প্রিয় ডটকমের সম্পাদক জাকারিয়া স্বপনের সাম্প্রতিক কয়েকটি লেখায় অনলাইন লেখকদের জন্য প্রেরণার বিষয় আছে। লেখাগুলো একান্তই ব্লগ এবং অনলাইন লেখকদের নিয়ে। তিনি লেখকদেরকে আত্মপ্রকাশে আরও সাহসী হবার তাগিদ দিয়েছেন। একটি লেখায় তিনি আক্ষেপ করে বলেছেন, বাঙালি লেখক ও সংস্কৃতি কর্মীদের সাহস অনেক কমে গেছে। এর কারণও তিনি তুলে ধরেছেন: “আপনি যদি সরকারের কোনো কাজের প্রশংসা করেন, সেই মুহূর্তেই আপনি হয়ে গেলেন সরকারের দালাল।... ... আর যদি আপনি সরকারের কাজের সমালোচনা করেন, তাহলে পর মুহূর্তেই আপনি হয়ে গেলেন বিএনপি-জামায়াত গোষ্ঠীর মানুষ। কি সাংঘাতিক সরলীকরণ!” অনলাইন লেখককে এসব বাধা অতিক্রম করে চলতে হয়।
অন্য একটি লেখায় তিনি অনলাইন লেখকদের ছদ্মনাম ব্যবহারের বিপক্ষে মত দিয়েছেন। তার বক্তব্য হলো সত্যই যদি বলবো, তবে নিজের নাম লুকিয়ে কেন? নিজের নামে আত্মপ্রকাশের প্রতি ব্যক্তিগত দুর্বলতা দেখিয়ে তিনি বলতে চেয়েছেন যে, ভালো কাজের কৃতীত্ব নেবার অধিকার লেখকের আছে। জাকারিয়া স্বপন ছাত্রজীবন থেকেই বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় লেখে চলেছেন এবং দেশের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক প্রকাশনায় তার রয়েছে বিশাল অবদান।
ব্লগপোস্ট আর পত্রিকার কলামের মধ্যে পার্থক্যটুকু দিনে দিনে ক্ষীণ হয়ে আসছে। একটা সময়ে বাংলা ব্লগ ছিল আদর্শবাদীদের স্বর্গস্থান! রাজনৈতিক, বুদ্ধিবৃত্তিক, ইতিহাসভিত্তিক আর অধিকার বিষয়ক লেখায় সরগরম থাকতো বাংলা ব্লগ। প্রবন্ধ বলুন আর সাহিত্য বলুন সবকিছুতে থাকতো মুক্তচিন্তা ও আদর্শবাদের কথা। থাকতো গবেষণাধর্মী মেগাপোস্ট। পাঠকেরা মন্তব্যের ঘরে বলতো ‘আগুন পোস্ট!’। কারণ যা-ই হোক, সেই প্রাণের উচ্ছ্বাস আর বাংলা ব্লগে দেখা যায় না।
বাংলা ব্লগ যেন অবসর যাপনের মাধ্যম হয়ে গেছে। যারা কর্মজীবন থেকে বিরতি নিয়েছেন, তারা তো বিশ্রামকামী। প্রবন্ধ ও সাহিত্য রচনায় তাদের প্রজ্ঞাদীপ্ত অবদানকে স্বীকার করেই বলছি, তারা সাহিত্য সৃষ্টি করুন। কিন্তু ব্লগের প্রাণ ফিরিয়ে আনার জন্য নবীন ও তরুণ ব্লগারদের অংশগ্রহণ জরুরি।
বাংলা ব্লগের সপ্তম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী ফিরে এসেছে। উনিশে ডিসেম্বর বাংলা ভাষাভাষী অনলাইন লেখকদের একটি বিশেষ দিন, কেননা ইন্টারনেটে লেখালেখি ও আত্মপ্রকাশের এই সুযোগগুলো হঠাৎ করে আসে নি। এর একটি শুরু ছিল। একটি উপলক্ষ্য ছিল। একটি প্লাটফরমের প্রয়োজন ছিল, যেখানে বাংলায় লেখা যাবে পৃথিবীর যেকোন প্রান্ত থেকে; যেকোন ওএস দিয়ে। ২০০৫ সালের ডিসেম্বরে সামহোয়্যারইন ব্লগের প্রতিষ্ঠার সাথে শুরু হয় বাংলা ভাষায় ব্লগ লেখার সুযোগ এবং শুরু হয় মাতৃভাষায় মত প্রকাশের নতুন যুগ।
বিজয় কিবোর্ড দিয়ে ইউনিকোডে লেখা তখনও চালু হয় নি। পরে বিজয় কিবোর্ডে ইউনিকোডে বাংলা চালু হলেও, অধিকাংশ প্রবাসী বাঙালির কাছে সে-সুযোগ অধরাই থেকে গেলো। ফলে অনেক ব্লগার সামহোয়্যারইনে লেখে সেটি তাদের ফেইসবুক বা অন্য কোন মাধ্যমে প্রকাশ করতেন। এখনও অনেকের এই অভ্যাস রয়ে গেছে। এভাবে সামহোয়্যারইন ব্লগ শুধুই বাংলাদেশের প্রথম ব্লগসাইট অথবা বিশ্বের সর্ববৃহৎ কমিউনিটি ব্লগ নয়, একটি বৈপ্লবিক পরিবর্তনেরও অনুঘটক হলো। তারপরের সবই ইতিহাস!
