যারা চাকরি করে শুক্রবার তাদের জন্য বিশেষ একটা দিন। সারা সপ্তাহের জমানো কাজ শুক্রবারে করি আমি। গত সপ্তাহে পবিত্র আশুরার ছুটি ছিলো বলে এই শুক্রবার রিলাক্স ছিলাম। তাই ছুটলাম উত্তরা আমার জামাইর শশুরবাড়িতে । আমার জামাইর শশুরবাড়িতে বেড়াতে গেলে আবার আমাকে খুঁজে পাওয়া যায়না। ওখানে ৪টা পিচ্চি নিয়ে সারাদিন কেটে যায়। আমাকে খোঁজার জন্য মাঝেমাঝে পিচ্চিদরে কাছে " একটি হারানো সংবাদ" শিরোনামে বিঙ্গাপণ দেয়। আর পিচ্চিগুলা হেসে হেসে বলে আমাদের পাপাটা (মানে আমার জামাইকে ওরা পাপা বলে) না অনেক বোকা।ওখানে গেলে ওদের সাথে দিনটা খুব দ্রুত কেটে যায় হাসি খুশিতে।
বহুকষ্টে সেদিন পিচ্চিদের বলে কয়ে আমাকে দিয়ে ওর চুলে তেল মাখিয়ে নিলো চপচপ করে। আর ওর তেল চপচপ চুলের মাঝখানে সিঁথি করে দিলাম আবুলের মতো। পিচ্চিগুলা ওদের পাপার চুল আঁচড়ানো দেখে হেসেই যাচ্ছিলো। আমিও হেব্বি আয়েশ করে চুলে চপচপ করে তেল দিলাম। ভাবলাম একটু যত্ন করি চুলের। দুপুরে শ্যাম্পু করে ফেলবো।
দুপুর ১২.৩০ মি ওর মোবাইলে ফোন আসে যে ওর খুব কাছের এক ফ্রেন্ডের বাবা গতকাল রাতে হার্ট অ্যাটাক করেছেন। উনি এখন আছেন শেরেবাংলা নগরে বাংলাদেশে হার্টের জন্য বিখ্যাত সরকারি হাসপাতালে। পাইলসের সমস্যা থাকার কারনে উনার শরীর থেকে অনেক রক্তক্ষরণ হয়েছে তাই উনার ২ ঘন্টার মধ্যে উনাকে রক্ত দিতে হবে। উনার ব্লাডগ্রুপ ও পজেটিভ। উনার ফ্যামির কারও সাথে ব্লাডগ্রুপ মিলছিলো না। যখন আমাদের ফোন দিলো আমি বললাম আমার ব্লাডগ্রুপ ও পজেটিভ। আমি ব্লাড দিব। মে মাসে আমি লাস্ট ব্লাড ডোনেট করেছি তাই আমি দিতে পারব। শুনে ওরা যত দ্রুত সম্ভব হাসপাতালে চলে আসতে বললো।
আমরা দুজনে বাইকে করে ছুটলাম ২ মিনিটের মধ্যে জামাকাপড় পরিবর্তন দূরে থাক ও চুলও ঠিক করলোনা। আবুল মার্কা চুল নিয়েই বাইক হাকালো। আর বলছিলো রাখও তোমার চুল। ঝড়ের গতিতে বাইক চালাচ্ছিলো। আর সারা রাস্তা আমি আল্লাহ আল্লাহ করছিলাম যেন আমাদের দেরি না হয়। শুক্রবার বলে রাস্তা ফাকাই ছিলো। আল্লাহর রহমতে আমরা ১টা কি ১.০৫ র মধ্যে হাসপাতালে পৌছে যাই। ওখানে আগে থেকে অপেক্ষারত এক ভাইয়ার সাথে আমি দৌড়ে হাসপাতালের দিকে ছুটে যাই ওর জন্য অপেক্ষা না করেই। শুধু বললাম বাইক পার্ক করে তুমি আস আমরা গেলাম।
কিন্তু মেইন গেটে ২ জন কর্তব্যরত সিকিউরিটি গার্ড পথ আটকে দিলো। বললো কোথায় যাবেন?
সঙ্গে থাকা ভাইয়া বললেন ব্লাডব্যাংকে যাবো। ব্লাড ডোনার নিয়ে আসছি।
১ম সিকিউরিটি গার্ড বললো এখন যাওয়া যাইবোনা।
আমি বললাম কেন যাওয়া যাবেনা।
১ম সিকিউরিটি গার্ড সঙ্গের ভাইয়াকে বললো ভাই আপনি একটু সাইডে আসেন।
২জনে সাইডে গেলে গার্ডটি ভাইয়ার কাছে কিছু টাকা দিতে বলেন।
আমি বুঝতে পেরে বলি খবরদার ভাইয়া এক টাকাও দিবেননা।
১ম সিকিউরিটি গার্ড বললো তাহলে ভিতরে যেতে পারবেননা।
শুরু হয় তর্ক।
এরমধ্যে আমার হাজবেন্ড বাইক পার্ক করে চলে আসে। আমি ওকে বলি যে ঢুকার জন্য টাকা চায়। ও শুনে ২য় গার্ডকে ধাক্কা দিয়ে জায়গা করে নিয়ে ভেতরে ঢুকে যায় আর বলে ঢুকেতো পরছি আর কিসের টাকা । এক টাকাও পাবানা। আর বাড়াবাড়ি করলে করতে পার। আমি আজকে বাড়াবাড়ির মুডে আছি। কিন্তু ঘুষ দিবনা। আর আমাদের বলে তোমরা আগাও আমি আসছি।
আমি আর ঐ ভাইয়া চলে আসি ব্লাডব্যাংকে। ব্লাডব্যাংকে একজন ভদ্রমহিলা একা কাজ করছিলেন। ভাইয়া উনাকে গিয়ে বললেন ম্যাডাম ডোনার নিয়ে আসছি একটু তাড়াতাড়ি ক্রস চেকটা করবেন?
