ডেঙ্গু হলেই মরে যাবেন, এমনটা ভাবা ঠিক না।
ভাইরাস জনিত রোগ ডেঙ্গু, বার্ডফ্লু, সোয়াইনফ্লু , চিকনগুনিয়া, ম্যাডকাউ, প্লেগ ইত্যাদির কোন ঔসধ নেই। তবে টিকা উদ্ভাবন করে রোগ হওয়ার আগেই প্রতিরোধ করা যায়।
ডেঙ্গু ৪ ধরনের ডেঙ্গু, ২য় ডেঙ্গুর কিছু টিকা বের হয়েছে ( TV003 ও TV005 ) ফিল্ড টায়ালও হয়েছে। তবে পদ্ধতি জটিল ও বাজারজাত হয়নি।
জাতিসংঘের বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরিসংখ্যান অনুযায়ী ১০০টিরও বেশি দেশে ডেংগি বা ডেঙ্গুর প্রকোপ ছড়িয়েছে।
প্রতি বছরই বিশ্বব্যাপী ডেঙ্গুতে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। প্রতি বছর প্রায় ৪০ কোটি মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হচ্ছেন।
ফিলিপিনসে এবার ডেঙ্গুতে ৬২২ জন মারা গেছেন। মেক্সিকো ও আমেরিকাতে দেখা গেছে ডেঙ্গু।
মালয়েশীয়াতে গত বছর ৩৩৬ জন মারা গেছে
বাংলাদেশে এজাবৎ ২৪+ জন মার গেছে, মৃতের সংখা দিন দিন বাড়ছে।
ক্লাসিক্যাল ডেঙ্গু জ্বরে সাধারণত তীব্র জ্বর ও সেই সঙ্গে সারা শরীরে প্রচণ্ড ব্যথা হয়ে থাকে। জ্বর ১০৫ ফারেনহাইট পর্যন্ত হয়ে থাকে। শরীরে বিশেষ করে হাড়, কোমড়, পিঠসহ অস্থি সন্ধি এবং মাংসপেশীতে তীব্র ব্যথা হয়। এছাড়া মাথাব্যথা ও চোখের পিছনে ব্যথা হয়। অনেক সময় ব্যথা এত তীব্র হয় যে মনে হয় বুঝি হাড় ভেঙ্গে যাচ্ছে। তাই এই জ্বরের আরেক নাম ‘ব্রেক বোন ফিভার’।
তবে অনেক ক্ষেত্রে ব্যাথা কম বা নাও হতে পারে।
জ্বর হওয়ার ৪ বা ৫ দিনের সময় সারা শরীরজুড়ে লালচে দানা দেখা যায়, যাকে বলা হয় স্কিন র্যাশ, অনেকটা এলার্জি বা ঘামাচির মতো। এর সঙ্গে বমি বমি ভাব, এমনকি বমি হতে পারে। রোগী অতিরিক্ত ক্লান্তিবোধ করে এবং রুচি কমে যায়। সাধারণত ৪ বা ৫ দিন জ্বর থাকার পর তা এমনিতেই চলে যায় এবং কোন কোন রোগীর ক্ষেত্রে এর ২ বা ৩ দিন পর আবার জ্বর আসে। একে “বাই ফেজিক ফিভার”বলে।
যেকোনো ধরনের জ্বর হোক না কেনো জ্বর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। উনিই সঠিক পরামর্শ দিবেন।
