somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

টিপাইমুখ :: ইতিহাস :: বিপর্যয় :: ফলাফলা :: কর্তব্য ::

২৯ শে নভেম্বর, ২০১১ বিকাল ৩:২৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

ভারতের পক্ষ থেকে বারবার আশ্বস্ত করা হয়েছে, টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণের ব্যাপারে তারা বাংলাদেশ সরকারকে জানাবে। কিন্তু সেই প্রতিশ্রুতি রাখেনি ভারত। বাংলাদেশকে এক প্রকার অন্ধকারে রেখেই বরাক নদের ওপর টিপাইমুখ বাঁধ এবং জলবিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে একতরফাভাবে একটি যৌথ বিনিয়োগ চুক্তি সই হয়েছে। গত ২২ অক্টোবর দিলি্লতে চুক্তিটি সই হয়। ভারতের পক্ষ থেকে দাবি করা হচ্ছে, বাংলাদেশের ক্ষতি হয় এমন কোনো কাজ ভারত করবে না। তবে বাংলাদেশের পানি ও পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ ধরনের বাঁধ নির্মাণের ফলে ভাটির দেশ হিসেবে বাংলাদেশে ভয়াবহ প্রাকৃতিক বিপর্যয় ঘটবে। এ দেশের কৃষি থেকে শুরু করে পরিবেশের মারাত্মক বিপর্যয় ঘটবে।

টিপাইমুখ বাঁধের ইতিহাস
আসামের কাছাড় অঞ্চলের মৌসুমি বন্যা প্রতিরোধের নামে মণিপুরের ২৭৫.৫০ বর্গকিলোমিটার এলাকায় টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণের পরিকল্পনা হাতে নেয় ভারত সরকার। ভারতের পরিবেশবিজ্ঞানীরা মনে করেন, এই বাঁধের কারণে খোদ আসামের ১৬টি গ্রাম পুরোপুরি ডুবে যাবে, আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হবে ৫১টি গ্রাম। ফলে ৪০ হাজারেরও বেশি মানুষের জীবন-জীবিকা এবং সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য ধ্বংস হবে। তাই টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণের ব্যাপারে আসামের জনগণ তীব্র আন্দোলন গড়ে তোলে। এ কারণে মণিপুরের বরাক নদের ওপর বাঁধ নির্মাণের স্থান ক্রমেই পরিবর্তিত হতে থাকে। ১৯৫৫ সালে ময়নাধর, ১৯৬৪ সালে নারায়ণধর, এরপর ভূবন্দর এবং সবশেষে আশির দশকে টুইভাই ও বরাক নদের সংগমস্থলের ৫০০ মিটার ভাটিতে টিপাইমুখে বাঁধ নির্মাণের পরিকল্পনা করা হয়। প্রথমে বাঁধটি ব্রহ্মপুত্র ফ্লাড কন্ট্রোল বোর্ডের (বিএফসিবি) আওতায় থাকলেও ১৯৮৫ সালে সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের পর ১৯৯৯ সালে এটিকে নর্থ ইস্টার্ন ইলেকট্রিক পাওয়ার করপোরেশনের (নেপকো) হাতে দিয়ে দেওয়া হয়। তখন থেকে বাঁধটির নাম 'টিপাইমুখ হাই ড্যাম' থেকে পরিবর্তিত হয়ে 'টিপাইমুখ পাওয়ার প্রজেক্ট' হয়।
টিপাইমুখ নামের গ্রামে বরাক এবং টুইভাই নদের মিলনস্থলের এক হাজার ৬০০ ফুট দূরে বরাক নদে ৫০০ ফুট উঁচু এবং এক হাজার ৬০০ ফুট দীর্ঘ বাঁধ নির্মাণ করে এক হাজার ৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্যে ভারত সরকার কাজ শুরু করেছে।
বরাক নদ ভারতের মণিপুর রাজ্যের কাছাড় পর্বতে উৎপন্ন হয়ে মণিপুর-আসাম-মিজোরামের ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। বাংলাদেশে প্রবেশের আগে ভারতের অমলসিদ নামক স্থানে নদটি সুরমা ও কুশিয়ারা_এ দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে সিলেট জেলার জকিগঞ্জ দিয়ে প্রবেশ করেছে। সুরমা ও কুশিয়ারা হবিগঞ্জের মারকুলির কাছে পুনরায় মিলিত হয়ে কালনী নামে প্রবাহিত হয়েছে। কিশোরগঞ্জের বাজিতপুরে কালনী ঘোড়াউত্রা নদীর সঙ্গে মিলিত হয়ে মেঘনা নাম ধারণ করে বঙ্গোপসাগরে গিয়ে মিশেছে। বরাক নদের ভারতে প্রবাহিত অংশের দৈর্ঘ্য ৪৯৯ কিলোমিটার। আর বাংলাদেশে এর দৈর্ঘ্য ৪০৩ কিলোমিটার। সুরমা ও কুশিয়ারা পাঁচটি প্লাবনভূমি অতিক্রম করেছে, যার অববাহিকায় বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ কৃষিভিত্তিক জনবসতি গড়ে উঠেছে।
আন্তর্জাতিক এবং বাংলাদেশের বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভারতের টিপাইমুখ বাঁধ বাংলাদেশের এই নদী অববাহিকার জনপদে সর্বনাশ ডেকে আনবে। বাংলাদেশ হাওর উন্নয়ন বোর্ড এবং নদী গবেষণা কেন্দ্রের সাবেক পরিচালক প্রকৌশলী ম. ইনামুল হক কালের কণ্ঠকে বলেন, 'বর্ষা শুরুর আগে নদীতে যে তলানি প্রবাহ থাকে, টিপাইমুখ বাঁধ তা আসতে দেবে না। এ ছাড়া বর্ষার শুরুতেও বৃষ্টির পানি আটকে রাখবে। ফলে বর্ষার শুরুতে সুরমা ও কুশিয়ারায় প্রায় এক মাস দেরিতে পানি আসবে। ফলে নদী দুটি শুকিয়ে থাকবে। তবে পুরো বর্ষায় ঠিকই নদী পূর্ণ থাকবে। এরপর বর্ষা শেষ হলে জলাধারে ধরে রাখা পানি আস্তে আস্তে ছাড়বে। আগে যেখানে নভেম্বরের দিকে নদীর পানি শুকিয়ে যেত, এখন তা জানুয়ারিতে হবে। ফলে হাওরাঞ্চলের একফসলি জমিগুলোতে ধান চাষ করা যাবে না। মৌসুমে এক হাজার কোটি টাকার বোরো ধানের আবাদ হবে না।' তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, 'ফেব্রুয়ারির দিকে জলাধারের পানি কমে গেলে আবার নদীর তলানি প্রবাহ আটকে দেবে। ফলে শুকনো মৌসুমে নদী দুটি বর্তমানের চেয়ে অনেক বেশি শুকিয়ে যাবে। এ প্রক্রিয়া চক্রাকারে চলতেই থাকবে। ফলে ওই দুটি নদী অববাহিকার জনজীবন, মৎস্যসম্পদ, কৃষি_সবকিছুই বিপর্যয়ে পড়বে।'
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যদিও বিদ্যুৎ উৎপাদনকে মুখ্য উদ্দেশ্যে পরিণত করার লক্ষ্যে বাঁধের ডিজাইনে কোনো পরিবর্তনই করা হয়নি, ফলে আগে বাঁধের যে উচ্চতা (১৬৮.২ মিটার) এবং লোড ফ্যাক্ট (২৬.৭৫%) আছে, এখনো তা-ই আছে। এর মানে হলো, বছরের কোনো এক সময়ের সর্বোচ্চ বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতার, অর্থাৎ ১৫০০ মেগাওয়াট ক্ষমতার মাত্র ২৬.৭ শতাংশ অর্থাৎ ৪০১.২৫ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সারা বছর পাওয়া যাবে। এই পরিমাণ বিদ্যুৎ থেকে মণিপুরবাসীর জন্য ৪৮ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ বিনা মূল্যে দেওয়া হবে। তবে মাত্র ৪৮ মেগাওয়াট বিদ্যুতের বিনিময়ে মণিপুরের মানুষ টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণ করতে রাজি হয়নি।
টিপাইমুখ বাঁধ শুধু জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য নির্মাণ করা হচ্ছে না। ভারতীয় গণমাধ্যম সূত্রে জানা গেছে, বিদ্যুৎ উৎপাদনের পাশাপাশি এই প্রকল্প থেকে পানি প্রত্যাহার করবে ভারত। টিপাইমুখ বাঁধের মূল পরিকল্পনায় বাঁধের ৯৫ কিলোমিটার ভাটিতে একটি ব্যারাজ নির্মাণের প্রস্তাব রয়েছে। সেই ব্যারাজ থেকে পানি প্রত্যাহার করে এক লাখ ২০ হাজার হেক্টর কৃষিজমিতে সেচ সুবিধা দেওয়া হবে। অথচ এ বিষয়ে কোনো তথ্যই ভারত বাংলাদেশকে দেয়নি। এ ছাড়া আসামের কাছাড় অঞ্চলের মৌসুমি বন্যা প্রতিরোধের নামে মণিপুরের ২৭৫.৫০ বর্গকিলোমিটার এলাকায় টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণের পরিকল্পনা হাতে নেয় ভারত সরকার।

