১)
রাতের নির্জনতায় অথবা অফিসের ব্যস্ততায় হুট করে একটি বার্তা এসে হাজির। আপনি হয়তো ভাবলেন বুঝি আপনার আপন কেউ আপনার খবর নিচ্ছে। কিন্তু না। ‘দারুণ অফার’ নামক নতুন আরেকটি অনাকাঙ্ক্ষিত মেসেজ। ছুটির দিন দুপুরের আহারশেষে আয়েশ করে একটি বৈকালিক ঘুম দিলেন, কিন্তু তা আর হয়ে ওঠলো কই? ‘দারুণ অফার’ এসে হাজির! একটি প্রতিষ্ঠিত ও স্বনামধন্য মোবাইল ফোন অপারেটর তাদের প্রোমোশনাল আইটেমগুলো নিয়ে এমন জ্বালা-যন্ত্রণা শুরু করেছে যে, সেটি স্বাভাবিক জীবনকে অস্বস্তিতে ফেলছে। আগে তারা শুধু বার্তাতেই সীমাবদ্ধ থাকতো, কিন্তু এবার কল করতে শুরু করেছে। অসহায় গ্রাহক তখন কী করবেন?
দেশের সুপারশপগুলো শুরু করেছে সুপার বাটপারি। মনে করুন, ৫৪৪ টাকার বিল হয়েছে। সেক্ষেত্রে আপনাকে ৫৪৫ টাকা দিতে হবে, কারণ তাদের কাছে ১টাকা চেইন্জ নেই! কিছুদিন তারা ক্রেতাকে ১টাকা দামের চকলেট খেতে বাধ্য করেছে, এবার সেটিও আর করছে না। ৫৫০ টাকা দিলে বিনাবাক্যে ৫টাকা দিয়ে তারা পরবর্তি ক্রেতার দিকে মনযোগ দেয়। এটি তো গেলো দৃশ্যমান প্রতারণা। ধরুণ আপনার বিল হয়েছে ৫৪৭.২৫ টাকা। তবে কি তারা আপনাকে পৌনে তিন টাকা ফেরত দেবে? বড়জোড় ২টাকা পেতে পারেন। এভাবে তারা ক্রেতাকে ঠকিয়ে হাজার হাজার টাকা অতিরিক্ত আদায় করছে। কেউ কি হিসাব করেছে? তাছাড়া, পণ্যের কোয়ালিটির কথা বাদই দিলাম। তো এসব ক্ষেত্রে ভোক্তার কত সময় আছে, পঁচাত্তর পয়সার জন্য বিশাল বড় সুপারশপগুলোর সাথে বাদানুবাদে যাবার?
ফাস্টফুড রেস্তোরাঁগুলোতেও একই দশা। চারশ’ টাকা দিয়ে একটি বার্গার অর্ডার করে দেখবেন, সেখানে চিজ (পনির) নেই। কেন নেই? কারণ আপনি তা দিতে বলেন নি। পনির দেবার জন্য এক্সট্রা আরও হয়তো ৪০/৫০ টাকা যোগ করতে হবে। খাবারের মান নিয়ে কথা বলবেন? তাদের চাকচিক্য দেখে কি কখনও সন্দেহ হবে যে, তারা মৃত মুরগির মাংসকে হার্বাল স্পাইস মিশিয়ে ফ্রাই করে আপনাকে খাইয়েছে? নিশ্চিত হলেও তা বলার পরিবেশ আপনি পাবেন না, কারণ আপনি একা।
এ প্রসঙ্গে দেশের শিক্ষা বা চিকিৎসা সেবা নিয়ে কিছু বলার প্রয়োজন আছে কি? চিকিৎসার সেবার অব্যবস্থা নিয়ে কথা বললে আরব্যরজনীর মতো শেষ হবার নয়। এখানেও স্বল্পবিত্তরা নিতান্তই একা আর অসহায়। উচ্চবিত্তদের জন্য দেশীয় চিকিৎসার দরকারই নেই!
