সবার জীবনেই আজব কিছু ঘটনা থাকে।
আজব ঘটনাগুলো আচমকাই ঘটে যায়। এইসব আজব ঘটনা এমনিতেই মানুষজনকে বিশ্বাস করানো কঠিন। তারউপর বহু মুখে চর্চিত হওয়ার দরূণ ঘটনাগুলো আর আজব থাকে না।
মহা আজব হয়ে যায়।
এমনকী যার জীবনে কোন আজব ঘটনাই ঘটে নাই, সেও দূর দূরান্ত থেকে কানে ধার করে আনা কোন ঘটনার সাথে সত্তর-তিরিশ যোগ-বিয়োগ ঘটিয়ে একটি আজব পান্ডুলিপি ফেঁদে বসে।
আর একটা ব্যাপার লক্ষ্যনীয়, মানুষ পারতপক্ষে আজব ঘটনাগুলো কিন্তু আপনজনদের কাছে বয়ান করে না। তবে কোন অপরিচিতজন পেলেই আরব্য রজনী শুরু হয়ে যায়।
তাই আমি ঠিক করেছি পরিচিত জনদের উপস্থিতিতে মানুষ যে আজব ঘটনাগুলো বহুবার চর্চা করে প্রকরণ ভেদে যাচাই বিচার পূর্বক তার কিছুকে বিশ্বাসযোগ্য বলে মগজে ঠাঁই দিব। তেমনি আজ আমার জীবনের আজব এক ঘটনা উন্মুক্ত করি―
আমি একবার গাইবান্ধা থেকে থেকে বোনারপাড়া হয়ে বগুড়া যাচ্ছিলাম। সোনাতলা এসে ট্রেন থামল। ট্রেন আর ছাড়ে না। প্রায় মিনিট বিশেক পর কুলি মারফৎ অবগত হলাম ট্রেন ছাড়তে দু’ঘণ্টা বাকী। আধঘণ্টা দূরত্বে আমার মাতুলালয়। ভাবলাম ঢু-মেরে আসি। কী ভেবে জানি পরক্ষণেই চিন্তাটাকে মগজ আউট করলাম।
ইতোমধ্যে ট্রেন প্রায় ফাঁকা হয়ে গেছে। প্রত্যেকেই কিছুটা যাত্রাকালীন পর্যটকের বেশে ছড়িয়ে পড়েছে। আমার কামড়ার দু’এক জনকে চোখে পড়লো। তাও অল্প কিছু সময়ের জন্য।
একবার ভাবলাম ফাঁকা বগিতে রাজার হালে একটা লম্বা ঘুম দেই। সে চিন্তাটাও একসময় বদলাতে হলো।
বদলানোর পিছনে অবশ্য একটা লজিক ছিল।
লজিকটা এইরকম - ধরি, যাত্রা বিরতিতে দু’এক জন অসচেতন যাত্রীর কিছু মূল্যবান সম্পদ (যেমন- হাতপাখা তাও তালপাতার বা কাঁথা-বালিশ) খোয়া গেছে। এখন আমি যদি ঘুমিয়ে পড়ি নিশ্চিত ট্রেন ছাড়ার আগে ঘুম ভাঙবে না। এর মধ্যে ট্রেন ছাড়ার ঘোষণা হবে। আধ-একজন যাত্রী কামরায় উঠবে। একসময় খোয়া যাওয়া সম্পদের মালিক কামরায় উঠবে। অতঃপর সামনে যাকে পাবে তাকেই ধরে বসবে। সেই ব্যক্তি তার পূর্বে ওঠা ব্যক্তির দিকে আঙ্গুল নাচাবে। ওইব্যক্তি তার পূর্বের......
এভাবেই চলবে। একসময় স্বভাবিকই আঙ্গুল আমার বরাবর নাচবে। একটা দুটো নয়। পূর্বের―পূর্বের―করে অন্তত কয়েক জন আঙ্গুল নাচাবে। কেউ কেউ ভিড়ের পিছন থেকে আবার কথা মাধুর্য অর্পণ করবে। অতি উৎসুক দু’একজন আমার কলার চেপে ধরবে। কেউ হয়তো কোমড়ে পেঁচানোর জন্য একটা দড়ি চাইবে।
তারচেয়ে কামড়া ত্যাগ করাই শ্রেয় নয় কী?