কী ক্ষতি হবে বাংলাদেশের?
ইনস্টিটিউট অব ওয়াটার মডেলিং ২০০৫ সালে একটি গবেষণায় উজানে বাঁধ নির্মাণে বাংলাদেশে কী পরিমাণ ক্ষতি হবে, তার বিস্তারিত হিসাব প্রকাশ করে। এর মধ্যে রয়েছে_প্লাবনভূমির প্লাবনের ধরন ও পরিমাণ এবং ঋতু বদলে যাবে। সুরমা ও কুশিয়ারার প্রাকৃতিক পানি প্রবাহ শুষ্ক করায় সিলেট, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, সুনামগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, কিশোরগঞ্জ এবং নেত্রকোনায় ধান উৎপাদন ব্যাহত হবে। শুধু সিলেট ও মৌলভীবাজারেই যথাক্রমে ৩০ হাজার ১২৩ হেক্টর এবং ৫২০ হেক্টর প্লাবনভূমি কমে যাবে। বর্ষায় জলমগ্ন হবে না সুরমা ও কুশিয়ারা নদীর উজানের ৭১ শতাংশ এলাকা। কুশিয়ারা নদীর প্রায় ৬৫ কিলোমিটার এলাকা নদীটির ডান পাশের প্লাবনভূমি থেকে বিচ্ছিন্ন হবে। কুশিয়ারার বাম তীরের বরদাল হাওর শুকনো মৌসুমে পুরোপুরি শুকিয়ে যাবে। কাউয়ার দিঘির হাওর দুই হাজার ৯৭৯ হেক্টর জলাভূমি হারাবে। ফলে সুরমা-কুশিয়ারা-মেঘনা অববাহিকার বিস্তীর্ণ অঞ্চলজুড়ে জলবায়ু, বাস্তুসংস্থান এবং জীবন-জীবিকার ব্যাপক ক্ষতিসাধন হবে।
ইনস্টিটিউট অব ওয়াটার মডেলিং-২০০৫-এর ওই গবেষণায় পানির পরিমাণ বাড়া-কমার হিসাব থেকে দেখা যায়, টিপাইমুখ বাঁধ পুরোদমে কাজ শুরু করলে বরাক নদ থেকে অমলসিদ পয়েন্টে সুরমা-কুশিয়ারা-মেঘনা নদীর দিকে পানিপ্রবাহ জুন মাসে ১০, জুলাইয়ে ২৩, আগস্টে ১৬ এবং সেপ্টেম্বরে ১৫ শতাংশ কমে যাবে। জুলাই মাসের দিকে অমলসিদ স্টেশনে কুশিয়ারা নদীর পানির উচ্চতা কমবে গড়ে ১ মিটারেরও বেশি। এ ছাড়া ফেঞ্চুগঞ্জ, শেরপুর ও মারকুলি স্টেশনের দিকে কমবে যথাক্রমে ২৫ এবং ৭৫ সেন্টিমিটার করে। একই সময়ে সুরমা নদীর পানির উচ্চতা সিলেট ও কানাইঘাট স্টেশনে ২৫ এবং ৭৫ সেন্টিমিটার করে কমে যাবে। আর শুকনো মৌসুমে বরাক-সুরমা-কুশিয়ারা থেকে আগস্ট মাসে ১৮ এবং সেপ্টেম্বরে ১৭.৫ শতাংশ পানি প্রত্যাহার করবে ভারত।

