★
হোটেল কেবিনের তেল চিটচিটে পর্দাটা সরিয়ে ভেতরে উঁকি দিতেই বেলার গম্ভীর মুখটা দেখতে পেল অঞ্জন। মাথার উপরে পাখাটা ঘুরছেনা বললেই চলে। কেবল কিছুক্ষণ পরপর ঘটাং ঘটাং শব্দ করে নিজের অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে। এই ভ্যাপসা গরমের মধ্যে একপ্রকার দম বন্ধ করেই বসে আছে বেলা বোস। চুপ চাপ অপরাধী মুখ করে তার সামনের বেঞ্চিতে বসে পড়ল অঞ্জন। পর্দাটা আবার টেনে দিল সে।
"খুঁজে খুঁজে শহরের সবচেয়ে সস্তা হোটেলটাতেই আসতে হয় তোমার!" রসিকতা করার চেষ্টা করল অঞ্জন।
"বড় হোটেলে নিবে? তা তোমার পকেটে কয় টাকা আছে শুনি?" বেলার ফিরতি প্রশ্ন শুনেই চুপসে গেল সে। সত্যি কথা বলতে তার পকেট এ কয়মাস ধরে রীতিমতো গড়ের মাঠ হয়ে আছে। গ্রাজুয়েশন শেষ করে বেকার ঘুরঘুর করা ধাঁড়ি ছেলেকে হাতখরচা দেয়ার কোন যুক্তি খুঁজে পায় নি মধ্যবিত্ত বাবা মা। তাই একটা সিগারেট খেতেও এখন বেলার কাছে হাত পাততে হয় তাকে। বাসা থেকে পাওয়া নিজের হাতখরচা থেকে তা যোগায় বেলা। এ নিয়ে তার তেমন কোন অভিযোগ ছিলনা। প্রতিটা ব্যর্থ ইন্টার্ভিউর পর সেই অনুপ্রেরণা যোগাত অঞ্জনকে। ও যখন হাসিমুখে বলতো "এটায় হয়নি তো কি হয়েছে পরেরটাতে নিশ্চয়ই হয়ে যাবে" অঞ্জনের বড্ড ভাল লাগতো। সে সত্যিই বিশ্বাস করতো যে সামনেরটাতে তার চাকরী হয়ে যাবে। যদিও একের পর এক ইন্টারভিউ থেকে নিয়মিত প্রত্যাখ্যাত হয়েই যাচ্ছিল সে।
★★
কিছুদিন হল বেলা পুরো বদলে গেছে। উচ্ছল হাসিখুশী মেয়েটি সারাক্ষণ গম্ভীর হয়ে বসে থাকে, কিছু বললেই শীতল চোখে একের পর এক গায়ে জ্বালা ধরানো কথা ছোঁড়া শুরু করে। কারনটাও অজানা নেই অঞ্জনের। বাড়ী থেকে প্রতিনিয়ত বিয়ের জন্য চাপ দিচ্ছে বেলাকে। এতদিন কোনমতে তা পাশ কাটিয়ে গেলেও এখন আর সম্ভব হচ্ছে না। বড় খালা বিলেত ফেরত এক ছেলের জন্য প্রস্তাব নিয়ে এসেছে। এমন প্রস্তাব হাতছাড়া করার কথা কেউ ভাবতেও পারছে না। সবাই উঠে পড়ে লাগছে বিয়ের জন্য। অন্যদিকে সে বাসায় অঞ্জনের কথাও বলতে পারছেনা, একটা বিলেত ফেরত ছেলের বিপরীতে সম্পূর্ণ বেকার একটা ছেলের কথা বলার সাহস করে উঠতে পারেনি বেলা। তাই ভেবেচিন্তে আজ সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছে সে।
★★★
অঞ্জন তার হাতের চায়ের কাপটার দিকে তাকিয়ে আছে। চায়ে দুইটা কালো পিঁপড়া ভাসছে। অন্য সময় হলে হয়ত ওয়েটারকে দুইটা গাট্টা দেয়ের জন্য হাত নিশপিশ করে উঠত তার। কিন্তু এখন কেন জানি তার ভীষণ মায়া লাগলো পিঁপড়া দুটির জন্য। এরা হয়ত চিনির পাত্রে সংসার সাজিয়ে দিব্যি চালিয়ে যাচ্ছিল। অথচ আচমকা এসে কিনা পড়তে হল এই গরম চায়ের কাপে।
"ইন্টার্ভিউ কেমন হল?" বেলার প্রশ্নে সম্বিৎ ফিরে পায় সে।
"ভালই হয়েছে" মুখে বিষণ্ণ হাসি ফুটিয়ে বলল অঞ্জন। আর আগ্রহ দেখালো না বেলা। অন্যদিকে তাকিয়ে স্থির গলায় বলল "আমি সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছি"
চমকে উঠে অঞ্জন "মানে! কি সিদ্ধান্ত?"
"ঠিক করেছি এ প্রস্তাবে 'হ্যাঁ' বলে দেব।" বলেই উঠে বেরিয়ে যায় বেলা।
ঝিম ধরে বসে থাকে অঞ্জন। এক মূহুর্তে তার চোখের সামনে ভেসে উঠে তাদের অতীতস্মৃতিগুলো, একসাথে সময় কাটানো, ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখা, সাদাকালো এই শহরে একটি লাল নীল সংসারের স্বপ্ন। চোখ দুটি ঝাপসা হয়ে আসে অঞ্জনের। টলতে টলতে বেরিয়ে আসে সে। মেসে এসে শুনে তার নামে একটা চিঠি এসেছে। খুলতেই দেখে এপয়েন্টমেন্ট লেটার। স্টার্টিংয়েই বেতন এগারোহাজার টাকা। একছুটে বেরিয়ে যায় অঞ্জন, গন্তব্য সামনের টেলিফোন বুথ।
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই অক্টোবর, ২০১৬ দুপুর ২:১০