ফলে খাদ্য, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ইত্যাদি মৌলিক অধিকারগুলোর জন্য টাকা খরচ করেও ভোক্তা বঞ্চিত হচ্ছে। এভাবে ভোক্তাবাজারের বিভিন্ন সেবাখাত থেকে শোষণ, বঞ্চণা ও প্রতারণা চলছে হরিলুট কায়দায়। শোষকেরা এখানে ঐক্যবদ্ধ, শোষিতরা নানা ধারায় বিভক্ত।
পুঁজিবাদি সমাজে একটি মুনাফাখোর শোষক শ্রেণী গড়ে ওঠে এবং ওঠেছে। তারা দৈত্যের ন্যায় শক্তিশালী কারণ শাসকশ্রেণীও একই স্বার্থে তাদের সাথে ঐক্যবদ্ধ। মাঝে মাঝে শাসকেরা খুবই সূক্ষভাবে আইওয়াশ করেন অবশ্য। কিন্তু সকলেরই উদ্দেশ্য যেকোনভাবে লাভবান হওয়া। বিজনেস এথিক্স এখানে অনুপস্থিত। কোথাও কোন নিয়ন্ত্রণ নেই, নেই কোন আইনের প্রয়োগ। বিখ্যাত এবং আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ডগুলোও এই লাগামহীন বাজারের সুবিধা নিচ্ছে, কারণ এখানে তাদের ভালো থাকার বাধ্যবাদকতা নেই। অন্যদিকে শোষিতরা নিরব! কী করবে তারা? নিম্নবিত্ত বা মধ্যবিত্ত ভোক্তাশ্রেণীর তো কোনই ক্ষমতা নেই। মাঝেমাঝে ভোক্তার অধিকার বলে শুধুই চিৎকার করি, যা কোন কাজে আসে না।
মোদ্দাকথা হলো, ভোক্তারা নিজেদের মতামতকে কার্যকরভাবে প্রকাশ না করলে, তাদের অসহায়ত্ব সম্পর্কে কোন ধারণা সৃষ্টি হয় না। ভোক্তার আহাজারি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কানে পৌঁছায় না, পরিস্থিতিরও উন্নয়ন হয় না।
২)
গত বছর কোরিয়া বেড়াতে গিয়েছিলাম। সপ্তাহ দুই বেড়ানোর পর ফেরার পথে সঙ্গত কারণেই লাগেজটা মোটা হয়ে গেলো! উপায় না দেখে আরেকটি লাগেজ কিনতে বাধ্য হলাম। কিন্তু বিমানে ওঠার পূর্বের রাতে দেখা গেলো যে, লাগেজটির একপাশের সেলাই ঢোলা হয়ে গেছে। মহাফ্যাসাদে পড়লাম! এখন তো আর কেনার সময় নেই, বদলাবারও সুযোগ নেই! কিন্তু আমার সফরসঙ্গীকে ততটা চিন্তিত হতে দেখলাম না। কিছুক্ষণ পর আমাকে জানানো হলো যে, লাগেজের দোকান থেকে নতুন একটি লাগেজ ২০মিনিটের মধ্যেই বাসায় পৌঁছাবে। সত্যিই তাই হলো! তারা বাতিলকৃত লাগেজটি নিতে চাইলেন না, দেখতেও চাইলেন না, বরং দুঃখ প্রকাশ করলেন। আমি তো বিস্ময়ে হতবাক!
আমাদের দেশে হলে তো এই সমস্যার দায়িত্বই দোকানদার মাথায় নিতো না। অবিলম্বে আমি এই যাদুর মাজেজা জানার জন্য ওঠেপড়ে লাগলাম। আমার সফরসঙ্গী জানালেন যে, এখানে ইন্টারনেট কমিউনিটি খুবই প্রভাবশালী। প্রসঙ্গত, ইন্টারনেট ব্যবহারে (internet penetration) কোরিয়ানরা পৃথিবীর শীর্ষে। কোন কোম্পানি/পণ্য সম্পর্কে কোন ভোক্তা যদি নেতিবাচক কোন অভিমত প্রকাশ করে, তবে কয়েক মিনিটের মধ্যে তা হাজার হাজার ভোক্তার মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। পরদিন সকাল হতে হতেই কোম্পানিতে লালবাত্তি!