ভূমিকম্প উসকে দেবে বাঁধ
উঁচু বাঁধ নিয়ে যেসব গবেষণা হয়েছে তা থেকে জানা গেছে, এ ধরনের বাঁধ ভূমিকম্পের ক্ষয়ক্ষতি বহুগুণ বাড়িয়ে দেয়। লন্ডনের জেড বুকস থেকে ১৯৯৬ সালে প্রকাশিত প্যাটট্রিক ম্যাককুলির 'সাইলেন্স রিভার্স : দ্য ইকোলজি অ্যান্ড পলিটিঙ্ অব লার্জ ড্যামস' গ্রন্থ থেকে জানা গেছে, বাঁধের জলাধারে যে বিপুল পরিমাণ পানি জমা করা হয়, বাঁধের ভিত্তিভূমি এবং এর আশপাশের শিলাস্তরের ওপর এই পানি ব্যাপক চাপ সৃষ্টি করে। অল্প জায়গায় পানির বিপুল পরিমাণ চাপ পড়ায় ওই অঞ্চলের শিলাস্তরের ফাটলকে দ্রুত সক্রিয় করে তুলতে পারে। এই প্রক্রিয়ায় মাটির নিচের সচ্ছিদ্র শিলাস্তরের ফাঁকে ফাঁকে জমে থাকা পানির যে স্বাভাবিক চাপ থাকে, তা বাঁধের পানির ভারে এবং শিলাস্তরের চুইয়ে যাওয়া বাড়তি পানির প্রভাবে স্বাভাবিকের চেয়ে বেড়ে যায়। এ ছাড়া বাড়তি পানির রাসায়নিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার কারণেও ফাটলের দুই দিকের শিলাস্তর, যা এমনিতেই টেকটোনিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার কারণে পরস্পর থেকে দূরে সরে যেতে চায়, কিন্তু পরস্পরের মধ্যকার ঘর্ষণের শক্তির কারণে একত্রই থাকে, তা আর বাড়তি চাপ সহ্য করতে না পেরে চ্যুতি সৃষ্টি করে। ফলে ভূমিকম্পের হাইপোসেন্টার সৃষ্টি হয়ে সেখান থেকে ভূকম্পন চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। এভাবে ভূমিকম্প বেড়ে যাওয়ার বিষয়টি প্রথম নজরে আসে ১৯৩২ সালে, আলজেরিয়ার কুঢে ফড্ডা বাঁধের ক্ষেত্রে। বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে এ ধরনের বাঁধের কারণে ভূমিকম্প বেড়ে যাওয়ার নজির পাওয়া গেছে কমপক্ষে ৭০টি। আর এ যাবৎকালে বিশ্বের সবচেয়ে তীব্র মাত্রার জলধর প্রভাবিত ভূমিকম্প হয়েছে খোদ ভারতের মহারাষ্ট্রের কয়লা বাঁধের কারণে। ১৯৬৭ সালের ১১ ডিসেম্বর ঘটা ৬.৩ মাত্রার এই ভূমিকম্পটি এমনকি তার কেন্দ্র থেকে ২৩০ কিলোমিটার দূরেও তীব্র আঘাত হেনেছিল।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভারতের যে জায়গায় টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণ হচ্ছে, তা বিশ্বের ছয়টি ভয়ংকর ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকার একটি। উত্তর-পূর্ব ভারত ছাড়া ক্যালিফোর্নিয়া, মেঙ্েিকা, তুরস্ক, তাইওয়ান ও জাপান ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকা। টিপাইমুখ বাঁধের ১০০ থেকে ১২০ কিলোমিটার ব্যাসার্ধের মধ্যে গত ১০০ বছরের মধ্যে ৭-এর অধিক মাত্রার ভূমিকম্প হয়েছে দুটি। এর একটি হয়েছে ১৯৫৭ সালে, টিপাইমুখ থেকে মাত্র ৭৫ কিলোমিটার দূরে। এলাকাটি ভূমিকম্পপ্রবণ অঞ্চল হওয়ার কারণ হলো, এটি সুরমা-গ্রুপ শিলাস্তর দ্বারা গঠিত। আর এ শিলাস্তরের বৈশিষ্ট্যই হলো অসংখ্য ফাটল ও চ্যুতি। বিজ্ঞানীরা বলছেন, পুরো বরাক অববাহিকায় রয়েছে অসংখ্য ফাটল আর চ্যুতি, যা আবার ওই এলাকার নদীগুলোর গতিপ্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করে। প্রস্তাবিত টিপাইমুখ বাঁধের অক্ষটি (অীরং) অবস্থিত হলো বহুল পরিচিত তাইথু (ঞধরঃযঁ) ফল্টের ওপর, যা সম্ভাব্য ক্রিয়াশীল একটি ফল্ট। ভূবিজ্ঞানীরা মনে করেন, ভবিষ্যতের যেকোনো ভূমিকম্পের এপিসেন্টার হয়ে উঠতে পারে এই অক্ষটি। তা ছাড়া ভারত ও মিয়ানমার টেকনোটিক প্লেটের সংঘর্ষের কারণে এলাকাটি পৃথিবীর অন্যতম ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকা হিসেবে এরই মধ্যে চিহ্নিত হয়ে গেছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এ ধরনের একটি এলাকায় ১৬৮.২ মিটার উচ্চতার একটি জলধর নির্মাণ করা মানে (জলাধারের উচ্চতা ১০০ মিটারের বেশি হলে রিভার ইনডিউচ্ড সাইসমিসিটির সম্ভাবনা বেশি থাকে) বাংলাদেশ ও ভারতের পুরো এলাকার জন্য আগ বাড়িয়ে অতিমাত্রায় ভয়াবহ ভূমিকম্প ডেকে আনার শামিল।

