হৃদয়পুর আমার জন্য নানা কারণে স্মরণীয়।
আমি তখন এক বিহবল সময়ের মুখোমুখি। একদিকে আশার সলতে জ্বেলে বসে আছে কেউ। আমার ভেতর চুপচাপ, অন্তরালে। অন্যদিকে আর একজন অসহায় হতাশায় ঝাঁপ দিয়ে জীবন নামের অচিনপুরে অবগাহন করছে। জীবন থেকে ক্রমশ দূরেও সরে যাচ্ছে। যতদূর যাওয়া যায়।
জীবন মানেই মানুষ, কোলাহল। সম্পর্ক, স্বজন। ভালোবাসা, বাড়ি ফেরা। জীবন মানে একটা নিশ্চিত অভিযাত্রা যেখানে অনিশ্চিয়তার জায়গা আসলে নেই। আমাদের ধরাবাঁধা জীবনে একেবারেই নেই।
আর আমি! তখন এক অনিশ্চিতের পথিক। ধারাপাতের জীবন অগ্রাহ্য করা এক বেভুলো বোহেমিয়ান। প্রথাগত পথগুলোর ঠিক বিরুদ্ধ পথে দাঁড়িয়ে। একা।
একা এবং নিঃসঙ্গ।
ঠিক সে রকম সময়ে আমার লেখার পাতায় সবুজ যখন শব্দ-বাক্য-ছন্দ ধরে উঠে আসে। লিখতে লিখতে আমার মনে পড়ে এই যে এলোমেলো তারুণ্যে আমি নিজেকে নিয়ে একটা নির্মম পরীক্ষা করছি, তার অদূরে আমার শৈশব-কৈশোরে আমার মতই একটা একা ছেলে ঝিম দুপুরে বারান্দায় বসে সবুজ দেখছে। একটা বিশাল কড়ই গাছের সাথে আপনমনে কথা বলে নিজেই চমকে উঠছে। বৃষ্টি দেখে তার অজাগতিক অনুভূতি হচ্ছে। সে ভাবছে সবাইকে কেন বড় হয়ে একটা কিছু হতেই হবে। কেন কিছু না হয়েও একটা জীবন কাটিয়ে দেয়া যায় না!
আমি তখন কাগজে কলমে লিখি। লিখতে লিখতে অনভ্যস্ত হাতে আঁকিবুঁকি করি। রাজশাহী বি আই টিতে কাগজে কলমে ছাত্র। কিন্তু বহু আগেই একরোখা সিদ্ধান্ত নিয়েছি আমি গীতিকার হব, লেখক হব। একটা সহজিয়া জীবন কাটাব।
তার কিছু আগ দিয়েই সঞ্জীবদার সাথে আমার পরিচয় আর সখ্যতা হলো। আহ শুনে যে মানুষটার লিরিক আমাকে মোহগ্রস্ত করেছিল তার সাথে করমর্দন করে আমি আরো বোহেমিয়ান হয়ে গেলাম। সঞ্জীবদার মত হতে চাইলাম। কিন্তু আমরা আসলে কেউ কারো মতো হই না। হতে পারিও না। আমাদের সবার গন্তব্য আলাদা। আমরা আমাদের জন্য নির্ধারিত সময়ের কিছু অংশে এক একজনের সফরসঙ্গী হতে পারি কেবল।
বাপ্পা ভাই এর সাথে ততদিনে কিছু গান হয়ে গেছে। এক নিবিড় নির্ভরতা, ভরসার জায়গা তখন বাপ্পা ভাই। কত দিন-রাত সেই নীলা মেটার্নিটি গলির বাসায় আড্ডা। লেখা। বসে বসে বাপ্পা ভাই এর কম্পোজিশন এর শুরুটা দেখা। তারেক ভাই, মাসুম ভাই। টনি, মাঝে মাঝে জুলফি। সন্ধাবেলায় মৌচাক এর মিউজিকম্যান স্টুডিও। সেই বোধহয় স্টুডিওতে গান রেকর্ডের শেষ সময়কাল। তারপর আমরা সবাই সবাইকে বাসা বন্দী করে ফেললাম।
সবুজ যখন বোধ করি দলছুটের হৃদয়পুর অ্যালবামের শেষ রেকর্ড হওয়া গান। এখনও কানে ভাসে সঞ্জীবদা বলছেন- রানা, তোর গান গেয়ে এলাম। আমার খুব প্রিয় কম্পোজার বাপ্পা ভাইয়ের ব্লুজ ঘরানার খুব অন্যরকম একটা কম্পোজিশন শুনে আমি আবার ডুব দিলাম কোথাও। তার ঠিকানা আমি নিজেও জানিনা।
কত সময় পেরিয়ে গেছে তারপর? প্রায় দুই যুগ! ফিরে তাকালে চমকে উঠি। এইতো সেদিন! সঞ্জীবদা, বাপ্পা ভাই, রাসেল ও নীল, টনি, মাসুম ভাই, তারেক ভাই...জমজমাট আড্ডা। আমার ডায়রীতে লিখে রাখা লিরিক। একে একে হয়ে ওঠা গান। একটু একটু করে আমার গীতিকার হয়ে ওঠা। অথবা গীতিকার হবার সেই স্বপ্নকে আলিঙ্গন করা।
এই সব ছাপিয়ে সবুজ যখন আদতে আমার সবুজে মুগ্ধতা ধরে রাখা লিরিক। সূর্যের সাথে পাখির শীষ মিশে যাওয়া দিন। আলোর সাথে চাঁদের গদ্য লেখার মুহূর্ত।
আর একটা নিঃসঙ্গ মানুষের এলোমেলো পথ ধরে পথিক হয়ে ওঠার গল্প।
-------------------------------------
আজ তোমার মন খারাপ মেয়ে বই -থেকে
নতুন করে লেখা
ম্যানুস্ক্রিপ্ট
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই নভেম্বর, ২০২২ রাত ৯:৩৯