উত্তরঃ তাকওয়া ও ত্যাগের মহিমায় ভাস্বর ঈদুল আযহা আবারও আমাদের মাঝে ফিরে আসছে। মুসলিম জাতির পিতা হযরত ইব্রাহিম (আ.) স্বীয় সন্তানকে উৎসর্গ করার পরীক্ষায় অবতীর্ণ হয়েছিলেন এবং এতে তিনি কৃতকার্য হয়েছিলেন। তিনি আল্লাহ তায়ালার নির্দেশে সন্তুষ্টচিত্তে তাঁর প্রাণপ্রিয় পুত্র সন্তান ইসমাঈল (আ.) কে কুরবানী করার জন্য মনস্থ করেছিলেন এবং মহান আল্লাহ তায়ালার নির্দেশ বাস্তবায়নের জন্য ইসমাইল (আ.) ও তাতে বিনা দ্বিধায় রাজী হয়েছিলেন। তিনি তাঁর প্রিয় পুত্রকে এ বিষয়টি জানানোর পর ইসমাঈল (আ) বলেছিলেন: “হে আমার পিতা, আপনি যে ব্যপারে আদিষ্ট হয়েছেন তা পালন করুন। আপনি আল্লাহর ইচ্ছায় আমাকে ধৈর্যশীল হিসেবেই পাবেন” [সূরা নং ৩৭ (আস-সাফ্ফাতঃ), আয়াতঃ ১০২]। ত্যাগ ও কুরবানীর সেই ঘটনাকে স্মরণ করে মুসলিম জাতি প্রতিবছর ঈদুল আযহার দিন এবং তাশরীকের পরবর্তী দিনসমূহের মধ্যে অর্থাৎ ঈদের পরের তিনদিন পশু জবাই করে।
অন্যান্য সকল ইবাদাতের ন্যায় কুরবানী করার ক্ষেত্রেও সহীহ নিয়্যাৎ ও ইখলাছ থাকা ওয়াজিব। আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে আল্লাহ তা‘আলা বান্দার সেই সব কাজ ও ইবাদাতই কবুল করেন যা শুধুমাত্র তাঁরই উদ্দেশ্যে তাঁকেই সন্তুষ্ট করার জন্য করা হয়। তাই আল্লাহ তা‘আলা কুরআনে পাকে ইরশাদ করেন, “আর তাদেরকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে কেবল আল্লাহরই ইবাদত করতে দ্বীনকে তাঁরই জন্য নির্দিষ্ট করে...” [সূরা নং ৯৮ ( আল-বায়্যিনাত), আয়াতঃ ৫]। আল্লাহ তা‘আলা আরও ইরশাদ করেছেন “সুতরাং তোমার প্রভূর উদ্দেশ্যে সালাত আদায় কর এবং কুরবানী কর।” [সূরা নং ০৮ (আল-কাউসার), আয়াতঃ ]। লোক দেখানো ইবাদাত আল্লাহ তায়ালা কুবুল করেন না বরং যারা মানুষকে দেখানোর জন্য ইবাদাত করে তাদের জন্য শাস্তি নির্ধারিত রয়েছে। আল্লাহ তা‘আলা বলেনঃ “ধ্বংস সে সকল সালাত আদায়কারীদের জন্য যারা তাদের সালাত সম্পর্কে উদাসীন এবং যারা লোক দেখানো কাজ করে” [সুরা নং ১০৭ (আল-মাউন), আয়াতঃ ৪-৬]।
ঈদুল আযহা উপলক্ষে পশু কুরবানী করা অত্যন্ত ফজিলতপূর্ণ ইবাদাত। ঈদুল আযহা উপলক্ষে পশু কুরবানী করা আল্লাহ তা‘আলার নিকট একটি পছন্দনীয় ইবাদাত। তিরমিযি শরীফে হযরত আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত আছে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, “কুরবানীর দিন কেন ব্যক্তি কুরবানীর পশুর রক্ত প্রবাহ করার চেয়ে আল্লাহ তায়ালার নিকট অধিক প্রিয় কেন কাজই সম্পাদন করে না।” কুরবানী করা সুন্নাতে মুয়াক্কাদাহ। সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও কুরবানী না করা মাকরূহ বা অপছন্দনীয় কাজ । রাসুল (সা.) বলেছেন, “সামর্থ থাকা সত্ত্বেও যে ব্যক্তি কুরবানী করেনা সে যেন আমাদের ঈদগাহে হাজির না হয়।” (মুসনাদে আহমাদ)।