বাঁধ ভাঙলে কী হবে বাংলাদেশের
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, একটি ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকায় বাঁধের জলধর ভূমিকম্পকে উসকে দেয়। যদি ভূমিকম্পে বাঁধ ভেঙে যায়, তাহলে তা ভাটির দেশ বাংলাদেশের জন্য ভয়াবহ সর্বনাশ বয়ে আনবে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। কারণ, বাঁধ থেকে মাত্র ২০০ কিলোমিটার দূরে বাংলাদেশের সীমান্ত শুরু। বাঁধ ভেঙে হঠাৎ বন্যা হলে বাংলাদেশের কী ধরনের ক্ষতি হতে পারে, সে ব্যাপারে স্পষ্ট কোনো তথ্য বাংলাদেশের হাতে নেই। বন্যা প্রতিরোধ পরিকল্পনা বা ফ্লাড অ্যাকশন প্ল্যান-৬ (ঋঅচ-৬)-এর আওতায় ১৯৯২-৯৪ সালে একটি গবেষণা চালানো হয়। ওই গবেষণা থেকে বন্যাবিষয়ক ক্ষয়ক্ষতির একটি হিসাব পাওয়া যায়। যদি বাঁধ ভেঙে বন্যা হয়, তাহলে ওই গবেষণা তথ্য অনুসারে, বন্যার পানি ১০ কিলোমিটার গতিবেগের হিসাবে বাঁধ থেকে ৮০ কিলোমিটার থেকে দূরের পার্বত্য উপত্যকা, ১৪০ কিলোমিটার দূরের শিলচর এবং ২০০ কিলোমিটার দূরের অমলসিদ পেঁৗছতে স্রোতের বেগ কমে এলেও ২৪ ঘণ্টারও কম সময়ে বাঁধের পানি কমপক্ষে ৫ মিটার উচ্চতা নিয়ে হাজির হবে। আর ২৪ থেকে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে পানি তার সর্বোচ্চ উচ্চতা ২৫ মিটারে পেঁৗছবে, যা প্লাবনভূমির উচ্চতার চেয়ে ৮ মিটার বেশি উঁচু। ফলে বাংলাদেশের পাঁচটি প্লাবনভূমিকে ৮ মিটার পানির নিচে তলিয়ে রাখবে ১০ দিন কিংবা তার চেয়েও বেশি।

