গত ক'দিন ধরে ব্রিটিশ ইতিহাসবিদ নায়াল ফার্গুসনের 'দ্য এ্যাসেন্ট অফ মানি' বইটি পড়ছি। বিষয়বস্তু দেখে প্রথমে যে ব্যাপক আগ্রহী হয়েছি তা নয়, কিন্তু পড়তে গিয়ে দেখি ছাড়া যায় না।
নায়াল ফার্গুসনের লেখায় ডগমা আছে, পড়তে গেলেই পরিষ্কার হয়। তবে, কার্ল পপার যেমন বলেছিলেন, অতটুকু ডগমা না থাকলে মনে হয় না সিদ্ধান্তে পৌঁছানো সম্ভব। যারা এই সমালোচনা করতে চান ফার্গুসনের, তাদের জন্য এটা বলে রাখলাম।
তবে সবচেয়ে মজা যে অংশগুলো সেটা হল ইতিহাসের টিডবিটগুলি। যেমন ধরেন: ব্যাংক। আমি নিজে জানতাম না যে ভেনিসের ইহুদী কোয়ার্টারের বেঞ্চের পিছনে বসে থাকা বণিকদের থেকে, যাদের ইটালিয়ান ভাষায় বলা হতো 'ব্যাংকিয়েরি' (বেঞ্চ শব্দ থেকে ব্যাঞ্চিয়েরি এবং ব্যাংকিয়েরি; ইটালিয়ানে উচ্চারণ খুব সম্ভবত ব্যাংকি) - সেখান থেকে ইংরেজি ব্যাংক। ব্যাংকের মত একটা রাশভারি প্রতিষ্ঠানের জন্য বেশ হালকা, কমিকাল টাইপের এই নামটার ইতিহাস জানার আমার বেশ ইচ্ছা ছিল - ঠিক যেমন ট্যাংক-এর নাম! আমি নিশ্চিত মার্কিন কৌতুকলেখক বিল ব্রাইসন সুযোগ পেলে এ নিয়ে ব্যাপক হাসির কিছু একটা লেখে ফেলতে পারতেন (ব্রাইসনের শেক্সপিয়ার নিয়ে লেখা বইটি পড়ছি, পাতায় পাতায় হাসি - জানেন কি, শেক্সপিয়ার নাম ইংরেজটা নিজেই ষোড়শ শতকে হাজারো ভাবে লিখলেও আধুনিক বানানে *কখনো* লিখেনি - এবং তার বিয়ের লাইসেন্সে তার নাম লেখা 'শ্যাগসপেয়ার'। )
যাই হোক, ব্যাংকিয়েরির কাহিনী তো আমরা জানলাম। বইটিতে এটি ছাড়াও ইতিহাসের আলোকে স্টক মার্কেট, বন্ড মার্কেট, মোনেটারি মার্কেট এর ইতিহাস দেয়া আছে। একটা জিনিসের তাৎপর্য বুঝতে সেটার ইতিহাসের কোনই জুড়ি নেই - নায়াল ফার্গুসনের বইটি সেটাই প্রমান করে।
উদাহরণস্বরুপ - নতুন বিশ্ব আবিষ্কারের আগে, চতুর্দশ শতকের দিকে, ইউরোপে বিনিময়ের মাধ্যমে হিসেবে সাধারণত বিভিন্ন ধাতু ব্যবহার করা হতো। সমস্যা একটাই, মুসলিমরা। মুসলিম সভ্যতাগুলো তখন এতই এগিয়ে ছিল যে ধাতু আর ইউরোপে রাখা যেতো না, ভোরটেক্সের মত চলে যেত বাগদাদ, কায়রো, বসরা, কর্দোবা, জেরুজালেম, বুখারায়। আমরা যেমন এখন বসে বসে মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিগুলোকে গালি দেই - শালারা নিলো নিলো আমাদের টাকা নিলো, ঠিক তেমনি তখন ইউরোপিয়ানরা মুসলমানদের গালাগালি করতো। ফার্গুসন দেখিয়েছেন যে ক্রুসেডের *আংশিক' উদ্দেশ্য ছিল এই ধাতু ফেরৎ আনা। ইউরোপিয়ানদের মধ্যে একটা ডেসপারেশন ছিল - এই ডেসপারেশন থেকেই পরবর্তীতে 'এজ অফ ডিসকভারি'-র আবিষ্কারগুলো আসতে থাকে। ক্যারিবিয়ান, দক্ষিণ ও উত্তর আমেরিকা আবিষ্কারের পর ইউরোপের অবস্থা ব্যাপকভাবে ফিরে আসে। তবে সোনা-রূপা নিয়ে অতি বাড়াবাড়ির কারণে এক পর্যায়ে এ অবস্থা পড়ে যায়। (সোনা-রূপা সম্পর্কে যদি জানতেই চান - জানেন কি, আর্জেন্টিনা দেশটার নাম এসেছে রুপা থেকে। বুয়েনোস আইরেস - আর্জেন্টিনার রাজধানী, যেই নদীর তীরে অবস্থিত তার নাম রিও ডি লা প্লাটা - রূপার নদী!)
