১। অনেকদিন পর সভ্য জগতে পদার্পণ করলাম।খাগড়াছড়ি থেকে চট্টগ্রামে এলাম গতকাল।চট্টগ্রাম শহরের লাল লাল নীল নীল বাতি দেখে আসলেই ভাল লাগছে।গত কয়েক মাস টানা পাহাড়ি এলাকায় থাকতে থাকতে হাঁপ ধরে গিয়েছিল।ইলেক্ট্রিসিটি নাই,ভরসা সোলার প্যানেলের টিমটিম করা বাল্ব।প্রতিদিন আধ ঘণ্টা জেনারেটর চলে,ওই সময়ে চার্জ দিয়ে যতক্ষণ ল্যাপটপ চালান যায় আর কী।
মাঝে মাঝে মনে হয় বাংলা সিনেমার সেই বিখ্যাত গান “……আছি মাগো বিপদে,বাইরের আলো চোখে পড়েনা, মা…” হাহাহা। কিন্তু মুদ্রার অপর পিঠে তাজা বাতাস,সোনাঝরা রোদ,পাহাড়ের অপরূপ সৌন্দর্য সুধা পান করে বুঁদ হয়ে আছি বলেই হয়ত ভাল আছি।ছেলে বেলায় পড়া ট্রেজার আইল্যান্ড বইয়ের খোঁড়া নাবিকের বলা সেই লাইন গুলো মনে পড়ে যায়। সে নেশায় চুর হয়ে বলত “……আরেক বোতল রাম নিয়ে আয়,ইয়া হো হো কি মজা…’’।তখন ভাবতাম রাম জিনিসটা বড় হয়ে খেয়ে দেখতে হবে,এতই যখন মজা।
রাম আর খাওয়া হয় নি,খাওয়ার ইচ্ছাও আর নেই কিন্তু ওই নাবিকের মতই যেন বুঁদ হয়ে আছি,নৈসর্গের নেশায়।একদিকে আধুনিক সুযোগ সুবিধা বঞ্চিত পরিবেশ, অন্যদিকে আলো বাতাস আর সবুজের রেশ। তাই ভাল মন্দে মেশানো আমার পাহাড়ি জীবন খুব একটা খারাপ যাচ্ছে না।
২। যাকগে,চট্টগ্রাম শহরে ‘সাব জিরো’ নামে একটা আইসক্রিম পার্লার আছে।কালকে জিইসি মোড়ে হাটতে হাটতে ওটার সামনে যেতেই অনেক স্মৃতি মনে পড়ে গেল।ওখানকার একটা ঘটনা মনে পড়তেই নিজে নিজেই হেসে ফেললাম।আমার এক বন্ধু যে কিনা ডাউট দেয়াকে মানে আজগুবি প্রশ্ন করাকে মোটামুটি শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গেছে তাকে নিয়ে স্মৃতি। প্রতিটি কাজেই তার অফুরন্ত সন্দেহ আর আজগুবি সব প্রশ্ন । আত্মরক্ষার্থে তার নাম ফাঁস করছি না। কারণ,মরিতে চাই না আমি সুন্দর ভুবনে…অন্তত এত তাড়াতাড়ি না।
কোন এক বিকেলে আমার বন্ধু গেল সাব জিরো আইসক্রিম পার্লারে।সাথে আরও কয়েকজন। যখন সেলস ম্যান জানতে চাইল কে কোন ফ্লেভার নিবে,তখন আমার বন্ধুবর তার অবিস্মরণীয় প্রশ্ন টা করল । সে খুব মুড নিয়ে সেলস ম্যান কে জিজ্ঞেস করল “ভাই আইসক্রিম ঠাণ্ডা হবে তো?” সাথে থাকা বন্ধুরা হতবাক আর সেলস ম্যান বাকরুদ্ধ।এইরকম কথা সে বোধহয় বাপের জন্মেও শুনে নাই।