আন্তর্জাতিক আইনকে ভারতের বৃদ্ধাঙ্গুলি

আন্তর্জাতিক আইন বরাবরই একটি পুরনো কথা। বিশেষ করে প্রভাবশালী রাষ্ট্রগুলো আন্তর্জাতিক আইনকে দুর্বল রাষ্ট্রের ওপর একটি অব্যর্থ অস্ত্র হিসেবে প্রয়োগ করে। আর নিজেদের বেলায় তা অহরহ লঙ্ঘন করে। যেমন_ইরাক, আফগানিস্তান এবং সম্প্রতি লিবিয়ার ওপর পশ্চিমাদের যে আক্রমণ ও দখলদারিত্ব, তা কোনোভাবেই আন্তর্জাতিক আইন দ্বারা স্বীকৃত হতে পারে না। কিন্তু অবলীলায় তারা ওই সব দেশের তেলসম্পদ দখল করার জন্য আক্রমণ চালিয়েছে এবং সরকার পরিবর্তন করে নিজেদের পছন্দের পুতুল সরকার বসিয়েছে। ভারতের ক্ষেত্রেও তা-ই। ভারত বাংলাদেশের সঙ্গে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত আইনগুলোকে পাত্তা দেয় না। তাই বিশেষজ্ঞরা বলছেন, টিপাইমুখে ভারতের একক সিদ্ধান্তে বাঁধ নির্মাণ আন্তর্জাতিক নদী আইনের লঙ্ঘন। যৌথ নদী ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত হেলসিংকি (১৯৬৬) নীতিমালার ৪ ও ৫ নম্বর অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, 'প্রতিটি অববাহিকাভুক্ত দেশ অভিন্ন নদী ব্যবহারের ক্ষেত্রে অন্য দেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক প্রয়োজন বিবেচনা করবে। এ জন্য অবশ্যই যেন অন্য দেশের কোনো ক্ষতি না হয়, সেদিকে দৃষ্টি রাখতে হবে।'
একই আইনের ২৯(২) নম্বর অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, 'একটি রাষ্ট্র নদী অববাহিকার যেখানেই অবস্থান করুক না কেন, তার যেকোনো প্রস্তাবিত অবকাঠামো নির্মাণ এবং ইনস্টলেশনের ব্যাপারে নদী অববাহিকায় অবস্থিত অন্য যেকোনো রাষ্ট্র, এই কাজের ফলে অববাহিকায় ঘটা পরিবর্তনের কারণে যার স্বার্থহানি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে, তাকে এ ব্যাপারে নোটিশ দিতে হবে। নোটিশ গ্রহীতা দেশ যেন প্রস্তাবিত পরিবর্তনের সম্ভাব্য ফলাফলের বিচার-বিশ্লেষণ করতে পারে, সে জন্য প্রয়োজনীয় তথ্যাবলি থাকতে হবে।'
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভারত আন্তর্জাতিক আইনও অনুসরণ করেনি।
টিপাইমুখসহ ভারত বাংলাদেশের অভিন্ন নদীতে কোনো প্রকল্প গ্রহণের ক্ষেত্রে ১৯৯৬ সালের গঙ্গা চুক্তিটিই হচ্ছে দুই দেশের জন্য সবচেয়ে প্রাসঙ্গিক আন্তর্জাতিক আইন। এই চুক্তিতে শুধু গঙ্গা নদীর পানি ভাগাভাগির কথা বলা হয়নি, অভিন্ন অন্যান্য নদীর কথাও বলা হয়েছে। এই চুক্তি অনুসারে ভারত বাংলাদেশের অভিন্ন নদীগুলোতে কোনো ধরনের তৎপরতা যদি কোনো দেশ করে থাকে, তাহলে উভয় দেশ স্বচ্ছ তথ্য বিনিময় করবে। কিন্তু ভারত টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণের ক্ষেত্রে তা করেনি। বাঁধ নির্মাণের ব্যাপারে ভারত বাংলাদেশ সরকারকে কোনো তথ্য দেয়নি। প্রথম থেকেই ভারত বাঁধ নির্মাণের ব্যাপারে গোপনীয়তা বজায় রেখেছে। ২০০৩ সালের ৯ জানুয়ারি টিপাইমুখ বাঁধের ব্যাপারে কেন্দ্রীয় সরকার এবং মণিপুর রাজ্য সরকারের মধ্যে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হওয়ার পর আসামে এই বাঁধের ব্যাপারে তীব্র আন্দোলন গড়ে ওঠার কারণে ভারত বাঁধ নির্মাণের পরিকল্পনা ধীরগতিতে এগিয়ে নেয়। আসামের বিভিন্ন গণমাধ্যমের সংবাদ সূত্রে জানা গেছে, ২০০৮ সালের ২৮ জুলাই রাজ্য সরকার আইন পাস করে টিপাইমুখ বাঁধের নির্মাণকাজের প্রয়োজনে নির্মাণসামগ্রী আনা-নেওয়ার কাজে ব্যবহৃত মনবাহাদুর রোডের ৯৯ কিলোমিটার দূরত্বের সাত কিলোমিটার অন্তর সামরিক ফাঁড়ি স্থাপন করে।
গত ২৮ এপ্রিল ভারতের রাজধানী নয়াদিলি্লতে টিপাইমুখ জলবিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়নে একটি জয়েন্ট ভেঞ্চার কম্পানি স্থাপনের জন্য ভারতের ন্যাশনাল হাইড্রো-ইলেকট্রিক পাওয়ার কম্পানি (এনএইচপিসি), সাটলুজ জলবিদ্যুৎ নিগম লিমিটেড (এসজেভিএন) এবং মণিপুর সরকারের মধ্যে একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়। সর্বশেষ গত ২২ অক্টোবর চুক্তিটি সই হয় দিলি্লতে। এ ধরনের চুক্তি করার আগে বাংলাদেশকে জানানোর প্রতিশ্রুতি দেওয়া হলেও ভারত কথা রাখেনি। যৌথ বিনিয়োগ প্রকল্পে জাতীয় জলবিদ্যুৎ নিগমের (এনএইচপিসি) ৬৯, রাষ্ট্রায়ত্ত জলবিদ্যুৎ সংস্থার (এসজেভিএন) ২৬ এবং মণিপুর রাজ্য সরকারের ৫ শতাংশ মালিকানা থাকবে।
২০১০ ও ২০১১ সালে ভারত এবং বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠক শেষে যৌথ ঘোষণায় ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং অঙ্গীকার করেছিলেন, 'টিপাইমুখে এমন কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হবে না, যাতে বাংলাদেশের ক্ষতি হয়।'

