৫ই সেপ্টেম্বর ১৯৭৭ একটি ঝলমলে রোদ্রকরজ্জল বিকেল।
৪১ নং লাঞ্চ কম্পেক্স, কেপ কেনাভেরাল, ফ্লোরিডা।
উৎক্ষপনের অপেক্ষায় ভয়েজার-১ মাথায় নিয়ে বিশাল টাইটান-৩ রকেট।
কাউন্টডাউন চলছে .. নাইন এইট .. সেভেন সিক্স ফাইভ ফোর থ্রি .. টু .. ওয়ান ... নিস্তব্ধতা ভেংগে গর্জে উঠলো বিশাল টাইটান রকেটের ইঞ্জিন, ধোঁয়ার কুন্ডলি, একই সাথে পা। পাশে লাগানো উচ্চক্ষমতা সম্পন্ন দুটি সলিড বুষ্টারের পুচ্ছ থেকে তীব্র অগ্নিধোঁয়া নিয়ে মহাশুন্যে মিলিয়ে গেল টাইটান-৩ সাথে ভয়েজার ১। প্যাসাডোনা কন্ট্রলরুমের তখন শতাধিক বিজ্ঞানি মনিটরের সামনে চেয়ার থেকে দাঁড়িয়ে গেছে, ... করতালি, .. আলিঙ্গন।
এরপর ৪১ বছর কেটে গেছে। ভয়েজার-১ । এই প্রথম ও একমাত্র যান যা সৌরজগত এর আকর্শন ভেদ করে দূরবর্তি ইন্টারস্টেলার মিডিয়ামে প্রবেশ করতে সক্ষম হয়েছে। ৮২৫ কিলোগ্রাম ওজনের ভয়েজার-১ আর পৃথিবীর মধ্যকার দুরত্ব এখন প্রায় ১৪ বিলিয়ন মাইল!
'লং ডিসটেন্স রিলেশনশিপ'এর সবচেয়ে বড় উদাহারণ হয়ে ভয়েজার-১ এখনো পৃথিবীর মানুষের সাথে যোগাযোগ রেখে চলেছে!
২০১৩ এর মার্চে বিজ্ঞানীরা নিশ্চিত করেন যে ভয়েজার ১ আমাদের সৌরজগতের সীমানা সফল ভাবে অতিক্রম করে তারকা মন্ডলির দিকে ছুটছে। সৌরজগত থেকে বহুদুর অতিক্রম করে মুল তারকা জগতে প্রবেশ করেছে বলা যায়। কারন তখন সুর্য তার কাছে আকাশের অন্যান্ন তারার মত একটি তারা মাত্র। উপরে শুন্য আকাশ নীচেও, ডানে বামে সুধু চারদিক না সবদিকেই শুন্য আকাশ বা মহাশুন্য। চারদিক, সবদিক ... অসীম শুন্য .. মহাশুন্য, আমাদের গ্যালাক্সি টা বড় দেখা যাচ্ছে, এন্ড্রমিডা দেখা যাচ্ছে, ছোট বিভিন্ন তারকা ঝলমল করছে। আসমান বা জমিন বলতে যা বোঝায় সেরকম কিছুরই অস্তিত্ত এখন আর নেই।
আমাদের সৌরজগত বাইরে তারকামন্ডলী ছাড়িয়ে অসীম দূরত্বে পাঠানো আমেরিকার NASA ও Jet Propulsion Laboratoryর ভয়েজার মিশন একটি উচ্চাভিলাসি প্রোগ্রাম। Voyager 1 ও Voyager 2 । এর আগে পায়োনিয়ার ১ ও ২ একই ধরনের প্রোগ্রাম।
মুলত ইন্টারস্টেলার দূর মহাশুন্যে প্রায় এবসুলুট জিরো তাপমাত্রায় কোন মহাকাশযান, ক্যামেরা যন্ত্রপাতি কেমন কতদিন টেকে, কি কি অবস্থা হয়, সেটা জানার জন্যই।
সবচেয়ে কঠিন কাজ ছিল সুর্যের কঠিন আকর্ষন ভেদ করে সৌরজগত ছাড়িয়ে তারকা জগতে প্রবেশ।
যত শক্তিসালী রকেটই হোক এজাবৎ কোন মহাকাশ যান সুর্যের বা সৌরজগত, সুর্যের দখল ভেদ করা সম্ভব হয় নি। Voyager 2 । এর আগে ১৯৭৩ পায়োনিয়ার ১ ও ২ উচ্চগতি থাকার পরও একসময়ে গতি কমে এসে উল্কার মত অবস্থা হয়, ডিম্বাকৃত প্রদক্ষিন, মানে আবার ফিরে আসে।