বৈশাখ মাসের শুরু। খাঁখাঁ রোদ। আমাকে আর পর্যটক হতে মন সায় দেয় না। আমি স্টেশনের যে দিকটায় একটু ভিড় কম সেদিকে আধভাঙ্গা একটা বিশ্রামাচার্য পাবলিক বেঞ্চে আয়েশ করে বসে পড়ি।
বহু মানুষ মেলা করে ফিরছে। কেউ কেউ হয়তো দূরের কোন মেলাতে যাচ্ছে। ট্রেনটার দিকে তাকিয়ে আমার একবার কুষ্ঠ রোগী একবার গুটি বসন্ত রোগীর কথা মনে হয়। কুষ্ঠ রোগী কারণ অবশ্যই অনেক সরকারী দরকারী মালের মতই যত্র-তত্র খসে পড়া ট্রেনের চামড়া দেখে। আর গুটি বসন্ত হল ট্রেনের বহির্ভাগে নানা পণ্যের পোটলা হয়ে ঝুলে থাকার দরূণ।
অল্পক্ষণের মধ্যেই আমি স্টেশনের এ দিকটার জনাকীর্ণতার কারণ উপলব্ধি করে বসি। মাঝে মাঝে দু’এক পসলা বৈশাখী বায়ু আমাকে ছুঁয়ে যেতে থাকে। আর আমি জনারোণ্য পাশটার বায়ু ইন্দ্রিয় উপলব্ধি করে এই মর্মে স্থির হই যে ইহা স্টেশনের পয়ঃনির্গমন পার্শ্ব। তবু কেন জানি আমার অবস্থান বদলের ভাবনা হয় না।
এক সময় দূরের এক কালো কেশীর প্রতি আমার দৃষ্টি নিবিষ্ট হয়। রমণী কিনা জানি না। তবে ধরে নেই রমণী। রমণী দাড়িয়ে স্টেশনের অপর পাশের প্লাটফর্মে । তার দীর্ঘ খোলা কালো কেশগুলো ঢেউ খেলে যাচ্ছে। দুই প্লাটফর্মের মাঝের অতি উজ্জ্বল সূর্যরশ্মির দরূণ দৃষ্টি স্থির রাখা প্রায় অসম্ভব। তবু আমি তার মুখাবয়ব দৃষ্টি গোচর করার প্রয়াস করি। কিঞ্চিত সফলও হই। তাকে আমার অতি পরিচিত এক জনার ধুপছায়া বলে মনে হয়।
আমার মন মুহূর্তে উড়ে যায় ধূপখোলা নামক বাসস্থানের ঢাকাস্থ কোন এক বাড়ীর বেলকোণীর দিকে।
আচ্ছা তার বাড়ীর সম্মুখ প্রান্তে তো এই সময় বৈশাখী মেলা বসে।
সে কী এই মধ্য দুপুরে ঠাঁয় তাকিয়ে আছে মেলা বরাবর?
আচ্ছা সে যদি নাগরদোলায় চাপতো, তার অতি মসৃণ বিজ্ঞাপন ঢঙ্গীয় কেশরাশিও কী এমনি করে দোল খেয়ে যেত?
নাগরদোলায় কী আমিও থাকতাম?
কেশরাশি কী আমার শার্টের কলারে পেঁচিয়ে যেত?
অমোঘ সৌন্দর্য নাকি ছুঁয়ে দেখতে নেই। নিজের করে পাওয়ার প্রয়াসও নাকি বৃথা। এতে নাকি অপারতা কষ্ঠে হয়ে যায়।
তাই দূর থেকে তার ঢেউতোলা কেশ রাশিই আমাকে আচ্ছাদিত করে। না হোক তাতে আমার তমপার্শ্বে নাগরদোলায় চাপা।
আমার ভাবনা ডোগায় ছেদ পড়ে। ইতোমধ্যে সম্মুখ রমনীও হাওয়া। অন্তর জনার জন্য ভাবুতা আমার শ্রেয় থেকে শ্রেয় তররূপে চেপে বসে। তার জন্য পৌনে-আধ ডজন পঙ্কতি লিপিবদ্ধ করার ঝোঁক হাতছানি দেয়।
নির্গমন আঁশটে ময় বৈশাখী হাওয়া আমাকে প্রশ্রয় দেয়। পার্শ্বপকেট হতে ছোট ডায়েরীটা হাতে নিয়ে কলমটাকে ছুঁয়ে দেখতে চাই। কিন্তু সেটি আর আমাতে ধরা দেয় না। অল্প সময় পর খুঁজে পাই সেটাকে। তবে পকেটে নয়। মন মঞ্জিলে। স্পষ্ট ধরা দেয় সেটি। ট্রেনের কামরায়। আমার বসার জায়গাটির পাশে। বাদামের খোসাভর্তি ঠোঙ্গাটার পাশে। মনের ভুলে ফেলে আসা স্মৃতির হাটে।
এখনও প্রায় ঘণ্টা উর্ধ্ব সময় পড়ে আছে। দু’পঙ্কতি লেখার জন্য না হোক। খেয়ালীপনার দরূণ কলমটি হারিয়ে বসতে পারি। তবুও কেন জানি কলমটি আনার ইচ্ছা তম্মদ্ধে জাগ্রত করতে পারি না।