পরিবেশ কি পুঁজি বিনিয়োগের ক্ষেত্র?
পুঁজিবাদী বিশ্ব এবং তার একচেটিয়া মুনাফাখোর বহুজাতিক কম্পানিগুলো মরিয়া হয়ে উঠেছে বাজার নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে মুনাফা অটুট রাখার জন্য। যেকোনো সময়ের চেয়ে বর্তমানে পুঁজিবাদী উৎপাদন সংকট আরো ঘনীভূত হয়েছে, ভেঙে পড়েছে মুক্তবাজার অর্থনীতি। পুঁজিবাদের ভয়াল রূপ আরো নৃশংস হচ্ছে, বেরিয়ে পড়ছে তার খাদক চেহারা। দুনিয়াব্যাপী যুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাজার-কাঁচামাল এবং পুনরুৎপাদন প্রক্রিয়া সচল রাখার চেষ্টা হচ্ছে। এবার তার নজর পড়েছে হিমালয়ের ওপর। হিমালয়কে ঘিরে বিশ্বব্যাংক, এডিবি এবং জাপানসহ বেশ কিছু করপোরেট ব্যাংক ধ্বংসের মহাযজ্ঞ শুরু করেছে। টিপাইমুখ তারই একটি।
পুঁজিবাদী শিল্পোন্নত দেশগুলোর চলছে অর্থনৈতিক মন্দা। মন্দা কাটানোর জন্য তারা ইরাক, আফগানিস্তান এবং সর্বশেষ লিবিয়া দখল করেছে, ইরানে হামলার পাঁয়তারা করছে। আর বাংলাদেশের মতো দেশগুলোতে_যেখানে জনগণ এবং রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে সেসব দেশের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে কার্যকর প্রতিরোধ নেই, সেখানে_তারা পুঁজি বিনিয়োগের মাধ্যমে দখল করে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, জাপান এবং ইউরোপের হয়ে সেই পুঁজি বিনিয়োগ করে বিশ্বব্যাংক আইএমএফসহ সাম্রাজ্যবাদী সংস্থাগুলো। এসব প্রতিষ্ঠান এমন সব ক্ষেত্রে পুঁজি বিনিয়োগ করে, যা আগে কখনোই ব্যবসার খাত মনে করার কারণ ছিল না। সেই পুঁজি এমন সব জায়গায় বিনিয়োগ করা হচ্ছে, যার ফলে খোদ মহাদেশই উল্টেপাল্টে যেতে পারে। বাংলাদেশের মতো দেশগুলোতে জনমনে একটা ধারণা আছে_বিদেশি বিনিয়োগ মানেই ভালো। কার আমলে কত বেশি বিদেশি বিনিয়োগ এসেছে, তা আবার নির্বাচনী ইশতেহারে বয়ান করা হয়। ফলে বিদেশি ওই সব সাম্রাজ্যবাদী প্রতিষ্ঠান যখন পুঁজি বিনিয়োগ করে, সেই পুঁজির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ না গড়ে তুলে বরং তাকে উন্নয়নের সাফল্য হিসেবেই দেখানো হয়। তেমনই একটি বিনিয়োগ হলো হিমালয়জুড়ে বাঁধ নির্মাণ।
বাংলাদেশের সঙ্গে ৫৪টি আন্তনদীর মধ্যে ৪৭টি নদীতে বাঁধ দিয়েছে ভারত। কেবল উত্তর-পূর্ব ভারতেই নির্মিত হচ্ছে ১৬০টি বাঁধ ও ব্যারাজ। ১৯৪৭-পরবর্তী সময় থেকে ভারত ৮০ হাজার কোটি রুপি খরচ করে ৩৬০০ বাঁধ নির্মাণ করেছে। বেশির ভাগ বাঁধ বন্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য করা হলেও বন্যার প্রকোপ বেড়েছে, খরার প্রকোপ বেড়েছে, বাঁধ ও ব্যারাজ নির্মাণের ফলে উদ্বাস্তু হয়েছে প্রায় সাড়ে আট কোটি মানুষ, যা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের উদ্বাস্তুর সংখ্যার চেয়ে বেশি। ডড়ৎষফ ঈড়সসরংংরড়হ ড়ভ উধস (ডঈউ) ১২৫টি বৃহৎ বাঁধের ওপর সমীক্ষা চালিয়ে এসব বাঁধ প্রকল্পকে মানুষ, পরিবেশ-প্রতিবেশ এবং উৎপাদনের জন্য অলাভজনক বলেছে। শুধু এই চিত্র? এর বাইরেও রয়েছে সত্য।
হিমালয় অঞ্চলে বাঁধ নির্মাণের মধ্য দিয়ে ভারতের একতরফা পানি প্রত্যাহারের কথা শোনা যাচ্ছে ৯০ দশকের শেষ দিক থেকে। বিষয়টি আরো বেশি করে তখনই আলোচনায় এসেছে, যখন খোদ ভারতের বিশেষজ্ঞ ও সংগঠন এসব বাঁধের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে লেখালেখি করেছে। ২০০৩ সালের এপ্রিলে ইকোলজিস্ট এশিয়া ইস্যুতে একটি বিশেষ সংখ্যাও হয়েছিল বিষয়টি নিয়ে। প্রকাশিত হয়েছে বিভিন্ন নিবন্ধ। সমাবেশ-সেমিনারও হয়েছে উল্লেখযোগ্য সংখ্যায়। কিন্তু ইন্টারন্যাশনাল রিভার্সের সমীক্ষায় যে চিত্র বেরিয়ে এসেছে, তা আশঙ্কার চেয়ে অনেক বেশি ভয়াবহ।
তথ্য মতে, হিমালয় অঞ্চলে চীনসহ দক্ষিণ এশিয়ার চারটি দেশই সব মিলিয়ে ৫৫৩টি জলবিদ্যুৎ প্রকল্প গ্রহণ করেছে। এর মধ্যে পাকিস্তানের ছয়টির নির্মাণকাজ এরই মধ্যে শেষ হয়েছে। নির্মাণাধীন রয়েছে সাতটি। পরিকল্পনাধীন রয়েছে আরো ৩৫টি। ভারতে ৭৪টি বাঁধ নির্মাণের কাজ ইতিমধ্যে শেষ হয়েছে। নির্মাণাধীন রয়েছে ৩৭টি। আরো ৩১৮টি বাঁধ পরিকল্পনাধীন রয়েছে। নেপালে ১৫টির কাজ শেষ হয়েছে। নির্মাণাধীন দুইটি এবং পরিকল্পনাধীন রয়েছে ৩৭টি। ভুটানের নির্মাণকাজ শেষ হয়েছে পাঁচটির। আরো ১৬টি পরিকল্পনাধীন রয়েছে। হিমালয় অঞ্চলের মধ্যে আফগানিস্তানের বর্তমান সরকার তালেবান ও আল-কায়েদা সামলানোর বদলে জলবিদ্যুৎ নিয়ে মাথা ঘামাবে_এমন সম্ভাবনাও নেই। প্রসঙ্গত, ভুটানের প্রায় সব প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে ভারতের সহায়তায়।
যেকোনো কৃত্রিম বাঁধ বা ড্যাম সেখানকার শত-সহস্র বছর ধরে চলে আসা জৈব প্রাকৃতিক ব্যবস্থাকে বাধাগ্রস্ত করে এবং শেষ পর্যন্ত ধ্বংস করে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও লাতিন আমেরিকার বাঁধগুলো সেদেশের জৈব প্রাকৃতিক পরিবেশ ধ্বংস করে দিয়েছে। মানুষ শুধু খাদ্য গ্রহণের মাধ্যমে বেঁচে থাকে না, প্রাকৃতিক এবং পরিবেশের হাজার রকমের বিচিত্র দান এবং অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে মানুষ ও প্রকৃতির টিকে থাকার শর্তগুলো জিইয়ে রাখে। ড্যাম এবং বাঁধ ওই জৈব প্রাকৃতিক ব্যবস্থার শর্তগুলো নষ্ট করে দেয়। হিমালয়জুড়ে বাঁধ হলো সম্ভাব্য সেই ক্ষতি ডেকে আনার নামান্তর।