তাই ঈদুল আযহার প্রধান উপাদান কুরবানীর পশুটি সুস্থ, সবল ও সুন্দর হওয়া বাঞ্ছনীয়। ইসলামের নির্দেশ হলো সকল কাজ সুন্দর ও সুচারুরুপে সম্পাদন করা। হাদীস শরীফে এসেছে “আল্লাহ তায়ালা সুন্দর, তিনি সুন্দরকে ভালবাসেন”। তাই কুরবানীর পশু ক্রয় করার সময় সুস্থ, সবল, ও সুন্দর দেখে ক্রয় করা আল্লাহ তায়ালার নিকট পছন্দনীয় হবে এতে কোন সন্দেহ নাই। তাই রাসুল (সা.) কুরবানীর পশুর জন্য সুনির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্য নির্ধারণ করে দিয়েছেন। কুরবানীর উদ্দেশ্যে ত্র“টিপূর্ণ ও দুর্বল পশু নির্ধারণ করা বা ক্রয় করা বৈধ নয়। যেসব দোষ-ত্রুটি সম্পন্ন পশু কোরবানী করা বৈধ নয় তা হলঃ (১) স্পষ্টত রোগাক্রান্ত (২) অন্ধ (৩) খোঁড়া (৪) যে পশুর মস্তিস্ক ক্ষয় হয়ে যেছে (৫) সামনের দিকের দাঁত পড়ে যেছে এমন (৬) বধির ইত্যাদি। তাছাড়া কুরবানির পশুর সর্ব নিম্ন বয়সও নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছ যা মেনে চলা আবশ্যক। শরীয়তের দলীল-প্রমাণের ভিত্তিতে ভেড়ার ক্ষেত্রে এই সর্বনিম্ন রয়স হল, ছয় মাস, ছাগলের ক্ষেত্রে এক বছর, গরুর ক্ষেত্রে দুই বছর এবং উটের ক্ষেত্রে ৫ বছর।
আবার, আমাদের সমাজে দেখা যায় অনেকেই বাজারের সবচাইতে সেরা গরুটি কেনার জন্য প্রতিযোগিতায় নামেন। আবার কেউ কেউ সুনাম কুড়ানোর জন্য বেশী দামের গরু, উট বা মহিষ কুরবানী করেন। অনেকে সামর্থ না থাকা সত্ত্বেও ‘নতুন জামাই কি বলবে” বা ‘এতদিন কোরবানী দিয়ে এসেছি এখন না দিলে লোকে কি বলবে" ইত্যাদি কারণে অনেকে কুরবানী করে থাকেন। কোরবানীর পশু যদি সুস্থ সবল হয়, বিভিন্ন দোষ-ত্রুটি থেকে মুক্ত হয় এবং তা আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে শরীয়াহ সম্মাতভাবে করা হয় তাহলে তা আল্লাহ তা‘আলার নিকট গ্রহণযোগ্য হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। লোক দেখানোর জন্য বা সুনামের জন্য বেশী দামের পশু কেনা। উট, মহিষ ইত্যাদি বড় বড় পশু কোরবানী করা, অথবা লোকজনকে দেখানোর জন্য কুরবানীর পশু লাল কাপড় ও মালা দিয়ে সাজানো, কুরবানীর পশুকে প্রদর্শনীর উদ্দেশে খোলা স্থানে বেঁধে রাখা ইত্যাদি কোনক্রমেই শরীয়তসম্মত নয় এবং তা আল্লাহ তায়ালার নিকট কবুলকৃত হওয়ার সম্ভাবনা কম। কারণ আল্লাহ তায়ালা শুধুমাত্র মানুষের অন্তরের মধ্যে ইখলাছ ও তাকওয়া দেখতে আগ্রহী। কোন কোরবানীর পশুতে কত মন মাংস হয়েছে বা কত রক্ত প্রবাহিত হয়েছে বা কোন পশুটিতে বেশী চর্বি হয়েছে, কোনটির শিং কত বড় ইত্যাদি মহান আল্লাহ তা‘আলার নিকট বিবেচ্য নয়। তাই আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেন, “আল্লাহ তা‘আলার কাছে এদের মাংস ও রক্ত কিছুই পৌছবে না, তাঁর নিকট শুধুমাত্র তোমাদের তাকওয়াই পৌঁছবে।” [সূরা নং ২২ (আল-হাজ্জ্ব), আয়াতঃ ৩৭] তাই সুস্থ সবল ও ত্রুটিমুক্ত কুরবানীর পশু ক্রয় করতে হবে। সাথে সাথে লক্ষ্য রাখতে হবে এ ক্ষেত্রে যেন ‘রিয়া’ বা প্রদর্শনেচ্ছা না থাকে। কারণ মানুষের মধ্যে সে ব্যক্তিই সর্বোত্তম যিনি সবচাইতে বেশী তাকওয়াবান। সুতরাং লোক দেখানো ও গতানুগতিকতা পরিহার করে ইখলাছ ও তাকওয়ার মহিমায় উজ্জীবীত হয়ে কুরবানী করা উচিত যাতে মুসলিম জাতির পিতা হযরত ইবরাহীম (আ) এর মত আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশে যে কোন ধরনের ত্যাগ শিকারে কোন মুসলিম পিছপা না হয়।
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৬ রাত ১১:৫৫