একমাত্র Voyager 1 কে সফলভাবে সৌরজগত হেলিওস্ফিয়ার ভেদ করে প্রকৃত ইন্টারস্টেলার স্পেসে পাঠানো সম্ভব হয়েছে। বিশেষ কৌশলে প্রাকৃতিক শক্তির সফল ব্যাবহার। বৃহস্পতি ও শনির মাধ্যাকর্শন ব্যাবহার করে গতি বৃদ্ধি করে অনেক জটিল অংক, কিন্তু শেষ পর্যন্ত সফল হয়েছে।
বৃহস্পতি ও শনি গ্রহের মাধ্যাকর্শনকে কাজে লাগিয়ে ভয়েজার এর গতিও ভয়ানক বেড়েছে, 38,610 MPH বা 62,137 kmph গতিতে তারকা মন্ডলি Ophiuchus এর দিকে ছুটছে। মানব নির্মিত যে কোন যান এজাবৎ এটাই সর্বচ্চ গতি। ৪১ বছর জাবত ছুটছে, কেউ ধরে না ফেললে বা কোন কিছুর সাথে ধাক্কা নাগলে আরো ৬০০-৭০০ বা আরো বেশী বছর ছুটবে।
পায়োনিয়ার, ভয়েজার উৎক্ষেপন, তারকা মন্ডলিতে প্রবেশ চেষ্টা, এছাড়াও নাসার আরো খুচরা কিছু উদ্দেস্য ছিল।
ভয়েজার উৎক্ষেপনের বেশ আগেই ভিন-নক্ষত্রের এলিয়েনদের জন্য (যদি থাকে) তথ্য উপাত্ত দেয়ার জন্য নাসায় কমিটি তৈরী করা হয়।
বিশিষ্ট বিজ্ঞানী / সাইন্সফিকশান লেখক কার্ল সেগান হলেন কমিটির প্রধান। এক বছর ধরে চললো ভীনগ্রহ, ভীন-নক্ষত্রের স্বজনদের জন্য বার্তা তৈরি ও বাছাইয়ের কাজ।
একটি উচ্চ তাপ সহনশীল অতিব শক্ত গোল্ড-প্লাটিনাম সংকরে তৈরি একটি ডিস্ক, যার মধ্য খোদাই করা থাকবে বিভিন্ন ছবি।
আর সাউন্ডের জন্য গোল্ড গ্রামোফোন ডিস্ক। এসব ধাতব ডিস্ক ভয়েজার যান কোন গ্রহে আছড়ে পড়লেও ধাতব ডিস্ক অক্ষত থাকবে। লক্ষাধিক বছর টিকে থাকবে।
সবচাইতে মজার ব্যাপার হচ্ছে, ভয়েজার ১ এবং ভয়েজার ২ তে গোল্ডেন রেকর্ড রাখা হয়েছে যেটাতে আমাদের পৃথিবী ও মানুষ প্রাণী অস্তিত্ব সম্পর্কে সহজ বর্ণনা দেওয়া রয়েছে।
ভয়েজার কোন না কোন একদিন ভীনগ্রহ, ভীন-নক্ষত্রের কোন না কোন বুদ্ধিমান প্রানীকুল/ এলিয়েনদের হাতে পরবে, এই আশায়
এটি একটি ফোনোগ্রাফ রেকর্ড ডিস্ক যেখানে এলিয়েনদের জন্য মানুষের পাঠানো ম্যাসেজ খোদাই করা রয়েছে। আর গ্রামোফোন রেকর্ড ডিস্কটি সোনার তৈরি আর এতে অনেক টাইপের সাউন্ড এবং ছবি যুক্ত করে দেওয়া হয়েছে, যাতে পৃথিবী, মানুষ আর আমাদের সংস্কৃতি সম্পর্কে এলিয়েনদের বুঝানো যেতে পারে। প্লেটটির গায়ে হাইড্রোজেনের সংকেত একে দেওয়া হয়েছে, যে হাইড্রজেন মহাবিশ্বের সবচাইতে কমন অংশ, যদি কোথাও কোন মানুষের ন্যায় বুদ্ধিমান প্রাণী থেকে থাকে, তারা হয়তো হাইড্রোজেন স্ট্র্যাকচার বুঝতে পারবে। সাথে পৃথিবীর বিভিন্ন সাউন্ড সম্পর্কে ধারনা নিতে পারবে। গোল্ড সঙ্কর প্লেটটিকে উচ্চতাপ/হিমশিতল সহনশীল করে কয়েক বিলিয়ন বছর টিকে থাকার মতো করেই তৈরি করা হয়েছে।
