বিএনপি কেন্দ্রীয় কমিটির ঘোষণা যত বিলম্ব হচ্ছে জটিলতা ততই বাড়ছে। ১৯ মার্চ অনুষ্ঠিত কেন্দ্রীয় সম্মেলনে বেগম খালেদা জিয়া আবারও চেয়ারপারসন এবং তদীয়পুত্র তারেক রহমান সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। সম্মেলনের ১০ দিন পর মীর্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে মহাসচিব, রুহুল কবির রিজভীকে সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব এবং মিজানুর রহমান সিনহাকে দলের কোষাধ্যক্ষ ঘোষণা করা হয়। এরপর আরও দুই দফায় বিভিন্ন পদে কয়েকজনের নাম ঘোষণা করা হয়েছে। কেন্দ্রীয় কাউন্সিলের প্রায় দেড় মাসের মধ্যে তিন ধাপে এই ৪১ জন দলীয় কর্মকর্তার নাম ঘোষণা করা হলো। সম্মেলন শেষে কেন্দ্র থেকে মাঠপর্যায়ে নেতাকর্মীদের সংগঠিত করে ঘুরে দাঁড়ানোর পরিকল্পনা নিয়েছিল বিএনপি। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, কেন্দ্রীয় সম্মেলনের দেড় মাসের মাথায় দলটি সাংগঠনিকভাবে আরও অগোছালো অবস্থায় নিপতিত হয়েছে। দলীয় কর্মকর্তা নির্বাচনকে কেন্দ্র করে প্রথম সারির নেতাদের মধ্যে চলছে ঠা-া লড়াই এবং ঘোষিত কর্মকর্তাদের নাম নিয়ে অসন্তোষের কারণে দলটি উজ্জীবিত হওয়ার বদলে আরও ঝিমিয়ে পড়ছে বলেই অনেকের ধারণা। এরই মধ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পুত্র সজীব ওয়াজেদ জয়কে অপহরণের পর হত্যা চেষ্টার ষড়যন্ত্র মামলায় ২২ এপ্রিল গ্রেফতার হয়েছেন বিএনপি রাজনীতির সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত প্রবীণ সাংবাদিক শফিক রেহমান। বিএনপির আন্তর্জাতিক কার্যক্রমের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত আছেন এই খ্যাতিমান সাংবাদিক। শমশের মবিন চৌধুরী কয়েকমাস আগে দল ছেড়ে গেলে বিদেশের সঙ্গে বিএনপির যোগাযোগের মুখ্য কার্যক্রম দেখাশোনা করেছেন শফিক রেহমান। দুই দফায় ৫ দিন করে ১০ দিন রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাদের পর বর্তমানে কারাগারে রয়েছেন তিনি। একই মামলায় গ্রেফতারে থাকা বেগম জিয়ার আরেক উপদেষ্টা আমার দেশ পত্রিকার ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মাহমুদুর রহমানকে ৫ দিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। জয় অপহরণ ও হত্যা চেষ্টা মামলায় বিএনপির ৫ কেন্দ্রীয় নেতা ফেঁসে যাচ্ছেন বলে পত্রিকান্তরে খবর বের হয়েছে। একই সঙ্গে খালেদা জিয়ার বিচারাধীন একাধিক মামলার বিচার কাজ দ্রুতগতিতে চলায় দলের মধ্যে দুশ্চিন্তা আরও বাড়ছে।