শুধু উপলব্ধি করতে পারি কলমটি এই মুহূর্তে আমার খুব দরকার। আমি এইমুহূর্তে আমার অর্ধতমের দ্বারা দু’কলম লেখার জন্য অতিশয় অনুপ্রাণিত। তবুও আমার জায়গাটি ছেড়ে উঠতে ইচ্ছে করে না।
আমি মন পাগাড়ে পঙ্কতি গুলোকে নিংড়াতে থাকি।
এর মাঝে এক বিজ্ঞাপন ঢঙ্গীয় কেশ রাশির উঠতি বয়সী আমার পাশের বেঞ্চটুকুতে আসন নেয়।
স্পষ্ট বুঝতে পারি সে আমার দিকে তাকিয়ে। তার কথার ছন্দে গাল মাঝের টোলটুকু গড়ছে-ভাঙছে ভাঙছে-গড়ছে।
হঠাৎই সে জানতে চায়, এই মুহূর্তে কলমটি তোমার খুব দরকার। নাহ্।
আমি যারপরনাই বিষ্মিত হই। তবুও তার দিকে না তাকিয়ে চুপ করে থাকি। কোথায় যে চাপা একটা খেয়ালীপনা উৎপন্ন হয়ে আমার সর্বাঙ্গ পরশে দেয়।
সে তার কথার প্রতিউত্তরের অপেক্ষা না করেই বলতে থাকে, “তোমাকে আজব একটা ঘটনা বলি, শুনবে?”
আমি তার মুখে “তোমাকে” শব্দটি শুনে আলোড়িত হই। খুব তমময়তা সুরালী ঠেকে শব্দটি। তবুও উত্তর না করে বসে থাকি।
সেও প্রতিউত্তরের প্রহর না গুণে বলে যায়, তুমি শুনে অবাক হবে জানি, ঠিক এমনই একদিন আমি ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করে আছি। স্টেশনটা প্রায় ফাঁকা। দীর্ঘ সময়ের অপেক্ষা। ভাবছি ওর জন্য একটা চিঠি লিখি। কোথায় আছে। কী করছে। একটু জানতে চাইবো। ওকে দেয়া প্রতিশ্রূতি তো রাখতে পারিনি। একটা চিঠি পেয়ে অন্তত পাগলাটে খুশিটাতে নতুন করে মিশুক। এতটুকু প্রাপ্যতার যোগ্যতার চাইতে বেশিই যে ওর প্রাপ্য ছিল।
এখানে এসে সে একটু থেমে যায়। একটা লম্বা শ্বাস লুকানোর চাতুরী আমার কাছে ধরা দেয়।
এতগুলো কথা বললে মানুষের বেশ সহজ হয়ে যাওয়ার কথা। আমি কেন জানি না কী একটা চাপাভিমান নিয়ে তার দিকে না তাকিয়েই নিরুত্তর বসে থাকি।
সে আবার শুরু করে।
চিঠিটা লিখবো কী লিখবো না করে ছোট ডায়েরীটা হাতে তুলে নিই। কিন্তু কলমটাকে আর খুঁজে পাই না। এক সময় কলমটা দৃশ্যত হয়। মন মঞ্জিলে। স্পষ্ট পড়ে থাকতে দেখি সেটিকে ট্রেনের বগিতে। আমার বসার আসনটির পাশে। বাদামের খোসা ভর্তি প্যাকেটটার পাশে।
এই জায়গায় এসে সে আবার থেমে যায়।
হয়তো আমার আগ্রহের পারদটা মাপতে চায়। কিন্তু আমাকে নিরুত্তর দেখে আবারো শুরু করে থেমে যাওয়া অংশটা থেকে।
কলমটি জানি খুব দরকার। চিঠিটা এই মুহূর্তে লিখতে না পারলে হয়তো আর লেখা হবে না। এমনিতেই কত না বলা আর অপূর্ণ-অপ্রাপ্তি ওকে দিয়ে এসেছি। কালের স্রোতে কে কত দূরে হারিয়ে যাবো। আজ না লিখলে আর হয়তো লেখা হবে না। কী করে ওকে আরও ঠকাই আমি।
“আজ না লিখলে আর হয়তো লেখা হবে না। কী করে ওকে আরও ঠকাই আমি”। কথাটা সে বেশ কয়েকবার উচ্চারণ করে। তবুও আমি যৎসামান্য আসক্তি প্রকাশ না করে ঠায় বসে থাকি। এমনকী তখনও একটিবার তাকাই না। কী যেন একটা অপূর্ণতাভিমান রূপীতা হিসেবে তাকে এঁকে ফেলি।
সে আবার শুরু করে, কলমটা আমার খুব দরকার। কিন্তু কলমটা আনতে ইচ্ছে করে না।
তারপর কী হলো জানো? হঠাৎ দেখি একটি উঠতি বয়সী ছেলে আমার পাশে এসে বসলো। ঠিক তুমি বেঞ্চের যে জায়গাটিতে বসে আছ সেখানটায়। আমি ছেলেটির দিকে তাকিয়ে চমকে উঠি। আমার গলার স্বর আবদ্ধ হয়ে যায়। আমি শুধু ইশারায় বলতে থাকি তুমি তুমি?