ভয়েজারের জন্য ধাতব ডিস্কে বার্তা রেকর্ড হচ্ছে
ভয়েজারের জন্য মানবকুলের বার্তা
শুরু হল ছবি সংগ্রহ ও ভয়েস রেকর্ডিং
৫৫ টি ভাষায় 'হাই' জানানো হলো ।
প্রথম জানালেন, তৎকালিন জাতিসংঘের সে সময়কার মহাসচিব কুর্ট ওয়াল্ডহেইম। তিনি বললেন, "I send greetings on behalf of the people of our planet. We step out of our solar system into the universe seeking only peace and friendship, to teach if we are called upon, to be taught if we are fortunate."
আছে বাংলা ভাষাও। বাংলাদেশের সামরিক শাসকদের অবহেলায়, নাসার আহবানে সাড়া না পেয়ে পশ্চিম বাংলার একজন কন্ঠ দিয়েছেন সুব্রত মূখার্জি। তিনি বলেছেন 'নমস্কার, বিশ্বের শান্তি হোক।'
পাঠানো হলো বৃষ্টির শব্দ, বাতাসের শব্দ, হাসির শব্দ। হেসেছিলেন কার্ল সেগান নিজেই।
পাঠানো হলো পাখির ডাক, ঝিঝি পোকার ডাক।
দুই ভয়েজারের সাথে পাঠানো হলো ৯০ মিনিট দীর্ঘ গান এবং সুর। এর মধ্যে ছিলো সাড়ে তিন মিনিটের একটি ভারতীয় সুরও।
ভিনগ্রহের স্বজনদের জন্য পাঠানো হলো আরো অনেক কিছু।
ছবি ১১৬টি। এর মধ্যে আছে আমাদের ডিএনএর ছবি, হাঁড়ের ছবি,পাখির ছবি, সূর্যদয়ের ছবি, সূর্যাস্তের ছবি, বৃক্ষ বনভুমি, নারী পুরুষের জননাঙ্গের ছবি, মিলনের ছবি! খাওয়ার ছবি, পান করার ছবি, শিশুকে স্তন পান করানোর ছবি!
যুদ্ধ আর অস্ত্রের ছবি স্থান পাওয়ার কথা থাকলেও একটি নেগেটিভ মেসেজ যেতে পারে বিধায় যুদ্ধাস্ত্রের ছবি আর দেয়া হয় নি।
লক্ষকোটি বছর পর হয়তবা এমন একটা সময় আসবে, যখন ভয়েজারকেই মানব প্রেরিত এক এলিয়েন যান হিসেবে চিহ্নিত করবে ভিন-নক্ষত্রের এলিয়েন রা, বুদ্ধিমান হয়ে থাকলে সহযেই বুঝবে কোথা থেকে এসেছে। এসব নিয়ে হয়তো লেখা হবে বিভিন্ন কল্পকাহিনী।
ভয়েজার ১ এর পর অবস্য ভয়েজার২ পরে পায়োনিয়ার ১০ পাইয়োনিয়ার ১১ একই ধরনের ছিল। তবে ভয়েজার ২ সপ্তাহ আগে লাঞ্চ করা হলেও ভয়েজার ১ অপেক্ষাকৃত বেশী গতিতে সবচেয়ে দূরে যেতে পেরেছে। শনি, বৃহস্পতি ও ইউরেনাস গ্রোহের মাধ্যাকর্ষন কাজে লাগিয়ে এক্সিলারেশন বৃদ্ধি করে সৌরজগত ও তারকামন্ডলি অতিক্রম করতে পেরেছে।
জেপিএল অবস্য পরে মঙ্গল ও শুক্র গ্রহ মিশনেও অনেক যান পাঠিয়েছিল।
বিপুল গতিতে ছুটে চলা ভয়েজার গতি বাড়ানোর জন্য বৃহষ্পতি গ্রহকে অতিক্রম করানো হয়েছে ১৯৭৯ সালে। যাত্রাপথে সে আমাদেরকে পাঠিয়েছে বৃহষ্পতির ছবি। আমরা দেখেছি দানবগ্রহ বৃহষ্পতির বুকে ১৮৮ বছর ধরে বয়ে চলেছে এক দানবঝড় - দ্যা গ্রেট রেড স্পট। এই ঝড়ের আয়তন তিনটা পৃথিবীর সমান!
