আনিসুল হক | তারিখ: ২৪-০৩-২০১১
ক্রিকেট নাকি মহান অনিশ্চয়তার খেলা! কই, কোনো অনিশ্চয়তা ঘটতে তো দেখলাম না। রেটিংয়ে এগিয়ে থাকা সাতটা দলই গেল কোয়ার্টার ফাইনালে। অষ্টম স্থান নিয়ে প্রতিযোগিতা ছিল বাংলাদেশ আর ওয়েস্ট ইন্ডিজের। শুশুকের ভেসে ওঠার মতো মুহূর্তের জন্য বাংলাদেশ অষ্টম হয়েই আবার নবম হয়ে গেছে, আর সমান পয়েন্ট নিয়ে রান গড়ে এগিয়ে থাকা ক্যারিবীয়রা উঠে গেছে শেষ আটে। শেষ আটে উঠলেও ওরা যে বাংলাদেশেরই সমান প্রায়, পাকিস্তানের সঙ্গে কালকের ব্যাটিংয়ে সেটা তারা ঠিকই দেখিয়ে দিয়েছে। তাহলে অনিশ্চয়তাটা আর রইল কোথায়? ওরা পাকিস্তানের কাছে হেরেছে ১০ উইকেটে, আমরা অবশ্য ১০ উইকেটে হারিনি ৫৮ করার পরও।
বাংলাদেশ বিশ্বকাপকে তার আত্মা ফিরিয়ে দিয়েছে। এ হলো জনতার বিশ্বকাপ। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের পর ক্রিকইনফো লিখেছিল, কালকে মিরপুর স্টেডিয়ামে জনতা যেভাবে উল্লাস করল, তাতে আন্তর্জাতিক ক্রীড়া ভাষ্যকারদের ইতিপূর্বে তোলা এই প্রশ্ন আবার নতুন করে সামনে আসবে, এই খেলাপাগল দেশটায় মাত্র আটটা খেলা কেন? ৫৮-বিপর্যয়ের পর সেই যে ঢিল-কেলেঙ্কারি, কালকের পর হয়তো সেই অপবাদও ঘুচে গেছে। বাংলাদেশের দর্শকেরাই চ্যাম্পিয়ন।
তবু মন-খারাপ ভাবটা যায় না। গতকাল তো পাকিস্তানের বিপক্ষে বাংলাদেশও খেলতে পারত! তাহলে কি সমস্ত গ্যালারি ‘বাংলাদেশ’ ‘বাংলাদেশ’ বলে চিৎকার করে উঠত না? বোমা-বিধ্বস্ত দেশ পাকিস্তান, আর ম্যাচ-ফিক্সিং কেলেঙ্কারি ও অন্তর্দ্বন্দ্বে বিধ্বস্ত পাকিস্তান ক্রিকেট দলের জন্য জয়টাই হয়তো একমাত্র ধন্বন্তরী। দেয়ালে পিঠ ঠেকা পাকিস্তানের মতো ভয়ংকর দল আর নেই, ক্রীড়া প্রতিবেদকদের এ কথা দেখছি ফলেই প্রমাণিত হচ্ছে। আজকে ভারত আর অস্ট্রেলিয়ার ম্যাচ। ১০০ কোটি মানুষের দেশ ভারত ক্রিকেট-বাণিজ্যের বড় পুঁজি, আজই তাদের বিশ্বকাপ শেষ হয়ে যাক, এটা বাণিজ্যলক্ষ্মী চাইবেন না। তবে দুই বড় দলের যেকোনো একটাকে তো আজ বেরিয়ে যেতেই হবে। গতকালের খেলাটা মন দিয়ে দেখিনি, আজকেরটা দেখব। পাকিস্তানের খেলা পড়বে আজকের ম্যাচের বিজয়ীর সঙ্গে। ভারত-পাকিস্তান ফাইনাল হচ্ছে না। আমি ক্রিকেট বুঝি না, কাজেই উৎপল শুভ্রর বিশ্লেষণে ভরসা রাখি, আমার বাজির ঘোড়া দক্ষিণ আফ্রিকা। কিন্তু যেখানে লাল-সবুজ নেই, সেখানে ‘কার চুল এলোমেলো কিবা তাতে এল গেল’। আমার নজর ঘুরেফিরে বাংলাদেশের দিকে। বাংলাদেশ ‘এ’ দলের অধিনায়ক হয়ে আশরাফুল দক্ষিণ আফ্রিকায় যাচ্ছেন। আমার প্রত্যাশা, এটাকে যেন আশরাফুল একটা সুযোগ হিসেবে দেখেন। অনেক রান নিয়ে ফিরে আসেন দেশে। তারকাদের জীবন রোলার কোস্টারে চড়ার মতো। এই ওপরে তো এই নিচে। সেই দিনই কথা হচ্ছিল সাবেক অধিনায়ক আকরাম খানের সঙ্গে, বললেন, আশরাফুলের মতো ব্যাটসম্যান আর হয় নাকি!
