ট্রেন একটা ছোট স্টেশনে থেমেছে‚ দীপ্ত উঠে দাড়াল। ব্যাগ হাতে নিয়ে নেমে পড়ার পায়তারা করতেই পাশে বসা ভদ্রলোক দ্বিধান্বিত গলায় জিজ্ঞেস করল‚ "আপনি এখানে নামবেন? এই স্টেশনে তো কুলি মজুর ছাড়া অন্য মানুষ তেমন নামে না।"
"হ্যা‚ এখানে নামব।"
"আপনার বাড়ি কি এই গ্রামে?"
"না।"
ভদ্রলোককে আর কিছু জিজ্ঞেস করার সুযোগ না দিয়েই দীপ্ত নেমে এলো স্টেশনে।
পুরনো‚ ভাঙা একটা স্টেশন। কেউ একজন স্টেশনের ভেতর গরু বেঁধে রেখেছে। গরুর আশেপাশে খড় ছড়িয়ে রাখা‚ ছোপ ছোপ গোবর সেখানে।
স্টেশনটা পেরিয়ে দীপ্ত একটা ছোট মেঠো পথে উঠে এলো। খুবই সংকীর্ণ একটা রাস্তা। দু' ধারে উঁচু উঁচু সুপারি গাছ। হলুদ-সবুজ রঙের সুপারি ঝুলছে গাছগুলোতে। রাস্তার এক পাশে ধানক্ষেত‚ আরেক পাশে ঝোপঝাড় এবং কয়েকটা ছোট-বড় পুকুর। পুকুরগুলোও অদ্ভুদ সুন্দর‚ এখানে সেখানে শাপলা জন্মেছে‚ আশেপাশের গাছগুলো হতে নানা রঙের ঝরাপাতা পড়ে ছেঁয়ে গেছে পুকুরের পানি‚ অদ্ভুত রঙের বর্ণালি সৃষ্টি হয়েছে।
লুঙ্গী আর সাদা গেঞ্জী পরা একজন মানুষ হাতে বাঁকানো কাস্তে নিয়ে ধান কাটছিল‚ থমকে গেল ওকে দেখে। এই গ্রামে শহুরে জামা-কাপড় পরা মানুষ তেমন আসে না। লোকটা দীপ্তর গম্ভীর মুখ দেখে ইতস্ততঃ ভাবে প্রশ্ন করল-
"আপনে কোন বাড়ি যাইবেন ভাই?"
দীপ্ত নির্লিপ্ত গলায় উত্তর দেয়- "কোন বাড়িতে যাব না।"
"তাইলে কই যাইবেন?"
"এই গ্রামে একটা মন্দির আছে শুনেছি‚ দু'শো বছরের পুরনো। সেটা কোথায় বলতে পারেন?"
"সেইটা তো গ্রামের উত্তর দিকে‚ শেষ মাথায়। একটা বড় জঙ্গল আছে‚ তার মইধ্যে।"
"ধন্যবাদ।"
"আফনে কি মন্দিরে যাইবেন? ওইখানে এক পাগলা মেয়েছেলে থাহে। পিশাচ মেয়েছেলে। ওইখানে যাওয়া তো ভাই নিরাপদ না। সন্ধ্যা হইলে মেয়েছেলেডার উপর পিশাচ ভর করে‚ হ্যায় নাকি মানুষও খায়।"
"ও।"
"আফনে কোথথেইকা আইছেন ভাই?"
"ঢাকা হতে।"
"ঐ মন্দিরে কি কাম আফনের?"
দীপ্ত দীর্ঘশ্বাস ফেলল। গ্রামের মানুষ কত সহজে প্রশ্ন করে ফেলতে পারে। কোন ইতস্ততঃ বোধ নেই‚ শহুরে অভিনয় নেই‚ ভদ্রতাবোধও নেই অবশ্য।
দীপ্ত জবাব না দিয়ে হাটতে লাগল মেঠোপথটা ধরে। লোকটা চোখ গোল গোল করে তাকিয়ে রইল।
কিছুদূর আসতেই গ্রামের রাস্তাটা তিন ভাগে ভাগ হয়ে গেল। মন্দিরে যেতে হলে উত্তরের রাস্তা ধরতে হবে। পকেট থেকে এনড্রয়েড ফোনটা বের করে মুহূর্তেই ও বের করে ফেলল কোন দিকটা উত্তর। তারপর উত্তর দিকের রাস্তাটা ধরে এগোতে লাগল।
এই পথটা আগের মতো সংকীর্ণ নয়‚ বেশ প্রশস্ত। মানুষজন আসা যাওয়া করছে। সাইকেল এবং ভ্যানগাড়িও দেখা গেল কয়েকটা। সব মানুষই দীপ্তকে দেখে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ ড্যাব ড্যাব করে। কেউ কেউ প্রশ্ন করতে গিয়েও কি মনে আর করে না।
গ্রামটা ছোট নয়‚ দু' কিলোমিটার রাস্তা পেরোনোর পর ওর হাঁফ ধরে গেল। একটা ছোট চায়ের দোকান দেখতে পেয়ে বসে পড়ল সেখানে। ব্যাগ থেকে পানি বের করে ঢঁক ঢঁক করে খেল।
কয়েক জন মানুষ বসে ছিল চায়ের দোকানে‚ অন্যদের মতো তারাও দীপ্তকে লক্ষ্য করছিল বেশ কৌতূহল নিয়ে। একজন জিজ্ঞেস করে বসল-
"ভাই‚ আফনে চেয়ারম্যান সাহেবের মেহমান?"