আমরা তো দিনভর ফেইসবুক দিয়ে ইন্টারনেট চালাই আর পণ্যের নিম্নমান নিয়ে মুখেমুখেই চিল্লাবিল্লা করি। ছবিসহ দু’টি লাইন লেখে দিলেই কিন্তু সংশ্লিষ্ট কোম্পানির টনক নড়বে। সেটা করি না – ব্যস্ত থাকি সেল্ফি আর কাউফিতে। আইন বলুন আর সরকার বলুন, না কাঁদলে আপন মাতাই দুগ্ধ দেয় না!
একটি অনলাইন নিউজ পোর্টাল সম্প্রতি ‘রিভিউ’ নামে একটি বিভাগ খুলেছে। সেখানে মূলত বিভিন্ন ব্র্যান্ড নিয়ে ইতিবাচক গুণকীর্তন করা হয়। তবু কোন ভোক্তা সেখানে তার নিজের অভিমতটি প্রকাশ করতে পারেন। তাছাড়া, ব্লগে, ফেইসবুকে অথবা টুইটারে প্রকাশ করতে পারেন নির্দিষ্ট সেবা/পণ্য সম্পর্কে ভোক্তার অভিজ্ঞতা। তাতে প্রতারিত/সংক্ষুব্ধ ভোক্তাদের মধ্যে একতা বৃদ্ধি পাবে, সে সাথে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানও সচেতন হতে বাধ্য হবে।
পণ্য বা সেবার বাস্তব ও অভিজ্ঞতাভিত্তিক রিভিউ লেখে আমরা সমাজের অসামান্য উপকার সাধন করতে পারি:
• প্রফেশনাল রিভিউ: পেশাদার মূল্যায়ন। আমরা নির্দিষ্ট কোন ব্র্যান্ডের ব্যবহারিক অভিজ্ঞতা তুলে ধরতে পারি। সঙ্গে থাকবে ইতিবাচক ও নেতিবাচক বিষয়ের সুসমন্বয়। দামের সাথে উপযোগিতার তুলনা। এটি সংশ্লিষ্ট কোম্পানির জন্য মহামূল্যবান নির্দেশনা হতে পারে। নিজের পরিচিত পণ্য দিয়েই শুরু করা যায় রিভিউ। উচ্চাকাঙ্ক্ষী ব্র্যান্ডগুলো এসব মূল্যায়নকে খুবই গুরুত্ব দেয়। একসময় উচ্চমূল্যে বিক্রি হতে পারে একটি রিভিউ।
• কনজিউমার রিভিউ: ভোক্তার অভিমত। এর আরেক নাম হতে পারে, তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া। এটি পেশাদার অথবা ভারসাম্যপূর্ণ হবার বাধ্যবাদকতা নেই। ভোক্তা যখন-তখন একটি রিভিউ লেখে তা নিজের ফেইসবুকে/ব্লগে/টুইটারে প্রকাশ করতে পারেন। তাতে কিছু কাজও হবে, ক্ষোভও প্রশমিত হবে। একপেশে বা আবেগাক্রান্ত না হলে সেটি বেশি ফলদায়ক হবে। যুক্তি এবং প্রমাণনির্ভর হলে সেটি কাঙ্ক্ষিত সুফল নিয়ে আসবে। ছবি থাকলে তো কথাই নেই!
ব্লগিং-এর একটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্য হলো, নাগরিক সাংবাদিকতা, যা আউট-অভ্-ফোকাস ও অবহেলিত মানুষের অধিকারের কথা বলে। আমি মনে করি, ব্লগারদের নৈতিক দায়িত্ব আছে দেশের অসহায় ভোক্তাদের পক্ষে কথা বলার। তারা নিজেরাও তো একেকজন ভোক্তা। বাস বলুন আর রিক্শা বলুন, কাঁচাবাজার বলুন আর শেয়ার বাজার বলুন – ভোক্তার চেয়ে অসহায় আর কে আছে!
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে অক্টোবর, ২০১৫ ভোর ৬:৫০