বাংলাদেশে আসছে অস্ট্রেলিয়া। ৯ এপ্রিল প্রথম একদিনের ম্যাচ। উৎপল শুভ্র চান না অস্ট্রেলিয়া আরেকবার চ্যাম্পিয়ন হোক, আমি চাই। খেললে বিশ্ব চ্যাম্পিয়নদের সঙ্গেই খেলি। হারলে সমস্যা নাই, জিতে গেলেই নিজেদের চ্যাম্পিয়ন ভাবতে শুরু করব।
দুই ডব্লুর মন নাকি কখনো পড়া যায় না। একটা ওয়েদার, আরেকটা...থাক, বলব না। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে, নিজেদের বানানো উইকেটও আমরা পড়তে পারি না। আর ক্রিকেট যে গণতান্ত্রিক খেলা, এবং গণতন্ত্রে জনমত ও গণমাধ্যমের ভূমিকা যে গুরুত্বপূর্ণ, সেটাও এবারের বিশ্বকাপে আমরা প্রমাণ করেছি। ভারতের বিপক্ষে এবার বোলিং আগে নিয়ে যে সমালোচনা সহ্য করতে হয়েছিল, তারই কারণে আগে ব্যাট নিয়ে আয়ারল্যান্ডের সঙ্গে প্রায় হারতে বসা, ওয়েস্ট ইন্ডিজের সঙ্গে ৫৮। দক্ষিণ আফ্রিকার সঙ্গে আগে বল নিয়ে অবশ্য প্রমাণ করেছি, উঠোন কেবল আমাদের জন্যই বাঁকা ছিল।
আজ ২৪ মার্চ। সাকিব আল হাসানের জন্মদিন। গতকাল নির্মলেন্দু গুণ লিখেছিলেন, উইজডেন সাময়িকীর বর্ষসেরা খেলোয়াড়ের তকমাটা সাকিব আল হাসান আর তামিমের হঠাৎ পাওয়া ধন। কথাটা তিনি একেবারেই ঠিক বলেননি। নিজেদের সারা বছরের পারফরম্যান্স দিয়েই তাঁরা সেই সম্মান অর্জন করেছিলেন। বিশ্বকাপে বহু সুপারস্টারই ফ্লপ করেন, চোখের সামনে ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোকে, মায় দেবদূতোপম মেসিকে বিশ্বকাপ ফুটবলে নিজের হাত কামড়াতে দেখেছি।
শুভ জন্মদিন সাকিব আল হাসান। শুভ জন্মদিন তামিম ইকবাল (২০ মার্চ)। রাত্রি যত গভীর হয়, প্রভাত তত কাছে আসে। কঠোর পরিশ্রম, নিরলস প্রশিক্ষণ, সাফল্যের তৃষ্ণা আর দুঃসময়ে ভেঙে না পড়াই খেলোয়াড়দের সাফল্যকে স্থায়ী করে। সাকিব আল হাসানদের হয়তো সংবাদমাধ্যমের সামনে কথা বলার কৌশলও রপ্ত করতে হবে। কারণ, সাকিব কেবল নিজেকে প্রতিনিধিত্ব করেন না, দেশকেও করেন। আর বাংলাদেশের ক্রিকেটের সামগ্রিক উন্নতির জন্য পুরো ক্রীড়া অবকাঠামোরই পরিবর্তন দরকার, ক্রিকেটকে ছড়িয়ে দেওয়া দরকার সারা দেশে। এভারেস্টের চূড়া একটা, কিন্তু অনেক বড় হিমালয় রেঞ্জ আছে বলেই একটা এভারেস্ট মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পেরেছে।
স্ফুলিঙ্গ তার পাখায় পেল ক্ষণকালের ছন্দ, উড়ে গিয়ে ফুরিয়ে গেল এই তারি আনন্দ, সাকিব আল হাসান, তামিম ইকবালরা তা নন, তাঁরা স্ফুলিঙ্গের মতো ফুরিয়ে যাবেন না, নক্ষত্রের মতো জ্বলতে থাকবেন আমাদের ক্রিকেট-আকাশে, তাঁদের জন্মদিনে এই শুভেচ্ছা জানাই।
সূত্র: প্রথম আলো
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে মার্চ, ২০১১ সকাল ১০:০৫