ভদ্রমহিলা উনার দিকে না তাকিয়েই বললেন একটু বসেন। বলে বাহিরে ইঙ্গিত করেন। আমরা বাহিরে গিয়ে অপেক্ষা করি। ১০মি পর আমি ভাইয়াকে বলি ভাইয়া ওরা ডাকে না কেন?
ভাইয়া বলেন দাড়াও ভিতরে গিয়ে দেখি। ভাইয়া ভিতরে যান দেখতে। আমি একা দাড়িয়ে ছিলাম ২/৩ মি পর আমার হাজবেন্ড চলে আসে আর আমাকে বলে কি ব্লাড নেওয়া শেষ?
আমি বলি না।
বলে কেন দেরি কেন?
আমি বললাম জানি না ভাইয়া ভিতরে গিয়েছে জানতে।
একটু পর ভাইয়া ভিতর থেকে এসে বলেন আর একটু ওয়েট করতে হবে উনি হাতের কাজ শেষ করে ডাকবেন।
আমি বললাব সময়তো যাচ্ছে ব্লাড তো আংকেলকে তাড়াতাড়ি দিতে হবে।
ভাইয়া বললেন আর একটু দেখি।
আর ওর মোবাইলে ওর ফ্রেন্ড ফোন দেয় ঐ সময় জানতে চায় আমরা আসছি কিনা? ও বলে আসছি আমরা তুই টেনশন করিস না।
আরো ১০ মি পর আমি বলি দূর কি করে মহিলা। আমি যাই ভিতরে দেখি কি সমস্যা।
বলে আমি ভিতরে গিয়ে বলি আপু প্লিজ একটু দেখবেন। আংকেলকে ২ ঘন্টার মধ্যে ব্লাড দিতে বলছে। প্লিজ আপু।
ভদ্রমহিলা আমাকে বলেন দেখেন এখন লান্চ টাইম। আমি লান্চে আছি। পরে আসেন।
আমি বললাম আপু আপনি ছাড়া আর কেউ নেই?
উনি বললেন আর একজন আছেন উনি বাহিরে গিয়েছেন লান্চ করতে।
আমি বললাম আপু একটু দেখেন না প্লিজ।
উনি বললেন আজ শুক্রবার তাই আমরা ২ জন।বাকি সবার অফ।
প্লিজ আপু আপনিতো এখন খাবার খাচ্ছেন না । একটু আমাদের হেল্প করেন।
দেখেন বেশি কথা বলবেন না। বাহিরে গিয়ে দাড়ান। আমি খেয়ে আপনাকে ডাকব।
আমি বললাম আপু আমরা কেউই খাই নি। জরুরী ব্লাড লাগবে বলে ছুটে চলে আসছি। একজন মানুষের জীবন একবেলা খাওয়ার চেয়ে অনেক বেশী ইমপরটেন্ট।
আমি অনেক অনুনয় করলাম উনাকে কিন্তু উনি কিছুতেই রাজি হলেননা। আমি রবললাম আপু ক্রসচেক করতে টাইম লাগবে আপু একটু দয়া করেন। তবুও উনি শুনলেননা। তারপর আমি বাহিরে এসে আমার বড় বোনকে ফোন দিলাম। বড়আপু মিনিস্ট্রিতে জব করে ওর জানাশোনা থাকতে পারে এই আশায়।
বড়আপুকে সব খুলে বললাম। ও বললো দাড়া দেখি কি করা যায়।
তুই একটু ওয়েট কর।
১০মি পর ভিতর থেকে ডাক পড়লো। মহিলা বললো সর্যিম ম্যাডাম আমি বুঝতে পারি নাই যে আপনাদের আত্বীয় আছে স্বাস্থ্য মন্ত্রনালয়ে। আপনারা আগে এই কথা বলবেন না আমাকে। তাহলে কিন্তু এত ঝামেলা হতোনা।
আমি খুব অবাক হলাম উনার কথা শুনে। বললাম একজন মানুষের অবস্হা এত খারাপ আর আপনারা এই চিকিৎসা করছেন????
যাক শেষ পর্যন্ত আংকেলকে ব্লাড দেওয়া হয়েছিলো। আর এখন উনি বেশ সুস্হ আছেন।
কিন্তু সামান্য ব্লাড এর জন্য এত ঝামেলা? কোন দেশে আছি আমরা? সেলুকাস না অন্য কিছু?
যখনই শুনি কারও ব্লাড দরকার ছুটে যাই ব্লাড দিতে যদি গ্রুপ মিলে যায়। সেদিন যেমন না খেয়ে তেলে ভিজে চপচপ করতে করতে। আর যদি গ্রুপে না মিলে তাহলে চেস্টা করি অ্যারেন্জ করে দিতে।
সর্বশেষ এডিট : ১১ ই ডিসেম্বর, ২০১১ বিকাল ৫:১০