শহর বন্দর গ্রামের, স্বদেশের ও বিদেশের সকল বাঙালি এক হতে শুরু করলো বাংলা ভাষার নামে। এ যেন আরেক বায়ান্ন! মাতৃভাষাকে ইন্টারনেটে প্রতিষ্ঠার বায়ান্ন।
স্বাধীনতার ইতিহাস, রাজনৈতিক সমস্যার বিশ্লেষণ, আন্দোলনের খবর, সামাজিক সমস্যা, এসিড সন্ত্রাস, শিশু ও নারী অধিকার, বীরাঙ্গনার অধিকার, যোদ্ধাপরাধের বিচার, জলবায়ু পরিবর্তন, জঙ্গীবাদ ও এর সমাধান ইত্যাদি ইস্যুতে সরব হতে থাকলো বাংলা ব্লগ।
অন্যদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যাচের মতো দু’তিন বছর পর পর বদল হতে থাকলো ব্লগারদের গোষ্ঠিবদ্ধ পদচারণা। কেউ অভিমানে, কেউবা জীবিকার তাগিদে ব্লগ ছাড়লেন। অন্যদিকে ক্রমাগত লেখতে লেখতে যারা একটি পর্যায়ে পৌঁছে গেছেন, তারা থেকেই থেকে গেলেন। কেউ কেউ বছর কয়েক যাবার পর ফিরে আসেন আরও কিছুদিনের জন্য, আরও কিছু মনের কথা প্রকাশের জন্য। কতিপয় ব্লগার আছেন, যারা বছরের পর বছর ধরে একই গতিতে লেখে যাচ্ছেন, আর মন্তব্য দিয়ে যাচ্ছেন সহযাত্রী ব্লগারদের লেখায়। তাতে তারা নিজেরা যেমন মুন্সিয়ানা অর্জন করছেন, তেমনি সৃষ্টি করছেন সৃজনশীল একটি লেখক সম্প্রদায়।
আত্মপ্রকাশ সামাজিক যোগাযোগ নাগরিক সাংবাদিকতা আদর্শবাদিতা আর নিজ ভাষায় সাহিত্য চর্চার সুযোগ নিয়ে এব্লগ থেকে গড়ে ওঠেছেন অনেক লেখক সাংবাদিক সমাজসেবক ও সেলিব্রিটি ব্লগার। কেউ কেউ পরবর্তিতে নিজেদের পেশাজীবী জীবনেও ব্লগের কথা ভুলতে পারছেন না।
ইন্টারনেটে আজ বাংলা ব্লগসাইটের সংখ্যা প্রায় অগুণতি। ব্যক্তিগত ব্লগ নয়, পাবলিক ব্লগের কথাই বলছি। বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, শিক্ষাদান, ক্রীড়া, সাহিত্য, রাজনীতি, প্রত্নতত্ত্ব, লাইফস্টাইল ইত্যাদি বিষয়ে বাংলা কনটেন্ট গড়ে ওঠেছে। গুগল সার্চ দিলে বাংলা ভাষায় শত সহস্র ব্লগ পোস্ট পাওয়া যাবে।
ইন্টারনেটে এই সুবিস্তৃত বাঙলায়নে সামহোয়্যারইনকেই অগ্রপথিক বলতে হয়, কারণ বাংলা ভাষায় ব্লগ কনটেন্ট তৈরির এ ধারণা তারাই সৃষ্টি করেছেন। আমরা কিছুদিন দেখেছি, ব্লগাররা তাদের কনটেন্ট তৈরিতে উইকিপিডিয়ার সাহায্য নিতে। এখনও নেন। কিন্তু বাংলা ভাষার উইকি কনটেন্ট তৈরিতে সামহোয়্যারইনও একটি উৎস হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। বাংলা উইকিপিডিয়ার মাত্র কয়েকটি নিবন্ধ দেখলেই বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে যাবে।
কথা হলো, প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে কী করা যায়? প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী মানেই যে মিটিংমিছিল হইহুল্লা করতে হবে, সকলের ক্ষেত্রে তা কিন্তু নয়। বন্যেরা বনে সুন্দর ব্লগাররা ব্লগে! ব্লগাররা ব্লগ লেখেই বাংলা ব্লগের প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীকে উদযাপন করবেন, এটিই স্বাভাবিক। এই স্বাভাবিক কাজটিই করে যাবার জন্য আমি সুপ্রিয় সহব্লগারদেরকে মনে করিয়ে দিলাম। পোস্টার নয়, ব্যানার নয়, লেখাই হোক ব্লগ দিবসের ওয়ে অভ্ সেলিব্রেশন!
সপ্তম বাংলা ব্লগ দিবস এবং সামহোয়্যারইনের প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী উপলক্ষ্যে সকল বাংলাভাষী ব্লগারকে এবং সামহোয়্যারইন টিমকে জানাচ্ছি আন্তরিক অভিবাদন ও কৃতজ্ঞতা। আপনারা সকলে মিলে একটি সুবিশাল তথ্য সাম্রাজ্য গড়ে তোলেছেন ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য। একটি বিশাল কাজ!!!
(সেই সাথে নিজের বর্ষপূর্তিতে ‘আমাকেও’ জানাই আন্তরিক অভিনন্দন। কোন সৃজনশীল কাজে লেগে থাকার ‘গর্বে আমি গর্বিত’! এজন্যেই অভিনন্দন জানাই, কারণ তারপরও চাকরিটি বহাল আছে! ‘বেলা বোসও’ সঙ্গেই আছেন!)
------------
এমন একটি মূল্যবান ছবি একবছর পরে হলেও যথাযোগ্য মর্যাদায় প্রদর্শন করতে পেরে আমি আনন্দিত। ম্যারুন রঙের পাঞ্জাবিতে ষষ্ঠ ব্লগ দিবসের পোস্টারের কারিগর সাদমান রহমানকে কেবল চিনতে পারলাম!
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই ডিসেম্বর, ২০১৫ বিকাল ৫:৪৮