এখানেও বিশ্বব্যাংক-এডিবি
বিশ্বব্যাংক, এডিবি এবং জাপানসহ বেশ কয়েকটি করপোরেট ব্যাংকের অর্থে সমাপ্ত হবে ভয়ংকর একতরফা পানি প্রত্যাহার। প্রাথমিকভাবে এই মহাপরিকল্পনার পেছনে ব্যয় ধরা হয়েছে ৫ দশমিক ৬ লাখ কোটি রুপি।
নদীতে বাঁধ দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনের তত্ত্ব দেশে দেশে ফেরি করে বিশ্বব্যাংক এবং এডিবির মতো কিছু আন্তর্জাতিক অর্থকরী সংস্থা। সংশ্লিষ্ট দেশের যা-ই হোক, এতে তাদের যে বহুমুখী লাভ হয়, সেই প্রসঙ্গ দীর্ঘ। ভারতীয় উপমহাদেশেও চলি্লশ থেকে সত্তর দশকে বিরাট বিরাট বাঁধ নির্মাণের ক্ষেত্রে এসব সংস্থা সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছে। হিমালয়জুড়ে এখন যে বাঁধযজ্ঞ চলছে, তাতে এ দুটি সংস্থার সঙ্গে যোগ দিয়েছে কিছু দেশীয় এবং বহুজাতিক কম্পানি। হিমালয় অঞ্চলের আলোচ্য চারটি দেশে কোনো একক পক্ষ বাঁধ নির্মাণের অর্থ জোগাচ্ছে না। সরকার স্বভাবতই বিপুল ব্যয় একা বহন করছে না। চারটি দেশে জলবিদ্যুৎ প্রকল্পে অর্থায়নের ক্ষেত্রে অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি এবং প্রভাবশালী ভূমিকা পালন করছে বেসরকারি খাত।
ভুটানের ক্ষেত্রে বাঁধ নির্মাণের নানা পর্যায়ে কাজ করছে বিশ্বব্যাংক এবং এডিবির মতো কয়েকটি আন্তর্জাতিক অর্থকরী প্রতিষ্ঠান, ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার, টাটা-রিলায়েন্স-জিএমআর-ল্যাংকো-জয় প্রকাশ-গ্রিন ইনফ্রাস্ট্রাকচার ডেভেলপমেন্টের মতো ভারতীয় কম্পানি এবং নরওয়ে ও দক্ষিণ কোরিয়ার কয়েকটি কম্পানি, নেপাল এবং এগুলোর পাশাপাশি চীনও উপস্থিত। পাকিস্তানে সক্রিয় বিশ্বব্যাংক, এডিবি, আইডিবি, চীন সরকার, জাপানভিত্তিক ওভারসিজ ইকোনমিক কো-অপারেশন ফান্ড, ইউরোপিয়ান ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক এবং দেশীয় কয়েকটি কম্পানি। ভারতে খোদ সরকার ছাড়াও রাষ্ট্রায়ত্ত ও বেসরকারি কম্পানি, দেশীয় ব্যাংক এবং অর্থকরী প্রতিষ্ঠান বাঁধ নির্মাণে মূল ভূমিকা পালন করছে। অন্য তিনটি দেশের সঙ্গে ভারতের পার্থক্য হলো, আন্তর্জাতিক অর্থকরী প্রতিষ্ঠানগুলোকে কাজ করতে হচ্ছে দেশীয় কোনো পক্ষের সঙ্গে যুক্ত হয়ে।