৩। চট্টগ্রাম শহরে আরেকটা স্মৃতির জায়গা হচ্ছে সেন্ট্রাল প্লাজার সাইবার ক্যাফে গুলো।২০০৩-০৪ সালে ওখান কার খুপরি গুলোতে বসে যে কত শত ঘণ্টা খরচ করেছি বিভিন্ন ভাল এবং দুষ্টু ওয়েবসাইটে তার হিসেব করতে গেলে দুর্বল টাইপের ক্যালকুলেটর ক্রাশ করবে নির্ঘাত।খুপরিগুলো আবার বাড়াবাড়ি রকমের ছোট।ওইখানে এক গ্লাস দুধ রাখলে একটু পর কন্ডেন্সড মিল্ক হয়ে যাবে বোধহয়।
এবার যাকে নিয়ে ঘটনা তারও নাম পরিচয় গোপন রাখছি।আমার এই বন্ধুটির শরীর স্বাস্থ্য একটু বেশিই ভাল।তার খাই খাই ভাব টাও এইজন্য বেশি, বিশেষ করে ফাও খাওয়ার ব্যাপারে তার পারদর্শিতা মোটামুটি কিংবদন্তীতুল্য।পারলে নিজের বিছানার কোল বালিশটাকেই হট-ডগ মনে করে খেয়ে ফেলে আরকি।
একদিন আমি সেন্ট্রাল প্লাজা থেকে কিছু খাবার দাবার কিনছিলাম,তিন প্যাকেট বিস্কিট,কয়েকটা কেক আর সুইট ম্যাক্স থেকে এক কেজি মিষ্টি,আগামী এক সপ্তাহের রশদ। খাবারগুলো ব্যাগে নিয়ে ক্যাফেতে যাচ্ছি,আমার বিশাল বপু বন্ধুটি কোত্থেকে যেন উদয় হল। আমাকে জিজ্ঞাসা করল কোথায় যাচ্ছি। ক্যাফেতে যাচ্ছি শুনে সে আমার সঙ্গী হতে চাইল। মুখে হে হে করে একটু হাসলেও মনে মনে অবাক হলাম। কারণ সাইবার ক্যাফের চেয়ে খাইবার ক্যাফের প্রতিই তার আকর্ষণ বেশি।
যাই হোক ক্যাফেতে গিয়ে দেখি ইশকুল খুইলাছে রে মউলা টাইপের অবস্থা। একটা মাত্র খুপরিই খালি পেলাম। অগত্যা সে আমার খুপরি পাটনার হল।আমি ইন্টারনেট এ চ্যাট রুমে ঢুকলাম। বরাত ভাল,পাঁচ মিনিটের মধ্যেই একটা মেয়ে আইডির সাথে বেশ হাই হ্যালো হয়ে গেলো…ইয়ে মানে বয়সের দোষ আর কী। আমার বন্ধুটি কতক্ষণ ভ্যাজর ভ্যাজর করল। আমাকে বলল যে চ্যাট করা ভাল না,খামখা টাইম লস,নেটের মেয়েরা ভাল না ইত্যাদি।
হঠাৎ তার নজর গেল আমার ব্যাগের দিকে। সে জিজ্ঞাসা করল ‘এই,ব্যাগে কি রে?’ আমার আঙ্গুল কী বোর্ডে থমকে গেল,শুকনা হাসি হেসে বলতে চাইলাম যে তেমন কিছুই না। কিন্তু ততক্ষণে সে আমার ব্যাগের জবরদখল নিয়ে নিয়েছে। তখন আমার মনে পড়ল সেই কথা “যদি বলো আকাশে চার বিলিয়ন তারা আছে, তাহলে না গুনেই সবাই সেটা বিশ্বাস করবে। কিন্তু যদি বলা হয়, মাত্র রং করেছি, চেয়ারের রংটা এখনো শুকায়নি, তাহলে সবাই হাত দিয়ে দেখবে।’’