বিভিন্ন সূত্রে প্রাপ্ত খবর অনুযায়ী বিএনপির উঁচু পর্যায়ের নেতাদের অবস্থান অক্ষুণ্ন রাখা এবং পছন্দের লোকদের অন্তর্ভুক্ত করা নিয়ে দলের মধ্যে প্রতিযোগিতার পাশাপাশি ঠা-া লড়াই চলছে। এই পর্যন্ত ঘোষিত কেন্দ্রীয় কমিটির ৪১ নেতার মনোনয়ন পর্যালোচনা করে জানা গেছে, সেখানে অধিকাংশই বেগম খালেদা জিয়ার বিশেষ সহকারী শিমুল বিশ্বাসের আশীর্বাদপুষ্ট। চেয়ারপাসনের গুলশান কার্যালয়ের কর্ণধার এই শিমুল বিশ্বাসই নাকি বর্তমানে বেগম জিয়ার সবচেয়ে কাছের লোক। নানা কারণে দলের শীর্ষনেতার অনেকের সঙ্গেই বেগম জিয়ার দিনকাল ভালো যাচ্ছে না। বেগম জিয়ার ২০১৪ সালের নির্বাচন বানচাল ও প্রতিরোধের ব্যর্থ আন্দোলন এবং ২০১৫ সালের প্রথম তিন মাসের সন্ত্রাসী অপতৎপরতায় শুধু জনগণ নয়, দলীয় নেতাকর্মীরাও রাজপথে নামেননি। পরপর বেগম জিয়া আহূত দু-দুটি পেট্রলবোমা আন্দোলন চরমভাবে ফ্লপ করে। ঐ ২টি আন্দোলনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যসহ কয়েকশত লোক নিহত হয়। পৃথিবীর গণতান্ত্রিক রাজনীতির ইতিহাসে এভাবে আন্দোলনের নামে পেট্রলবোমা ছুড়ে শত শত জীবিত মানুষের হত্যার কোনো দ্বিতীয় নজির নেই। বাস-ট্রাকে পেট্রলবোমা ছুড়ে জীবন্ত মানুষকে হত্যার মাধ্যমে বিএনপি নেত্রী ক্ষমতা দখলের ষড়যন্ত্র করেছিলেন।
আশ্চর্য লাগে, তিনি এখনও জনগণকে নছিয়ত করছেন। বেগম জিয়ার বিরুদ্ধে দলে এখনও কেউ প্রকাশ্যে কথা না বললেও তার অবস্থান আগের মতো সুদৃঢ় নয়। সম্মেলন হওয়ার দেড় মাসের মধ্যেও ম্যাডাম দলের কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির পূর্ণ তালিকা প্রকাশ করতে পারেননি। উল্লেখ্য, ২০০৯ সালের ডিসেম্বরে বিএনপি জাতীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হওয়ার ২২ দিনের মাথায় একযোগে পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষণা করা হয়েছিল।
ভুলে গেলে চলবে না, অন্য ১০টি রাজনৈতিক দলের যেভাবে জন্ম হয়, বিএনপির জন্ম সেভাবে হয়নি। দেশ ও জাতির প্রয়োজনে দেশপ্রেমিক রাজনীতিবিদরা মিলিত হয়ে বিএনপি গঠন করেননি। ১৯৭৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর জিয়াউর রহমান যখন এই দল গঠন করেন তখন তিনি দেশের রাষ্ট্রপতি, সেনাবাহিনী প্রধান, সশস্ত্র বাহিনীগুলোর প্রধান এবং প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সুবিধাবাদীদের ভাগিয়ে এনে তিনি বিএনপি প্রতিষ্ঠা করেন। স্বাধীনতাযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী উপমহাদেশের অন্যতম প্রাচীন দল আওয়ামী লীগকে নিশ্চিহ্ন করাই ছিল বিএনপির প্রথম ও প্রধান লক্ষ্য। বিএনপি গঠনের ৪ মাস পর ১৯৭৯ সালের ফেব্রুয়ারির নির্বাচনে ৩০০ আসনের পার্লামেন্টে দুই শতাধিক আসন দখল করে সরকারি দল। প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত করা হয় একজন চিহ্নিত স্বাধীনতাবিরোধী শাহ আজিজুর রহমানকে। আসলে বঙ্গবন্ধু হত্যা, জিয়ার ক্ষমতা দখল, স্বাধীনতাবিরোধী জামায়াত-শিবিরের পুনঃপ্রতিষ্ঠা, বিএনপি গঠনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগকে ধ্বংস করা একই সূত্রে গাঁথা।