লড়াই হবে বহুমাত্রিক
ভারতে টিপাইমুখ বাঁধের বিরুদ্ধে তীব্র আন্দোলন হচ্ছে। এই বাঁধের মূল বিষয় সামরিক। বাঁধ থেকে উৎপাদিত বিদ্যুৎ সেখানকার সামরিক আগ্রাসনকে আরো বেশি গতি দেবে। আসামে চলছে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন। সেই সঙ্গে আসামবাসী এই বাঁধের বিরুদ্ধে তীব্র গণ-আন্দোলনও জারি রেখেছে। প্রয়োজন সীমান্তের গণ্ডি পেরিয়ে দুই দেশের জনগণের সংগ্রামে মিলন ঘটানো। একই সঙ্গে আওয়াজ তোলা দরকার_অভিন্ন নদীর অভিন্ন বণ্টন চাই। দেশের সীমানা যেমন কাঁটাতার-পাসপোর্ট দিয়ে পার্থক্য করা যায়, নদীকে তেমনভাবে বিভাজ্য করা যায় না। যদি উভয় দেশের মানুষ এই আওয়াজ তোলে, তাহলে ক্ষমতায় যাঁরা থাকেন, তাঁদের অবশ্যই নড়েচড়ে বসতে হবে।
সবার আগে দরকার মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর মানসিকতা। যদি ধরেই নেওয়া যায়, ভারত বড় রাষ্ট্র; বাংলাদেশের উজানে বাঁধ দিলে বাংলাদেশের কিছু করার নেই। এটা হেরে যাওয়া মানসিকতা, নতজানু চিন্তা। বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে সম্ভাবনাময় রাষ্ট্র। প্রায় একই ধরনের সাংস্কৃতিক ঐক্য এখানে বিরাজমান। বিপরীতে ভারতের অভ্যন্তরে রয়েছে পাঁচ শতাধিক জাতি-ভাষা-ধর্মীয় জনগোষ্ঠীর মানুষ, যা দেশটির অখণ্ডতা রক্ষার প্রধান অন্তরায়। বিশেষ করে বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে বাংলাদেশ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দরকষাকষির জায়গায় রয়েছে।
ভারত নৌ ট্রানজিট কোনো মাসুল ছাড়াই শুরু করেছে। স্থল ট্রানজিটের ক্ষেত্রে কী হবে, তা এখনো জানা যাচ্ছে না। একের পর এক উলফা গেরিলাদের ভারতের হাতে তুলে দিচ্ছে বাংলাদেশ। তাহলে ভারত কেন এ ধরনের আচরণ করবে? বাংলাদেশ থেকে সব কিছু নিয়ে বিনিময়ে কিছুই দেবে না, এটা হতে পারে না। বাংলাদেশকে বুক টান করে দাঁড়াতে হবে। দেশের স্বার্থ রক্ষার্থে ভূ-কৌশলগত অবস্থানের বিষয়টি ভারতকে মনে করিয়ে দিতে হবে। ভারত তার নড়বড়ে অবস্থানের বিষয়টি অন্যদের তুলনায় খুব ভালো করেই জানে।

সূত্র: সবারতো সব পত্রিকা পড়া হয়ে ওঠেনা, তাই সরাসরি পত্রিকা থেকে পোষ্ট করা হল ।

টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণের প্রতিবাদে বিশাল বিক্ষোভ মানব বন্ধন
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

এনসিপি জামায়াতের শাখা, এই ভুল ধারণা ত্যাগ করতে হবে

লিখেছেন সত্যপথিক শাইয়্যান, ০৩ রা মে, ২০২৫ সকাল ১০:৪৪

প্রিয় রাজীব ভাই,
আপনি আমার আগের পোস্টে কমেন্ট করেছেন যে, এনসিপি জামায়াতের শাখা। আপনার এনালাইসিস ভুল! ওরা জামায়াতের শাখা নয়। এনসিপি-কে বুঝতে হলে, আপনাকে জামায়াতকে জানতে হবে। আমি একটু বিস্তারিত... ...বাকিটুকু পড়ুন

পাশ্চাত্যের তথাকথিত নারীবাদ বনাম ইসলাম: বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে একটি সংক্ষিপ্ত বিশ্লেষণ

লিখেছেন নতুন নকিব, ০৩ রা মে, ২০২৫ বিকাল ৪:২৪

পাশ্চাত্যের তথাকথিত নারীবাদ বনাম ইসলাম: বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে একটি সংক্ষিপ্ত বিশ্লেষণ

ছবি কৃতজ্ঞতা এআই।

ভূমিকা

নারীর অধিকার নিয়ে আলোচনা ইতিহাসের এক দীর্ঘ অধ্যায়। পাশ্চাত্যে নারী আন্দোলন শুরু হয় ১৮শ শতকের শেষভাগে, যার ফলশ্রুতিতে... ...বাকিটুকু পড়ুন

কি হবে আগামীর পাকিস্তানের

লিখেছেন ঊণকৌটী, ০৩ রা মে, ২০২৫ বিকাল ৪:৫৩

কি হচ্ছে পাকিস্তানে... ...বাকিটুকু পড়ুন

একটি স্মার্ট জাতির অন্তঃসারশূন্য আত্মজৈবনিক !

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ০৩ রা মে, ২০২৫ সন্ধ্যা ৭:৩৪


একটা সময় ছিল, যখন জাতির ভবিষ্যৎ বলতে বোঝানো হতো এমন এক শ্রেণিকে, যারা বই পড়ে, প্রশ্ন তোলে, বিতর্কে অংশ নেয়, আর চিন্তা করে। এখন জাতির ভবিষ্যৎ মানে—ইনফ্লুয়েন্সার। তারা সকাল ১০টায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইসলামী দলগুলো নারী বিদ্বেষী - এটা একটি মিথ্যা প্রোপাগান্ডা

লিখেছেন সত্যপথিক শাইয়্যান, ০৩ রা মে, ২০২৫ রাত ১১:২৯

আরবের দেশগুলোকে আমাদের দেশের নারী আন্দোলনের নেত্রীরা দেখতে পারেন না হিজাব ইস্যুর কারণে। অথচ, আরব দেশ কাতার বি,এন,পি'র চেয়ারপারসনকে চার্টারড প্ল্যানে করে দেশে পাঠাচ্ছে। আরো কিছু উদাহরণ দেই। আওয়ামী লীগ... ...বাকিটুকু পড়ুন

×