তু,রেজাল্টের অবনতি ছাড়া উন্নতি দেখিনি।কিন্তু যেটা লক্ষণীয় ছিল সেটা হল একজন নারী স্বত্বা 'মানুষ' হয়ে ভিতর থেকে বেঁচে থাকার লড়াই করছে!
ডাক্তারদের পরামর্শে প্রায় ৯-১০ দিন পর আন্নাকে আইসিউতে অ্যাডমিট করা হয়,যেখানে প্রতি মুহূর্তে শুধু হারানোর শঙ্কা!কাছ থেকে দেখেছি কতজন নির্বিঘ্নে চলে গেছে সমস্ত শব্দ আপনজনদের গাঁড়ে চাপিয়ে।
আইসিউতে আন্নার অবস্থা আরও খারাপ হয়ে যাচ্ছিল,টেস্টের জন্য স্যাম্পল কালেক্ট করার মত অবস্থা ছিল না।তাই,বারবার আইসিউর ভিতরে যেতে হত। নার্স বা স্টাফরা এইক্ষেত্রে কোন সহযোগিতা দূরে থাক,উল্টো সবসময় বিষয়টা নিয়ে ঝগড়ার মধ্যে থাকত।
শেষে একদিন রাতে এটা নিয়ে কোন এক স্টাফের সাথে ঝগড়া চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে গেলে আন্নার এক কাছের মানুষকে রাগের মাথায় 'উল্টা-পাল্টা' বলে 'হলে' চলে আসি। রাতে ১টার দিকে ফোন দিয়ে জানি আমার আন্নার জ্বর,কিন্তু নিজের দম্ভের কাছে পরাজিত হয়ে আন্নাকে আর দেখতে যাইনি সেই রাতে। কিন্তু,মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়ে রেখেছিলাম সকালে ঠিকই যাব।
অনেকটা স্বার্থপর হয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম।ঘুম থেকে উঠতে উঠতে সকাল ৭টা,মোবাইলে বন্ধুদের (হলের বন্ধুরা আন্নার অবস্থা সম্পর্কে অবগত ছিল) প্রায় ১১টা মিসড কল,৪ টা ম্যাসেজ। আশঙ্কায় বুক কেঁপে উঠল,দৌড়াতে দৌড়াতে কলব্যাক করলাম।আমাকে শুধু বলা হল,দ্রুত আইসিউতে যেতে।
৫-৭ মিনিটের মধ্যে যখন আমি আইসিউতে পৌঁছি তখন অনেক দেরী হয়ে গেছে,আমার আন্না-আমার মা তখন অনেক দূরে চলে গেছেন। জাগতিক পৃথিবীতে শেষ দেখা করার প্রয়োজনটাও বোধ করলেন না!
জানি আন্নার কাছের মানুষরা আমাকে কখনো ক্ষমা করতে পারবেন না। নিজেকেও নিজের ক্ষমা করা সম্ভব না,নিজের দম্ভের কাছে পরাজিত না হয়ে ধৈর্যের পরীক্ষা যদি আমি দিতে পারতাম তাহলে হয়তোবা আমার আন্না বেঁচে থাকতেন,হাসি-আদরে ভরে তুলতেন আমাদের!
মা আমার শুয়ে আছেন মিরপুরের জান্নাতুল মাওয়া কবরস্থানে তাওতো প্রায় ৩ বছর হতে চলল,কেমন আছেন মা জানি না!
ক্ষণস্থায়ী সম্পর্কটা কি অসহায়ত্ব দিয়ে ভরিয়ে দিয়ে গেছেন মা বলে বুঝাতে পারব না,শুধু বলব ভালো থাকবেন মা।।।
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই জুন, ২০১৫ রাত ১০:৫৫