সুপরিকল্পিত ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে একাত্তরের স্বাধীনতাবিরোধী আন্তর্জাতিক চক্র তাদের এদেশীয় এজেন্ট জিয়া, মোশতাক, ফারুক, রশিদ, ডালিম, নূর গংয়ের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে পরিবারের সদস্যসহ হত্যা করে। বঙ্গবন্ধুর বুকে গুলি চালাবার সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশ বেতার ও জয় বাংলা যথাক্রমে রেডিও বাংলাদেশ ও জিন্দাবাদ হয়ে যায়। গত চার দশকে সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয়েছে, আমাদের মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সেক্টর কমান্ডার বীরউত্তম খেতাবপ্রাপ্ত জিয়াউর রহমান মুক্তিযুদ্ধে একজন অনুপ্রবেশকারী। জিয়া নামে মুক্তিযোদ্ধা হলেও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও আদর্শ বিশ্বাস করেন না। আর এ জন্যই তিনি শুধু জাতির জনক হত্যা ষড়যন্ত্রে জড়িত নন, পিতা হত্যার বিচার পর্যন্ত তিনি বন্ধ রাখেন। জিয়া তার ৬ বছরের শাসনামলে স্বাধীন বাংলাদেশকে পরাজিত পাকিস্তানের আদলে 'মিনি পাকিস্তানে' পরিণত করেন। মুক্তিযুদ্ধের মহানায়ক থেকে শুরু করে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সমূলে ধ্বংস করেন ওই মুক্তিযোদ্ধা জিয়া। বর্তমানে স্বাধীনতাবিরোধী শক্তির প্রধান আশ্রয়দাতা, প্রশ্রয়দাতা ও মদতদাতা হচ্ছে বিএনপি ও বেগম খালেদা জিয়া। এবারের সম্মেলনেও জামায়াত-শিবিরের সংস্রব ত্যাগ করার কোনো ঘোষণা বেগম জিয়া দিতে পারেননি এবং কোনদিন পারবেনও না। অথচ দেশের জনগণ বিশেষ করে নতুন প্রজন্ম এবং বিএনপির মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের নেতাকর্মীরা এক মুহূর্তেও জামায়াত-শিবিরের সঙ্গে জোটের রাজনীতি করতে চাচ্ছে না। কিন্তু বেগম জিয়া বা তারেক রহমানকে বিএনপির রাজনীতি করতে হলে স্বাধীনতাবিরোধীদের সঙ্গে নিয়েই করতে হবে।
এবারের সম্মেলনে বেগম জিয়া রূপকল্প ভিশন-২০৩০ ঘোষণা দিয়ে অনেক ভালো ভালো কথা বলেছেন। রূপকল্প বাস্তবায়ন করতে হলে সংসদের দুই-তৃতীয়াংশ আসনে জিতে বিএনপিকে ক্ষমতায় আসতে হবে। অথচ বেগম জিয়ার ভুল রাজনীতি এবং দুই ব্যর্থ আন্দোলনে ক্ষতবিক্ষত বিএনপিকে সাংগঠনিকভাবে শক্তিশালী করে রাজনৈতিক কর্মসূচির মাধ্যমে ক্ষমতায় যাওয়ার কোনো দিক-নির্দেশনা ম্যাডাম সম্মেলনে উপস্থাপন করতে পারেননি। রূপকল্পে বেগম জিয়া বলেছেন, রাষ্ট্র পরিকল্পনায় প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতায় ভারসাম্য আনা হবে অর্থাৎ প্রধানমন্ত্রীর নিরঙ্কুশ ক্ষমতার অবসান ঘটানো হবে। কিন্তু আমরা দেখলাম, খালেদা জিয়া আবারও নিজেকে দলের চেয়ারপারসন নিযুক্ত করলেন। পুত্রকে দলের দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ নেতার পদে সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান নিযুক্ত করেন।