ভয়েজার-১ শনি গ্রহ অতিক্রম করানো হয়েছে ১৯৮০ সালে। ভয়েজার জানিয়েছে শনিকে প্রদক্ষিণ করছে আরো অনেকগুলো বরফের তৈরী চাঁদ!
১৯৮৮ সালে সৌরজগত সীমানা পার হয়ে যাবার পর ভয়েজার আর ছবিতুলে ব্যাটারি অপচয় করে নি।
ভয়েজার তাঁর সর্বশেষ ছবিটি তুলেছিলো ১৯৯০ সালের ভালোবাসার দিবসে। অর্থাৎ ১৪ ফেব্রুয়ারিতে।
সর্বশেষ এই ছবিটি ভয়েজার তুলেছিলো সেই কার্ল সেগান নামক একজন খেয়ালী বিজ্ঞানী ও সাইন্সফিক্সান লেখকের বিশেষ অনুরোধে। নাসা ও জেপিএল ভয়েজারের ব্যাটারি নষ্ট করতে চায় নি, এরপরও অনেক অনুরোধের পর শেষবারের মত ভয়েজারের ক্যামেরা পৃথিবীর দিকে তাক করা হয়।
অসংখ ক্ষুদ্র তারার (সুর্য) সাথে ছোট্ট একটি বালুকনা সদৃস্য পৃথিবী। কোনটা যে আমাদের পৃথিবী বোঝাই মুশকিল।
ভয়েজারের তোলা শেষবারের মত পৃথিবীকে গুডবাই বলা তাঁর সর্বশেষ ছবি। তীর চিহ্নিত স্থানে পৃথিবী।
ভ্রমণের টাইমলাইন:
৫ই সেপ্টেম্বর ১৯৭৭: ভয়েজার ১ এর যাত্রা শুরু। এর ১৬ দিন আগে রওনা দেয় ভয়েজার ২। দুটো যানই এখন সৌরজগতের বাইরে। তবে ভয়েজার ২ পিছিয়ে পরেছে, একই অবস্থা হয়েছিল ১৯৭৩ উৎক্ষেপিত পায়োনিয়ার ১ ও ২, উচ্চগতি থাকার পরও হেলিয়োস্ফিয়ার অতিক্রম করতে সক্ষম হয় নি।
জানুয়ারি ১৯৭৯: ভয়েজার ১ বৃহস্পতি প্রদক্ষিন করে। বৃহস্পতি গ্রহের কিছু গুরুত্বপূর্ণ ছবি এটি পৃথিবীতে পাঠাতে সক্ষম হয়। বৃহস্পতি গ্রহে ঝড়ের ছবি এবং ভিডিও পাঠায়। যখন এটি বৃহস্পতির একদম কাছে থাকে তখন পৃথিবী থেকে এর দুরত্ব প্রায় দুই লাখ মাইল।
নভেম্বর ১৯৮০: দুটো প্রোবই বৃহস্পতির মহাকর্ষ অতিক্রম করে শনির দিকে এগিয়ে যেতে সমর্থ হয়। এসব করা হয় ভয়েজারের গতি বৃদ্ধি করার জন্যই। এক সময়ে ভয়েজার ১ শনির কাছাকাছি অবস্থান করে। এসময় এটি শনির রিংয়ের গঠন সম্পর্কে বিজ্ঞানীদের ধারনা দেয় এবং এর রিমোট সেন্সরগুলো শনির পৃষ্ঠ এবং গ্যাস জায়ান্ট টাইটান(শনির একটি উপগ্রহ) সম্পর্কে গবেষণা করতে থাকে।
চিত্র:ভয়েজার ১ এর তোলা শনি গ্রহের ছবি।
১৭ ফেব্রুয়ারি ১৯৯৮ এ ভয়েজার ১ ১৯৭৩এ উৎক্ষেপিত পাইওনিয়ার ১০ কে অতিক্রম করে এবং সবচেয়ে দুরবর্তী মানুষ নির্মিত বস্তু হিসেবে স্বীকৃতি পেয়ে যায় এবং তখনও সেটি প্রতি সেকেন্ডে সতেরো কিলোমিটার বেগে যাত্রা অব্যাহত রাখে।