দীপ্ত তার দিকে না তাকিয়েই জবাব দিল-"না।"
"তাইলে কি আফনে মজুমদার বাড়ির জামাই?"
"না।"
"তাইলে‚ যাইবেন কই?"
"এই গ্রামে যে পুরনো মন্দিরটা আছে‚ সেখানে।"
লোকটা আঁতকে ওঠার মতো শব্দ করে বলল- "খাইছে! ওইখানে পিশাচ পাগলী থাহে। ওইখানে কি কাম ভাই আপনার?"
দীপ্ত জবাব দিল না। লোকটা তখন রসিয়ে রসিয়ে পিশাচ মেয়েটার গল্প বলতে লাগল। পিশাচ মেয়েটা মন্দিরে থাকে। তাকে মাঝে মাঝে কবরস্থানে দেখা যায়। কবর খুঁড়ে খুঁড়ে লাশ খেতে দেখেছে তাকে অনেকে। অবস্থা নাকি এমন হয়েছে যে কেউ মারা গেলে তার কবর কয়েক দিন ধরে পাহাড়া দিতে হয় অন্যদের।
এসব গল্পের কোন প্রভাব দীপ্তর উপর পড়ল না। সে চুপচাপ শুনে গেল। তারপর উঠে দাড়িয়ে হাটা ধরল জঙ্গলের পথে। কৌতূহলী কিছু মানুষ পিছু নিলেও কিছুদূর পর জঙ্গল শুরু হতেই থমকে গেল। কারণ বিকেল গড়িয়েছে। একটু পরই সন্ধ্যা নামবে। অন্ধকারে পিশাচের মুখোমুখি হতে চায় না কেউ।
বিকেলের আলো পড়ে এসেছে‚ অন্ধকার নেমেছে একটু একটু। এই স্বল্প আলোতেই দীপ্ত জঙ্গলের ভেতর ঢুকে পড়ল।
জঙ্গলটা বেশ ঘন‚ বয়স্ক গাছগুলো বেশ উঁচু উঁচু। জঙ্গলের ভেতর অনেক রকম শব্দ হবার কথা; পাখির ডাক‚ পশুর ডাক‚ কীটপতঙ্গের ডাক‚ পাতা ঝরার শব্দ‚ আরো নানান ধরনের গুমোট এবং চাপা শব্দ পাওয়া যায় যে কোন জঙ্গলে। এ জঙ্গলে তেমন কোন শব্দ নেই। নিস্তব্ধতাটুকু কানের উপর বড় চেপে বসে।
দীপ্ত সতর্ক পায়ে হাটতে লাগল আশেপাশে তীক্ষ্ণ নজর রেখে। গুগল ম্যাপ বলছে মন্দিরটা বেশি দূরে নয়‚ তিনশো মিটারের মধ্যেই আছে।
কিছুক্ষণের মধ্যেই পুরনো মন্দিরটা চোখে পড়ল ওর। লাল রঙা ইট দিয়ে তৈরি‚ বেশিরভাগ ইটই খসে পড়েছে অবশ্য। শ্যাওলা ধরেছে দেয়ালে‚ বুনো লতাপাতায় ছেয়ে গেছে। গা ছমছম করতে লাগল দীপ্তর।
মন্দিরের দরজাটা বেশ ছোট‚ এক সাথে একজনই ঢুকতে পারবে এমন করে বানানো। পায়ে পায়ে ভিতরে ঢুকল দীপ্ত। ঢুকতেই তীব্র মাংস পঁচা গন্ধ এসে ঝাপটা মারল ওর নাকে। নাড়িভুড়ি উল্টে আসার যোগাড়। নাকে হাত চাপা দিয়ে সে ঢুকে পড়ল ভেতরে।
মাঝারি সাইজের একটা কামড়া প্রথমে। দেয়ালে খোদাই করা কিছু দেবদেবীর ছবি। আবছা আলোতে ভয়ংকর দেখাচ্ছে ছবিগুলো। মনে হচ্ছে এক্ষুণি দেয়াল ফুঁড়ে বেরিয়ে আসবে।
পরের কামরায় গিয়ে চমকে উঠল দীপ্ত। ওর নার্ভ যথেষ্ঠ শক্ত। তাছাড়া ভয়ংকর কিছু দেখার মানসিক প্রস্তুতি নিয়েই এসেছে‚ তারপরও গা হিম হয়ে এল ভয়ে। গলগল করে বমি করে দিল।
