ফেসবুক, ই-মেইল, টুইটারের মতো সামাজিক মাধ্যম থেকে শুরু করে বিভিন্ন প্রয়োজনীয় ওয়েবসাইটের জন্য প্রয়োজন হয় পাসওয়ার্ড। আর ফেসবুক, টুইটার ইত্যাদি ব্যবহারে অন্তত একটি অংশ শেয়ার। অনেকের মেইলেই প্রতিদিন জানা-অজানা ঠিকানা থেকে আসে নানারকম মেইল, কৌতূহলের বশে খুলেও দেখেন অনেকে।
উপরের কাজগুলো এমনিতে খুব স্বাভাবিক মনে হতে পারে। কিন্তু জানেন কি, এসবের ফলে আপনিও সাইবার অপরাধী, তথা হ্যাকারদের খুব কাছাকাছি পৌঁছে যাচ্ছেন? নিজের অজান্তেই তাদের হাতে তুলে দিচ্ছেন আপনার অনলাইন জগতের চাবিকাঠি?
তবে সম্প্রতি এসব নিয়ে সচেতনতা বেড়েছে। অনলাইনে বিচরণের একটি অসতর্ক মুহূর্তে যে আপনার সব তথ্য অন্য কারও কাছে পাচার হয়ে যেতে পারে, তা এখন আর অজানা নয়। কিন্তু সমস্যা হলো, প্রতিপক্ষ, অর্থাৎ হ্যাকাররাও কিন্তু কম বুদ্ধিমান নয়! আর সেজন্যেই আপনার শত নিরাপত্তা ব্যবস্থা ভেদ করে, সতর্কতার ফাঁক গলে তারা ঠিকই চুরি করে নিচ্ছে আপনার প্রয়োজনীয় তথ্য।
এখানে একটি কথা ব্যাখ্যা করা প্রয়োজন। আমরা অনেকেই ভেবে থাকি, আমি তো সাধারণ এক ইউজার, কি এমন গোপন তথ্য আছে যাতে আমার প্রতি হ্যাকাররা আকৃষ্ট হবে?
কিন্তু এ ধারণা ভুল। প্রথমত, আপনার কম্পিউটার, ফেসবুক অ্যাকাউন্ট বা মেইল হতে পারে আপনারই পরিচিতজনের ব্যক্তিগত তথ্য চুরির প্রথম উদ্যোগ। দ্বিতীয়ত, হ্যাকাররা খুব সহজেই তাদের অপরাধের বোঝা আপনার ঘাড়ে চাপিয়ে দিতে পারে, যার ফলে ফেঁসে যাবেন আপনি। তৃতীয়ত, আপনার ব্যক্তিগত তথ্য ও ছবি চুরি করে তা প্রকাশ করে দেওয়ার হুমকি দিতে পারে। অর্থাৎ ব্ল্যাকমেইল করতে পারতে। চতুর্থত, পাচার হয়ে যেতে পারে আপনার ব্যাংক অ্যাকাউন্টের তথ্য, গবেষণাকর্ম, গুরুত্বপূর্ণ মেধাসত্ত্ব, গোপন নথিপত্র। আর আপনি যদি ব্যবসায়ী বা উদ্যোক্তা হয়ে থাকেন, তাহলে তো কথাই নেই। ব্যবসায়ীদের গুরুত্বপূর্ণ তথ্য হ্যাক করে লাখ ডলার দাবি করে বসা সাইবার অপরাধীদের জন্য সাধারণ ব্যাপার।
একটা সময় ভাইরাস নিয়ে মানুষের মধ্যে আতঙ্ক থাকলেও বর্তমানে ভাইরাসের চেয়েও বেশি ভয়াবহ রূপ নিয়েছে ম্যালওয়্যার, স্পাইওয়্যার, হ্যাকিং বট, ফিশিং ইত্যাদি। আগের হ্যাকারদের লক্ষ্য থাকতো শুধু আপনার কম্পিউটারটিকে সাময়িকভাবে বিপর্যস্ত করতে আনন্দ নেওয়া, আর এখনকার হ্যাকারদের লক্ষ্য এসব উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন প্রোগ্রাম ব্যবহার করে কোটি কোটি ডলার হাতিয়ে নেওয়া। ২০১০ সালে যুক্তরাজ্যে হ্যাকারদের মাধ্যমে পাচার হওয়া অর্থের পরিমাণ ছিল ২০০ কোটি পাউন্ড।