সে ভেতরের জিনিস হাত দিয়ে দেখল। দেখে তার চোখ চকচক করে উঠল।বলল ‘আরে ব্যাগ ভরতি খাবার,তুই এত খাবার দাবার কিনছিস,তুই কি মানুষ না রাক্ষস,এত খাস কেন’ ।আমি মিনমিন করে বললাম ‘দোস্ত,এক সপ্তাহের খাবার’। সে বলল ‘ক্যাফেটেরিয়াতেই তো এইগুলা পাওয়া যায়,খামোখা এখান থেকে কষ্ট করে নিয়ে যাবার দরকার কি?’ আমি বললাম ক্যাফের মিষ্টি আর বিস্কিট খেতে খেতে আর ভাল লাগে না,এইজন্য কিনলাম। সে বলল “ঠিক আছে,আমি দুইটা টেস্ট করে দেখলে আবার মাইন্ড করবি না তো?খুব খিদে পেয়েছে।”আমি দীর্ঘশ্বাস গোপন করে বললাম ‘না,না মাইন্ড করব কেন,খা না…’।
আমি চ্যাট রুমের সেই অজানা রমণীর মায়াজালে জড়িয়ে ডান বাম দুইহাতে ক্রমাগত টাইপ করে বাতচিত চালিয়ে যেতে লাগলাম।আর আমার বন্ধু তার ডান হাতের ব্যাবহার করে আমার ব্যাগ হালকা করার মহান ব্রতে নিজেকে চরম নিষ্ঠার সাথে নিয়োজিত করল।আমি চ্যাটিং এ এতই মগ্ন ছিলাম যে,একটু পর আর ওইদিকে খেয়ালই ছিল না।
যাই হোক ছলনাময়ী নারীর কারণে যে যুগে যুগে কত ধ্বংসযজ্ঞ চলেছে তা টের পেলাম প্রায় দেড় ঘণ্টা পর সেই রমণী যখন আমকে G2G,BYE বলল তখন।আমি সাইন আউট হয়ে আমার বন্ধুবরের দিকে নজর দিলাম।দেখি সে মুখে সুইট ম্যাক্স এর মিষ্টি নিয়ে আয়েস করে চিবাচ্ছে।গত দেড় ঘণ্টা যাবত সে নিষ্ঠার সাথে তার কাজ চালিয়ে গেছে।আমি ব্যাগ হাতে নিয়ে অন্দরমহলে নজর দিতেই বেকুব হয়ে গেলাম।
কিভাবে সম্ভব??? দুই প্যাকেট বিস্কিট আর প্রায় কেজি খানেক মিষ্টি একদম যাকে বলে হাওয়া মে উড়তা যায়ে। একজন মানুষ কিভাবে এই অসম্ভব কাজ করল। এইটাতো আফ্রিকার মাগুর মাছ বা পিরানহার পক্ষেও সম্ভব না।আমার খাদক বন্ধুটি বলল, ‘ক্যাফেটেরিয়াতেই তো এইগুলা পাওয়া যায়,খামোখা এখান থেকে কষ্ট করে নিয়ে যাবার দরকার কি?’ আমি মনে মনে বললাম—হে বঙ্গ,ভাণ্ডারে তব বিবিধ রতন…।
৪। আরও কিছু লিখার ইচ্ছা ছিল,কিন্তু এক রমণী ক্রমাগত আমার সেলফোনে কল দিয়ে যাচ্ছেন।দ্রুত তার ফোন রিসিভ না করলে অমঙ্গল অবধারিত,আর তাই আজকের অধিবেশনের সমাপ্তি টানতে হচ্ছে।যুগে যুগে এভাবেই……।যাই হোক এই রমণীর সাথে আমার প্রায় পাঁচ বছরের সম্পর্কের একটা আনুষ্ঠানিক পরিণতি বোধহয় এই বছরই হবে।মুরুব্বিরা,এট্টু দোয়া রাইখেন।