এখনি হাসপাতালে যাওয়ার দরকার নেই, যে কোন ডাক্তার দেখান পাড়ার গলির সাধারন এমবিবিএস ডাক্তারকে দেখান. তার পরামর্শমত চলুন। উনি কিছু টেষ্ট করতে দিলে ভিড়ের কারনে বড় হাসপাতালে/ডায়াগনিষ্টিকে চান্স পেতে ভোগান্তি হতে পারে।
সবচেয়ে ভাল হয় আইসিডিডিআরবি ল্যাবে চলে যান ২৪ ঘন্টা খোলা। রাত ১২টার পরে যান ভিড় কম থাকবে। কিউ থেকে সিরিয়াল নাম্বার নিয়ে চেয়ারে বসুন। মেশিনেই ডাকবে। সরকারি নির্দেশে সরকারি রেট। কোন ঝামেলা নেই।
ডেঙ্গুতে আইসিইউ কো ন দরকার নেই। ফাইভ স্টার হাসপাতালও দরকার নেই।
ডেঙ্গু জ্বরের সময় ভীষণ ব্যথা হয় বলে অনেকে বিভিন্ন রকমের ব্যথানাশক ওষুধ খেয়ে থাকেন।
নিয়ম হচ্ছে এমন পরিস্থিতিতে ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া কোনো ব্যথানাশক ওষুধ খাওয়া যাবে না। জর বা ব্যাথায় শুধু প্যারাসিটামল খাওয়া যেতে পারে। সেটাও ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া নিজেরা সিদ্ধান্ত নিয়ে কিছু করা যাবে না। না হলে পরিস্থিতি বিপদজনক হতে পারে।
বেশীরভাগ ক্ষেত্রে ডেঙ্গু জ্বর ৭ দিন থাকে মাঝের ৩ দিন ক্রিটিকেল পিরিয়ড সঠিক পরিচর্যা পেলে ৭ দিনে ভালহয়ে যায়
ডেঙ্গুতে মূলত দুইটা সমস্যা হয়।
প্রথম বিপদ - আক্রান্তের ৩-৪ দিন পর রক্তশীরা গুলো থেকে প্লাজমা লিকেজ ( রক্ত রস লিক হয়ে রক্তের জলিয় অংশ পরিমান কমে যায়)
এতে ব্লাড কমে প্রেসারও কমে যেতে পারে।
দ্বিতীয় বিপদ - একই সময় প্লাটিলেট কাউন্ট কমা শুরু করে। প্লাটিলেট হচ্ছে রক্তের একধরনের কনিকা বাংলায় অনুচক্রিকা। যা রক্ত জমাট বাধতে সাহায্য করে। প্লাটিলেট কমলেই ইন্টারনাল ব্লিডিং হবে এমনটা না। রুগি হাটা চলা শিড়ি ভাংগা হাসপাতাল থেকে আরেক হাসপাতাল ইত্যাদি কায়িক পরিশ্রম করলে দেহের অভ্যন্তরে ব্লিডিং হতে পারে। এছাড়া প্লাটিলেট কাউন্ট কমা শুরু হলে অনেকের কোন কারন ছাড়াই এমনিতেই ব্লিডিং হতে পারে।
অনেকের কম বা নাও হতে পারে।
প্লাজমা লিকেজ বা ইন্টারনাল ব্লিডিং এটাই সক। রক্তের জলিয় অংশ লিক সাথে আভ্যন্তরিন রক্ত লিক এই সকে সঠিক প্রয়জনিয় ব্যাবস্থা না নেয়া হলে মানুষ মারা যায়।
তবে সঠিক পদ্ধতিতে ট্রিটমেন্ট দিলে সহযেই রোগিকে বাচানো যায়।
যাই হোক ডেংগিতে তাহলে মানুষ মারা যায় কেন?