তবে হ্যাকিংয়ের ঝুঁকি থেকে দূরে থাকা কিন্তু খুব কঠিন ব্যাপার নয়। এর জন্য মূলত প্রয়োজন অনলাইন জগতের কিছু সচেতনতা, যার ফলে আপনার ব্যক্তিগত তথ্য জানার সুযোগই পাবে না হ্যাকাররা। এমনই কিছু সচেতনতামূলক টিপস-
১. ইন্টারনেট নিরাপত্তার সবচেয়ে প্রয়োজনীয় ধাপ হচ্ছে, কখনোই না জেনেশুনে কোনো লিংকে ক্লিক করবে না। আপনার কম্পিউটারে কোনো ম্যালওয়্যার বসিয়ে এটাই সহজতম উপায় হ্যাকারদের জন্য। ফেসবুকের মতো সামাজিক মাধ্যমগুলোয় এ ঝুঁকি আরও বেশি। আপনার পছন্দের বিষয় নিয়ে একটি লিংক আপনাকে পাঠানো হতে পারে, যাতে ক্লিক করলেই ব্রাউজারের মাধ্যমে কম্পিউটারে প্রবেশ করবে ম্যালওয়্যার। তাই ভুলেও নিশ্চিত না হয়ে কোনো লিংকে ক্লিক করবেন না।
২. বরাবরই হ্যাকারদের জন্য শক্তিশালী অস্ত্র আপনার পাসওয়ার্ড। এটি ব্যবহারকারীদেরও একটি দুর্বল জায়গা বটে। মেইল, ফেসবুক, ক্লাউড স্টোরেজ থেকে শুরু করে বিভিন্ন প্রয়োজনীয় ওয়েবসাইটেই এখন পাসওয়ার্ড প্রয়োজন হয়। এতরকম পাসওয়ার্ড মনে রাখার ঝক্কি পোহাতে চান না বেশিরভাগ ব্যবহারকারী, যে কারণে অনেক জায়গায় একই পাসওয়ার্ড ব্যবহার করেন। কিন্তু এখানেই ভুলটি করছেন।
বর্তমানে হ্যাকারদের কাছে অনেক শক্তিশালী ওয়ার্ডবট রয়েছে, যা সেকেন্ডে হাজার হাজার শব্দ মেলাতে সম্ভব। একে কাজে লাগিয়ে ও বিভিন্ন ব্যক্তিগত তথ্য ঘাঁটাঘাঁটি করে সঠিক পাসওয়ার্ডটি বের করে ফেলা অসম্ভব নয়। তাই যত পারুন ভিন্ন পাসওয়ার্ড ব্যবহার করুন, পাসওয়ার্ড যতোটা পারা যায় অনন্য করুন। শব্দের পাশাপাশি নম্বর, বড় ও ছোট হাতের অক্ষর, বিভিন্ন চিহ্ন ইত্যাদি ব্যবহার করুন, যাতে ওয়ার্ডবট সহজে পাসওয়ার্ড আন্দাজ করতে না পারে।
৩. আপনার অনলাইন জগতের মূল নিয়ন্ত্রক আপনার ই-মেইল। তাই ই-মেইল হ্যাক করা সম্ভব হলে ফেসবুক থেকে শুরু করে ব্যাংক অ্যাকাউন্ট, সবকিছুই হ্যাক করা সম্ভব। তাই এক্ষেত্রে সর্বোচ্চ নিরাপত্তা নিন। প্রয়োজনে কয়েকটি মেইল অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করুন। মূল অ্যাকাউন্টের পাসওয়ার্ড কিছু দিন পরপর বদলান।
৪. ম্যালওয়্যার, ভাইরাসের হাত থেকে রক্ষাসহ কম্পিউটারের সার্বিক নিরাপত্তায় অ্যান্টি-ভাইরাসের বিকল্প নেই। ২০১০ সালে জার্মান একটি অ্যান্টি-ভাইরাস কোম্পানির গবেষণা থেকে দেখা যায়, ওই বছর বিশ্বব্যাপী ৫ কোটিরও বেশি নতুন ধরনের ম্যালওয়্যার তৈরি করেছিল হ্যাকাররা। আর অ্যান্টি-ভাইরাস না থাকলে এসব ম্যালওয়্যারের কাছে আপনার কম্পিউটারটি রাস্তার খোলা খাবারের মতোই আকর্ষণীয়।