যা বলছিলাম, নতুন বিশ্ব (পশ্চিম গোলার্ধ) থেকে আসা রূপার দাপটে ইউরোপে প্রথমে অবস্থা ফিরে আসে, অত:পর ব্যাপক মূল্যস্ফীতি এবং ধাতব মুদ্রার পতন ঘটে। এ সময়টা ছিল আধুনিক 'ক্রেডিট' ব্যবস্থা গড়ে উঠার আদর্শ সময়।
এখানে সবার আগে মনে রাখা দরকার যে, সকল আব্রাহামিক ধর্মেই (ইসলাম, খ্রীষ্টধর্ম, ইহুদীধর্ম) সুদ নিয়ে নানারকম স্যাংশন আছে। তবে ধূর্ত অনুসারীরা তাদের ধর্মগ্রন্থের নানা লুপহোল সবসময়ই অনুসরন করেছে নিজের স্বার্থে। উদাহরণস্বরুপ ইহুদী ধর্মও সুদ নিয়ে বড়ই কট্টর - তবে ওখানে বলা আছে নিজের জাতির বাইরে সুদ দেয়া যেতে পারে। খ্রীষ্টধর্মে সুদের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা ইসলামের মতই করা। সুদ খাওয়াকে ইংরেজিতে বলে 'ইউজুরি' (উচ্চারণ নিশ্চিত নই)। কিন্তু মধ্যযুগের ইউরোপে নানা প্রক্রিয়ায় এই নিষেধাজ্ঞাকে পাশ কাটানোর চেষ্টা করা হতো - যেমন সামন্তবাদী পশ্চিম ইউরোপে ছেলে বা মেয়ের জন্য 'কন্ট্রাক্ট' কিনে নেয়া - এখানে একজন লোক ধরেন ১০,০০০ গিল্ডারের একটা কন্ট্রাক্ট কিনলো যাতে তার কন্যাসন্তান সারা জীবন ১০০ গিল্ডার করে মাসে পায়। তবে খোলাখুলি সুদ প্রদান সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ ছিল। এই সুযোগের সদ্ব্যবহার করে ইহুদীরা। তাদের ধর্মগ্রন্থে তো খ্রীষ্টানদের সুদ দিতে মানা নেই। চোখের সামনে খ্রীষ্টানরা দেখলো কিভাবে এই ঘেট্টোতে বসবাসকারী 'বাজে ইহুদী'-রা আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হচ্ছে। এ কারণে মাঝে মাঝেই (মাঝে মাঝে কম বলা হয়, নিয়মিত) ইউরোপে ইহুদী 'পগ্রম' চলতো - এইসব পগ্রমের পিছনে উদ্দেশ্য ধর্মীয় ছাড়াও ছিল অর্থনৈতিক। এখানে আরেকটা ইন্টারেস্টিং ব্যাপার হল এত প্রতিকূলতার মধ্যেও ইহুদীদের উত্থান। কৃষি, উৎপাদন ইত্যাদি ক্ষেত্রে ইউরোপীয় সমাজ ইহুদীদের অংশগ্রহণ করতে না দেয়ায় (এমনকি রাস্তাঘাটে ইহুদীদের চলাফেরাও নিষিদ্ধ ছিল) এরা বাধ্য হয়েই এ ধরনের 'নরম' পেশায় অংশগ্রহন করে এবং উন্নতি করে।
যাহোক, ক্রেডিট ব্যবস্থা গড়ে ওঠার আরেকটি কারণ ছিল যুদ্ধ। ইউরোপে, বিশেষ করে লম্বার্ড এলাকায় (উত্তর ইটালি) এসময় একদম যাকে বলে ননস্টপ যুদ্ধ চলছে। যুদ্ধের জন্য লাগে টাকা। টাকা কে কোথায় পাবে - মিলান মারে ভেনিসকে তো ভেনিস মারে ফ্লোরেন্সকে তো ফ্লোরেন্স মারে জেনোয়াকে তো জেনোয়া মারে পোপকে তো পোপ ডাকে বোলোনিয়ার হোলি রোমান এম্পেররকে। বাধ্য হয়েই ত্রয়োদশ এবং চতুর্দশ শতকে ইটালিয়ান নগররাজ্যগুলো নিজেদের নাগরিকদের থেকে টাকা ধার নেয়া শুরু করে; আর সেখান থেকেই গড়ে ওঠে আধুনিক ক্রেডিট এবং বন্ড ব্যবস্থা।