বাংলাদেশ পাবলিক হেলত বিভাগের ডেঙ্গু অভিজ্ঞতা ৩ দশকের। ডেঙ্গু মোকাবেলায় ন্যাশানাল গাইডলাইন তৈরি করা হয়েছে, প্রতি বছরই আপডেট করা হচ্ছে। বাংলাদেশের ডেঙ্গু অভিজ্ঞতা মার্কিন যুক্তরাষ্টের মহামারি রোগ নিয়ন্ত্রন বিভাগ CDC ও জাতিসংঘের WHO কে পাঠানো হচ্ছে। চলমান সারাবছরই তথ্য বিনিময় হচ্ছে। CDCর একটি ইউনিট বহু বছর আগে থেকেই আইসিডিডিয়ারবিতে আছে। বাংলাদেশের স্বাস্থ অধিদপ্তরের সাথে সমন্নিত ভাবে কাজ করে যাচ্ছে।
ডেংগিতে প্লেইটলেট কমে রক্তক্ষরণ হয়ে রোগী মারা যায় ব্যপারটা এমন না।
রোগী মারা যায় ডেংগি শক সিন্ড্রোমে। এর ম্যানেজমেন্ট ভিন্ন
ডেংগিতে ভাইরাসের কারণে রক্তনালীগুলো আক্রান্ত হয়। রক্তনালীর গায়ে যে ছোট ছোট ছিদ্র থাকে সেগুলো বড় হয়ে যায়। তা দিয়ে রক্তের জলীয় উপাদান বা রক্তরস বের হয়ে আসে। তখন ব্লাড প্রেসার কমতে থাকে।
Blood pressure কম কিন্তু Heamatocrit (HCT) বেশি = Plasma leakage হচ্ছে।
Blood pressure কম, Heamatocrit (HCT) ও কম = কোথাও Bleeding হচ্ছে।
এটা ঠেকাতে রোগীকে ফ্লুইড বা তরল খাবার দিতে হবে প্রচুর। মুখে খাওয়ান, শিরাতে দিন। ফ্লুইড, ফ্লুইড এন্ড ফ্লুইড।
মুখে খেতে পারলে সবচেয়ে ভাল। মুখে খেতে না পারলে শিরাতে নরমাল সেলাইন
ঘন ঘন প্লেইটলেট না দেখে ব্লাড প্রেসার কমছে কিনা দেখুন, ডিহাইড্রেশন আছে কিনা দেখুন, রক্তের পিসিভি, সিবিসি বা হেমাটোক্রিট দেখুন। Plasma leakage, শুরুর পর সাধারণত ৪৮ ঘন্টা স্থায়ী হয়। এরপর Recovery শুরু হয়ে যায়। আইভি ফ্লুইড নরমাল সেলাইন দিতে হবে Plasma leakage শুরু হবার পর ৪৮ ঘন্টা পর্যন্ত। ৪৮ ঘন্টার পর মুখে খেলে ভাল, শিরায় ফ্লুইড দিলে Volume overload হয়ে রোগীর শ্বাসকষ্ট সহ বিভিন্ন সমস্যা দেখা দিবে।সুতরাং সাবধান।
হাসপাতালে কখন যাবেন।
রোগির অবস্থা জটিল ও মুখে খেতে না পারলে
রোগীর পুর্বে ডায়াবেটিজ, বা লিভারের রোগ থাকলে।
রোগী খুব দুর্বল হয়ে গেলে, জর নেমে যাওয়ার পর রুগির অবস্থার অবনতি হলে
হতাশার কথা - দেখা যাচ্ছে বেসরকারি হাসপাতালের বড় বড় ডাক্তাররা ডেংগুর ন্যাশনাল গাইডলাইনকে গুরুত্ত দেন না। ত্রিশ হাজার প্লেইটলেট দেখে ভয়ে আতংকে ছয় ঘন্টা পর পর প্লেইটলেট চেক করে রোগীকে আরো আতংকগ্রস্ত করেন, রুগিরাও বার বার প্লেইটলেট চেক করতে চান। ডোনার খুজতে থাকেন।
এক ব্যাগ প্লেইটলেট করতে একের পর এক ক্রসম্যাচিং এরপর ৪ জন ডোনার মিলিয়ে ৮ ব্যাগ রক্ত লাগে। বহু খরচ, বহু হয়রানি। এই বড় বড় ডাক্তাররা প্রেসারের খোঁজও নেননা। হিমাটোক্রিট তো না'ই৷ কিছু না হলেও বলে আইসিইউ তে নাও।
ভাবটা এমন যেন প্লেইটলেট কমলে রক্ত ড্রেইন হয়ে কমে গিয়ে রোগীর হঠাৎ করে হার্ট বন্ধ হয়ে যাবে।