বর্তমানে বাজারে নানা ধরনের অ্যান্টি-ভাইরাস থাকলেও এর সবগুলো নিরাপদ ও কার্যকরী নয়। তবে সাম্প্রতিক এক গবেষণা থেকে দেখা যায়, ক্যাসপারস্কি, বিট ডিফেন্ডার ও এফ-সিকিউর অ্যান্টি-ভাইরাস কম্পিউটারকে তুলনামূলক বেশি সুরক্ষিত রাখে।
৫. রাস্তার অচেনা কোনো ব্যক্তি হুট করে আপনার ঘরে ঢুকতে চাইলে কি তাকে ঢুকতে দেবেন? নিশ্চয়ই না। অনলাইনে অচেনা আইডি থেকে আসা নিমন্ত্রণ/আমন্ত্রণ গ্রহণ করা, সেখানে কোনো তথ্য দেওয়া ওই অচেনা মানুষকে যেচে নিজের ঘরে নিয়ে আসার মতোই। আর এসব অজানা মেইল থেকে বারবার আমন্ত্রণ আসতে থাকলে তাকে ব্লক করুন।
৬. টুইট করা ও ফেসবুক শেয়ার আগে অবশ্যই সতর্ক থাকুন। মনে রাখবেন, একবার শেয়ার করার পর ওই তথ্য আর আপনার নাগালে থাকবে না, কিভাবে ছড়িয়ে পড়বে তা-ও আপনি জানেন না।
অনেকেই বেতন পেলে, কোনো পুরস্কারের অর্থ জিতলে বা হঠাৎ টাকা-পয়সা পেলে সামাজিক মিডিয়ায় সবার আগে সে তথ্য ছড়িয়ে দেন। খুবই সম্ভব যে সেই তথ্য দেখে সাইবার অপরাধীরা আপনার ব্যাংক অ্যাকাউন্ট হ্যাক করে বা অন্য কোনোভাবে সেই অর্থ কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা করবে। প্রতিদিনই এভাবে হ্যাকাররা চুরি করে নিচ্ছে হাজার হাজার ডলার।
৭. আজকের স্মার্টফোনে অনেক ব্যক্তিগত তথ্যও সংরক্ষিত থাকে। মনে রাখার সুবিধার্থে ব্যাংক অ্যাকাউন্ট নম্বর, ইন্স্যুরেন্সের তথ্য এমন পাসওয়ার্ডও অনেকে ফোনে সংরক্ষণ করে রাখেন। তাই ফোনটি চুরি গেলে এসব তথ্য চলে যাবে অন্য কারও হাতে। সেটি যেন না হয়, সে ব্যাপারে আগে থেকেই সতর্কতা নিন। ফাইন্ড মাই আইফোন, অ্যান্ড্রয়েড লস্ট, ব্ল্যাকবেরি প্রোটেস্ট ইত্যাদি অ্যাপ্লিকেশনের মাধ্যমে ফোন কাছে না থাকলেও সেখানকার সব তথ্য মুছে ফেলতে পারবেন।
৮. সারা বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশেও ই-কমার্সের প্রসার ঘটেছে, যার ফলে অনেক বেচাকেনার ওয়েবসাইটই এখন ডেবিট/ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে মূল্য পরিশোধের সুযোগ দিচ্ছে। এসব সাইট ব্যবহারের আগে অবশ্যই সাবধান থাকুন, কেননা এখানে আপনি আপনার কার্ডের গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন তথ্য দিচ্ছেন। কার্ডের তথ্য যে পেজে দেবেন, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সেই পেজের অ্যাড্রেস ‘http’ থেকে পরিবর্তিত হয়ে ‘https’ হয়ে যাবে, যার অর্থ আপনি নিরাপদ কানেকশনে আছে। তাই তথ্য দেওয়ার আগে ব্রাউজারের অ্যাড্রেস বার চেক করে নিন, ‘http’ থাকলে সংশ্লিষ্ট সাইট কর্তৃপক্ষকে জানান।