২০১২ এর শেষের দিকে ভয়েজারের চারপাশের আবহাওয়াতে ব্যাপক পরিবর্তন আসতে থাকে। এতে বোঝা যায় সুর্যের হেলিওস্ফিয়ার প্রভাব শেষ, কসমিক উইন্ড শুরু। ২০১৩ এর মার্চে বিজ্ঞানীরা নিশ্চিত করেন যে এটি আমাদের সৌরজগতের সীমানা সফল ভাবে অতিক্রম করে তারকা মন্ডলির দিকে ছুটছে।
সেপ্টেম্বর ২০১২ তে নাসা নিশ্চিত করে যে এটি ইন্টারস্টেলার মিডিয়ামে প্রবেশ করেছে।
ইন্টারস্টেলার মিডিয়াম হলো দুইটি নক্ষত্রের আকর্ষনের বাইরে মহাশুন্য, অসীম ..।
তবে একদম ফাঁকা না, বিচ্ছিন্ন ছুটন্ত চার্জড পার্টিকেল, কসমিক রে .. ইত্যাদি আছে। এসব পৃথিবীতে আসতে পারেনা, সোলার উইন্ডের কারনে। সব প্রমান ভয়েজার ১ দিয়েছে।
শেষ পর্যন্ত কি হবে?
আসলে ভয়েজারের ভবিষ্যত সম্পর্কে স্পষ্ট করে কিছু বলা যায় না। সৌরজগত পাড়ি দেয়ার পর এটির গন্তব্য অজানার উদ্দেস্যে, লক্ষকোটি বছর পরে কোথায় যেয়ে যে পড়ে কেউই জানে না।
এর অবশিষ্ট রকেট প্রপেলেন্ট ও ইঞ্জিনগুলো এখনও সক্ষম আছে। নাসা ইচ্ছে করলে এখনো এর গতিপথ চেইঞ্জ করতে পারে, তার দরকার হবে না। তবে ব্যাটারি বাচাতে সবগুলো ক্যামেরা বন্ধ করতে হয়েছে। এটি হয়তো আর দুই তিন বছর নাসার কাছে তথ্য প্রেরন করতে পারবে।
২০২৫ সাথে এর জ্বালানি ও ব্যাটারি সম্পুর্ন শেষ হয়ে যাবে। কিন্তু গতি (38,610 MPH বা 62,137 kmph) ভ্রমণ অব্যাহত থাকবে। যেহেতু মহাকাশে কোনো বাঁধার সম্মুখীন হওয়ার কথা না।
বিপদজনক এষ্ট্রয়েড বেল্ট সীমানা অনেক আগেই পার হয়ে গেছে। কোনো ধরনের জোতিস্ক বা মহাজাগতিক কনার সাথে এর সংঘর্ষের কোনো সম্ভাবনা নেই। তাই এটি নির্দ্বিধায় এগিয়ে যেতে থাকবে অনন্তকাল পর্যন্ত। এটি এখন যেই গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে সেই গতিতে আমাদের নিকটবর্তী আরেকটি স্টেলার সিস্টেম প্রক্সিমা সেন্চুরাইতে পৌছতেও এর সময় লাগবে প্রায় ৭৪ হাজার বছর!!!
ভয়েজার ১ সম্পর্কিত আরো কিছু প্রশ্ন ও উত্তর
প্রশ্নগুলো কিছুদিন আগে একটি সংবাদ সম্মেলনে জেপিএল ও নাসার সায়েন্টিস্ট এবং ইঞ্জিনিয়ারদের করা হয়েছিলো।
১। ভয়েজার কি এখনো পৃথিবীর বিজ্ঞানীদের কাছে ছবি তুলে পাঠাতে সক্ষম?