ক্ষমতায় গেলে প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা কমাবেন অঙ্গীকার করলেও দলীয় প্রধানের ক্ষমতার ব্যাপারে ম্যাডাম কিছু বলেননি। এবারও কেন্দ্রীয় কমিটি গঠনের সর্বময় ক্ষমতা নিজের হাতেই রেখে দেন ম্যাডাম। দেড় মাসে ৩ দফায় ৪১ জন কর্মকর্তার নাম ঘোষণা করলেও স্থায়ী কমিটিসহ বাকি কমিটি কবে ঘোষণা করবেন তা ম্যাডাম ও তার বিশেষ সহকারী শিমুল বিশ্বাসই কেবল বলতে পারেন। এই শিমুল বিশ্বাস কোনো রাজনীতিবিদ নন। দলে তার কোন পদ-পদবী ছিল না। তিনি ম্যাডামের গুলশান কার্যালয়ের একজন কর্মকর্তা। তিনি নাকি চেয়ারপারসনের বিশেষ সহকারী। পত্রিকান্তরে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী এই বিশেষ সহকারীই পর্দার অন্তরালে থেকে বিএনপি নামের দলটি পরিচালনা করছেন।
বিএনপি নামের দেশের অন্যতম বৃহত্তম রাজনৈতিক দলটি বর্তমানে প্রতিষ্ঠার ৩৮ বছরের মধ্যে সবচেয়ে কঠিন সময় অতিক্রম করছে। খালেদা জিয়ার ভুল রাজনীতি এবং দু-দুটি বড় ধরনের ব্যর্থ আন্দোলনের খেসারত দিতে হচ্ছে বিএনপিকে। কেন্দ্র থেকে উপজেলা পর্যন্ত হাজার হাজার নেতাকর্মীর নামে রয়েছে মামলার পাহাড়। পেট্রলবোমা আন্দোলনের মাধ্যমে শত মানুষ হত্যা এবং রাষ্ট্রের হাজার হাজার কোটি টাকার সম্পদ বিনষ্টের কারণেই এসব মামলা দেয়া হয়েছে। কেন্দ্রীয় সম্মেলন শেষে তৃণমূল থেকে কেন্দ্র পর্যন্ত নেতাকর্মীদের সংগঠিত করে বিএনপি ঘুরে দাঁড়াবে বলে অনেকে আশা করেছিল। কারণ দেশের গণতন্ত্রের স্বার্থে একটি দায়িত্বশীল বিরোধী দলের প্রয়োজন রয়েছে। বিরোধী দল না থাকলে সরকারি দল দৈত্যে পরিণত হয়। কেন্দ্রীয় কমিটি গঠনে বেগম জিয়া ভারসাম্য রক্ষা করতে না পারলে বিএনপি শুধু দুর্বল হয়ে পড়বে না, আরেক দফা ভাঙনের সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেয়া যায় না। কমিটি গঠনকে কেন্দ্র করে ইতোমধ্যেই দলে টানাপোড়েন শুরু হয়েছে। একে অপরকে ঘায়েল করতে তৎপর রয়েছেন। এরই মধ্যে খবর বের হয়েছে দলের কেন্দ্রীয় সহ-দপ্তর সম্পাদক তাইফুল ইসলামের ব্যক্তিগত ব্যাংক হিসেবে গত এক বছরে ৪ কোটি ৩৮ লাখ টাকার লেনদেন হয়েছে। এই অর্থ পৌরসভা ও ইউপি নির্বাচনে মনোনয়ন বাণিজ্য থেকে এসেছে বলে প্রচার করা হচ্ছে।
শফিক রেহমানের গ্রেফতার, মাহমুদুর রহমানকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ এবং খালেদা জিয়ার মামলার বিচার দ্রুতগতিতে সম্পন্ন করার আলামত বিএনপির হাইকমান্ডকে দুশ্চিন্তায় ফেলছে। এদিকে মা-ছেলের মধ্যে বিরোধ দেখা দিয়েছে বলে জানা গেছে। তারেক রহমান নাকি দলের কো-চেয়ারম্যান হতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সাত-পাঁচ বিবেচনা করে বেগম জিয়া এই ব্যাপারে তড়িঘড়ি কিছু করেননি। দলের নেতাকর্মীদের কাছে গ্রহণযোগ্য একটি কেন্দ্রীয় কমিটি অবিলম্বে দলের চেয়ারপারসনকে গঠন করতে হবে। এই অবস্থায় সর্বমহলে গ্রহণযোগ্য কেন্দ্রীয় কমিটি গঠনের মাধ্যমে খালেদা জিয়া বিএনপিকে সাংগঠনিক ও রাজনৈতিকভাবে কীভাবে চাঙ্গা করে তোলেন তা দেখার জন্য আমাদেরকে আরও কিছুকাল অপেক্ষা করতে হবে।
সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা মে, ২০১৬ সকাল ১১:০৪