১০. অনলাইন জগতে অভিজ্ঞরা মাত্রই জানেন পপ-আপ কতো বিরক্তিকর একটা ব্যাপার। বিভিন্ন সাইটে ঝকমকে গ্রাফিক্সে, আকর্ষণীয় কথাবার্তাসহ এসব পপ-আপ দেখা যায়। অনভিজ্ঞরা অনেক সময় এগুলোতে কৌতূহলী হয়ে ক্লিক করে ফেলেন। খুবই স্বাভাবিক যে ক্লিক করার সঙ্গে সঙ্গে পপ-আপে লুকানো ম্যালকোড আপনার কম্পিউটারে ম্যালওয়্যার ইনস্টল করা শুরু করেছে, আপনার অজান্তেই। তাই পপ-আপে ক্লিক করা থেকে বিরত থাকুন। এছাড়া যে ব্রাউজারই ব্যবহার করুন না কেন, তাতে অ্যাড-অন হিসেবে পপ-আপ ব্লকার পাবেন। সেটি ব্যবহার করুন।
১১. বিভিন্ন রেস্তোরাঁ ও পাবলিক প্লেসে আজকাল ওয়াই-ফাই জোন দেখা যায়। ব্যাপারটা লোভনীয় হলেও এই ওয়াই-ফাই দিয়ে কোনো কোনো কাজ করা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। সাধারণ ব্রাউজিং ছাড়া এই ওয়াই-ফাই দিয়ে সন্দেহজনক ফাইল ডাউনলোড, অনলাইন ব্যাংকিং, কোনো সাইটে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিগত তথ্য দেওয়া থেকে বিরত থাকুন। প্যাকেট স্নিফার (সিগন্যাল থেকে তথ্য চুরি করার যন্ত্র) দিয়ে এসব অনিরাপদ ওয়াই-ফাই জোন থেকে আপনার ব্যক্তিগত তথ্যটি খুঁজে পাওয়া হ্যাকারদের জন্য খুব কঠিন নয়।
১২. সবশেষে, ফেসবুকের নিরাপত্তা সেটিংসের সর্বোচ্চ ব্যবহার করুন। অন্য যে কোনো মাধ্যমের চেয়ে এসব সামাজিক মাধ্যম হ্যাক করা তুলনামূলক বেশি সহজ ও অনেক বেশি লোভনীয়, কারণ এখান থেকেই হ্যাকাররা পেতে পারে আপনার ব্যক্তিজীবনের তথ্যভাণ্ডার।
ফেসবুকে কে কে আপনার ব্যক্তিগত তথ্য দেখতে পারবে, তা ঠিক করার আগে একবার হলেও চোখ বুলান আপনার ফ্রেন্ডলিস্টে। ‘ফ্রেন্ডস অব ফ্রেন্ডস’ বা ‘বন্ধুর বন্ধু’ অপশনটি কোনো ক্ষেত্রেই ব্যবহার করা উচিত নয়। এক গবেষণা থেকে দেখা যায়, কোনো পোস্ট ‘ফ্রেন্ডস অব ফ্রেন্ডস’দের মধ্যে শেয়ার করা অর্থ সেটি গড়ে প্রায় এক লাখ ৫৭ হাজার মানুষের সঙ্গে শেয়ার করা। এছাড়া অপরিচিতদের বন্ধু তালিকায় যোগ করা, স্পর্শকাতর তথ্য শেয়ার না করা, যত্রতত্র লিংকে ক্লিক না করা ইত্যাদির মাধ্যমে হ্যাকারদের থেকে দূরে থাকা সম্ভব। ফেসবুক অ্যাপ্লিকেশন ব্যবহার করার সময়েও সতর্ক থাকুন, অনেক মাল্টিপ্লেয়ার গেম খেলার সময় আপনার পার্টনার বিভিন্ন ব্যক্তিগত জানতে চাইতে পারে, নিশ্চিত না হয়ে কখনোই তা শেয়ার করবেন না।
মনে রাখবেন, হ্যাকাররা কখনও কম্পিউটার/প্রোগ্রামের ত্রুটি খোঁজে না, খোঁজে সাধারণ ব্যবহারকারীদের ত্রুটি। আর একটু সচেতনতাই পারে এসব ত্রুটি সংশোধন করে হ্যাকিংয়ের সব পথ বন্ধ করে দিতে।
সূত্র বাংলা নিউজ ২৪