হ্যা সক্ষম, ২০২০ পর্যন্ত সক্ষমতা থাকার কথা। এখনো সব যন্ত্রপাতি এখনো চালু আছে। তবে ১৯৯০ সালের পর এর ক্যামেরাগুলো বন্ধ করে দেয়া হয়।
২। কেন ক্যামেরাগুলো বন্ধ?
সোলার সিস্টেমের হেলিওস্ফেয়ার অতিক্রম করানো একটি কঠিন চ্যালেঞ্জ। এর আগে pioneer 1 pioneer 2 ও Voyeger 1 এই লাইন অতিক্রম করাতে ব্যার্থ হয়েছিলাম
হেলিওস্ফেয়ার অতিক্রমের সময় বিভিন্ন নক্ষত্র থেকে আসা আধানযুক্ত কনাগুলো (charged particle) ও ইন্টার স্টেলার ওয়েভ সনাক্ত করার জন্য ও পৃথিবীর সংগে যোগাযোগ বজায় রাখতে পর্যাপ্ত পাওয়ার এবং মেমোরি রাখার জন্য এর ক্যামেরাগুলো ছবি তোলা বন্ধ করে দেয়া হয়।
৪। কবে নাগাদ ভয়েজারের পাওয়ার পুরোপুরি শেষ হবে?
২০২০ সাল পর্যন্ত এর বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতিগুলো চালিয়ে রাখা যাবে। তথ্য পাঠাতে পারবে। ২০২৫ সাল নাগাদ ব্যাটারি ফুরিয়ে যাওয়ায় এর সবগুলো যন্ত্র সম্পুর্ন বন্ধ হবে। তবে গতি আগের মতই সেকেন্ডে ১৭ kmph গতিতে এগোতে থাকবে।
৫। যাত্রাপথে ভয়েজারের গতির কি কোনো পরিবর্তন হবে?
না! এটি বর্তমানে যেই গতিতে আছে (38,610 MPH বা 62,137 kmph, সেকেন্ডে ১৭ kmph গতিতে ) ইনার্শিয়ার কারনে কোন জালানি ছাড়াই আরো লক্ষ কোটি বছর এই গতিতেই এগিয়ে যেতে থাকবে। এখন আলফা সেঞ্চুরির দিকে ছুটছে। একসময় আমাদের গ্যলাক্সি ছাড়িয়ে দূর গ্যালাক্সির দিকে যেতে থাকবে ... ..
কিছু তথ্য এখানে পাবেন
Astrophysical Journal
** অনেক ছোটকালে একটি ম্যাগাজিনে ভয়েজার মিশনের কথা শুনে খুব উৎফুল্ল হয়েছেলাম, পরে এব্যাপারে ভিষন আগ্রহী হয়ে বিভিন্ন বই, আর্টিকেল সংগ্রহ করা শুরু করি, খোজখবর নিচ্ছিলাম, তখন 'ভিনগ্রহের মানুষ' নিয়ে বিভিন্ন কল্পকাহিনী, সাইন্সফিকশান পড়তাম, তাই ভয়েজার মিশন নিয়ে ভিষণ উৎসাহি ছিলাম, পরে বড় হয়ে একসময় ভুলেই গিয়েছিলাম।
এখন ভাবলাম কিছু লেখা দরকার, ভয়েজার নিয়ে ব্লগে বা পত্রিকায় খুবই সামান্যই আলচিত, ডিটেইল কিছই নেই।
আমার মনে হয়েছে নাসার চন্দ্রাভিজানের পর এটিই সবচেয়ে গুরুত্বপুর্ন সফল একটি মিশন। আমার মতে মানবজাতীর বিশাল সাফল্য।
কিন্তু দেশি-বিদেশী মিডিয়াতে ভয়েজার নিয়ে খুব একটা সিরিয়াস দেখলাম না।
তাই ভাবলাম আমার কিছু লেখা উচিত।
আপডেট এপ্রিল ২৩, ২০২৪ প্রথম আলো
নভোযান ভয়েজার–১ সফটওয়্যারজনিত ত্রুটির কারণে ২০২৩ সালের ১৪ নভেম্বর থেকে যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়। ফ্লাইট ডেটা সিস্টেমে ত্রুটির কারণে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়।