পুরো কামরা ভর্তি মানুষের শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ প্রত্যঙ্গ কেটে রাখা। হাত‚ পা‚ উরু‚ বুক‚ পেট‚ আরো অনেক কিছু। বেশিরভাগেই পঁচন ধরেছে। বাজে‚ গা গুলানো গন্ধে ভারী হয়ে আছে আকাশ বাতাস।
দ্রুত বের হয়ে এলো ও মন্দির থেকে। এক ছুটে বেশ খানিকটা দূর চলে এলো। হাঁপাতে লাগল। ফিরে যাবে কি না ভাবল একবার‚ পরক্ষণেই মাথা নাড়ল; এতদূর এসে কাজ শেষ না করে ফিরে যাবার কোন অর্থ হয় না।
হঠাৎ-ই তাকে দেখতে পেল দীপ্ত! মন্দিরের সামনে একটা দীঘি‚ দীঘির ঘাট বাঁধানো‚ সেই বাঁধানো ঘাটের উপর পানিতে পা ডুবিয়ে বসে আছে মহিলাটি।
ফর্সা‚ স্বাস্থ্যবতী একজন মহিলা। বয়স ৩০-৩৫ হতে পারে। গায়ে উলোঝুলো ভাবে জড়ানো একটা বেসামাল শাড়ি‚ ব্লাউজও নেই। চুলগুলো কোঁকড়া‚ অপরিপাটি করে পিঠের উপর ছড়ানো। মহিলার পাশে একটা রাম দা রাখা‚ দায়ের গায়ে টকটকে রক্ত লেগে আছে। তার চোখের দৃষ্টিও অস্বাভাবিক; সামনে তাকিয়ে আছে ঠিকই‚ কিন্তু কিছু দেখছে বলে মনে হচ্ছে না। একটু একটু দুলছে তার শরীর‚ মনে হচ্ছে উপাসনা করছে কারো।
বুকে অনেক সাহস জড়ো করে অপ্রকৃতস্থ‚ অস্বাভাবিক মহিলাটিকে ডাক দিল দীপ্ত-
"এই যে‚ শুনছেন?"
মহিলাটি অসম্ভব ক্ষীপ্রতা নিয়ে তাকাল দীপ্তের দিকে। দাঁত-মুখ খিঁচে চিৎকার করে বলল-
"খানকীর পোলা‚ মাগীর পোলা‚ তোরে আইজকা...."
বলেই দা নিয়ে তেড়ে এলো ওর দিকে। দীপ্তর অন্তরাত্মা শুকিয়ে গেলেও সবটুকু মনোবল এক করে চুপচাপ দাড়িয়ে রইল সেখানে। মহিলাটা কাছে আসতেই বলল-
"আমি আপনাকে চিনতে পেরেছি মিসেস বোস‚ অভিনয় করে লাভ নেই!"
মহিলা থমকে গেল‚ তারপরই ভেঙে পড়ল অদম্য কান্নায়। কাঁদতে কাঁদতে দা ফেলে দিয়ে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল মাটিতে। দীপ্ত চুপচাপ দড়িয়ে থেকে তাকে কাঁদতে দিল। কিছুক্ষণ পর কিছুটা ধাতস্থ হতে বলল‚
" মিসেস বোস‚ আমি দীপ্ত‚ ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি নিয়ে পড়ছি। আপনার ছোট বোন আমার সহপাঠী। আপনার সবসরকম চিকিৎসার ব্যবস্থা আমি করে রেখেছি। বেশ কিছু মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞের সঙ্গে কথা বলে রেখেছি। আপনি আমার সঙ্গে ঢাকায় চলুন প্লীজ!"
মহিলাটি‚ কিংবা মিসেস বোস ভাঙা গলায় জিজ্ঞেস করল-"আমার কি চিকিৎসা সম্ভব?"