ও আমার হাতে কলমটি দিয়ে বলতে থাকে, কলমটি তোমার খুব দরকার তাই না? জানিনা কেন মনে হচ্ছিল এই মুহূর্তে আমাকেও তোমার খুব দরকার। তাই চলে এলাম।
আমি ওর পাগলামি দেখে চমকে উঠি না।
শুধু ওর প্রকাশভঙ্গি দেখে হতবাক হয়ে যাই। কতটা বদলেগেছে ও। আগে প্রকাশই করতে পারতো না। আর আজ কী অবলিলায় বলে বসলো ওকে আমার কতটা দরকার।
আমি বিষ্ময়তা গোপন করে ওর কাছে জানতে চাই, কী করছো ইদানিং----
ও কোন প্রতিউত্তর করে না।
আমরা দীর্ঘণ চুপ করে থাকি।
এক সময় আমার হাতে কলমটি দিয়ে তাকিয়ে বলে তোমার ট্রেনের সময় হয়ে গেছে।
বলেই প্লাটফর্ম ধরে হাঁটা দেয়। আমি ওকে আজও ধরে রাখতে পারি না। জানি আজও ও আমাকে কাছে টেনে নেবে। শুধু একটি মুহূর্ত আমি হ্যাঁ বললেই। আমি ওর চলার পথে অপলক তাকিয়ে থাকি। ওর সমস্ত শরীর জুড়ে গুড়িকন্দের মত লেতিয়ে ওঠা এক অপার মুগ্ধময় চাপাভিমান কিলবিল করতে দেখি।
ও এক সময় চোখের আড়াল হয়ে যায়। হারিয়ে যায় চেনা-জানা ভিড়ের মাঝে।
ঠিক এই জায়গায় এসে মেয়েটি থেমে যায়। আমি না তাকিয়েও বুঝতে পাড়ি তার চোখে জল এসে পড়েছে। বুঝতে পারি কপালের উপর দিয়ে কয়েকটা কেশ উড়ে বেড়াচ্ছে।
কুলির চিৎকারে আমার ঘুম ভেঙ্গে যায়। আমি বেঞ্চিতে বসেই আড়মোড়া ভাঙ্গার চেষ্টা করি। ট্রেন ছেড়ে যাবে। আমি উঠে পড়ার তাগিদ বোধ করি। আর স্বপ্নটার কথা মনে করে বলি যত্তসব গাঁজাখুড়ি!!
ব্যাগটা কাঁধে ঝুলিয়ে দাড়িয়ে পড়ি। কি মনে করে যেন হাঁটতে যেয়েও পিছু ফিরে তাকাই। এবার আমি সত্যি সত্যিই বিষ্মিত হই।
আমার বসার জায়গাটির ঠিক পাশে সযতনে ডায়েরীটার উপর রাখা আমার কলমটি দেখে।
আমি চারপাশে তাকাই। উৎভ্রানতের মত। বিজ্ঞাপন ঢঙ্গীয় সেই কালো কেশীর আশায়।
ট্রেন স্টেশন ছাড়ার হুইসেল দেয়।
ডায়েরীর মাঝে আমার হাতে লেখা নতুন কটা পঙ্কতি খুঁজে পাই।
পঙ্কতি গুলি এরূপ -------
থাক, সে হয়তো পড়ে গেছে। নয়তো পঙ্কতি গুলো তার জানাই। হয়তো একান্ত তারই জন্য।
এরপর থেকে মাঝে মাঝেই আমি প্লাটফর্মে ফিরে যাই। বসে থাকি। এবং অবশ্যই কলম ছাড়া।