ফ্লাইট ডেটা সিস্টেমের মাধ্যমে পৃথিবী থেকে ভয়েজারের বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি ও সেন্সরের তথ্যাদি জানা যায়। সৌরজগতের বাইরে পৃথিবীর প্রতিনিধি হিসেবে যাওয়া ভয়েজার–১ সব ধরনের যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়। কয়েক মাস ধরে নানা চেষ্টা করা হয়। বেশ কয়েক মাসের প্রচেষ্টার পরে ত্রুটি সারানো গেছে। আবারও পৃথিবীতে প্রকৌশলবিষয়ক হালনাগাদ তথ্য পাঠানো শুরু করেছে ভয়েজার–১।
এখন ভয়েজার–১ আন্তনাক্ষত্রিক মহাকাশের মধ্য দিয়ে ভ্রমণ করছে। ২০১২ সালে সৌরমণ্ডলের এলাকা ছেড়ে যায় নভোযানটি। গত বছরের নভেম্বর থেকে যোগাযোগ নিয়ে ত্রুটি দেখা যায়। ২০ এপ্রিল ভয়েজার–১ থেকে সাড়া পান নাসার বিজ্ঞানীরা। ভয়েজার–১ মহাকাশযান তার অনবোর্ড ইঞ্জিনিয়ারিং সিস্টেমের অবস্থা সম্পর্কে ব্যবহারযোগ্য তথ্য–উপাত্ত পাঠাচ্ছে পৃথিবীতে। এখন বিজ্ঞানসংক্রান্ত তথ্য পাঠানোর ত্রুটি ঠিক করার কাজ চলছে। নাসার জেট প্রপালশন ল্যাবরেটরিতে ভয়েজার প্রকৌশল দল কাজ করছে ত্রুটি নিয়ে। ফ্লাইট ডেটা সাবসিস্টেমে (এফডিএস) বিজ্ঞান ও প্রকৌশলবিষয়ক ডেটা প্যাকেজ আকারে জমা হয়।
পাঁচ মাসের মধ্যে প্রথম সাড়া দেওয়ায় উচ্ছ্বসিত নাসার ভয়েজার–১ দলের সদস্যরা
নভেম্বরে এফডিএস মেমোরির একটি অংশের একক চিপ কাজ করা বন্ধ করে দেয়। সেই চিপে এফডিএস কম্পিউটারের সফটওয়্যার সংকেত রয়েছে। সেই চিপের কারণে কাজ বন্ধ হয়ে যায়। সেই সংকেতের ক্ষতির ফলে বিজ্ঞান ও প্রকৌশল ডেটা ব্যবহারের সুযোগ বন্ধ হয়। ভয়েজার–১ পৃথিবী থেকে এত দূরে যে সেখানে মেকানিক পাঠিয়ে মেরামত করা যাবে না।
সংকেত অন্য কোথাও রাখার সিদ্ধান্ত নেওয়া হলেও তেমন জায়গা ছিল না। প্রয়োজনীয় সংকেত কয়েক ভাগে ভাগ করে এফডিএসের বিভিন্ন জায়গায় সংরক্ষণ করার পরিকল্পনা নেওয়া হয়। ১৮ এপ্রিল এফডিএস মেমোরি থেকে নতুন তথ্য পাঠানো হয়। একটি বেতারসংকেত ভয়েজার–১ যানে পৌঁছাতে প্রায় সাড়ে ২২ ঘণ্টা সময় নেয়। খুব স্বাভাবিকভাবে পৃথিবী থেকে ১ হাজার ৫০০ কোটি মাইল দূরে সংকেত আদান-প্রদানে সময় লাগবেই। মিশন ফ্লাইট দল ২০ এপ্রিল মহাকাশযানের উত্তর পায়। পাঁচ মাস পরে প্রেমিকার চিঠি পাওয়ার মতো আনন্দে ভাসে ভয়েজার দল।
৪৬ বছরের বেশি আগে চালু করা ভয়েজার মহাকাশযানটি ইতিহাসের সবচেয়ে দীর্ঘস্থায়ী ও দূরবর্তী মহাকাশযান। আন্তনাক্ষত্রিক অনুসন্ধান শুরুর আগে ভয়েজার আমাদের সৌরমণ্ডলের সব এলাকা পার হয়ে ছুটে যায় দিগন্তের পথে।
সূত্র: নাসা। আপডেট অংশটি প্রথম আলো ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ২১: ০০ তে প্রকাশিত
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:৩০