"অবশ্যই সম্ভব। আমি সব ব্যবস্থা করেই রেখেছি। ডক্টর জিব্রান আহমেদের নাম শুনেছেন? মস্ত বড় সাইকিয়াট্রিস্ট‚ তিনি রাজি হয়েছেন আপনার কেসটা নিতে। আপনি চলুন মিসেস বোস‚ আপনার পরিবার আপনাকে অনেক খুঁজেছে‚ আপনাকে তাদের দরকার।"
মিসেস বোস চুপ করে রইল‚ কিছুক্ষণ গুম মেরে থেকে বলল-
"দীপ্ত‚ তুমি আমার সম্পর্কে সব জানো?"
"কিছুটা জানি‚ বাকীটুকু অনুমান করে নিতে পারি।"
"কি জানো?"
"বলছি সংক্ষেপে‚ শুনুন। ছ'মাস আগে ঢাকায় যে ভূমিকম্প হয়েছিল‚ তাতে আপনাদের পুরো বিল্ডিংটা ধবসে পড়েছিল। আপনার স্বামী এবং একমাত্র সন্তান দু'জনই মারা যারা যায় সে ঘটনায়। আপনি বিল্ডিং এর নিচে চাপা পড়েছিলেন পুরো আট দিন। আপনাকে জীবিত ফিরে পাবার আশা সবাই ছেড়েই দিয়েছিল। পানি‚ খাবার ছাড়া এতদিন আপনার বাঁচার কথা না। তারপরও আপনি বেঁচে ছিলেন‚ আপনার দু'জন প্রতিবেশীর মৃতদেহ খেয়ে। আপনাকে উদ্ধার করা হলো‚ কিন্তু ক্যানিব্যালিজম পেয়ে বসল আপনাকে। স্বামী সন্তান হারিয়ে আপনি একদিক থেকে দিশেহারা এবং বিপর্যস্ত‚ তার উপর দু'জন মানুষ খেয়ে আপনার উপর তখন মানুষ খাবার নেশা চড়েছিল। স্বাস্থ্যবান মানুষ দেখলেই আপনার জীভে জল চলে আসত‚ অবশেষে থাকতে না পেয়ে আপনি সভ্য সমাজ ছেড়ে এই জঙ্গলে চলে এলেন।"
মিসেস বোস ভাঙা গলায় বলল-"হ্যা। ঠিক বলেছ। সেই ঘটনার পর নিজের উপর আর নিয়ন্ত্রণ ছিল না। পরিচিত মানুষদের শরীরের প্রতিও যখন লোভ এসে গেল‚ তখন বাধ্য হয়ে চলে আসতে হলো এই জঙ্গলে। কিন্তু তুমি আমায় খুঁজে পেলে কি করে?"
"এই গ্রামে এক মেয়ে পিশাচের আবির্ভাব হয়েছে বলে শোনা যায় ঈদানিং‚ ঢাকা থেকে খুব দূরেও নয় জায়গাটা‚ তাই সন্দেহ হলো। আপনাকে অনেক জায়গায় খুঁজেছি। এ জায়গাটাতেও একই কারণে আসা।"
মিসেস বোস আবারো ভেঙে পড়ল অদম্য কান্নায়। দীপ্ত এবারো তাকে কাঁদতে দিল। পকেট থেকে ফোন বের করে কল দিল ঢাকায়‚ আজকের ঘটনা জানানো দরকার।
ততোক্ষণে সন্ধ্যা নেমেছে‚ আলো ফুরিয়ে বেশ ভালোভাবেই অন্ধকার নেমেছে। সন্ধ্যা নামলেও কিছুক্ষণ আলো থাকে‚ সেই আলোতে দীপ্তকে দেখতে পাচ্ছে মিসেস বোস। পৃথিবীর যত কীট পতঙ্গ‚ জন্তু-জানোয়ার সব সন্ধ্যায় খাবার খুঁজতে বেরোয় এক রাশ ক্ষুদা নিয়ে। মিসেস বোসও বোধহয় এখন আর মানুষ নেই‚ নরখাদক জন্তুতে পরিণত হয়েছে। কান্না থেমে গিয়ে তার মুখ থেকে জান্তব ধবনি বের হতে লাগল। দীপ্তর সুঠাম দেহটা দেখতে লাগল সে লোভনীয় চোখে।
মিসেস বোসের কান্নার সুর পাল্টে যাওয়া লক্ষ্য করে দীপ্ত ঘুরে দাড়াল ফোন রেখে। আর দেরি করা যায় না। গায়ের সমস্ত জোড় দিয়ে তার ঘাড়ে কোপটা বসাল মিসেস বোস নামক পিশাচিনী!