বারবার বলা হচ্ছে ডেঙ্গু জ্বরে Platelet দিয়ে কোন উপকার প্রমাণিত না।
ডেঙ্গু জ্বরে আইসিইউতে ভর্তি করা/ভর্তি হওয়ার দরকার নেই।
মোদ্দা কথা: ডেংগিতে প্লেইটলেট এর পেছনে অহেতুক সময় নষ্ট না করে রোগীর ফ্লুইড কারেকশন করুন, প্রেসার দেখুন, জর কমাতে প্যারাসিটামল খাওয়ান। কখনই এন্টিবায়োটিক আর প্লেইটলেট দেবেননা। ব্যাথার অসুধ প্যারাসিটামল বাদে অন্যকিছি দেয়া যাবে না।
প্লেইটলেট কমে গেলে সাধারন রক্ত দিন। নট প্লেইটলেট, প্লাজমা কমলে নরমাল সেলাইন। গুরুতর অবস্থায় প্যাকড আরবিসি।
আর রোগি মুখে খেতে পারলে (ওরসেলাইন/সরবত/তরল খাবার) সবচেয়ে ভাল।
নিজেরা কিছু করবেন না। পাস করা এমবিবিএস ডাক্তারে্র পরামর্শে ও তত্তাবধানে করবেন।
হাসপাতালের ফ্লোরে থাকতে হলেও থাকবেন। এবার বেশী রোগী মারা গেছে বার বার হাসপাতাল বদল করাতে।
অনেক রুগির অবিভাবক বলে বসে "এসব ডাক্তার কিছু জানে না"
সত্য কথা বলতে সরকারি হাসপাতালেই ডেংগুর সবচেয়ে ভাল চিকিৎসা পাবেন।
ডাক্তার ভাইদের বলছি
সরকারি স্বাস্থ অধিদপ্তরের ডেংগুর ন্যাশনাল গাইডলাইনটি ফলো করুন।
চিকিৎসা এবং মনিটরিং এর ক্ষেত্রে হেমাটোক্রিট ভ্যালু ও রক্তচাপকে গুরুত্ব দিন। শিরায় নরমাল স্যালাইন দিন। প্লাজমা, ক্রাইওপ্রিসিপিটেট বা ব্লাড প্রোডাক্ট, প্লেইটলেট দিয়ে রোগীকে ভারাক্রান্ত করবেন না৷ হিমাটোক্রিট বেড়ে গেলে এবং রোগী শকে গেলে তবেই কলয়েড সলিউশন দেবেন নয়ত নরমাল স্যালাইন। ডেংগুর ন্যাশনাল গাইডলাইনটি ফলো করুন।
বাংলাদেশে ডেংগু রোগেরা বেশির ভাগ মরে যায় অতিচিকিৎসায়।
পরিশিষ্টঃ
ডেংগির ন্যাশনাল গাইডলাইনে শ শ লাইন লেখা আছে। সেখানে প্লেইটলেট নিয়ে লেখা মাত্র একটা লাইনই লেখা আছে -
platelet is rarely given but may be warranted in patients with severe thrombocytopenia
আপডেট ১৬ আগস্ট ২০১৯
এবার ডেঙ্গু ভাইরাস ডেনভি-৩-এর প্রকোপ বেশি
আইইডিসিআরের পরিচালক অধ্যাপক মীরজাদী সেব্রিনা প্রথম আলোকে বলেন, ডেঙ্গু মৃত্যু পর্যালোচনা কমিটি এ পর্যন্ত ৪০ জনের মৃত্যু নিশ্চিত করেছে। এর মধ্যে ২৭ জনের মৃত্যু হয়েছে ডেঙ্গু শক সিনড্রোমে। আর ৬ জনের মৃত্যু হয়েছে ডেঙ্গু হেমোরেজিক জ্বরে (ইন্টার্নাল রক্তক্ষরনে)।
তুলনামূলকভাবে রোগীদের মধ্যে ডেঙ্গু শক সিনড্রোম বেশি দেখা যাচ্ছে কেন, তা স্পষ্ট করে কেউ বলতে পারছেন না। আইইডিসিআর বলছে, এবার ডেঙ্গু ভাইরাস ডেনভি-৩-এর প্রকোপ বেশি।
ডেঙ্গু ভাইরাসের চারটি ধরন বা সেরোটাইপ আছে: ডেনভি-১, ডেনভি-২, ডেনভি-৩ ও ডেনভি-৪
উনিও সকল হাসপাতালকে সরকারি স্বাস্থ অধিদপ্তরের ডেংগুর ন্যাশনাল গাইডলাইনটি ফলো করতে বলেছেন
ডেঙ্গু - এবার শক সিনড্রোমে বেশি মৃত্যু হচ্ছে